মনোজাল I মনস্তুষ্টিতে
সৌন্দর্যবর্ধনে এর ব্যবহার যতটা না চর্চিত, স্ব-যত্নে আনুকূল্য ততটাই উপেক্ষিত। কাজ করে মানসিক সুস্বাস্থ্যের স্বার্থে, আবেগ আয়ত্তে
মেহেদি নিয়ে বাঙালি কবিরা অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। সবই রোমান্টিক। তোমার মেহেদি রাঙা হাত দেখে আমার মন রঙিন হয়ে ওঠে—এজাতীয়। নারীর মেহেদি রাঙা হাত তার ভালোবাসার মানুষটিকে আলোড়িত করে, এ তথ্যে নতুন কিছু নেই; বরং মেহেদি একজন নারীকে যেভাবে প্রশমিত, আনন্দ-আবেগে প্লাবিত করে, সে তথ্যে কিছুটা নতুনত্ব থাকলেও থাকতে পারে। আসলে, আমাদের এই উপমহাদেশে মেয়েদের সঙ্গে মেহেদির খুব নিগূঢ় একট সম্পর্ক তৈরি হয় সেই ছেলেবেলা থেকেই। উৎসবে, পার্বণে, খুশিতে বা যেকোনো উপলক্ষ পেলেই তারা মেহেদি পরতে ভালোবাসেন। আর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান ‘বিয়ে’ হলে তো কথাই নেই। বিয়ে হচ্ছে, আর মেয়েদের হাতে মেহেদি নেই, এই নজির নেই বললেই চলে। তা তিনি যে ধর্মেরই হোন।
কেন পরা হয় মেহেদি? শুধুই কি সাজ, সংস্কার বা নিছক হাত রাঙানো? বিশেষজ্ঞদের মতে, এর উত্তর এত সরল নয়। মেহেদি সব সময় সাজের চেয়ে আরও বেশি কিছু। এর ব্যবহারের পেছনে বৈজ্ঞানিক বিভিন্ন কারণও রয়েছে। যেমন মেহেন্দি বা মেহেদি পেস্ট ত্বকের ওপর একটি অ্যান্টি-ফাঙ্গাল ও অ্যান্টি-ভাইরাল এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। ফলে ত্বক-সম্পর্কিত অনেক রোগ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয় সেটি। তা ছাড়া আমরা জানি, ঐতিহ্যবাহী এশিয়ান বিয়েগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একটি কঠোর ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়ায়। টানা আচার-অনুষ্ঠানের কারণে প্রায়শই বর ও কনেকে অনেক চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। হাতে ও পায়ে মেহেদি লাগালে তা শরীর শীতল রাখতে সাহায্য করে। স্ট্রেসজনিত মাথাব্যথা ও জ্বর থেকে রক্ষা মেলে। এককথায়, শরীরের জন্য একটি শিথিল এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। চিকিৎসকেরাও বলেন, মেহেদি অত্যন্ত শক্তিশালী একটি ঔষধি গাছ। হাত ও পায়ে এর প্রয়োগ মনের চাপ প্রতিরোধ করতে পারে। এটি শরীর শীতল এবং স্নায়ুকে উত্তেজনা থেকে রক্ষায়ও সক্ষম।
হিন্দু বা মুসলিম, ধর্ম যা-ই হোক না কেন, আজকালকার বিয়েগুলো নানাবিধ আচার-অনুষ্ঠানের জন্য পরিচিত। প্রকৃতপক্ষে, বিবাহের সৌন্দর্য এই বিশেষ উদ্যাপনের সঙ্গে জড়িত অসংখ্য ঐতিহ্যের মধ্য দিয়েই আসে। প্রাক্-বিবাহ অনুষ্ঠান বিয়ের আগে শুরু হয় এবং কখনো কখনো এক সপ্তাহ পর্যন্ত চলে। এই উদ্যাপনের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান হলো মেহেদি। এই দিনে কনে এমনকি বরের হাতে ও পায়ে মেহেদি লাগানো হয়। হিন্দু-মুসলমাননির্বিশেষে উভয় বিয়েতেই এটি এখন গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। কারণ, এতে আনন্দ ভাগাভাগি করা যায়। শুধু বিয়ে নয়, এই উপমহাদেশে যেকোনো উদ্যাপনের সময়ই মেহেদি প্রয়োগ একটি প্রথা। ঈদ, বিয়ে, করওয়া চৌথ, তিজ, দিওয়ালি, রমজানের চাঁদ দেখা বা অন্য কোনো উদ্যাপন—যা-ই হোক না কেন! মেহেদির এই জনপ্রিয়তা এমনি এমনি নয়। যিনি মেহেদি পরান এবং যার হাতে মাখানো হয়—দুজনেই শরীর-মনে যে তৃপ্তি পান, তার তুলনা হয় না। এ ব্যাপারটি রীতিমতো গবেষণায় প্রমাণিত।
