টেকসহি I মৃত্তিকা মর্ম
বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে মাটির ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই এর সংরক্ষণ জরুরি। বিশ্বব্যাপী মাটির গুরুত্ব বাড়াতে এবং জীবন ও খাদ্যব্যবস্থায় এর অপরিহার্যতা নিশ্চিত করতে প্রতিবছরের ৫ ডিসেম্বর পালন করা হয় বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস
২০১৪ সাল থেকে সাড়ম্বরে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস পালন করা হলেও ধারণাটি বেশ আগের। এর প্রথম প্রস্তাব করেন থাইল্যান্ডের প্রয়াত রাজা ভূমিবল আদুলিয়াদেজ (১৯২৭-২০১৬)। মৃত্তিকার গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে তিনিই সাধারণ মানুষের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছিলেন উদ্দীপনা। মৃত্তিকা সংরক্ষণে রেখে গেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। চালিয়েছেন বিশ্বব্যাপী প্রচারও। পরবর্তীকালে, ২০০২ সালে, আন্তর্জাতিক মৃত্তিকাবিজ্ঞান ইউনিয়ন (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব সয়েল সায়েন্স- আইইউএসএস) ৫ ডিসেম্বরকে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব রাখে। কারণ, দিনটি রাজা ভূমিবলের জন্মদিন। ২০১৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ দিবসটিকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়।
প্রতিবছর বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের প্রতিপাদ্য থাকে, যা মাটির বিভিন্ন দিকের গুরুত্ব তুলে ধরে। এবারের বিষয় ‘মাটির প্রতি যত্ন: পরিমাপ, পর্যবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা’ (কেয়ারিং ফর সয়েল: মেজার, মনিটর, ম্যানেজ)। মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা এবং টেকসই ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব প্রচার করার পাশাপাশি এর দূষণ, ক্ষয় ও অবক্ষয় রোধে সচেতনতা বাড়ানো চলতি বছর দিবসটি পালনের অন্যতম উদ্দেশ্য।
মূলত ভূপৃষ্ঠের ওপরের নরম আবরণই মাটি হিসেবে পরিচিত। এটি প্রকৃতির অতি তাৎপর্যপূর্ণ উপাদান। তাই মাটির উৎকর্ষ বা গুণগত মান ঠিক রাখা গুরুত্বপূর্ণ। উপাদান ঠিক না থাকলে গুণগত মানও ঠিক থাকে না। বাংলাদেশের মোট মাটির ৮০ শতাংশ গঠিত হয়েছে বিভিন্ন নদীবাহিত পলির মাধ্যমে। অবশিষ্ট ২০ শতাংশ গঠনে ভূমিকা রেখেছে টারশিয়ারি পাহাড়সমূহের (১২ শতাংশ) এবং কোয়াটারনারি যুগের প্লাইসটোসিন সোপানসমূহের (৮ শতাংশ) পলল।
মাটি একটি মিশ্র পদার্থ। খনিজ পদার্থ, জৈব পদার্থ, বায়ু ও পানির মাধ্যমে গড়া। প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় শিলাপাথর ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে সৃষ্টি হয় মাটি। গাছপালার বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ২০টি মৌলিক উপাদানের মধ্যে ১৭টিই মাটি সরবরাহ করে। মাটি থেকে প্রাপ্ত উপাদানের মধ্যে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, সালফার, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, মলিবডেনাম, কপার, বোরন, জিঙ্ক, ক্লোরিন, সোডিয়াম, কোবাল্ট, ভ্যানাডিয়াম ও সিলিকন অন্যতম।
মাটি প্রধানত ৪ ধরনেরÑ বালু, সিল্ট (পলি), কাদা (এঁটেল মাটি) ও দোআঁশ। বালুমাটির কণার ব্যাস শূন্য দশমিক শূন্য ২ থেকে ২ মিলিমিটার। এ ধরনের মাটিতে ৭০ শতাংশের বেশি বালুযুক্ত মাটি থাকে। অপরদিকে পলি মাটি কণার ব্যাস শূন্য দশমিক শূন্য ২ থেকে শূন্য দশমিক শূন্য ২ মিলিমিটার; তাতে ৮০ শতাংশের বেশি পলিযুক্ত মাটি থাকে। আবার কাদামাটি বা এঁটেল মাটি মাটির কণার ব্যাস শূন্য দশমিক শূন্য শূন্য ২ মিলিমিটারের কম। ৮০ শতাংশের বেশি কাদা কণা ধারণকারী মাটিই কাদামাটি বা এঁটেল মাটি। দোআঁশ মাটি সাধারণত বালু, পলি ও কাদামাটির মধ্যবর্তী মিশ্রণ। এ ধরনের মাটি ফসল ফলানোর জন্য সবচেয়ে অনুকূল।
