কভারস্টোরি I শিল্পসূচক
নারীচরিত। নির্মাণের আনন্দ অনির্ণেয়। তাই তো বেদ-উপনিষদের এ ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীন শাস্ত্র, পুরাণ, কাব্য থেকে শুরু করে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় নানাবিধ নারী চরিত্র তৈরির আকর্ষণ শাশ্বত। হোক তা আধিদৈবিক, পৌরাণিক কিংবা মানবীয়। যুগে যুগে শাস্ত্রকার, পুরাণকার, কবিরা তো বটেই, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে মেতে ছিলেন ভাস্কর আর চিত্রকরেরাও। যার কিছু এখনো প্রত্যক্ষ করা যায় ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে অবশিষ্ট কিংবা রক্ষা পেয়ে যাওয়া গগনস্পর্শী মন্দিরের স্থাপত্যে, বর্ণোজ্জ্বল বিস্তৃত চিত্রকর্মে আর নানা আকৃতির অসংখ্য মূর্তিতে। প্রাচীন সেসব নারী ভাস্কর্য আর চিত্রকলা দেখে মানসপটে হঠাৎ ভেসে ওঠে সেকেলবাসিনীর জীবনযাত্রার স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। পুরাকালের সেসব শিল্পকলায় নারীদের বস্ত্র, অলংকার আর সেগুলো পরিধানের নানা কায়দা আজকের আধুনিকাদের বিস্মিত করে এতশত যুগ পরেও। এ যুগের মানুষের কাছে যেগুলো আজও উপস্থিত হয় বিশেষ সময়ের বিশেষ প্রবণতার প্রতীক হয়ে। সেই উৎস খোঁজের কিয়দংশ জাহেরা শিরীনের লেখায়
প্রাচীন ভারতবর্ষে সভ্যতার অঙ্গ এবং উচ্চ রূপবোধের পরিচায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল অসংখ্য শিল্পকীর্তি। সংখ্যায় ও উৎকর্ষে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে ভাস্কর্য ও চিত্রকলা; বিশেষ করে এগুলোতে ফুটে ওঠা নারী চরিত্রগুলো। সেই যুগে সমাজে নারীর অবস্থান আর তাদের জীবনযাত্রার স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি এই একেকটি শিল্পকর্ম। তাই এসব মূর্তি বা ছবিতে ভাস্করের দক্ষতা আর চিত্রকরের নৈপুণ্যই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় নয়, নারীর সামাজিক অবস্থান নির্ণায়কের উৎসও বটে। এমনকি ঠাহর করা যায় তাদের বসন-ভূষণ আর সাজসজ্জাও; যা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মহেঞ্জোদারোর নর্তকী-কন্যা, সিন্ধু সভ্যতার সমকালীন উর্বরতার দেবী, সাঙ্ঘোলের আসবপায়ী কন্যা থেকে শুরু করে কোণার্কের সূর্যমন্দিরের অপ্সরা, খাজুরাহোর সুরসুন্দরী, ভুবনেশ্বরের অলসকন্যা, বেলুর-হালেবিদের মদনিকার সাজসজ্জা ছুঁয়ে অজন্তা পর্যন্ত।
ভাস্কর্যে ভাস্বর
