তনুরাগ I অভয়াঙ্গ গুণে
নিজেকে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা পুরোটাই। হাতের কারিশমার সঙ্গে প্রকৃষ্ট তেলের যুগলবন্দীতে প্রশান্তি প্রাপ্তির প্রয়াস। যেন স্বকীয় সত্তার যত্নের উপাখ্যান
অভি আর অঙ্গ। দুটি সংস্কৃত শব্দের সন্ধি অভয়াঙ্গ। আয়ুর্বেদিক শাস্ত্র থেকে প্রাপ্ত বডি মাসাজ। বিশ্বের অন্যতম পুরোনো এই তত্ত্বের মূল শিকড় ভারতে। অভয়াঙ্গকে বলা হয় নিত্যদিনের অভ্যাস। বেশি নয়, মাত্র ১৫ মিনিটে সম্পন্ন করা যেতে পারে পুরো প্রক্রিয়া।
অভয়াঙ্গ অনুরাগ
ক্যালিফোর্নিয়া কলেজ অব আয়ুর্বেদের তথ্য পাওয়া যায় ইন্টারনেটের সূত্রে। জানা যায়, অভয়াঙ্গ মাসাজকে স্নেহানা বলে। বাংলায় মানে দাঁড়ায়, যত্ন নেওয়া অথবা ভালোবাসা। নিজের প্রতি মায়া থেকে পরম স্নেহের পরশে জড়িয়ে নেওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের এই রাজ্যের আরও একজন আয়ুর্বেদ শিক্ষকের মতামতও জানা যায়। শালিলা সুকুমারানের নামের এই শিক্ষকের তথ্যমতে, অভয়াঙ্গ সারা দিনের শারীরিক ক্লান্তি ও অবসাদ দূর করার মতো ক্ষমতা রাখে। দক্ষিণ ভারতে নিয়মিত দেহযত্নের অংশ হিসেবে এই মাসাজের চল রয়েছে।
সেলফ লাভ এখন চেনা কথা। সবাই জানে নিজেকে নিজে ভালোবাসার গুরুত্ব। অন্য কারও সাহায্য ছাড়াই সম্পন্ন করা যায় এই আয়ুর্বেদিক চর্চা। তাই বলা যেতে পারে, অভয়াঙ্গ নিজের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের একটি প্রয়াস।
মঙ্গলসাধন
দেহের সবচেয়ে বড় অঙ্গ ত্বক। অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে নিরাপদ রাখায় ভূমিকা পালন করে এটি। ত্বকের সঙ্গে পুরো দেহের সম্পর্ক থাকায় সেখানে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে মাসাজ করা হলে ইতিবাচক ফল মেলে। অভয়াঙ্গ মাসাজ প্রয়োগে সম্পূর্ণ দেহের যত্ন নেওয়া যেতে পারে। আর এই মাসাজ প্রক্রিয়ায় তেল যোগ করা হলে ত্বক কোমল হয়। শুষ্কতা দূর নিশ্চিত হয়। এর বাইরেও গুণ রয়েছে এই আয়ুর্বেদিক যত্নের।
বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যে জানা যায়, দেহজুড়ে নির্বিঘ্ন রক্ত চলাচল, সুখনিদ্রার নিশ্চয়তা, দৃষ্টির প্রখরতা বৃদ্ধি, দীর্ঘায়ু আর আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তোলে মাসাজটি। ব্যস্ত জীবনের নানা চাপে বিপর্যস্ত অবস্থা কাটিয়ে উঠতে ভূমিকা রাখতে সক্ষম। কেটি সিলকক্স নামের একজন আয়ুর্বেদিক শিক্ষকের মতামত এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, ‘ত্বকের সঙ্গে ত্বকের স্পর্শে একধরনের নির্ভরতা তৈরি হয়, যা নিরাপদবোধ তৈরিতে ভূমিকা রাখে। নিজের দেহকে যখন নিজে স্পর্শ করে মাসাজ করা হয়, তখন মন ও দেহ একে অপরের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ অনুভব করে। নিজের প্রতি নিজের ভালোবাসা প্রকাশিত হয়। ব্যক্তি বুঝতে পারেন, তিনি যেমন, তেমনটাই যথাযথ। আনকোরা, নান্দনিক। নিজেকে নিজের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে পারে এ সময়ে। আধ্যাত্মিক দিক থেকে নিজের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক উন্নয়নের একটি মাধ্যম হতে পারে এই আয়ুর্বেদিক আচার।’
রক্ত চলাচলে ভূমিকা রাখে অভয়াঙ্গ। কারণ, সম্পূর্ণ দেহ মাসাজ করার মাধ্যমে মস্তিষ্কও যত্ন পায়। তেল ব্যবহার করে ত্বকে মৃদু চাপ প্রয়োগ করা হয় বলে রক্ত চলাচল নির্বিঘ্ন হয়। একটি গবেষণায় পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, এই মাসাজের মাধ্যমে হৃৎস্পন্দনের গতি ধীর হতে শুরু করে। রক্তচাপও কমে আসে। মন ও দেহ শান্ত হয়।
