ছুটিরঘণ্টা I শ্যামলিমা গোরোঙ্গোরো
গোরোঙ্গোরো ন্যাশনাল পার্ক। পূর্ব আফ্রিকান দেশ তানজানিয়ার এক অবিশ্বাস্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। অগুনতি পশুপাখির আবাস। ঘুরে এসে লিখেছেন ফাতিমা জাহান
জায়গাটির নাম কারাতু। তানজানিয়ায় এমন গভীর জঙ্গলে যে রিসোর্ট বানিয়েছে, তাকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। পাহাড়ের চূড়ায় হিম ঠান্ডায়, বনানীর মাঝে অবকাশযাপন করার আনন্দই আলাদা। রিসোর্টটি এতই বড়, বনের মাঝ দিয়ে হেঁটে পাহাড়ের দিকে যেতে দশ মিনিট লেগে যায়। আর পাহাড় সবুজ মখমলের চাদর যেন নিচের দিকে বিছিয়ে দিয়েছে।
আমি আর তিন ইউরোপীয় বন্ধু মারিয়া, ওরায়ানা ও ডিয়ানা জুটেছি আরুশা থেকে ন্যাশনাল পার্কে ঘুরব বলে। আজকের গন্তব্য গোরোঙ্গোরো ন্যাশনাল পার্ক। সকালের কফি শেষ হতে না হতেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হলো। পাহাড়ের ঢাল চলে যেতে থাকল মেঘের আড়ালে। পাহাড়ি এলাকার আবহাওয়ার মন বোঝা দায়! কখন যে কী ভেবে হেসে ওঠে, আবার মুখ ভার করে ফেলে, একমাত্র সে-ই জানে! বৃষ্টি নামতেই শীতও দিল হানা; অথচ সকালে আবহাওয়া আরামদায়ক ছিল।
আমার বন্ধুরা এসে গেছে। আমাদের রাঁধুনি জন একে একে বিভিন্ন ধরনের খাবার নাশতার টেবিলে পরিবেশন করলেন- ব্রেড, স্ক্রাম্বেলড এগ ইত্যাদি। তানজানিয়ান নাশতা আলুর চপ আর পাকন পিঠা বা মান্দাজিও ছিল এর সঙ্গে। সকালের নাশতায় আলুর চপ আমি এই প্রথম খেলাম। বাইরে বৃষ্টির ঝংকার বাড়ছে। জ্যাকেট চাপিয়ে খোলা ডাইনিং হলে নাশতা করার এমন আনন্দ আগে কখনো পাইনি। মাঝেমধ্যে বৃষ্টি এসে আমাদের অনেকখানি ভিজিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আমরা এতে একটুও মুখ ভার করছি না; বরং ভীষণ খুশি। কেননা ছুটি কাটানো তো একেই বলে!
সাফারি জিপের সামনের সিটে বসলাম আমি। বাকিরা পেছনে। আমাদের ড্রাইভার ও গাইডের নাম অ্যান্ড্রু। রিসোর্ট থেকে গোরোঙ্গোরো ন্যাশনাল পার্ক খুব বেশি দূর নয়। আধঘণ্টায় পৌঁছানো যাবে। কিন্তু এখান থেকে ন্যাশনাল পার্ক অবধি পথের দৃশ্য দেখে ইচ্ছা করছে, এই পথে খানিক দাঁড়াই, একটু কথা কই পথিকের সনে, গ্রামের বাজারে ঢুঁ মেরে নিয়ে আসি কিছু ফল বা সবজি। তাজা ফল, সবজি দেখলে আমার মাথা ঠিক থাকে না!
