ছুটিরঘণ্টা I হরেক রঙের জলের ভুবন
আদিগন্ত ভারত মহাসাগরের বুকে বিন্দুসম মরিশাস। এই দ্বীপপুঞ্জে প্রকৃতির মহাকাব্যিক খেলা। উপভোগ করে এসে লিখেছেন ফাতিমা জাহান
মরিশাসের রাজধানী পোর্ট লুইস থেকে যাব একটি ছোট শহরে। অবশ্য পোর্ট লুইসকেও কোনো দিক থেকে বড় শহর মনে হয়নি। ছিমছাম, অল্প গাড়ি চলাচল করা, কম জনসংখ্যার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এক শহর। কিন্তু যেখানে যাব, সেখানকার নাম কিছুতেই হোটেলের ছেলেটিকে বোঝাতে পারছি না। এদের এখানে সব জায়গার নামকরণ হয়েছে ফরাসি ভাষায়। নিজেদের ভাষার পর এরা ফ্রেঞ্চ ভাষায় একে অপরের সঙ্গে মনের ভাব আদান-প্রদান করে। সাধারণত যেকোনো শব্দ ইংরেজিতে উচ্চারণ এক রকম, ফরাসিতে আরেক রকম। ইংরেজি পড়েই বললাম, ‘আমি প্লেইন ভার্তে যাব।’ বলেই ভাবলাম, বেশ ফ্রেঞ্চ বলা শিখে রাজ্য জয় করে ফেলেছি! ছেলেটি চোখ বড় বড় করে এখনো তাকিয়ে আছে। আমি মোবাইলে তাড়াতাড়ি টাইপ করে দেখাতেই বলল, ‘ও, তুমি প্লেইন ভিয়েত যাবে।’ লজ্জার সীমা নেই আর!
ইংরেজি ভাষায় যেখানে ‘ভি এ আর টি ই’ অক্ষরগুলোকে একসঙ্গে করলে ভার্টে বা ভার্তে হওয়ার কথা, সেটির উচ্চারণ অনেক দূরে ছুটে গিয়ে ‘ভিয়েত’ হলো কীভাবে! যাহোক, ট্যাক্সি ডেকে দিল হোটেল থেকে। ট্যাক্সিচালকের নাম ফয়েজ। পিতাসম বলে আমি তাকে আঙ্কেল ডাকা শুরু করলাম। আমার মরিশাস ভ্রমণের প্রায় পুরোটাই ফয়েজ আঙ্কেলের গাড়িতে চেপে ঘুরেছি। অবশ্য দেশটা এমন বড় কিছু নয়। কয়েক ঘণ্টায় এ-মাথা ও-মাথা ঘুরে আসা যায়। এখানে মূলত মানুষ আসে অবকাশ যাপন করতে এবং হানিমুনে। আমিও নিশ্চিন্তে কিছুদিন ঘুরে বেড়াতেই এসেছি, তবে সঙ্গীবিহীন। আমি এমনই! যেখানে সবাই যায় হানিমুন করতে বা যুগল ভ্রমণে, সেখানে একা একা চলে যাই। আমার কাছে নতুন দেশ, নতুন প্রকৃতির চেয়ে বড় সঙ্গী আর কিছুই নেই।
প্লেইন ভিয়েতে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে থেমেছিলাম। আমার বন্ধুর বন্ধু শমসেরের পূর্বপুরুষ প্রায় এক শ বছর আগে এ দেশে চলে এসেছিল। শমসেরের মায়ের ভারতীয় কিছু জিনিসপত্র দরকার ছিল, তাই পৌঁছে দিতে এসেছিলাম। তারা আমাকে চা-নাশতা না খাইয়ে যেতে দিলেন না। শমসেরের মা পরিষ্কার হিন্দি ভাষায় কথা বলেন। বাড়িটি দেখতে আর দশটা সাধারণ ভারতীয় দোতলা বাড়ির মতো।
