ফিচার I বড়দিনে ঘরের সাজ
২৫ ডিসেম্বর। ক্রিসমাস ডে। বড়দিন। খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব। এমন দিনে চেনা অন্দরমহলকে নতুন রূপে সাজানো গেলে দারুণ হয়
ক্রিসমাস খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের হলেও বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিক উৎসব। ঘর উৎসবের আবহে সাজিয়ে পরিবার, বন্ধু ও প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটানো, উপহার বিনিময়- সব মিলিয়ে দিনটি হয়ে ওঠে স্মরণীয়। প্রতিবছর তো ক্রিসমাসে সাধ্যমতো ঘরের চেহারা বদলে ফেলা হয়। এ বছর যদি ভিন্নভাবে সাজানো যায়, কেমন হয়?
তার আগে জেনে নেওয়া যাক কেন প্রতিবছর এই উৎসব উদ্্যাপন করা হয়, আর সেই চেনা সাজসজ্জায় কী কী থাকে।
ক্রিসমাস ডে উদযাপন করা হয় প্রতিবছরের ২৫ ডিসেম্বর, যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন ঘিরে। এ উৎসবের নেপথ্যে কয়েকটি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কারণ রয়েছে।
যিশুখ্রিস্টকে খ্রিস্টধর্মের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার জন্মকে গণ্য করা হয় মানবজাতির মুক্তির প্রতীক হিসেবে।
যিশুর জীবন ও শিক্ষাগুলো বিশ্বে শান্তি, মঙ্গল এবং নিঃস্বার্থ ভালোবাসার বার্তা বহন করে।
ক্রিসমাস ধর্মীয় উৎসব হলেও এটি এখন এক বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যেখানে সবাই মিলে একত্র হয়ে আনন্দ উদ্যাপন করে।
এ ছাড়া শিশুদের জন্য ক্রিসমাসের বিশেষ আকর্ষণ সান্তা ক্লজের আগমন। সান্তা ক্লজের গল্প এবং তার আগমনের পেছনেও রয়েছে ইতিহাস, সংস্কৃতি ও কল্পনার মিশ্রণ। ধারণাটি এসেছে সেন্ট নিকোলাস নামের একজন খ্রিস্টান বিশপের কাছ থেকে। যিনি তৃতীয় শতাব্দীতে তুরস্কে থাকতেন। দরিদ্রদের সাহায্য করতেন এবং শিশুদের ভালোবাসতেন। দরিদ্র পরিবারের দরজার সামনে গোপনে উপহার রেখে দিতেন। ২৪ ডিসেম্বর রাতে (ক্রিসমাস ইভ), সান্তা তার জাদুকরি স্লেজে করে রেনডিয়ারের টানা উপহারের থলি নিয়ে আসেন এবং বাড়ির চিমনি দিয়ে উপহার রেখে যান। সান্তা ক্লজ শিশুদের মধ্যে উদারতা ও ভালো আচরণের অনুপ্রেরণা দেন। উপহার পাওয়ার মাধ্যমে তারা শেখে, ভালো কাজ করলে পুরস্কার মেলে।
ক্রিসমাস উদ্যাপনের সময় বিভিন্ন ঐতিহ্য ও রীতিনীতি অনুসরণ করা হয়:
ঘরের কেন্দ্রস্থলে একটি ক্রিসমাস ট্রি রাখা হয়। টিনসেল, রঙিন বল, ফেইরি লাইট ও তারায় সাজানো হয় সেই ট্রি। এর নিচে রাখা হয় উপহারের বাক্স।
ঘরের জানালা, দরজা ও দেয়ালে ফেইরি লাইট ঝোলানো হয়। সঙ্গে ছোট ছোট লাইট ও মোমবাতি।
প্রধান দরজায় সবুজ লতাপাতা, বেরি ও রঙিন ফিতায় তৈরি মালা ঝোলানো হয়।
ডাইনিং টেবিলে লাল বা সবুজ টেবিলক্লথ ও সেন্টারপিস ব্যবহার করা হয়। বিশেষ ক্রিসমাস থিমড ডিশ ও কাপ রাখারও চল রয়েছে।
সান্তা ক্লজ, স্নোম্যান এবং রেনডিয়ারের মডেল জায়গা পায় ঘরের কোণে।
বিভিন্ন ক্রিসমাস কার্ড ও উপহার ঘরের বিভিন্ন জায়গায় সাজিয়ে রাখা হয়।
এ বছর ক্রিসমাস ঘিরে ঘরের সাজে যেসব নতুনত্ব আনা যেতে পারে:
থিমভিত্তিক সজ্জা