পথ চলতে চলতে কোথাও লম্বা সমান পাহাড়ের মতো ঢালু, আবার কোথাও ওপরে উঠে গেছে ধূসর রঙা পিচঢালা পথ দুপাশে শ্যামলিমা নিয়ে। চারদিকে সবুজ ঘাসের বিছানা, দূরে ঝিমাতে থাকা পাহাড় আর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি এ জনপদকে এক অন্য ভুবনের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে যেন।
গোরোঙ্গোরো ন্যাশনাল পার্কে প্রথমেই আমরা দেখতে যাব গোরোঙ্গোরো ক্রেটার। এটি একসময় ভলকানো বা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ ছিল। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আগ্নেয়গিরি নিভে গেছে। এ পরিবর্তন হতেও অনেক বছর লেগেছে। ক্রেটারে এখন বাস করে বিভিন্ন জাতের পশুপাখি।
গোরোঙ্গোরো ন্যাশনাল পার্ক তানজানিয়ার অন্য বনভূমিগুলোর চেয়ে বেশি সবুজ। পাহাড়ের বন্ধুর পথে ওঠানামা করতে করতে ঠান্ডার কথা ভুলেই গেলাম। চারদিকে সবুজের নানা রং আর লাল মাটির পথের ভাঁজে ভাঁজে মখমলের পাহাড়। পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ এখানে-ওখানে জমে আছে। মেঘের বাড়িঘর এখন মাটিতে নেমে এসেছে। অবশ্য মেঘ এখন বনভোজনে ব্যস্ত! দুপুরে সূর্য এসে হানা দিলে কোথায় চলে যাবে, হদিশ মিলবে না।
জিপের ছাদ খুলতে খুলতে অ্যান্ড্রু বললেন, ‘প্রথমে আমরা গোরোঙ্গোরো ক্রেটারে যাব।’ এ ক্রেটারের নাম অনুসারে ন্যাশনাল পার্কের নামকরণ। স্থানীয় মাসাই ভাষায় গোরোঙ্গোরো মানে একধরনের শব্দ। চারণভূমিতে গরু ছেড়ে দেওয়ার আগে এরা গরুর গলায় ঘণ্টা বেঁধে দিত, যেন দিন শেষে খুঁজে পাওয়া যায়। গরু হাঁটলে একধরনের শব্দ হয়Ñ গোরর…গোরর…। এই শব্দ থেকেই নাম হয়েছে গোরোঙ্গোরো।
ক্রেটারে গিয়ে জিপ থামাতেই অন্যরা ক্রেটার দেখার জন্য চলে গেল। আমার মনোযোগ তখন বুনোফুলে। ঝোপঝাড় নানা রঙের বুনোফুলে ভরে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে, পাহাড়ের গায়ে কেউ ইচ্ছা করেই অজস্র ফুল ছিটিয়ে দিয়েছে।
আরেক পাশে ক্রেটার ঢেকে গেছে মেঘে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে মেঘ জমেছে; বসে আছে যেন কারও অপেক্ষায়! টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। আমার পায়ের নিচে ফুলে ভরা বনভূমি আর তার নিচে মেঘের জমাট বাঁধা অভিমান ও অপেক্ষা; যেন এক্ষুনি ফুল ঝরিয়ে বনভূমি কেঁদে উঠবে এই মেঘমেদুর বরষায়।
আশপাশে অনেক জিপের ভিড়; কিন্তু কেউই এখন মেঘের কারণে ক্রেটার দেখতে পেল না। চারদিকে শুধু উড়ে যাওয়া মেঘ; ইচ্ছা করলেই ছোঁয়া যায়, জড়িয়ে ধরা যায়। অ্যান্ড্রু বললেন, ‘ফেরার পথে মেঘ না থাকলে তোমাদের ঘুরিয়ে নিয়ে আসব।’
আমরা গোরোঙ্গোরো ন্যাশনাল পার্কের ভেতরের সফর শুরু করলাম। সাফারি শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে আরবি সফর শব্দ থেকে। আফ্রিকায় আসার পর বেশ কয়েকটি ন্যাশনাল পার্কে সাফারি বা গেইম ড্রাইভ করেছি; কিন্তু গোরোঙ্গোরো ন্যাশনাল পার্কের মতো এত সুন্দর পার্ক কোনোটিকেই মনে হয়নি। এ ন্যাশনাল পার্কে সমতলভূমি যেমন আছে, তেমনি আছে পাহাড়ি বৈচিত্র্য। ন্যাশনাল পার্কের ভেতরে, মানে পশুপাখির অভয়ারণ্যে জিপ থেকে নামা সম্পূর্ণ নিষেধ। সারা দিন জিপে করেই ঘুরে বেড়াতে হবে।
