skip to Main Content

ফিচার I পলিটিক্যালি পলিশড

লাইট, ক্যামেরা, রানওয়ে আর রেড কার্পেটে আটকে থাকার দিন শেষ। ফ্যাশন বিশ্ব ব্যস্ত এখন জনসভা, ভাষণ আর রাষ্ট্রীয় সফরে। সারাহ্ দীনার লেখায় বিস্তারিত

ফ্যাশন সব সময় ফ্যান্সি নয়। ফিলোসফির প্রকাশও বটে। রাজনৈতিক দর্শন দৃশ্যমান হয় ফ্যাশনে। একজন রাজনীতিবিদ যখন জনগণের সামনে আসেন, তখন তার ভাষণই শুধু গুরুত্বপূর্ণ, এমন কিন্তু নয়। তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে তার পোশাক, অনুষঙ্গ, সাজসজ্জাও। কারণ, একজন রাজনীতিবিদ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন। তার পোশাক, বক্তব্য—সবকিছুই নাগরিকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই নির্বাচিত দলনেতার রাজনৈতিক দর্শন যেমন সমর্থকেরা মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করে, তেমনি পর্যবেক্ষণ করে তার পোশাকও।
ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার পিএইচডি গবেষক লারা বাকেরের গবেষণাপত্রের মাধ্যমে জানা যায়, রাজনৈতিক নেতা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে যাকে নিজেদের গোত্রের লোক বলে মনে হয়, তার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব কাজ করে। আবার, নিউইয়র্ক টাইমসের বদৌলতে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মেলে। একজন পলিটিক্যাল কনসালট্যান্টের বরাতে জানা গেছে, তার ক্লায়েন্টদের একটি বড় অংশ সমর্থকদের কাছে ইতিবাচক অবস্থান তৈরির ক্ষেত্রে বক্তব্যের পাশাপাশি নিজেদের পোশাককেও গুরুত্ব দেয়। কারণ, তারা জানেন, শব্দ যেমন রাজনৈতিক মতবাদ তৈরির জন্য কার্যকরী, তেমনি পোশাকও। জনগণ তাদের নেতাদেরকে নিজের মানুষ মনে করতে চান। তাই পোশাকের রং, নকশা—সবকিছুই গণমানুষের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার জন্য শক্তিশালী ভূমিকা রাখে। এই কনসালট্যান্টের বক্তব্যে আরও জানা যায়, তার সেবাগ্রহীতারা যেসব বিষয়ে আলোচনা করতে চান, সেগুলোর মধ্যে ভাষণের সময়কাল ছাড়াও পোশাক পরিকল্পনা বাড়তি গুরুত্ব পায়।
জনগণের সামনে উপস্থিত হওয়ার ব্যাপারে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা যে এই যুগে এসে মনোযোগী হয়েছেন, তা কিন্তু মোটেই নয়। বহু আগে থেকেই তারা এ বিষয়ে সচেতন। বিশ্বব্যাপী রাজনীতিতে ফ্যাশন ভূমিকা রেখেছে। উদাহরণে বলা যেতে পারে ভারতীয় উপমহাদেশের নেতা মহাত্মা গান্ধীর কথা। ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলন আর ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে বিদায় করতে তার ভূমিকা অগ্রগণ্য। তার চিরচেনা ছবিগুলোতে বরাবর তাকে দেখা গেছে দুই টুকরো খাদিতে। এর পেছনে আছে দেশপ্রেমের নিগূঢ় গল্প। ১৯২০ সাল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের জনগণকে দেশি পণ্য ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেন এই নেতা। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি নিজে খাদির পোশাক পরা শুরু করেন। ১৯২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো খাদির খাটো ধুতি আর একটুকরো শাল গায়ে জড়িয়ে নেন গান্ধী। এই আনকোরা অবতারের পেছনে ছিল তার দর্শন এবং ভারতের করুণতম সময়ের পষ্ট প্রতিফলন। বিদেশি পণ্যের আগ্রাসন ঠেকাতে তিনি স্বদেশি আন্দোলন শুরু করেছিলেন। নিজের জন্য বেছে নিয়েছিলেন দেশের তাঁতে বোনা মোটা সুতার খাদি। ভারতের আপামর জনগণ তখন দুর্দশাগ্রস্ত। অথচ রাজাধিরাজদের গায়ে শোভা পেত চাকচিক্যময় মণিমাণিক্য। সে সময়ে দেশে তৈরি কাপড়ে গান্ধীকে দেখে জনসাধারণ নিজেদের সঙ্গে তার মিল খুঁজে পেয়েছিল। গান্ধীর রাজনৈতিক দর্শনের স্পষ্ট প্রকাশ হিসেবে সামনে এসেছিল তাঁতে বোনা এই ফ্যাব্রিক।