কুন্তলকাহন I কুণ্ডলকৃপায়
সৌন্দর্যের আধার। শক্তির উৎসও বটে। রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচিত বিশ্বের বহু সংস্কৃতি ও কৃষ্টিতে। যোগী, সাধু আর যোগব্যায়ামকারীদের আস্থায়। সাত্ত্বিক এ তত্ত্বের বিশ্বাস, এতে বাড়ে জীবনীশক্তি, অন্তর্দৃষ্টি আর মনের প্রশান্তি
সৃষ্টির শুরুতে মানুষের মধ্যে চুল কাটার প্রচলন ছিল না। মাথায় আসতেই পারে, হয়তো স্যালনের অভাবে এমনটা ঘটত! ব্যাপারটা মোটেই তা নয়; বরং বিশ্বাস-সংক্রান্ত। সে সময় মানা হতো, চুল আপন সত্তার অংশ। তাই একে কাটা হতো শাস্তিস্বরূপ। প্রায়শই নতুন অঞ্চল দখল করার পর সে জায়গার মানুষের চুল কেটে দেওয়ার প্রচলন ছিল সে সময়। দাসত্বের স্বীকৃত চিহ্ন হিসেবে। সে সময়ের মানুষের ধারণা ছিল, এতে ক্রীতদাসদের ক্ষমতা কমে যায়। মানা হতো, কপালের হাড়গুলো ছিদ্রযুক্ত; যা সরাসরি পিনিয়াল গ্ল্যান্ড অব্দি আলো পৌঁছে দেয়। মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে। নিয়ন্ত্রণ করে থাইরয়েড এবং সেক্সুয়াল হরমোনও। চুলের ব্যাঙস কাট কপাল ঢেকে দেয়। পুরো প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা ঘটায়। চেঙ্গিস খান যখন চীন জয় করেন, তার বুঝতে দেরি হয়নি সেখানকার অধিবাসীরা অতি বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী। তাদের পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ করা কঠিন। তাই তিনি ভিন্ন ফন্দি আঁটেন। চায়নিজ সব নারীকে চুলে ব্যাঙস কাটাতে বাধ্য করেন। কারণ, তার বিশ্বাস ছিল, এতে তারা সাহসহীন হয়ে পড়বে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। তবে একটা সময় পরাজিতদের চুল কেটে নেওয়ার এ প্রথা এতটাই প্রচলিত হয়ে ওঠে, চুলের গুরুত্বই কমে যেতে থাকে নতুন প্রজন্মের কাছে; বরং প্রাধান্য পেতে শুরু করে হেয়ারস্টাইলিংয়ের নানা উপায়।
চুল যে প্রকৃতির পরম উপহার, এ নিয়ে দ্বিমত ছিল না প্রাচীনকালেও। যোগবিদ্যার দৃষ্টিকোণে এটি দেহের কুণ্ডলিনী শক্তি অর্থাৎ সৃজনশীল জীবনীশক্তি উন্নীত করতে সহায়তা করে। কাটা না হলে মানুষের চুল একটা নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য পর্যন্ত বাড়ে, তারপর থেমে যায়। ধারণা করা হয়, যার চুল যতটা বাড়ে, সেটাই তার জন্য সঠিক দৈর্ঘ্য। বিখ্যাত যোগী গুরু যোগী ভজনের মতানুসারে, মাথার চুল যখন পূর্ণ দৈর্ঘ্যপ্রাপ্ত হয়, তখন ফসফরাস, ক্যালসিয়াম আর ভিটামিন ডি উৎপাদিত হয় এবং এগুলো লিম্ফেটিক ফ্লুয়িডে প্রবেশ করে; যা পরবর্তী সময়ে মস্তিষ্কের উপরিভাগে অবস্থিত দুটি নালির মাধ্যমে স্পাইনাল ফ্লুয়িডে মিশ্রিত হয়। যা স্মৃতিশক্তিকে আরও কার্যকর করে তোলার পাশাপাশি দৈহিক সক্রিয়তা, ধৈর্য ও মনোবল বাড়ায়। যোগী ভজনের ব্যাখ্যা অনুসারে, চুল কেটে ফেললে বাড়তি শক্তি আর পুষ্টির এ উৎস হেলায় হারায়। এ ছাড়া কেটে ফেলা চুল পুনরায় বাড়ানোর জন্য দেহে প্রচুর শক্তি ও পরিপুষ্টির জোগান দিতে হয় নিয়মিত। তার ভাষ্যে, চুল হচ্ছে অ্যান্টেনার মতো, যা সূর্যের শক্তি বা প্রাণকে জমিয়ে রাখে এবং প্রয়োজন অনুসারে মস্তিষ্কের সম্মুখভাগের অংশে প্রবাহিত করে। মস্তিষ্কের এই অংশ সাধারণত ধ্যান ও কল্পনা সৃষ্টির কাজে লাগে। এ ছাড়া অ্যান্টেনার মতো কার্যকর চুল মহাজাগতিক শক্তি আকর্ষণেও সক্ষম। একবার কাটার পর, সে সময় থেকে পরের প্রায় তিন বছর লেগে যায় চুলের ডগায় কার্যকর নতুন অ্যান্টেনা গজাতে।
কুণ্ডলিনী হেয়ার কেয়ার