অ্যান্ড্রু আজ পশুপাখি না দেখালেও অসুবিধে নেই। প্রকৃতির রূপ দেখতে দেখতেই দিন পার করে দেওয়া যাবে। তবে সামনেই ঝাঁকে ঝাঁকে জেব্রা দেখে সোজা হয়ে বসলাম। এদের সঙ্গে ওয়াইল্ড বিস্ট বা গরুর মতো প্রাণী ঘুরছে। এই প্রাণীগুলো সব সময় একসঙ্গে চলাফেরা করে।
আরও খানিকটা এগোনোর পর অঢেল সৌন্দর্য নিয়ে বিচরণ করছে গ্যাজেলÑ একধরনের হরিণ, যাদের গায়ে দাগ নেই। সবুজের মাঝে সোনালি হয়ে জ্বলজ্বল করছে। অ্যান্ড্রু গাড়ি থামিয়েছেন বেশ কিছুক্ষণ আগে, কিন্তু এখান থেকে নড়ার নাম নেই। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমরা কি এখন যেতে পারি?’ অ্যান্ড্রুর জবাব, ‘অপেক্ষা করো, কাছাকাছি একটা সিংহ আছে।’ কিন্তু আমি তো দেখতে পাচ্ছি না! অ্যান্ড্রু দেখালেন, অনেক দূরে একটা হলুদ বিন্দু। আমাদের পেছনে এখন আরও কয়েকটি জিপ দাঁড়িয়ে। পশু যেমন শিকারের গন্ধে এর আশপাশে ঘোরে, তেমনি সাফারি পার্কের দর্শনার্থীরা শিকারি পশুর যতটা সম্ভবত কাছাকাছি চলে যান। কারণ, অভয়ারণ্যে পশু দেখতে পাওয়া যেমন অনন্য অভিজ্ঞতা, তেমনি এক পশুর অন্য পশু শিকার করাও ঝুলিতে ভরে নিজের দেশে নিয়ে যাওয়ার মতো দামি স্মৃতি।
সিংহ শিকারে নামে না; নামে সিংহী। দূর থেকে সে এখন টার্গেট করেছে গ্যাজেলগুলোকে। আরেকটু কাছে আসার পর দেখলাম, এখানে আসলে দুটি সিংহী। হঠাৎ তাদের চলার গতি বেড়ে গেল। আমরা রুদ্ধশ্বাসে দেখছি, কী হয়! সিংহী কি পারবে একটা গ্যাজেল ধরতে? সিংহীর গতি গ্যাজেল টের পেয়ে গেছে। মিছিলে টিয়ারগ্যাস পড়লে যেমন সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, তেমনি গ্যাজেলের দল ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। সিংহীরা কোনোভাবেই ওদের নাগালে আনতে পারল না।
এবার একটা সিংহী মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিছুতেই হাল ছাড়বে না। দিগি¦দিক জ্ঞান হারিয়ে সে এখন চারণভূমি ছেড়ে জিপ চলার পথে উঠে এসেছে। পেছন থেকে আসতে আসতে একদম আমার জানালার পাশ দিয়ে একটা চক্কর দিল। তারপর হাঁটতে থাকল জিপ চলার পথ ধরে। অ্যান্ড্রুও কম যান না। জিপের ইঞ্জিন চালু করে ঘরঘর আওয়াজ তুলে সিংহীর পেছন পেছন চললেন। আমরা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় জিপের সিটে দাঁড়িয়ে ছাদ থেকে মুখ বাড়িয়ে রেখেছি। সিংহীর মেজাজ এখন খুবই খারাপ। পরিবারের সবার মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার জন্য পথে পথে, বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। সে খাবার নিয়ে না গেলে সবাই অভুক্ত থাকবে আজ। পরিবারের একমাত্র অন্নদাতা সে; সিংহ তো শুধু বসে বসে খায় আর বড় বড় হাই তোলে সারা দিন!
