সঙ্গানুষঙ্গ I রুদ্রাক্ষরহস্য
অধ্যাত্মে আস্থা, নাকি ফ্যাশনেবল হয়ে ওঠার আকাক্সক্ষা—উদ্দেশ্য যেটাই হোক, পরিধানে নজর কাড়বেই। শাস্ত্রোক্ত বিধি অনুযায়ী শুদ্ধ এবং অভিমন্ত্রিত হয়ে এর ধারণের অজানা আখ্যান রত্না রহিমার লেখায়
রুদ্রাক্ষ। সন্ধিবিচ্ছেদ করলে দাঁড়ায়, রুদ্র+অক্ষ। শব্দটির সঙ্গে আমরা অপরিচিত নই। তবে এর পেছনের গল্প বা শক্তি সম্পর্কে সবাই যে অবগত, এমনটাও বলার উপায় নেই। দেশে জুয়েলারি হিসেবে রুদ্রাক্ষ পরার প্রচলন অবশ্য আগে থেকেই। তবে হলফ করে বলা যায়, যারা পরেন তাদের অধিকাংশ ফ্যাশন স্টেটমেন্ট হিসেবে বেছে নেন। কিন্তু একটু গভীরে গেলে বোধগম্য হয়, আদৌ ব্যাপারটি অত সহজ নয়।
ভারতীয় পুরাণ অনুযায়ী, রুদ্র হলেন শিব এবং অক্ষ হলো অশ্রু। বলা হয়, একটি রুদ্রাক্ষ ইচ্ছা করলেই পাওয়া যায় না। এটি শিবের অশ্রুবিন্দেুর মাধ্যমে মেলে। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, রুদ্রাক্ষের পুঁতিকে শিবের অশ্রু বলা হয়। বিশ্বাস করা হয়, শিব হাজার হাজার বছর ধরে ধ্যান করেছিলেন এবং যখন তিনি চোখ খুলেছিলেন, তখন অশ্রু গড়িয়ে পড়ে; যা পরে রুদ্রাক্ষগাছে পরিণত হয়। অতএব, রুদ্রাক্ষ পুঁতি পবিত্র। বিশ্বাস করা হয়, এর ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে। এই আধুনিক যুগেও এ বিশ্বাস বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। হিন্দু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রুদ্রাক্ষ কেবল রহস্যময় ক্ষমতার অধিকারীই নয়; এগুলো শারীরিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে নিরাময় করতে সক্ষম। বিশেষ করে, এ পুঁতি হিন্দুধর্মে তাদের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য এবং নিরাময় বৈশিষ্ট্যের জন্য পূজিত যুগে যুগে। যারা এটি দিয়ে তৈরি নেকলেস বা ব্রেসলেট পরেন, তারা মূলত এই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই। ইচ্ছা হলো, পরে ফেললাম, ব্যাপারটি এমন নয়।
পুঁতিগুলো আসলে রুদ্রাক্ষগাছের বীজ। যেটি মূলত হিমালয় অঞ্চল, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতের কিছু অংশে পাওয়া যায়। যেখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই পুঁতিগুলো প্রার্থনা মালায় ব্যবহৃত হয়। গয়না হিসেবেও পরা হয়। এর পেছনে শুধু ফ্যাশনেবল হয়ে ওঠাই নয়, অনেক সময় কাজ করে এর ওপর আধ্যাত্মিক আস্থা।
ইচ্ছা হলেই রুদ্রাক্ষ ব্যবহার করে গয়না তৈরি করার নিয়ম নেই শাস্ত্রে। এর অনেক প্রকারভেদ রয়েছে। এই পুঁতিগুলো তাদের মুখ বা ‘মুখী’ সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। প্রতিটি ধরনের রুদ্রাক্ষের আলাদা বৈশিষ্ট্য ও উপকারিতা রয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়। সবচেয়ে সাধারণ ধরন হলো একমুখী (এক মুখ), পঞ্চমুখী (পাঁচ মুখী) এবং গৌরী শঙ্কর (দুটি পুঁতি একসঙ্গে যুক্ত)। জানা গেছে, ভারতবর্ষে মোট ২১ ধরনের রুদ্রাক্ষ রয়েছে, যা রুদ্রাক্ষে উপস্থিত মুখ (মুখী) এবং সংখ্যার ভিত্তিতে শ্রেণিবদ্ধ। তবে কঠোর ধর্মীয় ব্যবহার ছাড়া সাধারণের কাছে সেগুলো তেমন জনপ্রিয় নয়।
