এডিটর’স কলাম I শেষ বলে কিছু নেই
ফুরিয়ে এলো বছর। শেষ হয়ে গেল প্রায়। একেবারেই কি শেষ? মোটেই নয়! বরং নতুন দিনের, নতুন সকালের, নতুন আশার সম্ভাবনা আরও জোরালো হলো। মানব সম্পর্কগুলোর মতোই। আশাহীনতার ভেতরও আশাবাদের সুপ্ত বিচরণ মাখা
দিনভর রোদ ছড়িয়ে, বিকেলের শেষ প্রহর পেরিয়ে, আরক্তিম রঙে দিগন্ত রাঙিয়ে যখন ডুবে যায় সূর্য, চরাচরজুড়ে নেমে আসে আঁধারের পর্দা। সেই পর্দা সব সময় নিকষ কালো নয়; কখনো কখনো মিহি আবরণ। এর ঘনত্ব নির্ভর করে চন্দ্র-নক্ষত্রের উঁকিঝুঁকির ওপর। অমাবস্যার রাতগুলোতে সাধারণত খুব গাঢ় থাকে আঁধারের স্তর। কৃত্রিম আলোর সাহায্য ছাড়া পথচলা হয়ে পড়ে দুরূহ। আবার, পূর্ণিমা রাতে সেই স্তর একেবারে পলকা হয়ে যায়; রুপালি স্রোতে খালি চোখেই দেখা মেলে অনেকটুকু পথের। এ তো গেল চাঁদের জাদু! নক্ষত্ররাও কম ক্রীড়নক নয়। রাশি রাশি খইয়ের মতো ফুটে থাকে আকাশের জমিনে; অথবা থোকা থোকা ফুলের মতো গগন-নকশিকাথায়। মিটিমিটি জ্বলে ছড়িয়ে দেয় হলদে আলোর আভা। প্রকৃতির এ এক অপার মহিমা। চিরন্তন খেলা। তার নিয়ম মেনেই, হোক নিষক কালো কিংবা মিহি আলোর প্রভাববিস্তারী রাত, তা-ও ফুরোয় ঊষালগ্নে। আবারও দেয় উঁকি সূর্য, নিজ দাপট নিয়ে। এমন চক্রেই বাঁধা পৃথিবীর জীবন। এই গ্রহের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে বিবেচিত মানুষের জীবনও অনেকটা এ রকম। কখনো অমাবস্যা, কখনো পূর্ণিমা। কখনোবা দুটোর বিবিধ ভারসাম্যের নিদর্শন। তাই সূর্য ডুবে গেলেই চির-অন্ধকার নেমে এলো, সবকিছু শেষ হয়ে গেল- এমনটা ভাবার কিছু নেই; বরং আবার আসবে সকাল, হাসবে আকাশ, জাগবে জীবন নতুন করে।
দুই
প্রত্যেক মানুষের জীবনেই এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যেগুলো কাক্সিক্ষত নয় কারও। তবু আসে। আসা অপরিহার্য বটে! আর তা সবাই সমানভাবে সামাল দিতে পারে না। কেউ কেউ মুথ থুবড়ে পড়ে; কেউবা বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দুঃসময় মোকাবিলার এমন বিপরীতমুখী মানবাচরণের কারণ, প্রত্যেক মানুষই নিজের মতো করে আলাদা। তাই তাদের সহ্যক্ষমতা, প্রতিরোধক্ষমতা, মানসিক দৃঢ়তাও ভিন্ন। যারা লড়তে জানে, তারা চূড়ান্ত পরাজয় জানলেও চিরতরে থেমে যাওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত সামান্যতম হলেও নড়েচড়ে ওঠে। আবার, ভীরু মনের বলয় কাটানো যাদের পক্ষে মুশকিল, তারা সামান্য জলপ্রবাহেই ভেসে যায় খড়কুটোর মতো। সূর্য ডুবে গেলেই ভাবে, সামনে বোধ হয় সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। আরেকটি সকালের স্বপ্ন দেখতে যেন তাদের মানা! বিশেষত তাদের বলছি, ক্যালেন্ডারের পাতায় এখন ডিসেম্বর। বছরের শেষ মাস। আর কটা দিন পরই ফুরিয়ে যাবে চলতি বর্ষপঞ্জি। সেই জানুয়ারি থেকে যে ক্যালেন্ডার ঝুলিয়ে রেখেছিলেন ঘরের কোণে, অথবা যে বছরের হিসাব রেখেছেন মনে মনে, সেটির সময় এই তো ফুরিয়ে এলো বলে! তারপর কী? থেমে যাবে জীবন আপনার? থমকে যাবে পৃথিবী? নাকি ডিসেম্বরের ৩১ তারিখের পর যথারীতি আরও একটি তারিখ তথা দিন আসবে, ১ জানুয়ারি। প্রতিবারের মতোই। তাতে সালের হিসাব লিখতে গিয়ে ২০২৪-এর বদলে ২০২৫ লিখবেন, পুরোনো ক্যালেন্ডার সরিয়ে নতুন বছরেরটি টাঙিয়ে দেবেন; কিন্তু জীবনের প্রবহমানতায় বিশেষ কোনো ব্যাঘাত নিশ্চয় ঘটবে না? কেননা, এ তো শুধু একটি তারিখমাত্র। জীবনও এমনই।