সিংহী চিন্তাযুক্ত মনে চারণভূমির দিকে চলে গেল। আমরা জিপ থামিয়ে দেখলাম, প্রাণীটি দূরে একদল গ্যাজেলের দিকে ক্ষিপ্র গতিতে লাফিয়ে পড়ল। অবশেষে টানাহেঁচড়া করে একটা গ্যাজেলের টুঁটি চেপে ধরতে পারল সে। অন্য গ্যাজেলগুলো পালাতে পারলেও এই বেচারার ভাগ্যে তা নেই। প্রাণ বাঁচানোর জন্য খুব ধস্তাধস্তি করেও শেষরক্ষা হলো না গ্যাজেলটির। সিংহী কীভাবে গ্যাজেলকে আরও ছিন্নভিন্ন করল, তা আর দেখা গেল না উঁচু উঁচু ঘাসের জন্য। আরেকটু এগোতেই বড় বড় ঘাসের মাঝে কী যেন নড়েচড়ে ওঠল। অ্যান্ড্রু জিপ থামাতেই দেখি, সিংহ শুয়ে শুয়ে বড় বড় হাই তুলছে। কোনো ন্যাশনাল পার্কেই আমি সিংহকে কখনো হাঁটাচলা করতে দেখিনি; শুধু শুয়ে-বসে থাকতে দেখেছি।
আমরা আরও খানিকটা এগিয়ে অন্যান্য পশুপাখি দেখতে থাকলাম। মাঝে দুটো উটপাখির সঙ্গে দেখা হলো। সামনের ঘন পাহাড় আর তার ওপর কোমল সবুজ গাছপালা। আরও এগিয়ে বিশাল আরামদায়ক হরিৎ সমতলভূমি। সেখানে চড়ে বেড়াচ্ছে শত শত জেব্রা আর ওয়াইল্ড বিস্ট। আমি কখনো এত পশু একসঙ্গে চড়ে বেড়াতে দেখিনি। যত দূর চোখ যায়, শুধুই সাদাকালো জেব্রা আর ধূসর বিন্দুসম ওয়াইল্ড বিস্ট। আমরা অনেকক্ষণ ধরে এই বিশাল বহর দেখতে থাকলাম। খানিক চলতেই হাতি পরিবারের সঙ্গে দেখা হলো। এরা নিয়ম মেনে একসঙ্গে চলাফেরা করছে। এদের দলপতি মা হাতি হাঁটছে সবার সামনে।
এরপরের গন্তব্য কী- অ্যান্ড্রু কিছুই বললেন না। একটা জলাশয়ের সামনে এনে দাঁড় করালেন জিপ। দিগন্ত বিস্তৃত নীল জলের বুকে সেখানে সাদা আর গোলাপি মুক্তা ফুটে উঠেছে। লেকের জলে ডানা ঝাপটিয়ে স্নানে মগ্ন হাজারো ফ্লেমিঙ্গো। বকের মতো লম্বা গলা আর গোলাপি লম্বা পা। কমলা রঙের পাখার ঝাপটা দিচ্ছে লেকের জলে। এরা এখন মনের আনন্দে কিচিরমিচির করছে। আমরাও নিজেদের মাঝে কিচিরমিচির করছি। আমি ফ্লেমিঙ্গোদের কখনো জলের বাইরে দেখিনি, আবার জলে সাঁতার কাটতে কিংবা গভীর জলে যেতে দেখিনি; এমনকি কখনো উড়তেও দেখিনি। মজার ব্যাপার হলো, এখন এরা ঠিকই দু পায়ে ভর দিয়ে জলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এই পাখি ঘুমায় এক পায়ে। আশ্চর্যজনকভাবে এক পায়ে ব্যালেন্স করে জলে দাঁড়িয়ে মাথা ঘাড়ের ভেতরে গুঁজে এরা নিশ্চিন্তে ঘুমায়। বকও একইভাবে ঘুমায়, তবে স্থলে। এই তথ্যগুলো আমার বন্ধুরা জানত না। জিপের ভেতরেই ডিয়ানা আর ওরায়ানা এক পায়ে ঘুমাবার প্র্যাকটিস করতে লাগল আর হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল জিপের ইঞ্জিন চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে।