মরিশাস একসময় জনমানবহীন দ্বীপ ছিল। প্রথমে কিছু আরব বণিক আসেন দশম শতাব্দীতে, তারপর এই অঞ্চলে ষোড়শ শতাব্দীতে আসেন পর্তুগিজ নাবিকেরা। কিন্তু আফ্রিকার মূল ভূখণ্ড থেকে হাজার মাইল দূরের, সাগরের বুকের এই বিন্দুসম দ্বীপে লোকজন না থাকার কারণে কেউই থিতু হননি। এরপর ফরাসিরা দ্বীপটিকে কিছুদিন ব্যবহার করেন আফ্রিকার দাসদের বন্দী রাখার জন্য। তখন ফ্রেঞ্চ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের বেশ কিছু মানুষকে চাকরি দিয়ে মরিশাসে নিয়ে আসে দাস দেখাশোনা করার জন্য। ফরাসিরা মরিশাস ত্যাগ করেন আঠারো শতকে। এরপর দ্বীপের দখল নেন ইংরেজরা। পূর্ব আফ্রিকায় কাজের সন্ধানে আসা ভারতীয়দের একাংশকে ব্রিটিশ ইস্ট আফ্রিকা প্রোটেক্টরেট (বা কেনিয়া কলোনিতে) মরিশাসে নিয়ে আসা হয়। তখন থেকেই এখানে আফ্রিকানদের চেয়ে ভারতীয়রা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তবে মজার ব্যাপার হলো, এদের দাপ্তরিক ভাষা ফ্রেঞ্চ আর নিজেদের মাঝে এরা ক্রেয়ল ভাষায় কথা বলেন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত মরিশানরা হিন্দি বা ভারতীয় কোনো ভাষায় কথা বলতে পারেন না।
পোর্ট লুইসের প্লেইন ভিয়েত থেকে আমার গন্তব্য প্রায় এক ঘণ্টার পথ। জায়গাটির নাম গ্র্যান্ড বে; ইংরেজিতে অন্তত তা-ই লেখা। কিন্তু এরা এ ছোট শহরকে বলেন গ্রামবে। এবারও উচ্চারণ করতে গিয়ে আমার দাঁত ভাঙার দশা!
সবুজ পাহাড়ে ঘেরা পোর্ট লুইসের শরীরজুড়ে বয়ে চলেছে ভারত মহাসাগর। তার মাঝে বিন্দুসম দ্বীপপুঞ্জ মরিশাস পড়েছে আফ্রিকা মহাদেশের মাঝে। তবে মানুষ, আচার-ব্যবহার, সংস্কৃতি—কোনো কিছুতেই আফ্রিকার ছাপ নেই। বেশির ভাগ ভারতীয়ই কয়েক পুরুষ আগে ভারত বা পূর্ব আফ্রিকা থেকে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। এদের অধিকাংশই কখনো ভারতে যাননি। ফয়েজ আঙ্কেলের পিতামহও চলে এসেছিলেন এ দেশে। তারা এখন নিজেদের ভারতীয় বলে মনে করেন না। নিজেদের মাঝে স্থানীয় ক্রেয়ল ভাষায় কথা বলেন। ফয়েজ আঙ্কেল আগে ব্যবসা করতেন। কথাবার্তায় মনে হলো, তিনি উচ্চশিক্ষিত এবং বেশ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা ছিল তার। এখন মাঝেমধ্যে ট্যাক্সি চালান। তার দুই মেয়ে লন্ডনে বসবাস করেন। দুজনই পেশায় ডাক্তার। মরিশাসে জিনিসপত্রের দাম বেশি বলে ফয়েজ আঙ্কেলের স্ত্রী মাঝেমধ্যে ভারতে চলে যান কেনাকাটা করতে। তবে আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে, একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী থেকে ট্যাক্সিচালক হতে কিছুমাত্র সমস্যা নেই তার।
বাইরে তখন শহর ছেড়ে সারি সারি আখখেতের মাঝ দিয়ে গাড়ি ছুটছে। শহরের আঁকাবাঁকা পথের মাঝখানে হঠাৎ করে নীল সমুদ্রের আভা মেলে; কিন্তু এই আখখেতের মাঝে সমুদ্রের দেখা নেই; বরং সারি সারি সোনালু গাছ থেকে বাতাসের দোলনায় দুলে দুলে ঝরে পড়ছে হলুদ হয়ে যাওয়া পাপড়িগুলো। পথের মাঝে এমন ঝাঁকড়া হলুদে মিশে যাওয়া বড় বড় গাছের আনন্দ আর দেখে কে! কেউ দেখে না বলেই দেখানোর তাড়া নেই এগুলোর। নিজের মতো ফুটে ঝরে যাচ্ছে কার আশায় কে জানে!