অপ্সরা, যক্ষিণী, প্রেক্ষণিকা, মদনিকা, দীপলক্ষ্মী, বৃক্ষকা, সুরসুন্দরী, অলসকন্যা, রতি, শালভঞ্জিকা ও নায়িকা—সবাই অতি সুন্দরী, যৌবনদৃপ্ত, লাবণ্যে গরীয়সী আর আবরণে-আভরণে সুসজ্জিতা। কথিত রয়েছে, সুপ্রাচীন সনাতনী এসব প্রতিমার কেউই পৃথিবীর নয়, তবু পার্থিক লাবণ্য ছড়িয়ে আছে এদের সর্বাঙ্গে। শুধু কি তাই! এই উপমহাদেশের প্রাচীন ও মধ্যযুগের নারীসমাজের প্রতিনিধিও বলা যায় এমন অসংখ্য নারীমূর্তিকে। সে সময়ের নারীর সৌন্দর্য এবং তাদের সাজসজ্জার শিল্পসম্মত রূপের প্রকাশ এ ভাস্কর্যগুলো। যাদের সূক্ষ্ম পর্যালোচনার মাধ্যমে জানা যায় সে যুগের আধুনিকারা কেমন করে চুল বাঁধতেন, কী কাজল পরতেন, গয়নার ধরন কেমন ছিল অথবা কীভাবে অঙ্গে জড়াতেন সূক্ষ্ম, সুন্দর, কারুকাজ করা বস্ত্র। তবে এটা নিশ্চিত, এ মূর্তিগুলোর কোনোটিই দেবীমূর্তি নয়। কারণ, সে সময়কার ভাস্কর বা শিল্পীদের দেবীমূর্তি নির্মাণের সময় খুব বেশি স্বাধীনতা দেওয়া হতো না। নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী দেবীমূর্তির রূপকল্পনা করার অধিকার? সে-ও ছিল অসম্ভব। শাস্ত্রকে অনুসরণ করতে হতো অক্ষরে অক্ষরে। তাই তাদের সৃজনশীলতা প্রকাশের সর্বোৎকৃষ্ট উপায় ছিল দেবীমূর্তির আশপাশে গড়া অসংখ্য যক্ষী, অপ্সরা, প্রেক্ষণিকা, মদনিকা, দীপলক্ষ্মী, বৃক্ষকা, সুরসুন্দরী, অলসকন্যা, রতি আর নায়িকাদের মূর্তি। রূপলাবণ্যময়ী যে দেবাঙ্গনারা আজও দর্শকদের মুগ্ধ ও অভিভূত করে।
গবেষকদের অনুমান, এই নারীমূর্তিরা সে সময়কার দেবদাসীদের অনুকরণে নির্মিত হয়েছিল। ব্যাপারটা অসম্ভব নয়। মন্দির স্রষ্টা ও শিল্পীদের সঙ্গে মন্দিরের দেবদাসীদের যোগ থাকার সম্ভাবনা যে প্রবল, সে প্রমাণও মিলেছে যুগে যুগে। রূপদক্ষ দেবদীনের সঙ্গে সুতনুকা দেবদাসীর প্রণয়ের উল্লেখ আছে যোগীমারা পর্বতের গুহালিপিতে।
সে প্রসঙ্গ ভিন্ন। কিন্তু এই মূর্তিগুলো থেকে যে তাদের সৃষ্টির সমসাময়িক সাজপোশাকের রীতি কেমন ছিল, সে ধারণা মেলে। এ সম্পর্কে কোনো দ্বিমত নেই। ভারতবর্ষের দিদারগঞ্জের চামধারিণী যক্ষ্মী, সাঁচীর শালভঞ্জিকা কিংবা মথুরার সখীকে ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে, এদের অলংকারের সঙ্গে মহেঞ্জোদারোর এক হাত চুড়ি পরা নর্তকীর ভাস্কর্যের সাদৃশ্য আছে। এদের হাতেও মোটা মোটা চুড়ির গোছা। কবজি থেকে কনুই পর্যন্ত তাতে ঢাকা। এদের পায়ে দেখা যায় মোটা মোটা মল। কারলা গুহামন্দিরে যে মানবীমূর্তিগুলো এখনো দাঁড়িয়ে, তাদের অঙ্গেও প্রায় একই ধরনের গয়না দেখে ঠাহর করাই যায়, শিল্পভাস্কর্যের যে নিদর্শন গোড়ার দিকে ছিল, তাতে সূক্ষ্মতার অভাব ছিল। যত দিন গেছে, নারীদের অলংকারে এসেছে সূক্ষ্মতা। পায়ে মলের বদলে নুপূর; হাতে এক হাত মোটা চুড়ির বদলে কারুকাজ করা কঙ্কণ বলয়; গলায় মোটা হারের বদলে একাধিক সরু হার, কণ্ঠি, মুক্তার মালা; কানে বড় দুলের বদলে