ফ্লেমিঙ্গো দলের সঙ্গে কিছু পেলিক্যান দাঁড়িয়ে আছে। এরা ফ্লেমিঙ্গোর চেয়ে আকারে বড়। ধবধবে সাদা এই পাখি গলা ফুলিয়ে ঢোল করে রাখতে জানে। গলায় খাবার বা জল জমিয়ে রাখে না। এমনিই কিছু বাতাস জমায়, আবার ছেড়ে দেয়। এরা যেমন সাঁতার কাটে, তেমনি ডাইভ দেয়; আকাশে উড়তেও পারে।
আমরা পথে একা গম্ভীর দলহীন কয়েকটি পুরুষ গ্যাজেল দেখতে দেখতে আরেকটি গভীর জলাশয়ের সামনে এসে থামলাম। অ্যান্ড্রু বললেন, ‘দেখো, জলহস্তী।’ এতক্ষণ অনেক হস্তী দেখেছি, কিন্তু জলহস্তী কোথায়? সামনে জলের মাঝে ছোট ছোট দ্বীপের মতো অনেকগুলো ধূসর চর জেগে আছে। আসলে সেগুলো জলহস্তীর পিঠ। পাশাপাশি পুরো শরীর ডুবিয়ে শুধু পিঠ উঁচিয়ে আছে বলে বোঝাই যাচ্ছে না, এরা যে জীবন্ত প্রাণী। ভালোমতো খেয়াল করে দেখলাম, এই জলাশয়ে কম করে হলেও পঞ্চাশটার মতো জলহস্তী জলে ডুবে আছে। সাধারণত দিনের বেলায় এরা ডাঙ্গায় আসে না, জলের মাঝেই থাকে। কারণ, এদের দেহে ঘর্মগ্রন্থি নেই। এ কারণে ত্বক সূর্যের স্পর্শ পেলেই ফেটে যায়। তাই এরা জলেই থাকে। এই বিশালদেহী প্রাণী নাকি তৃণভোজী! আরও মজার ব্যাপার হলো, পানিতে ভেসে ভেসেই ঘুমাতে পারে। নাকটা জলের ওপর রেখে বাকি শরীর জলে ডুবিয়ে এরা নিদ্রায় ডুবে যেতে পারে। আর আমরা এতক্ষণ ধরে এদের দেখছি, অথচ একটুও নড়েচড়ে উঠছে না। কী অলস প্রাণী রে বাবা!
জলহস্তী দেখে অ্যান্ড্রু চললেন জলাশয়ের কিনারা ধরে আরও সামনে। কিছুদূর যেতেই দেখি একপাল হাতি হাঁটুজলে নেমে জল ছিটাচ্ছে একে অন্যকে। আমি আফ্রিকার বেশ কয়েকটি ন্যাশনাল পার্কে অসংখ্য হাতি দেখেছি। কেনিয়ায় তো একসঙ্গে দুই শর বেশি দেখেছি; কিন্তু হাতির জলকেলি আগে কখনো চোখে পড়েনি। জিপের পেছনের সিটে বসা আমার বন্ধুরাও ভীষণ আনন্দিত। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাতির জল খেলা দেখছি। আজ যা কিছু দেখেছি, তার মাঝে হাতিদের এই খেলা আমার কাছে সেরা মনে হলো। মাঝেমধ্যে নিজের খুশিমতো জলে ভিড় করা কচুরিপানা শুঁড় দিয়ে তুলে মুখে পুরছে। আমরাও যেন শিশু হয়ে গেলাম। স্কুলের পিকনিকের মতো চিৎকার, হইচই করে অ্যান্ড্রুকে খুব জ্বালাতন করলাম। অ্যান্ড্রু বোধ হয় অভ্যস্ত এসবে, তাই হেসে প্রশ্রয় দিলেন।