এখন আমাদের দেশে শীত পড়ছে; অথচ এ দেশে ফুলের মৌসুম মানে বসন্তকাল। কে জানে এই উদাস করা হলুদ ফুলগাছগুলো কোন জনমে কে কিংবা কার কথা ভেবে লাগিয়েছিল। সে কি জানত, আসা-যাওয়ার পথে কার মন উদাস হবে ফুলের বন্যা দেখে!
গ্রামবেতে আমি সাগরপাড়ে একটি বিচ হাউস ভাড়া করেছি। এ রকম সারি সারি দোতলা বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়। দূর থেকে দেখতে একই রকম মনে হয়। সাদা দেয়াল আর কালচে ট্যালির ছাদ, সমুদ্রমুখী বাড়ি।
বিচ হাউসে পৌঁছে মনে হলো, বাড়ি নয়, যেন রাজপ্রাসাদ। বারান্দায় দাঁড়াতেই সাগর আমাকে জোরে ধাক্কা দিল! এত অদ্ভুত আর কোমল জলের রং আমি আগে দেখিনি। নীল আর সবুজের মিশেল এক আশ্চর্য সমাধান করে দিয়েছে রঙের। একদিকে দাঁড়ালে মনে হবে পান্না-সবুজ, আরেক দিকে এগিয়ে যেন ময়ূরকণ্ঠী নীল। এ কেমন ধাঁধা!
সাগরের জলে ভাসছে ছোট ছোট স্পিডবোট। চাইলে বিচ হাউসের বাসিন্দারা এই বোটে করে ঘুরে বেড়াতে পারবেন। আমি জলের রং দেখে দিশেহারা হয়ে গেছি। বোটে ঘোরার অনেক সময় পাওয়া যাবে। রোদ পড়লে এক রং, মেঘের ছায়ায় মুহূর্তেই আরেক রঙের পোশাক বদলে নিয়েছে সাগরপরি। এমন অদ্ভুত কাণ্ড আর কোথাও কি কেউ আমার মতো দেখেছে?
এক ছুটে নেমে গেলাম সাগরে। এ আমার একান্ত নিজস্ব সৈকত, মানে প্রাইভেট বিচ। আপাতত তটে কেউ নেই। প্রতিবেশীদের বাড়ির সাগরপাড় ফাঁকা। এ সুযোগ কাজে লাগানো চাই। সম্পূর্ণ জনমানবহীন সাগরপাড়ে বহুদিন ঘুরে বেড়াইনি। জল ছুঁয়ে দেখলে মনে হয় জুঁইফুলের মতো সাদা তটে জল যেন নিজেই ধুয়ে নিয়ে নিজেকে বারবার শুদ্ধ করছে। মোমের মতো জল আদুরে রঙে গলে যাচ্ছে চারদিকে। আর আঁজলা ভরে নীলকান্তমণি সারা শরীরে মেখে নেওয়া যাচ্ছে।
সুনসান চারপাশ। আশপাশে এখনো কাউকে দেখছি না। দুপুরের খাবার খাইনি। বিশাল রান্নাঘরে রান্না করার আগে বাজার করতে হবে। বিচ হাউস থেকে সকালের নাশতা বরাদ্দ আছে আমার জন্য। পোর্ট লুইসের চেয়েও এ শহর ছোট আর ছিমছাম। সুপারশপ খুঁজতে হবে, নয়তো রেস্তোরাঁ খুঁজে আগে দুপুরের খাবার খেয়ে অন্য কোথাও যাব কি না ভাবছি।
পথের দু পাশে সাদা দেয়াল আর কালচে ট্যালির ছাদের বাড়ি অল্প কয়েকটি। গুটিকয়েক অভিজাত জামাকাপড় আর কসমেটিকসের দোকান। ঝাঁ-চকচকে রেস্তোরাঁ আর সুপারশপ। সব পাশাপাশি একই ধাঁচের ভবনে দাঁড়িয়ে—সাদা দেয়াল আর কালচে ট্যালির ছাদ। নারকেল আর অন্য অনেক গাছে ঘেরা সরু পথগুলোর ফুটপাতে নানা রঙের টবে সারি সারি গাছ লাগানো। তবে এই পথ দেখে দেশটিকে আফ্রিকা বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ইউরোপের কোনো এক শান্ত দ্বীপের টুকরো।