কুণ্ডল; সাদা সাপটা মেখলার বদলে কারুকাজ করা কাঞ্চি—এসবই চোখে পড়বে খাজুরাহোর সুরসুন্দরী, ভুবনেশ্বরের অলসকন্যা, কোণার্কের অপ্সরা কিংবা বেলুর—হালেবিদের মদনিকার সাজসজ্জায়। এদের হাতে আছে আর্মলেট আর আংটি, গলায় লম্বা মালা, মাথায় টিকলি বা অন্য শিরোভূষণ। একেকজনের গয়নার সূক্ষ্ম নকশা একালের ফ্যাশন-সচেতন নারীদের মনে ঈর্ষা জাগানোয় যথেষ্ট।
তবে গবেষকদের মত, এসব নারীমূর্তি থেকে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে প্রধান বাধা—এগুলোর প্রতিটিই অত্যন্ত স্বল্পবাসা। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতেই পারে, ভারতবর্ষের নারীরা কি তাহলে অর্ধ-অনাবৃতই থাকতেন? এ প্রসঙ্গে বিশিষ্টজনদের ধারণা, শালীনতার মানদণ্ড সব সময়ই সমাজভাবনা থেকে উদ্ভূত। সমাজতত্ত্ববিদ বেলা দত্তগুপ্ত এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমরা ইউরোপের মেয়েদের আবক্ষ-উন্মুক্ত পোশাক পরতে দেখি, যার নাম “দেকলেতে”। ইউরোপের মেয়েরা এ পোশাকে একটুও লজ্জিত নন। তাদের লজ্জা পায়ের উন্মোচনে। অন্যদিকে চীনা মেয়েদের উঁচু কলারওয়ালা এবং বক্ষ আবৃত কিন্তু বাঁ পায়ের ঊরু পর্যন্ত একটি দিক খোলা পোশাক গ্রাহ্য ছিল। তাহলে দেখা যাচ্ছে, চীনা মেয়েদের বুক থেকে গলা পর্যন্তই সবচেয়ে সংকোচের জায়গা। এ থেকে বোঝা যায়, দুটি উন্নত অঞ্চলের মেয়েদের পোশাক ও তাদের শোভনীয়তা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি কত বিপরীত।’ প্রাচীন ভারতবর্ষের রীতিনীতির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বেশ গুরুত্ববহ। সেভাবে চিন্তা করলে দিদারগঞ্জের যক্ষিণীকে যদি নির্লজ্জ ভাবা হয়, ভুলই হবে। দেশ-কাল আর পারিপার্শ্বিকতা বিচার না করে কোনো মন্তব্য করা মোটেই সমীচীন নয়।
পোশাক যেমনই হোক, সূক্ষ্ম বস্ত্র ছিল প্রাচীন ভারতবর্ষের নারীদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে। এ উপমহাদেশের শিল্পীরা পাথরের বুকে নারীমূর্তি গড়বার সময় পোশাকের এই সূক্ষ্মতা আর স্বচ্ছতার কথা মনে রাখতেন। সে সময় এই অঞ্চলের জল-হাওয়ার উপযোগীও ছিল হালকা আর সূক্ষ্ম এই সুতিবস্ত্র। বিশেষজ্ঞদের মত, এটাই পরে মসলিন নামে জগদ্বিখ্যাত হয়। পৌরাণিক সাজসজ্জার প্রতিফলনও দেখা গেছে অনেক ভাস্কর্যে। এর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ মনিচীর পরিহিত প্রতিমা। মনিচীর হচ্ছে মুক্তা বসানো সূক্ষ্ম বস্ত্র। জানা যায়, দক্ষিণ ভারতে তখন মুক্তা বসানো মসলিনের প্রচলন ছিল।