হাতিগুলো একে একে সারিবদ্ধভাবে জল থেকে বেরিয়ে এলে আমরা চললাম পিকনিক স্পটে, দুপুরের খাবার খেতে। পথে কয়েকজন জংলি রেসলারের দেখা পেলাম, এ তল্লাটে তাদেরকে ওয়াটার বাফেলো নামে ডাকা হয়। মহিষের শিং দেখলেই বোঝা যায়, এরা মোটেই সিংহের শিকার হওয়ার জন্য জন্মায়নি। তবে কখনো কখনো শিকার হতেও হয়।
এ বনাঞ্চলে সেক্রেটারি, গিনিফাউল, ক্রাউন ক্রেইন, ইজিপশিয়ান ডাক ইত্যাদির অভাব নেই। পথে এদের দেখতে দেখতে, অনতিদূরের পিকনিক স্পটে এসে পৌঁছলাম। এক জায়গায় সারি সারি সাফারি জিপ পার্ক করা। সেখানে নেমে আরেকটু সামনে পাহাড়ের কাছে দৌড়ে গেলাম। উঁচু উঁচু ঘাস-গুল্ম আর তার পরে পাহাড়, পাহাড়ের মাথায় কুণ্ডলী পাকিয়ে মেঘ ঘন হয়ে আসছে। মেঘের চেয়ে বড় চিত্রশিল্পী বোধ করি প্রকৃতিতে আর নেই! এই মেঘই যেন কল্পনার সবকিছু আকাশের মনের কথা হয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারে।
আমরা পাহাড়ের দিকে হাঁটা দিচ্ছিলাম। সবাই না; আমি আর ডিয়ানা। দেখে অ্যান্ড্রু তাড়া দিলেন। তার হাতে বিশাল এক ব্যাগ, হটপট ইত্যাদি। আমরা সবাই কিছু না কিছু হাতে নিয়ে জলাশয়ের দিকে চললাম। এদিকে খোলা আকাশের নিচে উঁচু উঁচু ঘাসের মাঝে বেশ কয়েকটি কাঠের টেবিল আর বেঞ্চ পাতা। আমরা একটার দখল পেলাম। অ্যান্ড্রু ঝটপট মাসাই কাপড়ের চাদর বিছিয়ে ফেললেন। তখনই তিনজন ইউরোপীয় ছেলে-মেয়ে এসে আমাদের সঙ্গে একই টেবিলে বসতে চাইল। কারণ, আর কোনো টেবিল খালি ছিল না। সামনে জিপের সারি, আরেক পাশে মানুষের সারি দেখে অনুমান করা যায়, কত ট্যুরিস্ট এই অনন্যসাধারণ জায়গায় দুপুরের খাবার খেতে এসেছেন; বেশির ভাগই ইউরোপীয়।
অ্যান্ড্রু এক এক করে খাবার পরিবেশন করলেন। জন অত ভোরে উঠে কত কী যে রান্না করে পাঠিয়ে দিয়েছেনÑ ফ্রায়েড রাইস, চিকেন কারি, ভেজিটেবল, স্যালাদ, ফল ইত্যাদি। রিসোর্টে ফিরে ওকে ধন্যবাদ জানাতে হবে। প্রতিটি খাবার খেতে এত ভালো হয়েছে যে নিমেষে প্লেট, বাটি খালি হয়ে গেল। আমাদের সঙ্গে বসা ইউরোপীয় ছেলেমেয়েদেরও খানিক দেওয়া হলো।
আমরা যতক্ষণ খাচ্ছিলাম, ততক্ষণ আশপাশে অনেকগুলো গিনিফাউল ঘুরে বেড়াল। এরা দেখতে ময়ূরের মতো, তবে লেজ নেই। এদেরকে খাবার দেওয়া নিষেধ। যেকোনো বন্য প্রাণীকেই খাবার দেওয়া নিষেধ। গিনিফাউলের সঙ্গে ম্যারাবু পাখিও ছিল। ম্যারাবুরা এত বড় যে কোনো কোনোটি উচ্চতায় আমার সমান।