হাঁটতে হাঁটতে আমি মূল গ্রামবে বিচে চলে এলাম। এই সৈকতে মানুষজনের বেশ সমাগম ঘটেছে। স্থানীয়রা চাদর বিছিয়ে পিকনিকের মেজাজে রয়েছেন; আর বিদেশিরা কেউ জলে নাইছেন, কেউবা তটে শুয়ে করছেন সমুদ্রস্নান। এই জমজমাট তট দেখে বেশ আনন্দ হলো আমার। প্রাইভেট বিচ সব সময় কি আর ভালো লাগে! এ তটের জলের রং এখন আকাশের সঙ্গে মিশে যেতে চাইছে। আকাশ সমস্ত নীল ঢেলে দিয়েছে সমুদ্রে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগোতে থাকি। আশপাশের মানুষের উপস্থিতি এখন আর চোখে পড়ে না। এই এক সমুদ্র আকাশ ছুঁয়ে দেখার জন্য হাজার ঝড়-ঝঞ্ঝা পার হতে আমি রাজি আছি। আকাশ এখন সমর্পণে ব্যস্ত। এ বেলা হেলাফেলার নয়; এ বেলা শুধু ডোবার অভিপ্রায়ে দূরে ভেসে যাবার।
কতক্ষণ জলে দাঁড়িয়ে আছি, জানি না। স্থানীয় ভারতীয় এক নারী আমার দিকে এগিয়ে এলেন। প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, ভারত থেকে এসেছি কি না। কারণ, চেহারায় সে রকম ছাপ থাকুক বা না থাকুক বিচ দেখে জামা ফেলে রেখে সমুদ্রস্নানের জন্য দৌড় মারিনি, যা আমেরিকান বা ইউরোপীয়রা সাধারণত করে থাকেন; তাতেই তিনি নিশ্চিত হয়েছেন, আমি ভারত উপমহাদেশ থেকে এসেছি। ভারতীয় বংশোদ্ভূত ভদ্রমহিলাটি কখনো ভারতে যাননি। ওই উপমহাদেশ থেকে কেউ এলে খুব আগ্রহভরে তার সঙ্গে গল্প করেন। আমি কিছুক্ষণ গালগল্প করে খাবারের খোঁজে এগোলাম।
বিচের রাস্তা ধরে বেশ কয়েকটি খাবারের ভ্যান, জুসের দোকান দাঁড়িয়ে। পথের ধারের পার্কের মতো বেঞ্চে বসে নিশ্চিন্ত মনে সমুদ্র দেখতে দেখতে খাবার খেয়ে আমি সাগরের দিকে চললাম। সমুদ্রস্নান দুপুরে আমার নিজস্ব তটে করেছি। যাকে বলে পুরোদস্তুর সানট্যান হয়ে। এখন এসেছি সূর্যাস্ত দেখতে।
সৈকতে এখন সারি সারি তোয়ালে বিছিয়ে স্নানের পোশাক পরা ইউরোপীয় বুড়ো-বুড়িরা শুয়ে সূর্যস্নান করছেন। আমি তো জানতাম মরিশাসে লোকে আসে হানিমুন করতে। বুড়ো-বুড়িদের এ কেমন হানিমুন! কম বয়সী হানিমুন করতে আসা যুগল নেই এখানে।
মরিশাসের সঙ্গে আমার পরিচয় বহু পুরোনো। তখন আমি বেঙ্গালুরুতে একাদশ শ্রেণিতে পড়ি। আমার হোস্টেল ছিল আন্ডারগ্র্যাড হোস্টেলের পাশে। বড়দের সঙ্গেই চলাফেরা বেশি করতাম। সুবিধা ছিল উইকেন্ডে তাদের কাউকে গার্ডিয়ান হিসেবে নিয়ে শহরে ঘোরাফেরা করতে পারতাম। এমনিতে হোস্টেল থেকে বের হওয়ার অনুমতি ছিল না। সে বছর আন্ডারগ্র্যাডে একজন এসেছিল মরিশাস থেকে, নাম নাতাশা। তখন মরিশাস কোথায়, কেমন দেশ—কিছুই জানতাম না। নাতাশার কথাবার্তা, চালচলন—কিছুই আমাদের মানে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মতো ছিল না। ইংরেজি বললে মনে হতো ইউরোপীয়, কিন্তু দেখতে ভারতীয়দের মতোই।