স্বল্পবাসা মূর্তিগুলোর বেশির ভাগেরই ঊর্ধ্বাঙ্গ প্রায় অনাবৃত। তক্ষশীলার হারিতির সর্বাঙ্গে শাড়ির মতো আবরণ থাকলেও ঊর্ধ্বাঙ্গে দৃশ্যমান কোনো পোশাক নেই। ভারতবর্ষের পুরোনো দারুমূর্তিতে এর প্রমাণ সুস্পষ্ট। যেমন ধরা যাক গোয়ালিয়রে প্রাপ্ত কাঠের পরীর কথা। যার শুধু কোমরে জড়ানো আছে একটি বস্ত্রখণ্ড—তার পাড়ও আছে, ভেতরে কাজ করা নকশাও আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সে সময়ে এই বৈশিষ্ট্য শুধু এ উপমহাদেশের নারীর পোশাকেই দেখা গেছে। সারা বিশ্বের আর কোনো দেশের মেয়েদের পোশাকে সে সময় পাড় বা আঁচলের ভূমিকা ছিল না; এমনকি পরবর্তী সময়ে আর কোনো মূর্তিতেও। সংস্কৃত সাহিত্যেও এর কোনো বর্ণনা মেলেনি বহুদিন। নানা রকম বস্ত্র, রং-ছাপার নকশার উল্লেখ থাকলেও নেই পাড় বা আঁচলের কথা। কিন্তু প্রমাণ রয়ে গেছে যুগপুরোনো কাঠের পরীর প্রতিমায়।
তবে ঊর্ধ্বাঙ্গে পোশাক পরিহিত ভাস্কর্যও ছিল প্রাচীন ভারতবর্ষে। কুষাণ স্থাপত্যের নারীমূর্তিগুলোর অঙ্গে দেখা গেছে সেলাই করা জামা; যা ছিল সপ্তম শতাব্দীর সেই মূর্তিতেও। যার বাঁ দিকের কাঁধের কাছ থেকে নেমে এসেছে কারুকাজ করা বোতামঘর, অনেকটা লক্ষ্ণৌ অঞ্চলের কামিজ বা পাঞ্জাবির মতো। এই মূর্তিতে প্রমাণিত, নারীদের সূক্ষ্ম বসনকে শিল্পীরা কীভাবে অদৃশ্য করে তুলে ধরে তাতে নান্দনিক সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতেন। পরবর্তীকালে বাণভট্টের বর্ণনার সূক্ষ্ম বাদর-বসনের সঙ্গে মিলে যায় এর বৈশিষ্ট্য। কাপাস তুলা থেকে তৈরি হতো কার্পাস বা বাদর। চলতি ভাষায় এটি মসলিন হিসেবে বেশি পরিচিত। অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা, মসলিন নামটা বিদেশিদের দেওয়া।
কেউ কেউ মনে করেন, মসুলিপটম থেকে কিংবা সেকালের অন্যতম প্রধান বন্দর মসৌলের নামেই নামকরণ হয়েছে মসলিনের। ধারণা করা হয়, সে সময় কার্পাস বা বাদর-বসন এ উপমহাদেশের নারীদের অত্যন্ত প্রিয় ছিল। এ দিয়েই সেকালের ধনী ও বিলাসিনীরা পোশাক তৈরি করতেন। এই স্বচ্ছ ও সূক্ষ্ম বস্ত্রই ভাস্করের হাতে অদৃশ্য হয়ে পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের নারীদের এক অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। তবে ইউরোপের শিল্পীদের আঁকা ভেনাসকে দেখে যেমন ধরে নেওয়া যায় না যে সেখানকার সব নারীই নগ্ন থাকতেন, ঠিক একই কথা খাটে ভারতবর্ষের মূর্তিগুলোর ক্ষেত্রেও। শালীনতার প্রশ্ন পাশে রেখে যদি সৌন্দর্যের কথা ওঠে, সে ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের মত পরিষ্কার। সে সময়কার ভারতবর্ষের সুন্দরীরা আবরণের মোহময় আড়ালকে কখনোই অস্বীকার করেননি। তারা কখনোই নগ্নভাবে নিজেদের প্রকট করতেন না। পোশাক পরার চল তাদের মধ্যে ছিল। আর্যরা আসার আগে এ উপমহাদেশে