ফিচার I রাখিও ‘রাখি’তে
যেমন দেশ, তেমন বেশ—বিয়ের জনপ্রিয় এ অনুষঙ্গের বেলায় কি সেকথা খাটে? নাকি সীমান্ত আর সংস্কৃতির ঘেরাটোপ ঘুচিয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে সৌন্দর্য—তারই খোঁজে রুম্পা সৈয়দা ফারজানা জামান
১৯৯৭ সালের কথা। তখন সবে ঘরে ঘরে আসছে রঙিন টেলিভিশন। বসার ঘরে মোটা তারে এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া ক্যাবল কানেকশন। তাতে আবার নানা রকমের আয়োজন। এই মিউজিক চ্যানেল, তো সেই সিনেমা। সে সময় বালি সাগু নামে একজন দারুণ শ্রোতাপ্রিয় ভারতীয় মিউজিক অ্যারেঞ্জার ছিলেন। র্যাপার হলেও গানের রিমেক ও রিমিক্স করতেন। ঠিক তখন একটি গান অনেকের মাথায় খেলে যেতে থাকে। পাঞ্জাবি গানটি হলো, ‘কুড়ি নাল ইশক মিঠা’। তাতে প্রধান ভূমিকায় দেখা যায় মালাইকা অরোরাকে। উপস্থাপক হিসেবে তখন তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। এর মধ্যে আবার গানে আকর্ষণীয় উপস্থিতি। তারপরও সব ছাপিয়ে গেল সেই গানের একটি গয়না। মিউজিক ভিডিওতে থাকা কনের হাতে। চুড়ির মতো হলেও তাতে লম্বা লম্বা ঝালর জুড়ে দেওয়া। সে সময়ের সেই গান হিট হতে হতে গয়নাটি রীতিমতো মানুষের ঘরে ঘরে ঢুকে গেল। তখন বিয়ে মানে হয়ে উঠল লাল শাড়ি, শেরওয়ানি আর অবশ্যই সেই গয়না।
কিন্তু তারও একটা নাম তো চাই। নামটি কালিরা। এটি অবশ্য ভারতের দিকের নাম। এমনই এক ধরনের গয়না বাংলাদেশে বহু আগে থেকেই প্রচলিত। নাম রাখি। কেউ বলে বিবাহের নিদর্শন, কেউবা মঙ্গলের সূচনা, কারও কাছে নতুন কিছু শুরু করার একটি প্রতীক। এই রাখি নিয়ে আছে নানা গল্পও।
সে সময়কার বিয়েতে মূলত চার দিনের আয়োজন হতো। প্রথম দিন মেয়ের গায়েহলুদ, পরের দিন ছেলের। তারপর বিয়ে; বউভাত। যুগের তালে কখনো বিয়ে নিয়ে আয়োজন কমেছে, আবার বেড়েছেও। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শেষ পর্যন্ত এই চার দিনে থাকত নানা আয়োজন। এর সঙ্গে এলাকানির্বিশেষে রং খেলা, মেহেদি উৎসব, গানের উৎসবসহ আরও নানা আয়োজনের চল ছিল, এখনো আছে।
বিয়ের ইতিহাসের আদিকাল থেকে কনেকে সাত সধবার পানি মাথায় ঢেলে গোসল শেষে নতুন কাপড় পরানো এবং হলুদের জন্য তৈরি করা হয়। এরপর বরপক্ষ আসে তত্ত্ব নিয়ে। সেই তত্ত্ব ডালায় রাখি থাকবেই। এই রাখি দিয়ে কনের সৌভাগ্য, নতুন জীবন, বন্ধন—নানা ধরনের প্রতীক নির্দেশ করা হয়। আবার অনেকের ধারণা, হাতে রাখি বেঁধে দিলে তার ওপর সে সময় ‘বদনজর’ পড়বে না।
আগেকার দিনে বিয়ের সময় বদনজর বা কুনজর—এসব বিষয়ে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হতো। কনে খোলা চুলে ঘুরবে না, তত্ত্বে পাঠানো পাটি ছাড়া বসবে না, হলুদ খাবে না, মাছ খাবে না ইত্যাদি। অনেকের কাছে একে অতি বিশ্বাস মনে হলেও গ্রামবাংলার অসংখ্য পরিবার এই ধারণাকে বিশ্বাস করে বছরের পর বছর কাটিয়েছে।
আবার হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী রাখি হলো কবচের মতন। বিশ্বাসে রক্ষা—এমন ধারণা থেকেই যুগ যুগ ধরে এর প্রচলন।