পরে বেঙ্গালুরুতে পড়তে আসা মরিশাসের কিছু বন্ধুবান্ধব জুটে যায়। মরিশাসের মতো এত সুন্দর একটি দেশ যে আফ্রিকা মহাদেশে পড়েছে, তা-ও জানা হলো। এ দেশের এখনকার ভারতীয় প্রজন্ম নিজেদের মরিশান বলেই জানে। তারা ক্রেয়ল ভাষায় কথা বলে এবং বেশির ভাগই কখনো ভারতে যায়নি। তবে ভারতের প্রতি এদের আগ্রহ ও দুর্বলতা অসীম। আমি মরিশাসে আসব জেনে কয়েকজন আগে থেকেই নিমন্ত্রণ করে বসে আছে। একজন তো নিজের ক্রুজ শিপ এক দিনের জন্য বরাদ্দ দিয়েছে।
এমন মোহিত করা জলের রং দেখব আশা করিনি। ছবির মতো একটি দেশ দেখে মনে হয় ইউরোপের কোনো দ্বীপে ঘুরে বেড়াচ্ছি। দূরে নারকেলগাছে ঘেরা যে বাংলো বা বিচ হাউসগুলো দেখা যাচ্ছে, তার একটি আপাতত আমার। বিশাল বাংলোতে একা থাকার মাঝে বিশাল আনন্দ লুকিয়ে থাকে। তবে এখন আমি মুক্ত স্বাধীনভাবে সূর্যাস্ত দেখব। সামনে সাগর এসে থেমে গেছে, থামিয়ে দিয়েছে অন্যদের রং খেলা, ডুবে গেছে আশ্চর্য এক রত্নের জগতে।
সূয্যিমামার ডুবতে ঢের দেরি আছে। এই তটে ধীরে ধীরে মানুষ বাড়ছে। আমি আবার চলে এলাম নিজের তটে। একবার দোতলার বারান্দায় গিয়ে দেখলাম কোথা থেকে সূর্যাস্ত দেখলে ভালো হবে। বারান্দা থেকেই উত্তম মনে হলো। বারান্দায় কফি নিয়ে বসে দেখি সাগর তার রং বদলাচ্ছে। আগে ছিল গাঢ় পান্না-সবুজ, এখন হালকা। সঙ্গে আকাশের রংও ফিকে হয়ে উঠছে। এরপর আকাশ হলো কমলা, আর সাগর নিয়ে নীল আকাশি রং। একসময় আকাশ হয়ে গেল গোলাপের মতো গোলাপি, আর সাগর দিল তার সঙ্গে পাল্লা; কিছুতেই নীলের মাঝে আটকে রাখা গেল না, সে-ও হতে চাইল গোলাপ। এর কিছুক্ষণ পর আকাশের আনন্দ বাধা পড়ে গেল বেগুনির মাঝে। সাগরকে তো আকাশ কবেই প্রভাবিত করে ফেলেছে! তাই তারা দুজন মিলে বেগুনি রং নিয়ে একসঙ্গে দূরে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। রেখে গেল শুধু রাতের তটের ছলাৎ ছলাৎ বাজনা। রাতে ঘুমানোর আগে এই শব্দ হয়ে গেল ঘুম পাড়ানির গান।
সকালে উঠে নিচে কিচেনে গিয়ে দেখি, কামিজ পরিহিত এক নারী আমার জন্য নাশতা তৈরি করছেন। দেখতে ভারতীয়দের মতো। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। দুই হাতে বালা আর কপালে টিপ। আমাকে দেখে অতি উচ্ছ্বাসে জিজ্ঞেস করলেন, আমি ভারতীয় কি না। ভারতে পড়ালেখার সুবাদে আছি শুনে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। ভদ্রমহিলা একটুও হিন্দি বা গুজরাটি বলতে পারেন না; যদিও পূর্বপুরুষ এসেছে গুজরাট থেকে। আমার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলছিলেন। এরা এত আবেগ নিয়ে পূর্বপুরুষের ভূমিকে যত্নে বুকে আগলে রেখেছেন, না দেখলে বিশ্বাস হবে না। ভদ্রমহিলার নাম রেনুকা। আমি মাসি বলেই ডাকছি। তিনিও খুব খুশি। