প্রাগৈতিহাসিক I প্রাচীন রোমান পাতে
২৭ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ। এক সুদীর্ঘ সময়কাল পৃথিবীর বুকে ধাপে ধাপে ছিল রোমান সাম্রাজ্যের দাপট। প্রাচীন রোমান খাদ্যাভ্যাস কেমন ছিল?
দুনিয়াজুড়ে কালে কালে ইতালীয় খাবারের ঘটেছে দারুণ বিস্তার। কিছু খাবার সুদূর প্রাচীনকাল থেকে এখনো টিকে আছে। কিছু আবার হারিয়ে গেছে সময়ের গহ্বরে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ইতালির আইকনিক ফুড আইটেম পিৎজা কিংবা পাস্তা প্রাচীনকালে ছিল না। এমনকি খাবারে টমেটো কিংবা লেবু ব্যবহারের চলও ছিল না তখন। তবে ঔষধি হিসেবে রসুনের ব্যবহার দেখা যেত। অবশ্য ডরমাইস ও ফ্ল্যামিঙ্গো টাং (ময়ূর ও নাইটিঙ্গেলের জিব) ফ্রাইয়ের মতো কিছু অদ্ভুত পদ এখনো চেখে দেখেন ভোজনরসিকদের অনেকে। এ ধরনের ব্যতিক্রমী খাবার প্রাচীনকালে শুধু ধনীদের পাতেই দেখা যেত। সাধারণ মানুষ প্রচলিত খাবারেই সারত উদরপূর্তি। প্রাচীন রোমানরা প্রাচীনকাল থেকে এখনো টিকে থাকা ট্যাপেনেড এবং কিশের মতো বিরল ও অদ্ভুত খাবারে আসক্ত ছিল।
স্পষ্টতই অনেক খাবার আজ ইতালীয় রান্নার জগতের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার মতো নয়! রোমান সাম্রাজ্যে উদ্ভূত বেশ কিছু পদ বর্তমান ইতালির সীমানা পেরিয়ে অন্য কিছু দেশেও বেশ জনপ্রিয়। যেমন স্কটল্যান্ডের জাতীয় খাবারের মর্যাদা পেয়েছে হ্যাগিস; অন্যদিকে ফয়ে গ্রাসের মতো খাবারকে ফরাসিরা সময়ের পরিক্রমায় নিখুঁত করে তুলেছে। এর অন্যতম কারণ, রোমান সাম্রাজ্যের আয়তন ছিল বিশাল। এর শাসকেরা যখন বিভিন্ন রাজ্য জয় করে বসতি স্থাপন করতেন, সেখানে নিজেদের পছন্দের খাবারেরও প্রচলন ঘটাতেন। রন্ধনশিল্পে রোমানদের অবদান এককথায় অতুলনীয়।
একটি বিষয় অবশ্য এড়িয়ে যাওয়ার অবকাশ নেই। ধনী ও সাধারণ মানুষের খাদ্যাভ্যাস তথা রন্ধনপ্রণালি ও খাদ্যতালিকার মধ্যে কোনো মিল ছিল না। কেননা, ধনী অশ্বারোহী ও প্যাট্রিশিয়ান বা অভিজাত শ্রেণি এবং রোমের আমজনতা বা প্লেবিয়ানদের মধ্যে বিশাল ব্যবধান দৃশ্যমান ছিল। প্লেবরা রুটি, শাকসবজি ও পনির খেত। তবে সামর্থ্যরে সবটুকু উজাড় করে দিয়ে মাঝেমধ্যে খাবারের তালিকায় মাংস যোগ করার প্রয়াস ছিল তাদের। শহুরে জীবনে ব্যয়ের কারণে এটি আরও চ্যালেঞ্জিং ছিল। শহরে তাদের আবাসস্থল ছিল ৫-৬ তলাবিশিষ্ট কাঠের তৈরি অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং, যাকে বলা হতো ইনসুলে। যারা ইনসুলের দ্বিতীয় বা তার চেয়ে উঁচু তলাগুলোতে থাকতেন, চুলায় আগুন ধরানো তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে গরম খাবার পেতে বাইরে যাওয়ার বিকল্প ছিল না। সৌভাগ্যবশত, পুরো রোমে পপিনা বা থার্মোপিলাই নামে বিভিন্ন ধরনের খাবারের দোকান ছিল। ডোলিয়া (একধরনের পাত্র) থাকার কারণে ক্ষুধার্ত ভ্রমণকারীদের স্কুপের মাধ্যমে খাওয়ার জন্য খাবার সংরক্ষিত থাকত। এই দোকানগুলোতে সাধারণত মাংস, শাকসবজি রান্না ও সেদ্ধ করার জন্য ছিল উনুন।