ট্র্যাডিশনাল ক্রিসমাস সাজে লাল, সাদা ও সবুজ রঙের আধিক্য থাকে। চাইলে এবার এগুলোর বাইরে গিয়ে অন্য কোনো রং ব্যবহার করতে পারেন। ট্র্যাডিশনাল সাজের পরিবর্তে একটি নির্দিষ্ট থিম বেছে নিলে মন্দ হয় না। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক।
রঙের ভিন্নতা: সাদা-সোনালি, কালো-রুপালি কিংবা প্যাস্টেল রং ব্যবহার করুন। অথবা কালো ও সোনালির মতো আধুনিক রঙের থিম বেছে নিন।
মিনিমালিস্ট থিম: অত্যধিক সাজসজ্জার পরিবর্তে হালকা ও সূক্ষ্ম উপকরণ দিয়ে ঘর সাজাতে পারেন। যেমন সাদা ফোম বা কাগজ দিয়ে স্নোফ্লেক তৈরি করে জানালায় লাগানো। তুলা, সাদা ফোম আর নীল আলো ব্যবহার করে ঘরে তুষারাবৃত পরিবেশ তৈরি করা যেতে পারে।
বোহিমিয়ান স্টাইল: কাঠ, দড়ি ও পাটের তৈরি বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে একটি আর্টিস্টিক বোহো থিম জাহির করতে পারেন।
পরিবেশ পরিচর্যা
বর্তমান বিশ্বে পরিবেশবান্ধব উদ্যোগগুলো বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। এ বছর ক্রিসমাস সজ্জায় এমন উপকরণকে প্রাধান্য দিতে পারেন।
প্রাকৃতিক উপকরণ: প্লাস্টিকের পরিবর্তে কাঠ, পাতা, পাইন কন, শুকনো ফুল ও গাছের ডাল ব্যবহার করা যেতে পারে।
ডিআইওয়াই (ডু ইট ইওরসেলফ) ডেকোরেশন: পুরোনো কাপড়, বোতল, কাগজ কিংবা রিবন দিয়ে নিজেই ক্রিসমাস গারল্যান্ড, স্টার ও অর্নামেন্ট তৈরি করুন। এমনকি ক্রিসমাস ট্রিও বানিয়ে ফেলতে পারবেন সহজে। ক্লে দিয়েও এই ট্রি বানানো সম্ভব। তা যেমন অন্যদের চেয়ে আলাদা হবে, তেমনি নিজে তৈরি করার আনন্দও পাবেন। এ ছাড়া নিজের হাতেই ক্রিসমাস কার্ড বানিয়ে ফেলুন।
রিসাইকেলড উপকরণ: পুরোনো কার্ড, কাপড় কিংবা ভাঙা গ্লাস দিয়ে সাজিয়ে রাখা যায় এমন সৃজনশীল কিছু তৈরি করতে পারেন।
থিমেটিক কর্নার
ঘরের একটি বিশেষ অংশকে থিমেটিক কর্নার হিসেবে সাজাতে পারেন; যা হবে ক্রিসমাস কর্নার। যেখানে পরিবারের সবাই মিলে ছবি তুলতে পারবেন। সেখানেই সাদা তুলা, ফোম ও লাইট দিয়ে তুষারাবৃত পরিবেশ তৈরি করা যেতে পারে। সান্তা ক্লজের আদলে ভাস্কর্য বা ছবি রাখতে পারেন। এ ছাড়া রেনডিয়ার ও গিফট বক্স দিয়ে সাজিয়ে তুলতে পারেন কর্নারটি। ঘরে যদি বড় জায়গা থাকে, তাহলে অন্য একটি কোণে বাচ্চাদের জন্য খেলনা আর মজার আর্ট উপকরণ রাখুন, যেখানে তারা সৃজনশীলতা প্রকাশ করতে পারবে।
আলোর খেলায় নতুনত্ব
আলোকসজ্জাবিহীন ক্রিসমাস যেন ভাবাই যায় না! চাইলে এবার লাইটিংয়েও আনতে পারেন নতুনত্ব।
প্যাটার্নড প্রজেক্টর: ফেইরি লাইটের সঙ্গে প্যাটার্নড প্রজেক্টর লাইট যোগ করুন, যা ঘরের ছাদে তারার আলোর প্রতিফলন ঘটাবে।
প্যাটার্নড লাইটিং: বিভিন্ন আকৃতির ফেইরি লাইট ব্যবহার করতে পারেন; যেমন স্টার, হার্ট কিংবা স্নোম্যান।
ফেস্টুন লাইট: একটি দেয়ালজুড়ে লাইট দিয়ে বড় ক্রিসমাস ট্রি বা অন্য কোনো আকৃতি তৈরি করা যেতে পারে।
মোমবাতি ও ল্যাম্প: রঙিন মোমবাতি আর ছোট ল্যাম্প ব্যবহার করে ঘরে কোমল ও উষ্ণ পরিবেশ তৈরি করতে পারেন।
গিফট কর্নার
উপহার বিনিময় ক্রিসমাসের অন্যতম আকর্ষণ। তাই ঘরের একটি কোণ সাজান শুধু উপহারের জন্য।
গিফট র্যাপিং স্টেশন: যেখানে সবাই তাদের উপহার প্যাক করতে পারবেন। তাই বিভিন্ন রঙের কাগজ, ফিতা আর স্টিকার রাখুন।
