skip to Main Content

টেকসহি I সহনশীলতার সুবাতাস

১৬ নভেম্বর। আন্তর্জাতিক সহনশীলতা দিবস। সহনশীলতা এমনই এক মানবিক গুণ, যার চর্চা করা গেলে জীবনযাপন শান্তিপূর্ণ হয়ে উঠবে সকলের

২৫ মে ২০২০। যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা রাজ্যের মিনিয়াপলিসে চার পুলিশ অফিসারের কাস্টডিতে মৃত্যুবরণ করেন জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি। তার মৃত্যুর আগমুহূর্তের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেখা যায়, হ্যান্ডকাফ পরা ফ্লয়েডের ঘাড়ে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরেছেন ডেরেক শেভিন নামের এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ। এ ঘটনায় আমেরিকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারস’ নামে শুরু হয় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন। এর রেশের বিস্তার ঘটে বিশ্বজুড়ে।
এখন প্রশ্ন, কেন আমেরিকায় শুরু হয়েছিল এই বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন? পেছনের কারণটি কি শুধু বর্ণবাদই, নাকি অসহনশীলতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ? কারণ খুঁজতে গেলে অবশ্য বহু বছর ধরে চলতে থাকা অসহিষ্ণুতার কথাই উঠে আসবে। আমেরিকা এখানে উদাহরণমাত্র। বিশ্বজুড়ে চলতে থাকা অসহনশীলতার উদাহরণ কম নয়। তাহলে যুদ্ধ-বিগ্রহ-সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর উপায় কী? উপায় একটাই—সহনশীলতার চর্চা বাড়ানো।
তাই প্রতিবছরের ১৬ নভেম্বর পালিত হয় ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর টলারেন্স বা আন্তর্জাতিক সহনশীলতা দিবস। লক্ষ্য, সহাবস্থান সৃষ্টি করে বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবনযাপনে শান্তি নিশ্চিত করা। ১৯৯৬ সাল থেকে পালিত হয়ে আসছে দিবসটি। সহনশীলতা এমন এক গুণ, যা সমাজে বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি, ধর্ম ও মতাদর্শের সহাবস্থানকে সমর্থন করে। মানব ইতিহাসে একাধিক সময়ে সহিংসতা, বৈষম্য, অসহিষ্ণুতা সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। তাই বিংশ শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সহিংসতা বৃদ্ধির আশঙ্কা থেকেই জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেসকো) প্রথম সহনশীলতা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯৯৫ সালের ১৬ নভেম্বর ইউনেসকো সদস্যরাষ্ট্রগুলোর ‘সহনশীলতার মৌলিক নীতি ঘোষণাপত্র’ সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করে। এই ঘোষণাপত্রের মূল বিষয় ছিল, মানুষকে সহনশীলতার গুরুত্ব ও মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতন করা এবং বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার প্রয়াস চালানো। সে অনুযায়ী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৯৬ সালে ৫১/৯৫ নম্বর প্রস্তাবটি গ্রহণের মাধ্যমে ১৬ নভেম্বরকে আন্তর্জাতিক সহনশীলতা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়। ইউনেসকো ঘোষিত এই আন্তর্জাতিক দিবস প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য হচ্ছে বহুমুখী সমাজে সহনশীলতা শিক্ষার মাধ্যমে পৃথিবীর সব মানুষের সুষম ও শান্তিপূর্ণভাবে জীবনযাপন নিশ্চিত করা। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালন করে।
আন্তর্জাতিক সহনশীলতা দিবস পালনের অন্যতম উদ্দেশ্য বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির প্রতি সম্মান এবং গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করা। জাতিসংঘ মনে করে, সহনশীলতা বিভিন্ন সংস্কৃতি ও জনগণের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতা গড়ে তোলে। এটি অন্যের অধিকার ও স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা করতে শেখায়। সহজ ভাষায়, সহনশীলতা মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষায় সহায়ক এবং সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আন্তর্জাতিক সহনশীলতা দিবস অসহিষ্ণুতার নেতিবাচক প্রভাবগুলো তুলে ধরে এবং সে সম্পর্কে বিতর্ক ও আলোচনার সুযোগ তৈরি করে দেয়। বৈষম্য, বর্ণবাদ, নিপীড়ন ও অবিচার কীভাবে সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, এ দিবসে সে বিষয়ে সরাসরি আলোচনা হয়। এসব আলোচনার ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান খোঁজা এবং প্রতিকারের উপায় নির্ধারণের চেষ্টা চালানো হয়, যাতে সমাজে সহনশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
বলা বাহুল্য, সহনশীলতা সারা বিশ্বে শান্তি বজায় রাখতে এবং সংঘর্ষ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তা সত্ত্বেও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নিপীড়ন, শোষণ, যুদ্ধবিগ্রহের কমতি নেই। চলতি দশক এখনো চার বছর পার করতে পারেনি; অথচ যুদ্ধের দামামা বিভিন্ন দেশে বেজেই চলেছে। রাশিয়া-ইউক্রেনের কথা দিয়েই শুরু করি। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত প্রকট হয়ে ওঠে ২০২৩ সালে। সব ছাপিয়ে ধীরে ধীরে এই সংঘাত রূপ নেয় রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের এক অলিখিত যুদ্ধে। এ পর্যন্ত এতে বিভিন্ন পর্যায়ের লাখ লাখ ইউক্রেনীয় ও রাশিয়ান হতাহত হয়েছে।