মাথার ওপর গাঢ় নীল আকাশ; আকাশে গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘের ফুল। সামনে মখমলি পাহাড় আর পা ডুবে যাচ্ছে নরম ঘাসে। বন্ধুদের সঙ্গে দুপুরের খাবার খেতে খেতে, নানা গল্প করতে করতে এত অভাবনীয় প্রাকৃতিক দৃশ্য আমি কখনো উপভোগ করিনি। কেননা, সব সময় একা ভ্রমণেই অভ্যস্ত আমি। ভাগ্যিস, টাকাপয়সা কম ছিল বলে দল বেঁধে সাফারিতে বেরিয়েছি! আর এরাও কথায় কথায় আমায় অভিভূত করছে।
আমরা খেয়ে, টেবিল গুছিয়ে একটু সময় পেলাম এই জলাশয় ধরে ঘুরে বেড়ানোর। মানুষের জন্য উন্মুক্ত উদ্যানে কিছুক্ষণ ঘুরে আবার চললাম বাকি সময়টুকু কাজে লাগাতে। এ জঙ্গলে লেপার্ড আছে, কিন্তু খুব কম মানুষ এদের দেখা পায়। এরা গাছে চড়ে বসে থাকে; সহজে দূর থেকে চেনাই যায় না। আমি তো গাছে পাতা থাকলে অন্য কিছুই দেখতে পাই না। বড় বড় জিরাফও আমার চোখ থেকে বাদ পড়ে যায়, আর লেপার্ড দেখা আমাকে দিয়ে হবে বলে মনে হয় না। জঙ্গলের পশুপাখি খুঁজে বের করার দায়িত্ব তাই বন্ধুদের ওপরই ছেড়ে দিলাম।
জিরাফের কথা ভাবতে ভাবতে একটা জিরাফ সামনে চলে এলো। সে এক গাছের নিচ থেকে অন্য গাছের নিচে হাঁটছিল। তার পেছনে আরেকটিকে দেখা গেল। এত লম্বা হয়েও কীভাবে যেন নিজেকে গাছের পেছনে লুকিয়ে ফেলার কৌশল জানে এরা। আমার প্রথম থেকেই আফ্রিকার জঙ্গলের প্রাণীদের মধ্যে জিরাফ সবচেয়ে ভালো লেগেছে। কী সুন্দর দেখতে, আর শান্ত! এই জিরাফগুলো যখন দূরের সারি সারি অ্যাকাশিয়া গাছ, তার পেছনের ধোঁয়াটে পাহাড় আর তারও পরে আকাশের মেঘ দেখতে ব্যস্ত, তখন গলাসমান ঘাস আর কাঁটা ঝোপঝাড় থেকে একটি বাচ্চা জিরাফ উঁকি দিল। আমি পারলে জিপ থেকে লাফ দিয়ে নেমে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বাড়ি চলে যাই!
ন্যাশনাল পার্ক বন্ধ না হওয়া অবধি এখান থেকে নড়ছি না আমরা! ঘুরে ঘুরে কিছু গ্যাজেল আর পাখি দেখলাম। কোথা থেকে কোথায় যে জিপ ঘুরিয়ে অ্যান্ড্রু নিয়ে যান, আমাদের জানা নেই। একটা সমতলভূমি আর তার পেছনে পাহাড় দেখিয়ে থামলেন তিনি। সামনে কিছুই নেই। আমরা চারপাশ তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছু পেলাম না। অ্যান্ড্রু আমাদের হাতে বাইনোকুলার দিয়ে বললেন, ‘এখন দেখ, দূরে গন্ডার দেখা যাচ্ছে।’ আমরা একে একে দেখলাম। আমি ক্যামেরা জুম করেও অত দূরের গন্ডারের ছবি কিছুতেই ভালোভাবে তুলে রাখতে পারলাম না। বাইনোকুলার দিয়ে দেখে শুধু মনের সাধ মেটালাম। জিপ চলার পথের বহু দূরে চড়ে বেড়ায় গন্ডার। জিপের শব্দ এরা পছন্দ করে না। এখানে এখন মা, বাবা আর বাচ্চা গন্ডার মুখ নিচু করে ঘাস খাচ্ছে। ঘাসে তাদের শরীরের অনেকখানি ঢাকা। ন্যাশনাল পার্কে যত পশুশাবক দেখেছি, প্রতিটিই মা-বাবার খুব বাধ্যগত। মা যেদিকে যায়, বাচ্চাও সেদিকে। বাচ্চারা একদম জেদ করে না। এই বিশাল অরণ্যে তাদের জগৎ শুধু মায়ের সঙ্গে বাঁধা।