বাংলা সিনেমার সত্তর ও আশির দশক দেখলেই সে সময়ের বিয়ের আনুষঙ্গিক বোঝা সহজ। ছেলেদের মাথায় ওই বিশেষ কায়দার পাগড়ি আর হাতে রুপালি ঝলমলে সেলোফেন ধরনের উপাদানে তৈরি রাখি। মেয়েদের হাতে দেখা যেত সোনালি রঙের রাখি। এই রাখি পরেই বর ও বধূকে চার দিন পার করতে হতো। এরপর ফুল-প্রদীপ দিয়ে কেউ কেউ বাড়িসংলগ্ন নদীতে ভাসিয়ে দিতেন। কেউ আবার সংরক্ষণও করতেন। যেন কারও হাতে না পড়ে, কোনো কিছুর ছোঁয়া না পায়, এতটাই সতর্কতা।
এই সোনালি আর রুপালি রাখি নানা রং পেল মূলত আকাশসংস্কৃতি প্রবেশের পর থেকে। আরেকটি বিষয় কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না, তা হলো ওয়েডিং ফটোগ্রাফি। বিয়ে শুধু প্রথা নয়, সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়ে যায় এই দুটো বিষয়ের সংযোজনে।
তবে হুট করে কালিরা এসে রাজত্ব করা শুরু করেনি এ দেশে। প্রথম দিকে সনাতন রাখির সঙ্গেই জুড়ে দেওয়া হতো নানা রকমের পুঁতি, ঝলমলে উপাদানে যুক্ত হতে শুরু করে লাল নীল বর্ণ। আর যে দুই ফিতা দিয়ে বাঁধন, তাতে জরি, মুক্তা ইত্যাদি উপাদান যুক্ত হতে থাকল।
হাতের ওপর ফুলের মতো ফুটে থাকা রাখি জনপ্রিয়তা হয়ে ওঠে একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই। এর কিছুদিন পর রাখি ডালপালা মেলতে শুরু করে! কালিরা এসে যুক্ত হয় বিয়ের সামগ্রীতে। রাখির নতুন রূপে। জুড়ে যায় বিয়ের ঐতিহ্যের গল্পে।
রাখির প্রচলন বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের নানা প্রদেশে আছে। এগুলোর মধ্যে গুজরাট আর পাঞ্জাব শীর্ষে। পাঞ্জাবে আবার সোহাগ চূড়াকে ঐতিহ্যগতভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এটিও সিনেমা বা টিভি সিরিয়ালের কল্যাণে বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এমনকি রাখি চুড়ি নাম দিয়ে রাখি ও কালিরার একটি মিশেল তৈরি করে ফেলেন কেউ কেউ। উপাদানে আমূল পরিবর্তন এনে। নানা রকমের পাথর, রংবেরঙের সুতার মিশেল, মুক্তার পাশাপাশি জুড়তে শুরু করে ড্রাই ফ্লাওয়ার, কাঠের বোতাম, চুমকিসহ নানা কিছু। মূলত নিজ নিজ বাজেটের মাঝেই সবচেয়ে সুন্দর রাখি তৈরিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন কনেরা।
ছেলেদের হাতের রাখিতে অন্যান্য উপাদান একইভাবে সংযুক্ত হলেও কালিরার বা ঝালর অংশটি থাকে না; বরং কবজির ওপর এঁটে বসা রাখিই যেন সব সময়কার স্মার্টনেস।
যুগ যা-ই বলুক, ঐতিহ্যও টিকিয়ে রাখা চাই। চাই সুন্দর স্মৃতিও। তাই রাখিটাও হওয়া চাই একদম অন পয়েন্ট। সে ক্ষেত্রে অনেকে ট্রেন্ডকে প্রাধান্য দেন। হালের আলোচিত আম্বানি পরিবারের বিয়েতে রাধিকা মার্চেন্টের হাতের রাখি নিয়ে তাই তো জল্পনাকল্পনার শেষ নেই। ফলাফল—বাংলাদেশের এবারের বিয়ের বাজারে রাধিকার রাখির কাটতি বেড়েছে দোকানে দোকানে; এমনকি অনলাইনেও।
সব মিলিয়ে ফ্যাশনে হোক বা ইতিহাসের পাতায়, ঐতিহ্যের হোক বা বিশ্বাসের অদৃশ্য খাতায়—রাখি এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
মডেল: তৌহিদা ও শাকিরা ইসরাত
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: সাফিয়া সাথী
জুয়েলারি:গ্লুড টুগেদার ও ধৃতি
ছবি: কৌশিক ইকবাল