ভারতবর্ষে মুনি-ঋষিদের কথা ভাবলেই মানসপটে ভেসে ওঠে চুল চূড় করে বাঁধা কোনো ব্যক্তির চিত্র। ‘ঋষি নট’ হিসেবে পরিচিত এ হেয়ারস্টাইল। নির্দিষ্ট নিয়ম মানা হয় এ ক্ষেত্রে। দিনের বেলা চুল পেঁচিয়ে চূড় করে রাখা হয় মস্তিষ্কের কোষগুলোতে শক্তির জোগান দিতে। আর রাতে নামিয়ে আঁচড়ে রাখা হয়। বিশ্বাস করা হয়, ‘ঋষি নট’ পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডলকে ইতিবাচক করে তুলতে সহায়তা করে। মস্তিষ্কের মধ্যবর্তী অংশের পিনিয়াল গ্ল্যান্ডকে উদ্দীপ্ত করে। এই সক্রিয়করণ বিশেষ একধরনের নিঃসরণের সঙ্গে সংযুক্ত; যা উচ্চতর বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যকারিতা, সেই সঙ্গে উচ্চতর আধ্যাত্মিক উপলব্ধির বিকাশের কেন্দ্রবিন্দু। দিনের বেলা চুল সৌরশক্তি শোষণে সক্ষম; কিন্তু রাতে শোষণ করে চন্দ্রশক্তি। তাই দিনে চুল ওপরে উঠিয়ে চূড় বাঁধা আর রাতে নামিয়ে রাখাই নিয়ম। রাতে চুল বেণি করে রাখলে দিনের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা সম্ভব হয়।
কুণ্ডলিনী হেয়ার কেয়ারের নিয়ম অনুসারে চুলের ফাটা আগাও কাটা যাবে না। কারণ, এতে অ্যান্টেনা কেটে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। বরং রাতভর আমন্ড অয়েল মেখে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয় ফাটা অংশে। এতে চুল পুষ্টিগুণ শুষে নেওয়ার সময় পাবে। পরের দিন চুল ধুয়ে ভালো করে শুকিয়ে নিয়ে পেঁচিয়ে মাথার ওপর চূড় করে বেঁধে রাখতে হবে। পাতলা কাপড়ের আবরণে ঢেকে রাখা যেতে পারে দিনভর। এতে অ্যান্টেনার ক্ষতি সারাইয়ের সুযোগ মিলবে।
ভেজা চুল শুকানোর ক্ষেত্রে মেনে চলা চাই নিয়ম। মাঝেমধ্যে সূর্যের নিচে বসে প্রাকৃতিক রোদ আর বাতাসে শুকিয়ে নেওয়া ভালো। এতে চুল শুকানোর পাশাপাশি ভিটামিন ডি-এর বাড়তি জোগানও মিলবে। যোগীবিদদের পরামর্শ ৭২ ঘণ্টা পরপর চুল ধোয়ার। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মন খারাপ অবস্থায় চুল ধোয়া হলে তা আবেগের উথালপাতাল অনুভূতিকে আত্মস্থ করতে সহায়তা করে। যোগীরা সাধারণত কাঠের চিরুনি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন চুল আঁচড়াবার ক্ষেত্রে। এতে মাথার ত্বকে রক্তসঞ্চালন বাড়ে; সহজে উদ্দীপ্ত হয়। আর কাঠ স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটি তৈরি করে না, যা চুলের ক্ষতি হওয়ার জন্য দায়ী। আঁচড়াবার ক্ষেত্রেও মানা চাই নিয়ম। চুল ও স্ক্যাল্পের সামনে থেকে পেছনে, পেছন থেকে সামনে, তারপর পুরোটা ডানে নিয়ে আবার পুরোটা বামে নিয়ে আঁচড়াতে হবে কয়েকবার। চুল যত বড় কিংবা ছোট হোক না কেন, এভাবে আঁচড়ে নিলে সারা দিনের ক্লান্তি দূর হবে নিমেষে। অনুভূত হবে সতেজতা। দিনে দুবার এভাবে চুল আঁচড়ালে বজায় থাকবে তারুণ্য, মাসিক চক্রের সুস্থতা আর দৃষ্টিশক্তির সূক্ষ্মতা।
কারও মাথা যদি টাক হয়ে থাকে বা চুল পড়ে টেকো হয়ে যাওয়ার উপক্রম দেখা দেয়, সে ক্ষেত্রে হেয়ার এনার্জি বা চুল থেকে প্রাপ্ত শক্তির যে ঘাটতি তৈরি হয়, নিয়মিত মেডিটেশনে তা মোকাবিলা করা সম্ভব। চুলে ধূসরতা বা পাক দেখা দিলে চিন্তার কিছু নেই। এতে বরং ভিটামিন ও শক্তির প্রবাহ বাড়ে, বার্ধক্যের ক্ষতিপূরণ হিসেবে। যোগবিদ্যা অনুসারে, বাড়ন্ত বয়সের সঙ্গে মস্তিষ্কের সুস্থতা বজায় রাখার জন্য প্রাকৃতিকভাবে চুল যেমন, তেমনটাই রেখে দেওয়া প্রয়োজন। বরং মনোযোগ বাড়ানো চাই স্বাস্থ্যোজ্জ্বল রাখার চেষ্টায়।
বিউটি ডেস্ক
মডেল: জেরিন
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: কৌশিক ইকবাল