র্যাপিং স্টাইল: প্রতিটি উপহারকে আলাদা ও আকর্ষণীয় করে প্যাক করতে বিশেষ র্যাপিং স্টাইল ব্যবহার করা যেতে পারে।
ট্রান্সপারেন্ট ব্যাগ: ছোট উপহার ট্রান্সপারেন্ট ব্যাগে রেখে র্যাকে সাজিয়ে রাখুন।
পার্সোনালাইজড গিফট কার্ড: নিজের হাতে তৈরি কার্ড দিয়ে গিফট বক্সের সৌন্দর্য বাড়ানোর চেষ্টা চালাতে পারেন।
হ্যান্ডমেইড অর্নামেন্ট
বাজার থেকে কেনার বদলে বরং নিজের হাতে তৈরি কিছু অনন্য অর্নামেন্টে সাজিয়ে তুলতে পারেন অন্দরমহল।
কাগজের ঝুলন্ত তারা: রঙিন কাগজ কেটে সুন্দর সুন্দর ঝুলন্ত তারা বানিয়ে নিতে পারেন।
কাঠের টুকরো: ছোট কাঠের টুকরা বা ডাল কেটে স্নোম্যান বা রেনডিয়ারের মতো আকৃতি দিন।
প্লাস্টার বা ক্লে: প্লাস্টার বা ক্লে দিয়ে মিনি ক্রিসমাস ট্রি বা বেল তৈরি করে রং করে নিন।
আমেজে সুবাস
গন্ধ বা সুবাস সজ্জার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারে। তাই ক্রিসমাসের সজ্জায় রাখতে পারেনÑ
সেন্টেড ক্যান্ডেল: ভ্যানিলা, দারুচিনি কিংবা পাইন গন্ধযুক্ত ক্যান্ডেল ব্যবহার করলে মন্দ হয় না।
পটপুরি: শুকনো ফুল, কমলা বা লেবুর খোসা, দারুচিনি ও লবঙ্গ মিশিয়ে পটপুরি তৈরি করে ঘরের বিভিন্ন কোণে রাখুন।
জানালা-দরজায়
এদিন দরজা ও জানালা সজ্জায় কার্পণ্য নয়! বরং সামান্য সাজসজ্জাতেই পুরো ঘরের চেহারা বদলে যাবে। জানালায় স্প্রে স্নো দিয়ে স্নোফ্লেক বা সান্তার ছবি আঁকতে পারেন। সাদা কাগজ দিয়ে স্নোফ্লেক কেটে জানালায় লাগিয়ে নিন। দরজার ওপরে একটি বড় মালা ঝুলিয়ে দিন। লতাপাতা, বেরি ও পাইন কন দিয়ে এটি তৈরি করে ফেলতে পারবেন নিজেই। এ ছাড়া দরজা বা জানালায় গারল্যান্ডের সঙ্গে ছোট ছোট এলইডি লাইট জুড়ে দিতে পারেন।
খাবার টেবিলে
ডাইনিং টেবিল ক্রিসমাস উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু। এদিন লাল, সবুজ বা সোনালি রঙের টেবিল রানার ব্যবহার করতে পারেন। চাইলে কনট্রাস্ট করে অন্য রঙের রানারও বিছিয়ে নেওয়া যেতে পারে। একদম সিম্পলের বদলে বরং ক্রিসমাস থিমের রানার বেছে নেওয়াই শ্রেয়। নিজেই রানারে এঁকে নিতে পারেন ক্রিসমাস ট্রি। টেবিলের মাঝে পাইন কন, কৃত্রিম বেরি আর মোমবাতি রাখুন। কাস্টমাইজড প্লেট ব্যবহার করতে পারেন। প্রতিটি প্লেটে একটি ছোট উপহার বা পার্সোনালাইজড ন্যাপকিন রাখলে দেখতে দারুণ লাগবে।
স্মৃতি ধরে রাখতে
ক্রিসমাসের মুহূর্তগুলো ধরে রাখতে ঘরের কোনো দেয়ালে একটি স্মৃতি বোর্ড তৈরি করতে পারেন। সেটি পরিবারের পুরোনো ক্রিসমাস ছবি দিয়ে সাজিয়ে নিন। ছবির সঙ্গে ফেইরি লাইট জুড়ে দিতে পারেন। এ ছাড়া উইশ বোর্ড রাখুন, যেখানে উৎসব ঘিরে সবার বার্তা জায়গা পাবে। উপহারের সঙ্গে পাওয়া ক্রিসমাস কার্ডগুলোও একটি বোর্ডে সেঁটে দিতে পারেন।
ক্রিসমাসে ঘর সাজানোর পুরো বিষয়টি হলো ভালোবাসা, সৃজনশীলতা ও আনন্দের প্রকাশ; তাতে ব্যক্তিত্বের ছাপ পড়াও চাই। প্রতিবারের একই ধরনের ডেকোরেশনের মধ্যে আটকে না থেকে এবার বরং নতুন থিম, রং এবং পরিবেশবান্ধব উপকরণ দিয়ে সাজুক আপনার অন্দরমহল। তাতে উৎসবের আমেজই শুধু নয়, অতিথিদের কাছ থেকে আপনার সৃজনশীলতার প্রশংসা পাওয়ার সম্ভাবনাও বাড়বে।
সুবর্ণা মেহ্জাবীন
ছবি: ইন্টারনেট