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আলোচনার তুঙ্গে। শোনা যাচ্ছে প্রধান দুই প্রার্থীর দুর্দান্ত সব কূটকৌশলের গল্প। বলা হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্প আর কমলা হ্যারিসের কথা। শুধু এই নির্বাচনের কারণেই যে তারা ফ্যাশন নিয়ে ভাবছেন, তা কিন্তু নয়। তাদের পোশাক-সাজ-জীবনযাপন আলোচনায় আগে থেকেই। ২০১৭ সালে ক্ষমতা গ্রহণের সময় ট্রাম্পের লম্বা টাই ছিল অন্যতম অনুষঙ্গ। বেশির ভাগ সময়ে লাল টাইয়ে দেখা গেছে তাকে। পাশাপাশি ঢিলেঢালা স্যুট নিয়েও হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। বলা হতো তার অতি অহংকার প্রকাশিত হয়েছে বড় সাইজের পোশাকে আর লাল গলাবন্ধে। তার ‘মেইক আমেরিকা প্রাউড অ্যাগেইন’ লেখা ক্যাপ নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় উঠেছে অনেক গোলটেবিল বৈঠকে। তবে এর কোনোটিকেই ইতিবাচকভাবে নিতে পারেননি অনেক নাগরিক। জানা যায়, ট্রাম্পের অহংবোধ ও স্বার্থপরতা তার পোশাকে আরও বেশি করে প্রকাশিত হয় বলে আমেরিকানদের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়। যদিও ট্রাম্প তার নির্বাচনী মূলমন্ত্র ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ কথাটির গুরুত্ব সবক্ষেত্রে প্রকাশ করার চেষ্টা প্রথম দিন করেছেন। ক্ষমতা গ্রহণের দিন তাই তিনি এবং তার সহধর্মিণী মেলানিয়া ট্রাম্প আমেরিকান ফ্যাশন ডিজাইনারের পোশাক পরেছিলেন। তবে এই চেষ্টায় নিজেরাই হাত ধুয়ে নেন দ্রুত। অফিশিয়াল ফটোসেশনে মেলানিয়ার গায়ে দেখা যায় ইতালিয়ান লাক্সারি ব্র্যান্ড ডলশে অ্যান্ড গাবানার জ্যাকেট। আর ডোনাল্ড ফিরে যান তার ইতালিয়ান স্যুট ব্র্যান্ড ব্রিয়নিতে। উচ্চ মূল্যের পোশাক পরতেন দুজনেই। এমনকি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার টালমাটাল সময়গুলোতেও; যা আমেরিকানদের নেতিবাচক অনুভূতি দেয়। ফলাফল—জনগণের প্রত্যাখ্যান।
এরপরেই ক্ষমতায় আসে জো বাইডেন আর কমলা হ্যারিস জোট। তারা ভোটারদের ফ্যাশনের প্রতি আবেগের জায়গা বুঝতে পেরেছিলেন প্রথম থেকেই। তাই শপথ অনুষ্ঠানে বাইডেন পরেছিলেন রালফ লরেন আর কমলা হ্যারিস পরেছিলেন ক্রিস্টোফার জন রজারস। দুটোই খোদ আমেরিকার ব্র্যান্ড। আর ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন পরেছিলেন তরুণ ডিজাইনার আলেকজান্ডার ও’নিলের ব্র্যান্ড। কমলা হ্যারিসের জীবনসঙ্গী সেকেন্ড জেন্টলম্যান ডগ এমহফও আস্থা রেখেছিলেন রালফ লরেনে।
কমলা হ্যারিস এ বছর লড়বেন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে। ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালেই পোশাক নিয়ে তিনি ছিলেন দারুণ আলোচনায়। ভেসেছেন প্রশংসায়। নির্বাচনী প্রচারণায়ও তিনি নিজের আলোয় উদ্ভাসিত। আত্মবিশ্বাসের পূর্ণতা ফুটে উঠছে তার আউটফিটে, এমনটাই শোনা যাচ্ছে। বর্ণবৈষম্য নিয়েও যে তিনি বেশ ভাবছেন, তা বোঝা যাচ্ছে তার ডিজাইনার সিলেকশনে। স্টেটমেন্ট মেকিং স্যুটে তার আগ্রহ দেখা গেছে। স্ট্রাকচারড ব্লেজার, টেইলরড প্যান্টের সঙ্গে কখনো কখনো পায়ে দেখা যাচ্ছে স্নিকার। শু সিলেকশনে দারুণ প্রশংসিত হয়েছেন তিনি। আমেরিকানদের নিত্যদিনের পোশাকে হাজির কমলাকে তাই সহজে আপন ভাবতে পেরেছেন অনেকেই। তার বারগেন্ডি প্যান্ট স্যুট স্টেটমেন্ট ফ্যাশন হিসেবে মনোযোগ কেড়েছে। পাওয়ার স্যুট হিসেবে অনেক ডিজাইনারের অনুপ্রেরণাও হয়ে উঠেছে এই পোশাক।