ছিলেন দ্রাবিড় কন্যারা। তারা চুল বাঁধতেন নানা কায়দায়; কাঁচুলির ব্যবহারও জানতেন। আর্য নারীরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করেন পোশাক পরিধানের ভিন্ন নীতি নিয়ে। তাদের বক্ষ আবৃত থাকত রোমান সেনেটরদের মতো চাদর বা আঁচলের আবরণে। এই ভিন্ন দুই ধারার মিলনে তেমন বড় রকমের বিরোধ হওয়ার কোনো প্রমাণ মেলেনি ইতিহাসে; বরং উভয় সমাজের নারীরা দুটোকেই সাদরে গ্রহণ করেন। এই গ্রহণ করার প্রবণতাই ভারতীয় নারীসাজকে বিচিত্র করে তোলে। বহু দেশের, বহু যুগের পরিচ্ছদই রূপবদল করে এই অঞ্চলের নারীদের অঙ্গে উঠেছে, তবু এ উপমহাদেশের সুন্দরীরা স্বকীয়তা হারাননি। এটাই তাদের বৈশিষ্ট্য। আর তারই পষ্ট সাক্ষী ভারতবর্ষের আনাচকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অনেক লাস্যময়ী নারীর অপরূপ সব মূর্তি। যেগুলো একটি বিশেষ সময়ের বিশেষ প্রবণতার প্রতীক হয়েও এ যুগের মানুষের কাছে এখনো প্রাসঙ্গিক।
এমনকি ভারত ভাস্কর্যে যে সুন্দরীদের দেখা গেছে, তারা রঙিন বস্ত্রও পরতেন। শুধু তা-ই নয়, রং মিলিয়ে পরতেন গয়নাও। পাথরের বুকে সেই রং ধরা পড়েনি, কিন্তু কাঠের যেসব মূর্তি কালের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পেয়েছে, তাতে দেখা গেছে রঙের আভাস।
পুরোনো কিছু শিলালেখ থেকেও হাজার বছর আগের সাজপোশাকের আভাস মেলে। এগুলোর একটি মুম্বাই প্রিন্স অব ওয়েলস মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে, যা মালবের ‘ধার’ অঞ্চল থেকে পাওয়া। যেখানে মিলেছে সাত বক্তার বক্তব্য। সাতটি ভিন্ন দেশ থেকে আগত এই ব্যক্তিরা কথাও বলেছিলেন সাতটি ভিন্ন অঞ্চলের ভাষায়—গোল্ল (দাক্ষিণাত্য), কানোড় (কর্নাট), টেল্ল (গুজরাট), টক্কী (পাঞ্জাবী), গৌড়ী (বঙ্গ), মালবী (হিন্দি) ও সম্ভবত ব্রজভাষার মতো হিন্দিতে। দিয়েছিলেন স্বদেশের তরুণীদের সাজপোশাকের বিবরণ; যা সংরক্ষিত রয়েছে শিলালেখটিতে। প্রথম ব্যক্তির বক্তব্য মতে, তার দেশের মেয়ের চোখে কাজল, চুলে ছোট ফুল, অধরে তাম্বুল, গলায় জালকাঁটি, পরনে রাঙা কাঁচুলি ও ঘাগরা। দ্বিতীয় ব্যক্তির ভাষ্যে, তার দেশের মেয়ের চুল সুন্দর করে বেণী বাঁধা, তার শেষে জুঁই ফুলের থোকা, কানে ঢেড়ি (ঝুমকা), গলায় জালকাঁটি, কাছা দেওয়া অধোবাস, হাতে সরু উজ্জ্বল রক্ষাসূত্র, তাগা, পায়ে সুন্দর পাশুলি। তৃতীয় ব্যক্তির বক্তব্য, তার দেশের মেয়ের চোখে সামান্য কাজল, কানে মদনের সাজির মতো ঝুমকো, গলায় পুঁতির হার, লম্বা রাঙা কাঁচুলি, বাহুতে জড়ানো মালা, হাতে রতনচূড়, অঙ্গে স্বচ্ছ কাপড়, পায়ে নুপূর। চতুর্থ ব্যক্তি বলেছিলেন, তার দেশের মেয়ে এমন খোঁপা বেঁধেছে দেখে মনে