skip to Main Content

যাপনচিত্র I পলাশ পর্ব

পলাশ নূর। বাংলাদেশি রক মিউজিক সিনারিওতে হার্ড রকের অগ্রদূত ব্যান্ড ওয়ারফেজের ভোকাল। দাপুটে এ রকস্টারের একান্ত জীবন কেমন?

ওয়ারফেজ মানেই গিটারের ডিস্টরশন টোনের সঙ্গে ভোকালের গগনবিদারী চিৎকার; রক মিউজিকের ভাষায় স্ক্রিমিং। আদি ভোকাল সান্জয় থেকে বর্তমানের পলাশ নূরের কণ্ঠে। চলতি ধারণায় রক ভোকালদের ‘গাইতে গাইতে গায়েন’ ভাবা হলেও পলাশ তা নন। তার মিউজিকের হাতেখড়ি বিভিন্ন ধ্রুপদি গান শেখার মধ্য দিয়ে; বিশেষত নজরুলগীতি। তবে তার কাছে জীবন বদলে দেওয়ার বার্তা ছড়ানো শিল্পী ছিলেন ব্রায়ান অ্যাডামস। ব্রায়ানের হাস্কি ভয়েস ও কণ্ঠের মাদকতা তাকে মুগ্ধ করে।
রকস্টার পলাশ একজন উদ্যোক্তাও। নিজের সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞাপনী সংস্থায় সময় দেন। এর আগে দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞাপনী সংস্থায় ১৪ বছর চাকরি করে অভিজ্ঞতা বাড়িয়েছেন। বিভিন্ন কোম্পানি কিংবা ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপনে কাজ করতে গিয়ে যে যোগাযোগ তৈরি হচ্ছে, তা বেশ উপভোগ করছেন।
ভোর খুব পছন্দ পলাশের। ৫টা-৬টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে প্রার্থনা ও স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের মাধ্যমে দিন শুরু করেন। ভোরের পরিবেশ তাকে অন্য রকম শিহরণ দেয়। সূর্যোদয়, শীতল বাতাস, পাখির কলরব- সব মিলিয়ে এমন এক প্রশান্তি অনুভব করেন, যা একজন মিউজিশিয়ান হিসেবে তার কাছে গুরুত্ববহ। তারপর ওয়ার্কআউট শেষে ৮টা-৯টার দিকে ব্রেকফাস্ট সারেন। এরপর? সাপ্তাহিক ছুটির দিন হলে একটু ঘুমিয়ে নেন; অন্য দিনগুলোতে কন্যাকে স্কুলে পৌঁছে দেন। পলাশের কাছে পরিবার সব সময় অগ্রাধিকার। স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার কালে ১৫ মিনিট মেয়ের সঙ্গে কাটানো সময়টাকে দিনের সেরা মুহূর্ত মনে করেন। সে সময় মেয়ের দেওয়া বিভিন্ন উপদেশ উপভোগ করেন খুব!
পলাশ তেমন ভোজনরসিক নন, তবে বাংলা খাবারই বেশি পছন্দ; বিশেষ করে বিদেশে অবস্থানকালে এ জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন! ব্রেকফাস্ট হিসেবে ডিম, রুটি, কলা, খেজুর পছন্দ। বাসায় ব্যবস্থা আছে বলে আলাদা করে জিমে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। জানালেন, ২০১২-১৩ থেকে ওজন বাড়ছিল তার। পরে, করোনা অতিমারির সময় সপরিবারে গ্রামের বাড়ি রংপুরে গিয়েছিলেন। ওয়ার্ক ফ্রম হোম থাকায় নিজেকে দেওয়ার মতো প্রচুর সময় পেয়েছিলেন তখন। সময় কাটাতেন মাঠে ফুটবল খেলে, সাইকেল চালিয়ে, সাঁতার কেটে। প্রচুর ফিজিক্যাল অ্যাকটিভিটি করায় রিফ্রেশ ফিল করতেন; মনও ভালো থাকত। এভাবেই ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যসচেতন হয়ে ওঠেন। এখন কিছুটা ওয়েট লিফটিংও করেন। ফিজিক্যাল ও মেন্টাল হেলথ ঠিক রাখার জন্য প্রতিটি স্টেজ পারফরমারেরই নিয়মিত এক্সারসাইজ করা আবশ্যক মনে করেন। এ জন্য তিনি সকালে ঘুম থেকে উঠে আগে কার্ডিও করেন, এরপর ওয়েট লিফটিং। কার্ডিও বলতে ট্রেডমিল। মধ্যাহ্নভোজ সারেন ২টার দিকে। পাতে থাকে ভাত, সবজি, মাছ-মাংস ও ডাল। নৈশভোজে কুসুমবিহীন ডিম, আধা সেদ্ধ চিকেন এবং ছোলা বুট।