তিন
সহজে বলা কিংবা হয়তো যথেষ্ট সহজভাবে বোঝা গেলেও, সামলে ওঠা সব সময় সম্ভব হয় না, জানি। তাই মনের আকাশে গাঢ় অন্ধকার জমা হলে যদি দেখা না মেলে চন্দ্র-তারার, কিংবা এমনকি কৃত্রিম আলোর, তাতেও হাল ছেড়ে দেওয়া কিছুতেই মনুষ্য গুণাবলি নয়। জানা কথা, ব্যক্তিমানুষের পক্ষে অনেক কিছুই সামলানো সম্ভব; আবার সবকিছুই যে সম্ভব, তা-ও নয়। তাই প্রয়োজন পড়ে অন্যের। এ জন্যই সামাজিক প্রাণী হিসেবে খ্যাতি ও স্বীকৃতি মানুষের। হতে পারে কাছের কেউ, কিংবা বিপদ গুরুতর হলে পেশাদার কোনো বিশেষজ্ঞ। বিষয়টি যেহেতু মানসিক, তাই একধরনের ভ্রান্ত ধারণার দুর্ভাগ্যজনক চলের শিকার হতে হয় অনেক সময়। আমাদের সমাজে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হওয়াকে বাঁকা চোখে দেখেন কেউ কেউ। তাতে চেপে বসে দ্বিধা; বাড়ে ঝুঁকি। অথচ একজন আধুনিক চিন্তাসম্পন্ন মানুষের উচিত নয় এমনতর ‘পাছে লোকে কিছু বলে’র ঘেরাটোপে নিজেকে আটকে বিপদ বাড়িয়ে তোলা। তাই যদি মনে হয়, একা একা কিংবা অপেশাদার বা কাছের মানুষদের সাহায্য নিয়ে সরানো যাচ্ছে না মনের মেঘ, ওঠানো যাচ্ছে না রোদ আবারও, তাহলে সময়ক্ষেপণ আর নয়; পেশাদার চিকিৎসক কিংবা মনোবিশ্লেষক রয়েছেন আপনার অপেক্ষায়।
চার
কথায় বলে, যে নিজেকে সাহায্য করে না, কেউ তাকে সাহায্য করতে পারবে না। ঠিকই বলে! তাই নিজের চেষ্টাই অগ্রগণ্য। সে জন্য বাড়ানো চাই মানসিক শক্তি। এর রয়েছে বিবিধ উপায়। অন্তর্জালে ঢুঁ মারলেই চোখের সামনে ভেসে উঠবে ভূরি ভূরি উদাহরণ। যেমন মাইন্ডফুলনেস বা মননশীলতার অনুশীলন, আত্মসমবেদনাকে আলিঙ্গন, স্বস্তির বলয় থেকে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টা, নিজ অনুভূতি শনাক্ত ও অনুধাবন, দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণতা, স্ব-যত্ন চর্চা, অর্থবহ যোগাযোগ স্থাপন, লক্ষ্য নির্ধারণ ও অনুসরণ, ইতিবাচক মানসিকতার বিকাশ, ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ প্রভৃতি। জানা কথা, মনের জোর বাড়লে অল্পতেই নিরাশা কাবু করতে পারবে না। কোনো কিছু হারিয়ে ফেললে কিংবা ফুরিয়ে গেলে তার ভেতর থেকেও নতুন কিছুর আবির্ভাব ঘটার অন্তর্নিহিত প্রভার ঠিকই দেখা মিলবে।
পাঁচ
ফুরিয়ে এলো বছর। শেষ হয়ে গেল প্রায়। একেবারেই কি শেষ? মোটেই নয়! বরং নতুন দিনের, নতুন সকালের, নতুন আশার সম্ভাবনা আরও জোরালো হলো। মানব সম্পর্কগুলোর মতোই। আশাহীনতার ভেতরও আশাবাদের সুপ্ত বিচরণ মাখা। যেন অঞ্জন দত্তের গানের মতো, ‘যখন মনের ভেতর সূর্যটা হঠাৎ ডুবে যায়,/ যখন আশা ভরসা সব রাস্তা হারায়।/ যখন ভরদুপুরে পথের ধারে একলা করে ভয়,/ যখন বাসের ভিড়ে গলার ভিতর কান্না চাপতে হয়।/ জেনো তোমার মতোই আমি হাতড়ে বেড়াই/ জেনো তোমার মতো আমার বন্ধু একটা চাই।/ যেমন মাঝ দরিয়ার নৌকো ফিরে আসে কিনারায়,/ ওরে মানুষ যখন আছে তখন হাতও জুটে যায়।/ শেষ বলে কিছু নেই।/ শেষ যেখানে, জেনো শুরু সেখানে…।’
জীবন সুন্দর হোক। আলোকোজ্জ্বল হোক নতুন সম্ভাবনার দ্যুতিতে।