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেই ফিরে যেতে চাইলেন অ্যান্ড্রু। আমি মনে করিয়ে দিলাম, একবার ক্রেটারের ওদিকটায় যেতে চাই; কারণ, সকালে শুধু মেঘের বন্দর দেখেছি সেখানে, গভীরে দৃষ্টির নোঙর ফেলতে পারিনি। অ্যান্ডু রাজি হচ্ছিলেন না; কিন্তু আমরা এত কিচিরমিচির শুরু করলাম, বাধ্য হলেন! জিপ উল্টো দিকে ঘুরিয়ে চললেন ক্রেটারের দিকে। ক্রেটার এমনিতেই চারপাশ থেকে গোল করে উঁচু উঁচু পাহাড় দিয়ে ঘেরা। যখন আগ্নেয়গিরি শান্ত হয়ে গিয়েছিল, তখন ভেতরে একটি ঢালু সবুজ সমতলভূমির জায়গা রেখে গেছে; সেটাই এখন ক্রেটার। ক্রেটারের সামনে এখন জিপের বহর। আমরা গিয়ে দেখি, মেঘ উড়িয়ে দিয়ে কচি পাতা রঙের ক্রেটার পাহাড়ের পায়ের কাছে বসে হাসছে! এই ক্রেটারে আমরা ঘুরে বেড়িয়েছি, পশুপাখি দেখেছি। পাহাড়ের ওপর থেকে সরু জলাশয়কেও দেখা যাচ্ছে। বিশাল এই ক্রেটারে যেমন বনভূমি আছে, তৃণভূমি আছে, তেমনি জলাশয়ও। হাজার হাজার পশুপাখি বুকে ধারণ করে রাখে এই ক্রেটার।
ওদিকে অ্যান্ড্রু ফিরে যাওয়ার তাড়া দিচ্ছেন। আমরা ক্রেটার থেকে মুখ ঘুরিয়ে জিপে গিয়ে বসলাম। এদিকে আঁধার ঘনিয়ে আসছে। ঠান্ডাও পড়েছে জাঁকিয়ে।
রাতের খাবার শেষ করে আমরা আড্ডা দিচ্ছি। ডাইনিং টেবিল ছেড়ে রিসোর্টের অন্য অতিথিরাও চলে যাননি। হঠাৎ ড্রাম বাজার শব্দে ঘুরে তাকালাম। ইতিমধ্যে বাদ্যযন্ত্র সাজিয়ে একদল ছেলেমেয়ে ঘুরে ঘুরে গাইছে ‘হাকুনা মাটাটা’, আর তালে তালে নাচছে। এরপর শুরু হলো ছেলেমেয়েদের অ্যাক্রোব্যাট। আগুনের চক্রের মাঝ দিয়ে ঝাঁপ, ছয় ইঞ্চি সমান্তরাল ফোকর দিয়ে গলে বেরিয়ে যাওয়া, হিউম্যান ট্রি…আরও কত যে কসরত দেখাল।
এরা থাকে পাশের গ্রামে। মাঝেমধ্যে কয়েকটি রিসোর্টে নেচে-গেয়ে, খেলা দেখিয়ে পয়সা কামায়। রিসোর্ট থেকে কিছু পায়, আর কিছু টিপস আশা করে অতিথিদের কাছ থেকে। সবশেষে সোয়াহিলি গানের সঙ্গে প্রায় সব অতিথিকে নাচিয়ে ছাড়ল।
আমরাও ভীষণ খুশি এমন আশাতীত মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের জন্য। নাচে-গানে মুখর করে তুলতে, নতুন বছরের নতুন সন্ধ্যাকে রঙিন করে তুলতে, রঙিন মনের আফ্রিকানদের জুড়ি নেই।
ছবি: লেখক