হচ্ছে গৌরী আলিঙ্গিত শিব। চাঁদের মতো টিপ, চোখে কাজলের ছোঁয়া। কানে ঝুমকো, কণ্ঠে জালকাঁটি, পরনে ফাঁদালো ঘাগরার সঙ্গে দোরঙা ছোট কাঁচুলি। পঞ্চম ব্যক্তির দেওয়া তথ্যমতে, তার দেশের মেয়ের চুড়ো-বাঁধা খোঁপা, তাতে ছোট ছোট তারার মতো ফুল, কপালে গোল টিপ, কানে তালপাতার গয়না, গলায় পাঁচনর হার, মুক্তার চেয়েও সুন্দর সোনার দানার মালা, গেঁটে সুতলি হার, দুই স্তনের মাঝে সুতলি হাল, বাহুতে তাবিজ, পাতলা শাড়ি কটিতে জড়িয়ে পরা, ধবল ওড়না। ষষ্ঠ ব্যক্তি বলেছিলেন, তার দেশের মেয়ের কেশ দুভাগ করে বাঁধা, কপালে টিপ, চোখে কাজল, কানে কানপাশা, পরনে ধড়িবন (চুমকির কাজ করা কাপড়?), গলায় একাবলী হার, হাতে-পায়ে সোনার চূড়। সপ্তম ব্যক্তির বক্তব্য অনুসারে, তার দেশের মেয়ের পরনে ‘নিরী’, গলায় একাবলী। ফর্সা মেয়েরা পরতেন লাল কাপড়, শ্যামলীরা পরতেন পাটল রঙের। প্রত্যেকেরই বক্তব্য, বড় মানুষের ঘরে এমন মেয়েই মানায়।
চর্চায় চিত্র
প্রাচীন ভারতবর্ষে চিত্রচর্চার চল ছিল। অজন্তার গুহাচিত্রে লক্ষ করলেই নজর কাড়বে সুবেশা নারীদের মিছিল। যাদের অধিকাংশেরই বসন-ভূষণ এক নয়। তাদের সাজসজ্জার বৈচিত্র্য এখনো মনে দাগ কাটতে পারে অনায়াসে। প্রাচীন মূর্তিগুলোর মতো অজন্তার গুহাচিত্রে পষ্ট একটা বিষয়। রঙে-রেখায় সুষমায় চোখ ফেরানো যায় না বটে, দুই হাজার বছর পরেও রাজমহিষীর মুক্তার মালার ঝলমলে ভাব চোখ ধাঁধিয়ে দেয়; কিন্তু একটু খেয়াল করলেই নজরে আসে সুন্দরীদের সকলেই স্বল্পবাসা, সবারই ঊর্ধ্বাঙ্গ প্রায় অনাবৃত। অজন্তা চিত্রের নারীদের অধিকাংশের নিম্নদেহের আবরণ ডোরাদার বা ফুল-পাতার নকশাকাটা স্বচ্ছবস্ত্র দিয়ে তৈরি হাঁটুর ওপর পর্যন্ত ঝুলের আঁটো পোশাক। মেয়েদের অনেকের ঊর্ধ্ব দেহ গয়না ব্যতিরেকে অনাবৃত থাকতে দেখা যায়। তাঞ্জাভুরের চোল-চিত্রের নারীদের পোশাক অনেকটা একই রকমের হলেও, তার দৈর্ঘ্য অজন্তার মেয়েদের পোশাকের তুলনায় অনেক বেশি। চোল নারীদের সেসব চিত্রের অনেককে আবার পিরানজাতীয় দড়ি-বাঁধা জামা ব্যবহার করতে দেখা গেছে। অজন্তার শেষ দিকের গুহাগুলোর প্রায় সমসাময়িক বাঘগুহার ছবিতে আবার বেশ কিছু নারীকে দেখা যায় দেহের উপরিভাগ আবৃত করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে কোমরের কাছ থেকে রঙিন নকশাকাটা বস্ত্রখণ্ড জড়িয়ে রাখতে। যাদের প্রায় সবারই গায়ের রং কালো। দেহে অলংকারের প্রাচুর্য নেই।