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, দুপুরে কী খেতে চাই। বিচ হাউস থেকে শুধু নাশতা তৈরি করে দেওয়ার কথা আছে; কিন্তু তিনি আমার জন্য বাড়তি রান্না রাঁধতে প্রস্তুত। এই যে মূল ভূখণ্ড থেকে হাজার মাইল দূরে বসবাস করার যন্ত্রণা, তা আমি এখন টের পাচ্ছি। ইচ্ছা করলেই পাশের দেশে সড়কপথে অল্প খরচে চলে যাওয়া যায় না। কারণ, আশপাশে হাজার মাইল অবধি কোনো সড়কপথ নেই; আছে সমুদ্র। সবচেয়ে কাছের দেশ মাদাগাস্কার। আরেকটু দূরে কেনিয়া বা তানজানিয়া। সেসব দেশে যেতে হলে প্লেনই ভরসা। কজনই-বা প্লেন ভাড়া দিয়ে অন্য দেশে যাওয়ার সামর্থ্য রাখে; তার ওপর আছে ভিসার ঝক্কি। সব দেশের অ্যাম্বাসি নেই ছোট এই দেশে।
মাসিকে বললাম, ‘রান্নাবান্না করতে চাইলে কাল করবেন। আজ আমার দাওয়াত আছে।’ মাসি আমার নাশতা সাজিয়ে সব গুছিয়ে চলে গেলেন। আমি আরও কিছুক্ষণ পর বের হবো। আমার এক বন্ধু এই গ্রামেই কয়েকটি ক্রুজ শিপের মালিক। আমার সঙ্গে আরেক বন্ধুর আসার কথা ছিল; কিন্তু সে মরিশাসে আসেনি। তাই অগত্যা আমাকে একা একাই ক্রুজ শিপের অভিজ্ঞতা নিতে হবে। যে আসেনি, তার জন্য আমারই আফসোস হচ্ছে, পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর দেশ দেখল না বলে।
আমার নেমন্তন্নে যেতে ইচ্ছে করছে না আজ। বারান্দায় বসে সাগরের রং বদলানো দেখতে ইচ্ছে করছে। এই খামখেয়ালিপনার জন্য বাজারের দামি চাকরি ছেড়ে দিয়ে পথে পথে ঘুরছি। তবে বন্ধুকে অপেক্ষায় রাখা ঠিক হবে না।
সুশান্তর ক্রুজ শিপ মাঝ সাগরে ভাসছে। গ্রামবে বিচে বন্ধুটি আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। বহু বছর পর দেখা। ইতিমধ্যে আমরা সবাই বড় হয়ে গেছি। সুশান্ত বিবিএ পড়তে বেঙ্গালুরুরে গিয়েছিল। ফিরে এসে বিরাট ব্যবসায়ী হয়েছে। আমি বড় অফিসার থেকে ভবঘুরে হয়ে গেছি—এ নিয়ে তার আক্ষেপের শেষ নেই। আরও বেশি আক্ষেপ করল আমার সঙ্গের বন্ধুটি আসেনি বলে। আমাকে আঙুল তুলে মাঝ সাগরে ভাসমান ক্রুজ শিপ দেখিয়ে বলল, ‘ওই যে তোমার জন্য প্রস্তুত। যখন চাইবে, তখনই যেতে পারবে।’ সুশান্তের সঙ্গে জনাআটেক ক্রুজ শিপ সদস্য দাঁড়িয়ে। বিচে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। বললাম, ‘তবে চলো, তোমার জাহাজে যাই। সেখানে নিশ্চয় তুমি কোনো না কোনো ব্যবস্থা করেছ।’