কথায় আছে, ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়।’ এ ক্ষেত্রে উলুখাগড়ার তালিকায় বাংলাদেশের মতো তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশেরও নাম রয়েছে। খাদ্য, জ্বালানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর ঊর্ধ্বমুখী বাজার, পাশাপাশি সরবরাহ ব্যবস্থার অচলাবস্থা—সব মিলিয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো মুখোমুখি হয়েছে নানা সমস্যায়।
রাশিয়া-ইউক্রেনের চলমান সংকটের মাঝেই বেজে ওঠে আরেকটি সংঘাতের দামামা—ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ। মানবাধিকারের নীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সহনশীলতা। কিন্তু এটি কোনো নীতি-নির্ধারণের ধার ধারে না। তার উদাহরণ ফিলিস্তিনের ওপর হামলা। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরের বেশি সময়ে ইসরায়েলের হামলায় সেখানে নিহত হয়েছেন অন্তত ৪২ হাজার ৫১৯ জন। আহত অন্তত ৯৯ হাজার ৬৩৭ জন। শিশু, নারীসহ হাজার হাজার মানুষ আজ উদ্বাস্তু। এসব ঘটছে বিশ্বনেতাদের সহনশীলতার অভাবে।
গত এক বছরের সংঘাতে গাজায় ১৪ হাজার ১০০ শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ। সংস্থাটির মুখপাত্র জেমস এলডার অবরুদ্ধ গাজার ১০ লাখ শিশুর জন্য উপত্যকাটিকে ‘পৃথিবীর বুকে নরকে’র সঙ্গে তুলনা করেছেন।
এবার আসি বাংলাদেশে। আমাদের ভূখণ্ডে বিভিন্ন ধর্মের ও গোত্রের মানুষের বসবাস রয়েছে। সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। এ দেশের জনগণ দীর্ঘকাল ধরে বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে এসেছে। কিন্তু ইদানীং রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতায় নানা সংঘাত ও সমস্যা তৈরি হয়েছে। দেখা যাচ্ছে সহনশীলতার অভাব; তার ফল সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সংঘটিত সহিংসতা, নির্যাতন ও নিপীড়ন নিয়ে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের জুন থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এক বছরে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৪৫টি। এসব ঘটনায় ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৪৫ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া হত্যাকাণ্ড বলে প্রতীয়মান—এমন মরদেহ উদ্ধার হয়েছে ৭ জনের। হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে ১০ জনকে। হত্যার হুমকি পেয়েছেন ৩৬ জন। হামলা, শারীরিক নির্যাতন, জখম হয়েছেন ৪৭৯ জন। চাঁদা দাবি করা হয়েছে ১১ জনের কাছে। বসতঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ১০২টি। বসতবাড়ি-জমিজমা দখলের ঘটনা ৪৭টি। দেশত্যাগের হুমকি বা বাধ্য করার চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে ১১টি। দেবোত্তর, মন্দির, গির্জার সম্পত্তি দখল ও দখলের চেষ্টার ঘটনা ১৫টি। শ্মশানভূমি দখল ও দখলের চেষ্টার ঘটনা ৭টি। মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ১৪টি। প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে ৪০টি। তা ছাড়া ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ কিংবা ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ২৫টি। অপহরণ ও জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের ঘটনা ১২টি। ধর্ম অবমাননার মনগড়া অভিযোগে আটক হয়েছেন ৮ জন।
তা ছাড়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও সহনশীলতার অভাব হতাশাজনক। রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে সহিংসতা, ধর্মঘট, অবরোধ ও অন্যান্য সংঘাতমূলক কার্যক্রম সাধারণ মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। একটি দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ অস্থিতিশীল হলে তার ফল ভোগ করতে হয় সাধারণ জনগণকে। তাই এই অঙ্গনের পরিবেশ স্থিতিশীল রাখা দেশের স্থিতিশীলতার জন্য জরুরি। প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত সহনশীলতার চর্চা এবং সাধারণ মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা করা।
সহনশীলতার মূল ভিত্তি শিক্ষা। ব্যক্তিগত থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত প্রত্যেকের মাঝে সচেতনতা তৈরির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম এটি। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সহনশীলতার নীতি সম্পর্কে জানতে এবং তা চর্চা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে পারিবারিক থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সহনশীলতার প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমেই দলমত, ধর্মীয় পরিচয়, সামাজিক অবস্থাননির্বিশেষে সকলকে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করার ক্ষেত্রে অভাবনীয় ভূমিকা রাখতে পারে।
সহনশীলতা হচ্ছে বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা বজায় রাখার একটি অপরিহার্য গুণ। আন্তর্জাতিক সহনশীলতা দিবস উদ্‌যাপন আমাদের সবাইকে সহনশীলতার মূল নীতি সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। অন্যের মতামত, বিশ্বাস ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে উদ্বুদ্ধ করে সহনশীলতা। এটি মানুষের মধ্যে বিভেদ, ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি ইত্যাদি ঘোচাতে মহৌষধ হিসেবে কাজ করে। তাই দেশের আদর্শ নাগরিক হিসেবে সহনশীলতার চর্চা করে বিশ্বব্যাপী সংঘাত, বৈষম্য ও বিদ্বেষ কমানোর চেষ্টাই কাম্য।

 সুস্মিতা চক্রবর্তী মিশু
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top