এসব দোকানের বিভিন্ন কামরায় বসে খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। পরিবেশিত খাবারের তালিকায় মিটবল, মসুর ডাল ভাজার মতো দ্রুত ও সহজে রান্নাযোগ্য বিভিন্ন খাবারের দেখা মিলত। আপাতদৃষ্টে এই দোকানগুলোকে কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে খাবার গ্রহণের উপযুক্ত বিবেচনা করা না হলেও সেখানে সময়ে সময়ে প্যাট্রিশিয়ান ও সম্রাটদের সঙ্গে বিদ্রোহী জনতার আলোচনায় বসার নজির ছিল। সমাজের উঁচু শ্রেণির অনেকে এসব ঘটনাকে বিদ্রূপের চোখে দেখতেন। কেননা, অভিজাত শ্রেণির মধ্যে সে যুগে আয়েশ করে হেলান দিয়ে অথবা আধশোয়া অবস্থায় খাদ্য গ্রহণের রেওয়াজ থাকলেও প্লেবরা সেভাবে নয়, বরং বসে খেত; যেমনটা আজ অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রচলিত।
সমাজে উচ্চবিত্তদের খাবারের ব্যাপারটি আগাগোড়াই ছিল অন্য রকম। ধনী পৃষ্ঠপোষকদের ক্লায়েন্ট হওয়া ছিল চরম সৌভাগ্যের। সে ক্ষেত্রে রীতি ছিল ক্লায়েন্টকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানানোর। আমন্ত্রিত অতিথি পৃষ্ঠপোষকদের পালঙ্কে বসে খাবার খাওয়ার চল ছিল। তবে সবকিছু অনুসরণ করতে হতো রীতিমাফিক। অতিথিকে নিজের ন্যাপকিন নিয়ে যেতে হতো। এ ছাড়া ঘরে থাকা লারারিয়াম নামক প্রার্থনাস্থলে পৃষ্ঠপোষকের গৃহদেবতাকে ধন্যবাদ জানানোর বাধ্যবাধকতা ছিল। ডাইনিং রুম ও ডাইনিং সোফা—উভয়কেই ডাকা হতো ট্রিক্লিনিয়াম বলে। সোফা বা পালঙ্কটি ছিল তিন দিকবিশিষ্ট [উল্টো ইউ শেপ]। সাধারণত নয়জনের ডিনারের ব্যবস্থা করা যেত এতে। ৯ সংখ্যাটি নয়জন দেবতার প্রতিনিধিত্ব করত। অধিক স্থানের প্রয়োজন হলে বাড়তি ট্রিক্লিনিয়াম জুড়ে দেওয়া হতো; তবে সেগুলোও প্রতিটি ৯ সংখ্যাবিশিষ্ট হওয়া ছিল আবশ্যক। খাবার রাখা হতো বাঁ পাশে। তারা যেকোনো হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে আংশিক শুয়ে থাকতেন। সোফা বা পালঙ্কের মাঝখানে বর্গাকৃতির টেবিল থাকত। মাঝের আসনটি ছিল সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ও গুরুত্বপূর্ণ। দাওয়াতের বাইরেও অতিথিরা কখনো কখনো বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে আসতেন। সেই ব্যক্তিকে বলা হতো ‘শেডো’ বা ‘প্যারাসাইট’। তাকে যিনি নিয়ে আসতেন, তিনি তার পায়ের কাছে বসতেন। তারা বিনা মূল্যে খেতে আসতেন বলে তাদের কাছ থেকে আসর জমানোর মতো হাস্যরসাত্মক আলাপের প্রত্যাশা করা হতো।
অনেকের হয়তো জানা নেই, খাবারের জন্য তিনটি কোর্সের ধারণার প্রচলন প্রাচীন রোমেই। ওর দার্ভ বা গুস্টাটিও [যেটিকে আমরা স্টার্টার বা অ্যাপেটাইজার হিসেবে জানি] দিয়ে খাদ্য গ্রহণ পর্ব শুরু হতো। মূল খাবার পরিচিত ছিল মেনসি প্রিমেইট নামে। সবশেষে থাকত মেনসি সেকেন্ডি [ডেজার্ট]। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডিমে তৈরি একধরনের খাবার দিয়ে খাদ্য গ্রহণ শুরু হতো; আর শেষ হতো ফল দিয়ে। খাবার থাকত টেবিলের মাঝখানে। অতিথিদের মাংস ও অন্যান্য খাবার কেটে দিতেন একজন ‘সিজার স্লেভ’। খাবার নিতে অতিথিরা ডান হাত ব্যবহার করতেন। কখনো কখনো চামচও ব্যবহার করতেন তারা।