গবেষকেরা আরও বলছেন, বর্তমান ব্যস্ততম জীবনের অত্যধিক চাপ কমাতে সেলফ কেয়ার বা রিলাক্সেশনের জন্য সময় বের করা খুব জরুরি। স্পেশাল কিছু নয়, জাস্ট সাধারণ সুস্থতা সংরক্ষণের জন্যই এটি গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে মেহেদির এই শিল্পকলা বা মেহেদি প্রয়োগ, সেলফ কেয়ারের একটি চমৎকার কৌশল হতে পারে। কারণ, এর প্রচুর থেরাপিউটিক গুণ রয়েছে, যেগুলো খালি চোখে সেভাবে বোঝা যায় না। মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য মেহেদি প্রয়োগের বেশ কয়েকটি সুবিধা রয়েছে, সেগুলো রীতিমতো থেরাপির মতো কাজ করতে সক্ষম।
মননশীলতা ও উপস্থিতি
মেহেদি প্রয়োগের জন্য মনোযোগ ও ধৈর্য প্রয়োজন। যখন ত্বকের ওপর সূক্ষ্মভাবে জটিল নকশা আঁকা হয়, তখন বর্তমানের সব যন্ত্রণা ভুলে মনোনিবেশ করতে হয় শুধু সে মুহূর্তে। এই মনোযোগ মন শান্ত ও ইন্দ্রিয়গুলো জাগ্রত করতে সাহায্য করে। মননশীলতার এই অবস্থা মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও বাহ্যিক চিন্তাভাবনা কমাতে সক্ষম; পাশাপাশি মস্তিষ্কে অবচেতনভাবেই ছড়িয়ে পড়ে।
মানসিক চাপ উপশম
মেহেদি আর্টের মতো সৃজনী কাজে নিযুক্ত থাকা মানসিক চাপ কমাতে একটি শক্তিশালী পন্থা হিসেবে কাজ করতে পারে। মেহেদি প্রয়োগের ছন্দময় গতি, ত্বকের ওপর পেস্টের স্পর্শকাতর নরম প্রলেপ শরীর ও মনের উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করতে পারে। যখনই নকশার প্রবাহে মস্তিষ্ককে কাজে লাগানোর সুযোগ তৈরি হয়, সেটি তাৎক্ষণিক একধরনের স্বস্তিবোধ করাতে শুরু করে।
ক্ষমতায়ন ও স্ব-অভিব্যক্তি
বিশেষজ্ঞদের মতে, মেহেদি আর্ট নিজেকে প্রকাশ করার জন্য একটি সৃজনশীল ও অভিব্যক্তিপূর্ণ ক্যানভাস দেয়। বিভিন্ন কৌশল নিয়ে খেলার ছলেই হোক কিংবা জটিল ডিজাইন তৈরির মাধ্যমে; মেহেদি স্বতন্ত্র শৈলী ও ব্যক্তিত্ব দেখানোর সুযোগ এনে দেয়। যখন অন্যকে বা নিজেকে মেহেদির নানা কারুকাজে সাজিয়ে তোলা হয়, সেই সৃজনশীল অভিব্যক্তি ক্ষমতায়ন ও আত্মবিশ্বাসের বোধকে উন্নীত করে তোলে।
সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের যোগ
থেরাপি হিসেবে মেহেদির ব্যবহার কেবল মন ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিই করে না; বরং ফেলে আসা প্রিয়জন ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্ককে শক্তিশালী করে। এটি অতীত ও বর্তমানের মধ্যে একটি যোগসূত্র হিসেবে কাজ করতে পারে, যা পুরোনো ভালোবাসার মানুষদের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেটি হতে পারে মা, দাদি, বোন বা বন্ধু। পরিচয় ও স্বত্বের অনুভূতির মূলে এমন সাড়া ফেলে যে কিছুক্ষণের জন্য সেই মমতাময় অনুভূতি বা স্মৃতিতে ফিরে যেতে বাধ্য হন যে কেউ; যা অভূতপূর্ব এক প্রশান্তি সৃষ্টি করে মনে।
আচার ও অনুষ্ঠান
সেলফ কেয়ার টেকনিক হিসেবে যদি মেহেদি তালিকায় থাকে, তাহলে সাধারণ অনুষ্ঠানগুলোও উদ্যাপন ও আচারের অনুভূতি দিতে পারে। সুন্দর, সূক্ষ্ম, বিস্তৃত নকশা তৈরি করতে ত্বকে মেহেদি প্রয়োগ করার জন্য যে সময় ব্যয় হয় বা পরিতৃপ্তি আসে, তা একসময় আত্মপ্রেম ও উপলব্ধির আধ্যাত্মিক অনুশীলনে পরিণত হয়।
সমাজ ও সংযোগ
বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের মধ্যে মেহেদি ভাগাভাগি করা বরাবরই ঐতিহ্যের অংশ ছিল, আছে। প্রিয়জনের সঙ্গে এমন মমতামাখা শেয়ারিং মনে সমাজ ও সংযোগের অনুভূতি তৈরিতে সহায়তা করতে পারে। যেকোনো উৎসব বা উদ্যাপনে কিংবা এমনিতেই একসঙ্গে মেহেদি পরার আয়োজন অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি এমন একটি স্থায়ী আনন্দময় স্মৃতি দেয়, যা দীর্ঘদিন ধরে নিরাময়ক প্রক্রিয়াকে কার্যকর রাখতে সহায়তা করে।
রত্না রহিমা
মডেল: নাজাহ নোয়ার
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: আদ্রিয়ানা এক্সক্লুসিভ
জুয়েলারি: রঙবতী
ছবি: কৌশিক ইকবাল