আগে বন্ধুবান্ধবের একটা সার্কেল ছিল। এখন কলেজ ফ্রেন্ডদের সঙ্গে আড্ডা একদমই হয় না; কেননা, সবাই নিজ নিজ জীবন নিয়ে ব্যস্ত। ইউনিভার্সিটির ফ্রেন্ডদের সঙ্গে মাসে দু-একবার আড্ডায় মাতেন। তা ছাড়া পেশাগত জীবনে কিছু বন্ধুবান্ধব হয়েছে, তাদের সঙ্গে সপ্তাহে এক দিন আড্ডা। তবে প্রতিদিন কারও সঙ্গে আড্ডা দেওয়া কিংবা হ্যাংআউট করার মতো সময় হয়ে ওঠে না। বেশির ভাগ সময় নিজের স্টার্টআপ বিজনেস নিয়ে ব্যস্ততায় কাটে, যেখানে এখন ৬ জনের একটি টিম রয়েছে।
ওয়ারফেজের সঙ্গে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স ট্যুরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে পলাশের। এর মধ্যে প্যারিসকে মনে হয়েছে স্বপ্নের মতো সুন্দর ও গোছানো, যেন চারদিকে ছবি আঁকা। আমেরিকাও ভালো লেগেছে। ট্যুরে গেলে আবহাওয়া বদলের কারণে কণ্ঠে প্রভাব পড়ে। তাকে একটু হাই পিচে গান গাইতে হয় বলে একবার গলা বসে গেলে রিকভার হতে ১০-১৫ দিন লেগে যায়। তাই তিনি এই রিস্ক খুব একটা নিতে চান না!
হোম ইন্টেরিয়র নিয়ে খুব একটা ভাবেন না পলাশ। তবে এ ক্ষেত্রে ক্রিয়েটিভ ও নান্দনিক জিনিসকে অমূল্য বলে মনে করেন। হ্যান্ড পেইন্ট আর্ট, হ্যান্ড মেইড জিনিস খুব পছন্দ। তা ছাড়া ফটো ফ্রেমের প্রতি দুর্বলতা আছে। ব্রাইট লাইট ভালোবাসেন। সাধারণত লাইট জ্বালিয়ে ঘুমাতে পছন্দ করেন।
পরিধেয়র ক্ষেত্রে কালো রংই পছন্দ। বেশির ভাগ সময় টি-শার্ট, কেমো প্যান্ট, ডেনিম জিনস পরেন। স্পোর্টি টাইপ শু ব্যবহারে স্বচ্ছন্দ; পছন্দের ব্র্যান্ড অ্যাডিডাস, নাইকি ও রিবক। রোলেক্স ঘড়ির প্রতি বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। সংগ্রহে আছে ক্রেডেন্স, ফসিলস, টাইটান ও ক্যাসিও ব্র্যান্ডের ১৭টি ঘড়ি। পারফিউমের ক্ষেত্রে পছন্দের বিশেষ বালাই নেই; আতরই ব্যবহার করেন বেশি। এই সুগন্ধির প্রতি ভালো লাগার ব্যাপারটি মূলত বাবার কাছ থেকে পাওয়া। আতরের মাধ্যমে প্রকৃতির সঙ্গে কানেকটিভিটি খুঁজে পান।
অবসরে টেলিভিশনে খেলা দেখেন, বিশেষত বিশ্বকাপ। ফুটবলে আর্জেন্টিনার সমর্থক; প্রিয় ফুটবলার ম্যারাডোনা, মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। ক্রিকেটে বাংলাদেশের পাশাপাশি ওয়েস্ট ইন্ডিজেরও অনুরাগী। প্রিয় ক্রিকেটার ব্রায়ান লারা, রিকার্ডো পাওয়েল, জ্যাকব ওরাম। পলাশের কাছে স্টাইল হচ্ছে ব্যক্তিত্ব। নিজে কীভাবে কথা বলেন, কীভাবে বসেন- এসব মিলিয়ে। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চুল বড় রেখেছিলেন; তবে ছোট চুলেই আরামবোধ করেন।