মার্কিন অঞ্চলের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ফ্যাশন নিয়ে কথা বলতে গেলে জ্যাকলিন কেনেডিকে ভুলে যাওয়ার অবকাশ নেই। আমেরিকার ইতিহাসের প্রথমবারের মতো ‘ফার্স্ট লেডি’ হন তিনি। তার জীবনসঙ্গী জন এফ কেনেডি যেদিন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, সেদিন থেকেই পষ্ট প্রকাশ ছিল তাদের পোশাক পরিকল্পনায় রাজনীতির হিসাব-নিকাশের। অর্থাৎ এই দম্পতি সচেতন ছিল প্রথম থেকে। তাদের দুজনের ফ্যাশনেই ছিল সূক্ষ্ম সৃজনশীল রাজনীতি। এদিনের পোশাক নির্বাচনের জন্য এই দম্পতি নিজেদের পছন্দকে সর্বাধিক গুরুত্ব না দিয়ে ভোটারদের পছন্দ নিয়ে ভেবেছিল বলে জানা যায়। কনজারভেটিভ এবং লিবারেল—দুই ধারার মানুষই ইতিবাচকভাবে নেওয়ার সম্ভাবনা আছে এমন পোশাকে হাজির হয়েছিলেন তারা। প্রেসিডেন্ট পরেছিলেন স্যুট, আর ফার্স্ট লেডির পরনে ছিল গাউন।
আমেরিকান রিপাবলিকান পার্টিতে কাউ বয় বুট একটি বিশেষ প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। এই ধারার শুরু রোনাল্ড রিগ্যানের হাত ধরে। এর ধারাবাহিকতায় জর্জ ডব্লিউ বুশ শপথ গ্রহণের দিন পায়ে গলিয়েছিলেন কাউ বয় বুট। সেই থেকে রাজনীতিতে আরও শক্তপোক্ত হয়ে জাঁকিয়ে বসেছে এই জুতা। ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। রিপাবলিকানদের কাউ বয় বুট ব্যবহার শুরুর পেছনে আছে গৌরবের এক ইতিহাস। এই জুতা আমেরিকার সম্পূর্ণ নিজস্ব পদ্ধতিতে তৈরি করা প্রথম পণ্য; যাকে বলা হয় ‘ট্রুলি আমেরিকান’। ১৮৭০ সালে বাজারে আসে। তারপর থেকে টিকে আছে গৌরবের সঙ্গে।
ওবামা পরিবারের ফ্যাশনেও তাদের রাজনৈতিক দর্শনের দৃপ্ত প্রকাশ দেখা গেছে। মিশেল ওবামা বরাবরই আমেরিকান তরুণ ফ্যাশন ডিজাইনারদের পোশাক বেছে নিতেন। সাহসী এই পদক্ষেপ রাষ্ট্রের ফ্যাশন বাজারকে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করেছে। তিনি হয়ে উঠেছিলেন ফ্যাশনের অগ্রপথিক। এর মধ্যে অন্যতম ‘ডেমোক্রেটিক ড্রেসিং’। মিশেল ওবামা যখন কোনো রাজনৈতিক ভ্রমণ কিংবা দাওয়াত গ্রহণ করতেন, তখন ফ্যাশন বিষয়ে বেশ সচেতন থাকতেন। অনেক সময় বেছে নিতেন সে দেশের ডিজাইনারের পোশাক। উদাহরণ পাওয়া যায় বেশ কয়েকটি ঘটনার। যেমন তিনি ভারতের রাষ্ট্রীয় দাওয়াতে ইন্ডিয়ান-আমেরিকান ডিজাইনার নাইম খানের নকশা করা পোশাক পরেছিলেন। আবার বাকিংহাম প্যালেসে রানি এলিজাবেথের নৈশভোজের আয়োজনে হাজির হয়েছিলেন লন্ডন বেইসড আমেরিকান ডিজাইনার টম ফোর্ডের পোশাকে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতেও পোশাকের ভূমিকা নিয়ে ভাবা হয়েছে। এ দেশের ঐতিহ্যবাহী জামদানি, তাঁতের শাড়িতে হাজির হতে দেখা যায় নেত্রীদের। জাতীয় পোশাক শাড়ি। গ্রাম থেকে শহর—সবখানেই নারীদের পোশাক হিসেবে সমাদৃত। ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের আউটফিট হিসেবেও দেখতে পছন্দ করে সাধারণ জনগণ। আবার অনেক নেতাকে দেখা যায় পাঞ্জাবি-পাজামায় হাজির হতে। এ দেশের জনগণের কাছে এই মেল অ্যাটেয়ারও ইতিবাচক।
উপযোগী ফ্যাশন ব্যক্তির পলিটিক্যাল ক্যারিয়ারকে যেমন অনেকটা এগিয়ে নিতে পারে, তেমনি নেতিবাচক ধারণাও তৈরি করতে পারে মুহূর্তে। দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় পোশাক নির্বাচন তাই গুরুত্বপূর্ণ।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top