ক্রিস্টাল কিংয়ের ‘ফিস্ট অব সরো: আ নভেল অব অ্যানশিয়েন্ট রোম’ [২০১৭] উপন্যাসের তৃতীয় ও দ্বাদশ অধ্যায়ে প্রাচীন রোমানদের খাদ্যাভ্যাস এবং প্রথম শতাব্দীর ভোজনরসিক ও খাদ্যবিশারদ মার্কুস গাভিয়ুস আপিকিয়ুসের সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা রয়েছে। ভোজনরসিক হিসেবে তিনিই প্রথম বিশ্বব্যাপী খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তার রচিত রোমান কুকারি রেসিপির এক ঋদ্ধ সংগ্রহের সংকলন প্রথম প্রকাশ পায় সম্ভবত পঞ্চম শতাব্দীতে কিংবা তারও আগে। লাতিন ভাষায় লেখা, ‘আপিকিয়ুস’ নামে অধিক পরিচিত এই সংকলনের মূল শিরোনাম ‘দে রে কোকুইনারিয়া’ [‘অন দ্য সাবজেক্ট অব কুকিং’]। ১০ খণ্ডের এই বইজুড়ে রয়েছে শাকসবজি, শস্য, মুরগি, ‘বিলাসী খাবার’, বিভিন্ন প্রাণিজ মাংস, সি-ফুডসহ অনেক খাবারের রেসিপি। খাবার সংরক্ষণের জন্য নিবেদিত বেশ কয়েকটি রেসিপির পাশাপাশি স্বাদ ও হজমের বিষয়ও পেয়েছে গুরুত্ব। ৬০টির বেশি সসের রেসিপি রয়েছে বইটিতে। এর শেষাংশে ভিন্ডারিয়াস নামের এক ব্যক্তির বেশ কয়েকটি রেসিপি রয়েছে। বিশেষজ্ঞমতে, তিনি ছিলেন সমাজের উচ্চবিত্ত মানুষ এবং একজন ভোজনরসিক।
নানা সময়ে অনুবাদ হয়েছে বইটির। এগুলোর মধ্যে ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত জোসেফ ডোমারস ভেহলিংয়ের একটি ইংরেজি অনুবাদ অনলাইনে সহজলভ্য হলেও মান বেশ হতাশাজনক। তবে ২০০৬ সালে প্রকাশিত স্যালি গ্রেঞ্জার ও ক্রিস্টোফার গ্রোককের ‘কুকিং আপিকিয়ুস’ বইটিকে উৎসের প্রতি বিশ্বস্ত প্রথম মানসম্মত ইংরেজি সংকলন হিসেবে গণ্য করা হয়।
এ বইয়ে থাকা অনেক রেসিপিই প্রাচীন; বিশেষ করে প্রথম শতাব্দী বা তারও আগের। সিলফিয়াম বা লেজারের মতো বেশ কয়েকটি রেসিপি রয়েছে এতে, যেগুলো ৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বলে রাখি, এ দুটি খাবার ছিল কামোত্তেজক। আপিকিয়ুসের হেঁসেল থেকে এসব খাবার এসেছিল বলে ধারণা করা হয়। বলা বাহুল্য, আপিকিয়ুসের রান্নাবিষয়ক বইতে এখন যে পরিমাণ রেসিপি মেলে, অতীতে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি ছিল বলে ধারণা খাদ্য ইতিহাসবিদদের।
বর্তমানের কেচাপ ও পার্সলের সাদৃশ্য দুটি পদ ২০০০ বছর আগে, রোমান সাম্রাজ্যেও প্রচলিত ছিল; তবে গারুম ও সিলফিয়াম নামে। গারুমের পাত্র পূর্ণ জাহাজের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে সম্প্রতি। প্রশ্ন জাগতেই পারে, এটি কী ছিল? থাই ও ভিয়েতনামের খাবারের সঙ্গে এর মিল রয়েছে বলে ধারণা পাওয়া যায়। গারুম ছিল একধরনের গাঁজানো মাছ দিয়ে তৈরি সস, যা প্রাচীন রোমানরা পছন্দ করত। রোমান সাম্রাজ্যে বেশির ভাগ খাবারে এটি ব্যবহৃত হতো। উপকূল অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত ছিল এর কারখানা। অন্যদিকে, সিলফিয়াম পরিচিত ছিল লেজার নামেও। প্রাচীন রোমানদের কাছে এর জনপ্রিয়তা গারুমের চেয়ে কম ছিল না। সিলফিয়াম ছিল লিবিয়ার উপকূলের সাইরেনিকা দ্বীপে চাষ করা একটি ভেষজ। মূলত ওই অঞ্চলেই ফলত। প্রাচীন রোমান ও গ্রিকরা নিজেদের ভূখণ্ডে শতাব্দীর পর শতাব্দী চেষ্টা করেও এর চাষাবাদে খুব একটা সফল হয়নি। এ কারণে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর বিলুপ্তি ঘটে যায়। বিলুপ্ত হওয়ার আগে এটি এতই মূল্যবান ছিল, সাইরেনিকার মুদ্রায় এর ছবি খোদাই করা ছিল।
ফ্লেমিঙ্গো, ময়ূর, সারস, তোতা, সংবার্ডস, ডরমাইস, শামুক, পোসকা—এসবের পদ সাধারণ রোমানদের পাতে মিলত না। এগুলো ছিল ব্যয়বহুল ও দুষ্প্রাপ্য। তবে টেপানাড, ফোয়ে গ্রাস, ফ্রাইড ডোও, হ্যাগিস, মিট বল, অ্যাবসিন্থ বা ভার্মাউথ, ফ্রেঞ্চ টোস্ট, ফ্রিটাটাস, অমলেট, কিশ, ফ্ল্যাটব্রেডের মতো খাবার ছিল সর্বসাধারণের কাছে জনপ্রিয়।
ফুয়াদ রূহানী খান
চিত্রকর্ম: সংগ্রহ