আমেরিকান মাসাজ থেরাপি অ্যাসোসিয়েশনের মতে, অভয়াঙ্গ মাসাজে ঘুমের মান বাড়ে। এমনকি ইনসোমনিয়া অথবা শারীরিক ব্যথা যাদের ঘুমকে ব্যাহত করে, তাদের জন্য এটি খুব কার্যকরী। এ জন্য অনেকে ঘুমের আগে রুটিনে রাখেন এই মাসাজ। প্রি-বেড রিচুয়াল হিসেবে উপভোগ করেন।
অভয়াঙ্গ মাসাজে মাথার ত্বক ও চুলও উপকৃত হয়। মাথার তালুর শুষ্কতা দূরে ভূমিকার পাশাপাশি খুশকি থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে এর মাধ্যমে। জানা যায়, তেল ও হাতের সংস্পর্শে মাথার তালুতেও রক্তসঞ্চালন বাড়ে; আবার মৃতকোষ উঠে আসে। এসব কারণে মাথার তালুর যত্নও নিশ্চিত হয়।
শাস্ত্র বিহিত
অভয়াঙ্গ মাসাজ নিতে চাইলে প্রথমে আদ্যোপান্ত জেনে নেওয়া ভালো। এ বিষয়ে সাহায্য করতে পারবেন আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞরা। যথাযথ জ্ঞান কার্যকরীভাবে অভয়াঙ্গ মাসাজের ইতিবাচক দিকের প্রতিফলনকে নিশ্চিত করার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলবে।
আয়ুর্বেদিক তত্ত্বমতে, পৃথিবীর চারটি উপাদান মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে—আগুন, বাতাস, পানি ও মাটি। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রমতে, একে দশা বলা হয়। মোট তিনটি দশা মানুষের জীবনে কাজ করে—পিত্ত, ভাটা ও কাফা। পিত্তে আছে আগুন, ভাতায় বাতাস আর কাফায় পানি ও মাটি। প্রতিটি দশার জন্য অভয়াঙ্গ ভিন্ন হয়। এ বিষয়ে সঠিকভাবে জেনে সে অনুযায়ী বাকি পদ্ধতি মেনে চললে সঠিক ফল পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
অভয়াঙ্গ মাসাজের ক্ষেত্রে তেল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই একটি বাহ্যিক উপাদান ব্যবহারে সম্পন্ন করা হয় সম্পূর্ণ মাসাজ। বিভিন্ন রকম তেলের মাঝে ফুড গ্রেড অয়েল বেছে নেওয়ার পরামর্শ পাওয়া যায়। শুষ্ক ত্বকের জন্য সিসেমি অয়েল কার্যকরী। নারকেল তেলের গুণপনাকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। আয়ুর্বেদিক তত্ত্বমতে এটিকে বলা হয় ‘ঠান্ডা তেল’। গরমের দিনে এবং পিত্ত দশার জাতক হলে এই উপাদান বেশ উপযোগী। হালকা তেলের বিভাগে আছে কাজুবাদামের তেল এবং জোজোবা অয়েল। কাফা দশার জাতক এবং যাদের ত্বক তেলতেলে, তাদের জন্য এই ধরনের তেল বেছে নেওয়ার পরামর্শ পাওয়া যায়। আবার এই তেলে যোগ করা যেতে পারে মসলাও। যেমন দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচি, তেজপাতা। উদ্দেশ্য—গুণমান বৃদ্ধি।
তেল ব্যবহারের আগে গরম করে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। স্বাভাবিক তাপমাত্রার তেল দুই হাতের তালুতে ঘষে নিয়ে শুরু করা যেতে পারে এই আয়ুর্বেদিক চর্চা। এতে দেহের নিজস্ব তাপে উষ্ণ হয়ে উঠবে তেল। বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতের ওপরের অংশ থেকে শুরু করা যেতে পারে প্রক্রিয়া। তারপরে ধীরে ধীরে পুরো শরীরে। প্রথমে বাঁ হাত কার্যকরী করার কারণ হিসেবে ধারণা করা যায় বাঁ হাতের অবস্থানকে। হৃৎপিণ্ডের কাছাকাছি থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে পুরো দেহে পৌঁছে যাওয়া। হাঁটু ও কনুইয়ের মতো সন্ধিস্থলে হাতের তালু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চাপ দিয়ে মাসাজ সম্পন্ন করা হয়। নাভি ও কানের ছিদ্রকেও স্পর্শ করার পরামর্শ পাওয়া যায়।
সমাপন
মাসাজ শেষ হওয়ার পর তেল অন্তত পাঁচ মিনিট শরীরে রেখে তারপরে ধুয়ে নেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। এমনটাই উল্লেখ মেলে অন্তর্জালে। মাসাজ শেষে মৃদু উষ্ণ পানি দিয়ে তেল ধুয়ে নিতে হবে যত্নের সঙ্গে। মন আর দেহ—উভয়ই প্রশান্ত হবে।
সারাহ্ দীনা
মডেল: তানহা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: কৌশিক ইকবাল