কী উপকার মিলবে রুদ্রাক্ষ পরলে? প্রথমত, হিন্দু তান্ত্রিকেরা বিশ্বাস করেন, এটি পরার উপকারিতা অনেক। সেটি আধ্যাত্মিক ও শারীরিক—উভয় ক্ষেত্রে। যিনি পরেন, এটি তাকে নেতিবাচক শক্তি থেকে রক্ষা করে এবং তার সামগ্রিক মঙ্গল সাধনের সম্ভাবনা বাড়ায়। জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির স্পষ্টতা বাড়ায়, ফোকাস বৃদ্ধি করে, শরীরকে জটিল রোগ থেকে সুরক্ষিত রাখে। এই বিশ্বাস সামনে রেখেই আধ্যাত্মিক ও ঔষধি উদ্দেশ্যে বহু শতাব্দী ধরে রুদ্রাক্ষ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। নানামুখী নিরাময় ক্ষমতার পাশাপাশি এটি পরিধানকারীর জীবনে ইতিবাচকতা ও সমৃদ্ধি আনতে পারে। আর এসব কারণেই অন্য যেকোনো আধ্যাত্মিক বস্তুর মতো, রুদ্রাক্ষের পুঁতি ইচ্ছা হলেই পরা যায় না। পরার সময় কিছু করণীয় আছে, যেগুলো অবশ্যই মেনে চলা চাই।
সব সময় একটি নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে রুদ্রাক্ষ কেনা জরুরি। নিশ্চিত করতে হবে—পুঁতিগুলো খাঁটি; নকল প্লাস্টিক নয়।
বেজোড় সংখ্যায় রুদ্রাক্ষ পরা উচিত, যেমন ১, ৩, ৫, ৭ বা ৯টি করে। কারণ, বিশ্বাস করা হয়, জোড় সংখ্যার চেয়ে বেজোড় সংখ্যা বেশি শুভ।
পরতে হবে সোমবার। কারণ, এই পুঁতিগুলো পরার জন্য এটি সপ্তাহের সবচেয়ে শুভদিন মনে করা হয়।
পরার আগে অবশ্যই স্নান করা জরুরি।
মালা হিসেবে পরতে হলে ব্যবহার করতে হবে সিল্ক বা সুতির সুতা। ধাতব চেইনে পরা হলে তা পুঁতির কার্যকারিতা কমাতে পারে।
পরিষ্কার ও পবিত্র স্থানে রুদ্রাক্ষ সংরক্ষণ করা চাই। ইলেকট্রনিক গ্যাজেট বা রাসায়নিক বিকিরণ নির্গত হয় এমন বস্তুর কাছে রাখা যাবে না।
মাসিক চক্রের সময় বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণে রুদ্রাক্ষ পরা এড়িয়ে চলতে হবে। বিশ্বাস করা হয়, রুদ্রাক্ষ এই সময়ে নেতিবাচক শক্তি শোষণ করতে পারে, যা এর কার্যকারিতায় প্রভাব ফেলতে পারে।
পরার সময় আমিষজাতীয় খাবার, মদ্যপান বা ধূমপান অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ, এই ক্রিয়াকলাপগুলো পুঁতির কার্যকারিতা কমাতে পারে।
নোংরা বা অপরিষ্কার হাতে পুঁতি স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকা চাই। পুঁতি ধরার আগে অবশ্যই হাত ধুয়ে নিতে হবে।
আরও নিয়মকানুন আছে। তবে ধর্মীয় কাজে না পরলে সেগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে রুদ্রাক্ষ পরা হবে? সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে মালা হিসেবে পরা। ভারত বা নেপালে তো বটেই, আমাদের দেশেও ফ্যাশনের অংশ হিসেবে রুদ্রাক্ষের মালা পরা হয়। তা ছাড়া নেকলেস বা ব্রেসলেট হিসেবেও পরা যেতে পারে। তবে যেভাবেই পরা হোক না কেন, সঠিকসংখ্যক মুখীসহ নিয়মকানুন মানা গুরুত্বপূর্ণ। যাতে এগুলোর সুবিধা পুরোপুরি উপভোগ করা যায়।
এখানেই শেষ নয়! পরার পর এর শক্তি বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত যত্ন ও রক্ষণাবেক্ষণ। যেমন নিয়মিত পানি ও হালকা সাবান দিয়ে পুঁতিগুলো পরিষ্কার করা চাই। কঠোর রাসায়নিক এবং চরম তাপমাত্রা থেকে দূরে রাখার পাশাপাশি মাঝে মাঝে এটি ধরে মন্ত্র জপ করার কথাও বলা হয়।
রুদ্রাক্ষ পুঁতি হিন্দু সংস্কৃতিতে একটি বিশেষ স্থান ধারণ করে আছে। তাই ফ্যাশন স্টেটমেন্ট হিসেবে বা এগুলোর নিরাময়ের বৈশিষ্ট্যের ওপর আস্থা—যে কারণেই পরা হোক না কেন, সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করতে উল্লিখিত করণীয়গুলো অনুসরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। সুতরাং শক্তি, সুরক্ষা ও শান্তির প্রতীক এই রুদ্রাক্ষ জীবনে কিছু ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে—এই বিশ্বাস যদি করা যায়, তাহলে আর দেরি কেন!
মডেল: জেরিন
মেকওভার: পারসোনা
জুয়েলারি: রঙবতী
ছবি: কৌশিক ইকবাল