এই সাধারণ ৪ শ্রেণি ছাড়াও মাটির আরও বারোটি ভাগ রয়েছে- দোআঁশ-বালু, বেলে দোআঁশ, দোআঁশ, এঁটেল, পলি দোআঁশ, বেলে এঁটেল দোআঁশ, এঁটেল দোআঁশ, পলি এঁটেল দোআঁশ, বেলে এঁটেল, পলি এঁটেল ও এঁটেল। তবে বাংলাদেশকে যেহেতু সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বলা হয়, স্বাভাবিকভাবে এখানকার মাটিতেও সেই ছোঁয়া রয়েছে। বাংলাদেশের মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০০ মৃত্তিকা শ্রেণিক্রম চিহ্নিত করেছে।
সাধারণত পরিকল্পিত উপায়ে সংরক্ষণ করতে না পারলে সেই মাটি থেকে সুফল মেলে না। আর মাটি যেহেতু সমগ্র প্রাণিকুলের আবাসস্থল, তাই এর সংরক্ষণ অত্যাবশ্যক। দুঃখের বিষয়, মাটির ক্ষয় আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে, আর তার ভুক্তভোগী জীবকুল। কেতাবি ভাষায় ক্ষয় বলতে মাটির গুণমানে ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক পতনকে বোঝায়। প্রাকৃতিকভাবে স্বাভাবিক বা ভূতাত্ত্বিক মাটির ক্ষয় এবং ত্বরান্বিত মাটি বা ভূমি ক্ষয়- এই দুইভাবে মাটির ক্ষয় হয়ে থাকে। তবে কেবল প্রাকৃতিক কারণ; অর্থাৎ শিলা-খনিজের চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়াতেই নয়, মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হওয়াও মাটির ক্ষয়ের মধ্যে পড়ে। এ ছাড়া মানুষের নানাবিধ কার্যক্রমেও ব্যাপকভাবে মাটির ক্ষয় ঘটে।
আমাদের খাদ্য উৎপাদন, জীবনাচরণ ও বেঁচে থাকা কোনো না কোনোভাবে মাটির ওপর নির্ভরশীল। তাই মাটি দূষিত হলে তা মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃত্তিকার অপসারণে মাটি নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি আবাসস্থলও ধ্বংস হচ্ছে। উৎকর্ষ বাড়ানোর জন্য মাটিদূষণ নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষয়রোধ করে মাটি সংরক্ষণ করা দরকার। এতে খাদ্য উৎপাদনের ভারসাম্য থাকার পাশাপাশি মানুষ স্বাস্থ্যগত সুফলও পাবে।
মাটির ক্ষয়রোধে খেয়াল রাখা চাই অনেক কিছু। সংরক্ষণের সবচেয়ে কার্যকর ও সহজ কৌশল হলো বেশি করে গাছ লাগানো। মাটিতে তৃণগুল্ম ও দূর্বা কিংবা অন্য যেকোনো ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ এবং অন্যান্য গাছপালা থাকলে ভারী বৃষ্টিপাতও তেমন ক্ষয়সাধন করতে পারে না। গাছের শিকড় মাটির ভেতরে থাকায় সেটি মাটিকে দৃঢ়ভাবে আটকে রাখে এবং সরে যেতে দেয় না। মাটির উপরিভাগে সাধারণত ৭ থেকে ৮ ইঞ্চি গভীরতা পর্যন্ত ফসলের পুষ্টি উপাদান থাকে। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, পানিপ্রবাহ, বাতাসের গতিবেগ ইত্যাদি কারণে উপরিভাগের মাটি স্থানান্তরিত হওয়ার দরুন সঞ্চিত পুষ্টি উপাদান বিনষ্ট হয়ে উর্বরতা কমে। তাই বৃষ্টি ও বন্যার পানি গড়ানোর সময় যেন জমির উপরিভাগের মাটি অপসারিত কিংবা নালা ও খাদের সৃষ্টি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা চাই।
বীজের পর মাটি হচ্ছে কৃষির অন্যতম ভিত্তি। উপযুক্ত অর্থাৎ ফসলের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান সমৃদ্ধ মাটি না হলে কাক্সিক্ষত ফসল পাওয়া কেবলই দুরাশা। বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় আবাদি জমির পরিমাণ খুব কম। তাই এ জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে অধিক ফসল আবাদের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা ভীষণ প্রয়োজন।