অজন্তার চিত্রে রঙের অভাব নেই। রূপসীদের মিছিলের যে ছবি এখনো আছে, সেটির পোশাক-আশাকের অভিনবত্ব, বর্ণবিখ্যাত, অলংকার আর শিরোভূষণের বৈচিত্র্য ভারতবর্ষের সাজসজ্জার উদাহরণ হিসেবে মনে রাখা দরকার। যেখানে কোনো নারী স্বল্পবাসা, কারও বুকে স্তনপট্ট, কেউবা পরেছে হাতাওয়ালা বুটিদার ব্লাউজ, কারোর বস্ত্রে ডোরা, কারোর-বা নকশা। মাথায় কেউ পরেছে মুকুট, কেউ জড়িয়েছে রঙিন পাগড়ি, কারোর গলায় সাতলহর মুক্তার মালা, কারোর-বা সাদাসিধে পেনডেন্ট। কারোর খোঁপায় ফুল আছে, কেউ বেঁধেছে মাথার ওপর চূড়া। কারোর হাতে একটা বালা, কেউ পরেছে চুড়ির গোছা। এসব থেকে একটাই অর্থ পরিস্ফুট হয়, আজকের আধুনিকাদের মতো প্রাচীনকালেও মেয়েরা নানাভাবে সাজতেন। অজন্তার সতেরো নম্বর গুহার কৃষ্ণা রাজকুমারীর গলার রঙিন বা জড়োয়া নেকলেসটি এ যুগের সুন্দরীর কণ্ঠেও বেমানান হবে না।
প্রাচীন ভারতবর্ষের চিত্রে রাগরাগিণীরও দেখা মেলে। সেখান থেকে সে সময়কার ভারতীয় উপমহাদেশের নারীদের সাজপোশাকের কিছুটা আভাস মেলে। দু-একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। শিল্পীর কল্পনায় ভৈরবী রাগিণীর সাজ সাদা, তার সঙ্গে রক্তলাল কোমরবন্ধ এবং গলায় একটি স্বর্ণচাঁপার মালা। চিত্রে গৌড়ী রাগিণীও পোশাক পরেছেন রাজহাঁসের পাখার মতো সাদা, তার কানে দুটি নবমুকুলিত আমের মঞ্জরি, কামোদিনী রাগিণীর সাজ স্বচ্ছ হলুদ, পোশাকের নিচে রক্তিম অন্তর্বাস। আবার খাম্বাবতী রাগিণীর স্বচ্ছ হলুদ পোশাকের নিচে দেখা গেছে সবুজ কাঁচুলি, গলায় মুক্তার মালা, চুলে স্বর্ণালংকার। দেশি রাগিণীর পরিচ্ছদের রং পলাশ ফুলের মতো লাল, সর্বাঙ্গে মণিময় অলংকার। মালশ্রী রাগিণীর গায়ের রং গাঢ় গোলাপি, তার অঙ্গে হলুদ পোশাক কিন্তু সর্বাঙ্গে লাল, নীল, সাদা, হলুদ পাথর বসানো অলংকার। আশাবরী রাগিণীর কর্পূরচর্চিত অঙ্গে ময়ূর পেখমের পরিচ্ছদ, মাথার চুল চূড়া করে বাঁধা, কণ্ঠে গজমুক্তার মালা, হাতের কঙ্কণে সাপের নকশা। এদের সবার সাজপোশাকেই রঙের বৈপরীত্য চোখে পড়ার মতো। তবে একই রঙের সাজ এবং অলংকার পরার নজির, যা আজকের ফ্যাশনকে সংজ্ঞায়িত করে, তা সেকালেও ছিল। যেমন চিত্রে অঙ্গিত মল্লার রাগিণীর গায়ের রং চাঁপা ফুলের মতো উজ্জ্বল। তার অঙ্গে পীতাম্বর বা হলুদ বস্ত্র। তিনি চুলে চাঁপা ফুলের মালা পরেছেন, দুটি কানে চাঁপা ফুলের দুল, হাতের গয়নাও তৈরি হয়েছে চাঁপা ফুল দিয়ে। প্রাচীন চিত্রে অঙ্কিত এই রাগিণীদের দেখে মনে প্রশ্ন জাগা খুবই স্বাভাবিক যে এসবই কি শুধু শিল্পীর কল্পনা, নাকি তাদের চোখের সামনেই ছিলেন এই সুসজ্জিত নারীরা।
তথ্যসূত্র:
‘আবরণে-আভরণে ভারতীয় নারী’; চিত্রা দেব
‘ভারতশিল্পে নারীমূর্তি’; প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত
মডেল: জেসিয়া
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: বেলওয়ারি বাই ব্লুচিজ
জুয়েলারি: রঙবতী
ছবি: কৌশিক ইকবাল