ক্রুজ শিপে যেতে হবে স্পিডবোটে চড়ে। এখানে মোটামুটি ধনী সবার নিজস্ব স্পিডবোট রয়েছে। আর হোটেল, রিসোর্ট, ক্রুজ শিপেরও নিজস্ব স্পিডবোট থাকে। সুশান্তের ক্রুজ শিপটি মাঝারি আকারের। এ ধরনের শিপে সাধারণত রাতে ডিজে পার্টির আয়োজন করা হয়। যেকোনো বিচেই এ খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এরাও শুরু করবে। জাহাজে উঠেই একজন বড়শি নিয়ে পটাপট কয়েকটি মাছ ধরে ফেললেন। জাহাজের রান্নাঘরে তা ভাজা হলো এবং দুপুরের খাবারের সঙ্গে করা হলো পরিবেশন। এই জাহাজে ছেলেমেয়ে উভয়ই কাজ করেন। আজ তাদের কাজ কম; কারণ, বাইরের কোনো অতিথির মনোরঞ্জনে ব্যস্ত থাকতে হবে না। আজ তারা ছুটির আমেজে আছেন। এদের মাঝে একজন মারিয়া। পঞ্চাশের মতো বয়স। বেশ হাসিখুশি আর সাবলীল। আমাকে বললেন, ‘চলো, আমরা এখান থেকে সাগরে ঝাঁপ দিই।’ ঝাঁপ দিতে আপত্তি নেই; কিন্তু বাগড়া দিল সুশান্ত। বলল, ‘এ রকম গভীর জলে কুমির থাকে। তোমার নামার দরকার নেই।’ আমি তাই আশাহত হলাম। কিন্তু মারিয়া এসবে অভ্যস্ত। তিনি মিডির সঙ্গে স্নানের পোশাকেই ছিলেন; তাই দিলেন ঝাঁপ। একটু পর আবার উঠে এলেন জাহাজে।
সুশান্ত তার কিছু বন্ধুবান্ধবকে ডেকেছে। তারা সূর্য ডুবলেই চলে আসবেন। আমাকে নিরিবিলিতে সূর্যাস্ত দেখতে দিয়ে সবাই যেন ভোজবাজির মতো গায়েব হয়ে গেলেন। সূর্যের রং কোথায় যেন হারিয়ে গেছে আজ। গতকালের মতো ভিন্ন ভিন্ন রং ছড়াচ্ছে না। অথবা তটেই সে রং ছড়ায়; অন্য কোথাও নয়। জাহাজের ডেকে আধশোয়া হয়ে কিংবা বসে আমি দেখছি লালিমা আর সাগরের আলতোভাবে তট ছুঁয়ে যাওয়া। এ দেশের সাগর ভীষণ শান্ত। অবসাদহীন রঙে নীলা, পান্না, ফিরোজা রত্নভান্ডার ছড়িয়ে যায় একেক সময়। জাহাজের ক্যাপ্টেনকে বলতেই সূর্যের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন জাহাজ।
পুরো জগৎ সেজেছে সোনালি-কমলা রঙের আলোয়। মনে হচ্ছে তার আভা পুরোটাই আমার গায়ে এসে পড়েছে। আমি ডুবে যাচ্ছি এক আশ্চর্যজনক ঢিমে আলোর সমাধানে। এখানে এখন কোনো কপটতা নেই; সূর্য শুধু নিজের মতো রং সাজাচ্ছে। এখানে আমি আর আশ্চর্য নিভতে নিভতে ছড়িয়ে দেওয়া লালিমা। জাগতিক কোনো ব্যস্ততা নেই। নেই কোনো তাড়া।
আকাশ ধূসর হতেই আরও পাঁচ-ছয়জন বন্ধু চলে এলেন সুশান্তের সঙ্গে। আর জাহাজের স্টাফরা তো আছেনই। সবাইকে নিয়ে রাতে জাহাজ আলোয় ঝলমলিয়ে উঠছে। সঙ্গে বাজছে ডিজে মিউজিক। ক্রুজ শিপে এখন সন্ধ্যা কিশোর হয়ে উঠেছে; হয়ে উঠেছে উচ্ছল, চঞ্চল। আর এই একদল পরিচিত ও অপরিচিত মানুষ নাচে গানে আনন্দে মুখর হয়ে স্বাগত জানিয়েছে আমাকে। মরিশাস আমার কাছে এক অপূর্ব আনন্দভূমি।
ছবি: লেখক ও ইন্টারনেট