একই জমিতে একাধিক ফসল চাষেও নজর দেওয়া জরুরি। জমিতে প্রতিবছর একই বা একই ধরনের ফসলের চাষ করলে একটি নির্দিষ্ট স্তরের নির্দিষ্ট পুষ্টি, উপাদান নিঃশোষিত হয়ে উর্বরতা বিনষ্ট হয়। তাই পর্যায়ক্রমে গুচ্ছমূলজাতীয় ফসলের পর প্রধান মূলজাতীয়, একবীজপত্রীর পর দ্বিবীজপত্রী এবং অধিক খাদ্য গ্রহণকারীর পর অল্প খাদ্য গ্রহণকারী ফসল আবাদ করা শ্রেয়। মাটি, প্রকৃতি ও ভৌগোলিক অবস্থানভেদে উপযুক্ত শস্যবিন্যাস অনুসরণ করা চাই। তা ছাড়া ফসল পুষ্টির জন্য মাটি থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান গ্রহণ করে বলে বিভিন্ন আবাদের দরুন মাটির উর্বরতা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। বিভিন্ন ফসল মাটি থেকে বিভিন্ন পরিমাণে পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে। তাই ঘাটতি পূরণের জন্য জমিতে জৈব ও রাসায়নিক সারের সমন্বয়ে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করা বাঞ্ছনীয়।
মাটিতে ৩ থেকে ৫ শতাংশ জৈব পদার্থ থাকা প্রয়োজন। অথচ বাংলাদেশে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। এখন অধিকাংশ স্থানে ১ শতাংশের কিছু বেশি মেলে। জৈব পদার্থের পরিমাণ শূন্য দশমিক ৮ শতাংশের নিচে চলে গেলে সে মাটি আর ফসল উৎপাদনের উপযোগী থাকে না। তাই জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়ানো চাই। এককাট্টা ফসল ধান, গম ও ভুট্টার আবাদ কমিয়ে অন্যান্য ফসল যেমন ডাল, তেলবীজ, শাকসবজি, ফলমূল, মসলা ইত্যাদির আবাদ বাড়ানো শ্রেয়। ফসল চক্রে পরিবর্তন আনা চাই। মিশ্র ফসলের আবাদ বাড়ানো জরুরি।
মাটির প্রাণ বাঁচাতে প্রয়োজন সুষ্ঠু পানি সেচ ও নিষ্কাশনব্যবস্থা। এমন ব্যবস্থার অভাবে উর্বরতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তা ছাড়া মাটিতে অনেক সময় ক্ষতিকর রোগ ও কীটের জীবাণু বা ডিম থাকে এবং ফসল উৎপাদনকালে সেগুলো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। পর্যায়ক্রমে উল্টেপাল্টে জমি চাষ করলে এবং মাটি রোদে শুকিয়ে নিলে সেগুলো বিনষ্ট হয়ে যায় এবং মাটির উন্নয়ন সাধিত হয়। প্রয়োজনে সঠিক সময় সঠিক কৌশলে উপযুক্ত বালাইনাশক ব্যবহার করা আবশ্যক।
আমাদের দেশে ২০১০ সালে মাটি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে ‘বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন’ প্রণয়ন এবং ২০২৩ সালে এই আইনের সংশোধন বিল পাস করা হয়। প্রাথমিক আইনে কৃষিজমি থেকে বালু বা মাটি তোলা-সম্পর্কিত কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। সংশোধিত বিলে বলা হয়, ‘কোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি থেকে বালু বা মাটি তোলা যাবে না, যদি তা উর্বর কৃষিজমি হয় বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়, কিংবা কৃষিজমির উর্বর উপরিভাগের মাটি হলে যদি পরিবেশ-প্রতিবেশ বা জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি সাধিত হয়, বা ড্রেজারের মাধ্যমে কিংবা যদি অন্য কোনো কৌশলী প্রক্রিয়ায় বালু বা মাটি উত্তোলন করা হয়, যাতে এই জমিসহ পার্শ্ববর্তী অন্য জমির ক্ষতি, চ্যুতি বা ধসের উদ্ভব হয়।’
ভূমি, কৃষি ও সবুজ অবকাঠামো ব্যবস্থাপনার এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার কৌশলের সঙ্গে মাটির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মাটি যত ভালো থাকবে, জলবায়ুর গতিশীলতা তত ভালোভাবে বোঝা যাবে। তবে মাটির একার পক্ষে জলবায়ু পরিবর্তন সম্ভব নয়। সে জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে মানুষকেই এবং একযোগে টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করা চাই।
সুস্মিতা চক্রবর্তী মিশু
ছবি: ইন্টারনেট