পলাশ একজন উপস্থাপকও। তার হোস্টিং করা টিভি শোগুলোর মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় কিংবদন্তি রকস্টার আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে শো। এটি ছিল জীবদ্দশায় বাচ্চুর শেষ জন্মদিনের পরের দিন, অর্থাৎ ১৭ আগস্ট ২০১৮। সেটিই শেষ টিভি টক শো অ্যাপিয়ারেন্স ছিল ওই মহাতারকার। সেই অনুষ্ঠানে আইয়ুব বাচ্চু নিজ হাতে তুলে কেক খাইয়েছিলেন পলাশকে। এরপর পরম স্নেহে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন। তারপর বুকে হাত রেখে দোয়া করেছিলেন, ‘অনেক বড় হও।’
শিক্ষাজীবনে পলাশ ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। বই পড়তে ভালোবাসেন। উইলিয়াম শেকসপিয়ার ও উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের সাহিত্যকর্ম তাকে প্রেরণা জোগায়। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুরাগী। হুমায়ূন আহমেদও বেশ পছন্দের। সবচেয়ে পছন্দের চরিত্র মাসুদ রানা। হিমু ও তিন গোয়েন্দাও ভালো লাগে।
ছোটবেলায় ডাকটিকিট ও ক্যাসেট সংগ্রহের শখ ছিল। সুযোগ পেলে সিনেমা ও টিভি সিরিজ দেখেন। পছন্দের সিনেমা ‘ট্রয়’, ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’ প্রভৃতি। টিভি সিরিজের মধ্যে ‘জ্যাক রায়ান’। তার সেলিব্রিটি ক্রাশ ‘টাইটানিক’খ্যাত কেট উইন্সলেট।
স্পিরিচুয়াল ব্যাপার নিয়ে খুব ভাবেন। নিজের জীবন, সুস্থতা, কণ্ঠ এবং সর্বোপরি মানসিক প্রশান্তির জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি সুখ ও শান্তির মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পান। তার মতে, সুখ অনেক ক্ষেত্রে কিনতে পারা যায়, কিন্তু প্রশান্তি শুধু সৃষ্টিকর্তাই দিতে পারেন।
তার জীবনদর্শন হলো, যতটুকু সম্ভব সত্য বলা, সৎ পথে চলা, সত্য দেখা। স্রষ্টার অন্যান্য সৃষ্টির যত্ন নেওয়া মানুষের দায়িত্ব মনে করেন। ছোটবেলায় ডিংকি নামে একটা পোষা কুকুর ছিল। কুকুরটির মনিব ছিলেন তাদের পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা, কোনো কারণে যিনি ডিংকিকে রেখে দেশান্তরিত হন। ২ বছর বয়সী কুকুরটি তখন একা হয়ে যায়। প্রতিবেশীর বলে কুকুরটির সঙ্গে পলাশের আগে থেকেই সখ্য ছিল। তাই ওকে বাড়ি নিয়ে আসেন। ডিংকির সঙ্গে বন্ধুর মতো সম্পর্ক হয়ে যায় তার। খেলতে যাওয়ার সময় সঙ্গে যেত, স্কুল থেকে ফেরার সময় মোড়ে অপেক্ষা করত। ছোট বোনের পোষা বিড়াল ছিল- গেডাস। একই বাসায় ডিংকি ও গেডাস বন্ধুর মতো থাকত, কুকুর ও বিড়ালের মধ্যে যে সখ্য সাধারণত দেখা যায় না। কবুতরও পুষতেন পলাশ। শেষ পর্যন্ত ৮৫টির মতো কবুতর ছিল তার। এসবই ছিল গ্রামের বাড়িতে। ঢাকায় পাড়ি জমানোর পর আর পশুপাখি পোষেননি।

 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top