স্বাদশেকড় I মোমো মধুরতা
তিব্বতি ভাষায় ‘মোমো’ অর্থ সেদ্ধ করা রুটি। দুর্গম পার্বত্যাঞ্চল থেকে চরম গতিশীল নগরজীবন; রাস্তা থেকে পাঁচ তারকা হোটেল—সর্বত্রই মুখরোচক এ খাবারের বিস্তার
নেপালিদের নাকি মোমো নিয়ে চিন্তার অবকাশ নেই। তারা সব চিন্তা বাদ দিয়ে শুধু মোমো খেতেই থাকে! এ খাবার ঘিরে নেপালের আছে এক সমৃদ্ধ ইতিহাস। তিব্বত, নেপালের কাঠমান্ডু কিংবা বাংলাদেশের ঢাকা—মোমো কিন্তু দুনিয়ার নানা প্রান্তেই বিরাজমান। তবে নেপালের কথা বিশেষভাবে আসার কারণ, দেশটির প্রায় প্রতিটি জায়গায় এর দেখা মেলে। তা ছাড়া নেপালিদের প্রাত্যহিক খাদ্যতালিকায়ও এটি জায়গা করে নিযেছে। এমনও শোনা যায়, কে কতগুলো কিংবা কোথায় মোমো খেয়েছে, তা তাদের রোজকার আলাপের অংশ।
ভারতের উত্তর প্রদেশ এমনকি রাজধানী নয়াদিল্লিতেও শত শত স্ট্রিট ভেন্ডরের দেখা মেলে, যারা মোমো প্রস্তুত ও বিক্রিতে ব্যস্ত। দার্জিলিং থেকে ধর্মশালা—স্ট্রিট ফুড হিসেবে মোমো থাকবেই! কিন্তু এর মূল শিকড় নেপাল কিংবা ভারত নয়, বরং তিব্বত। সেখানকার ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ার অ্যাম্বাসেডর স্যার চার্লস আলফ্রেড বেল ১৯২৮ সালে এ খাবারের উল্লেখ করেন। তিব্বতের পাশাপাশি ভুটান ও সিকিমে দায়িত্ব সামলালেও প্রথমোক্ত দেশটির ভীষণ অনুরাগী ছিলেন তিনি। তাকে তিব্বতবিদ বলা হয়। তার বয়ানে জানা যায়, সেখানকার স্থানীয়রা প্রতিদিন মধ্যাহ্নভোজে ১০-১৫টি করে মোমো খেয়ে থাকে!
একই মোমো স্থানভেদে বিভিন্ন নামে পরিচিত। জাপানিদের কাছে গজা, চীনাদের কাছে জিয়াওজি এবং মধ্য এশিয়ায় মান্তি। তবে রান্নার কৌশল প্রায় অভিন্ন। চালের গুঁড়ার ছোট ছোট ডোয়ের ভেতরে মাংস থাকে, তারপর ভাঁপে সেদ্ধ করা হয়।
প্রশ্ন জাগতে পারে, তিব্বতের পর্বতমালা থেকে কীভাবে এ খাবার নেপাল হয়ে দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল? অনেকে কেন একে নেপালি ফুড হিসেবে গণ্য করে? ইতিহাস বলে, সতেরো শতকে নেওয়ার জাতিগোষ্ঠীর ব্যবসায়ীদের হাত ধরে তিব্বতের লাসা থেকে নেপাল, ভারত এবং বাকি বিশ্বে মোমোর বিস্তার শুরু হয়। সে কালে কাঠমান্ডু উপত্যকার অধিবাসীদের প্রায় অর্ধেকই ছিল নেওয়ার সম্প্রদায়ের; যারা এসেছিল তিব্বত থেকে। মোমোর ইতিহাসের সঙ্গে তাদের হেঁটে ও ঘোড়ায় চড়ে সাহসিকতাপূর্ণ দীর্ঘ অভিযান ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। প্রতিটি সফরে সময় লাগত ১০ থেকে ১২ সপ্তাহ। একই সঙ্গে বিশেষ এক ব্যক্তির নাম নেওয়া চাই। তিনি লক্ষ্মী নরসিংহ মল্ল। ১৬১৭ থেকে ১৬৪১ সাল পর্যন্ত শাসন করেছেন কাঠমান্ডু রাজ্য। সে সময় তিব্বতের সঙ্গে একটি বিশেষ চুক্তি করেন। এর মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় ব্যবসায় প্রসার ঘটে। তখন কাঠমান্ডুতে ব্যবসায়ীদের ৩২টি ট্রেডিং হাউস স্থাপনের অনুমতি, শুল্ক অব্যাহতি, মুদ্রা আদান-প্রদানসহ ব্যাপক ব্যবসায়িক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। তবু বাধা থাকে। কারণ, রাস্তার অভাব, দীর্ঘ কাফেলা এবং দস্যুদের আক্রমণ, যাতে অনেকের জীবন ও ব্যবসায় মারাত্মক ক্ষতি হয়। এ থেকে রেহাই পেতে নেওয়ার সম্প্রদায় কাঠমান্ডুতে বসতি স্থাপন এবং সেখানেই ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে। তা ছাড়া ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধের আগে সিকিমের নাথু লা পাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে প্রাচীন ট্রান্স-হিমালয়ান বাণিজ্যের সমাপ্তি ঘটে। তত দিনে অবশ্য নেওয়ার সংস্কৃতি কাঠমান্ডুর একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে যায়। প্রথম দিকে তারা নিজ নিজ বাসায় মোমো বানিয়ে খেলেও পরবর্তীকালে স্ট্রিট ফুড হিসেবে রাস্তার পাশে বিক্রি শুরু করে।
কাঠমান্ডুর রাস্তার ধারে প্রথম মোমো স্টলের দেখা মেলে ১৯৪২ সালের দিকে। শুরুর দিকে মোমোর চালের গুঁড়ার ডোয়ের ভেতরে তিন ধরনের উপাদান ব্যবহৃত হতো—মাংসের কিমা, আলু ও খুয়া (শুকনো দুধ)। মোমোর পাশাপাশি তারা মাংসের কিমা দিয়ে ভাজা একধরনের ফ্ল্যাট ব্রেডও বিক্রি করত। এসব খাবার ভারতের দিল্লির মজনু কা টিলা এবং কর্ণাটকের বাইলাকুপ্পেসহ বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরেও পরিবেশন করা হতো। সেই ফ্ল্যাট ব্রেড ছিল মোমোর তুলনায় বড় আকারের এবং কম মসলাযুক্ত। তবে সেটির তুলনায় মোমোর ব্যাপক বিস্তার ঘটার নেপথ্যে রয়েছে নেপালি সংস্কৃতির সঙ্গে খাবারটির খুব ভালোভাবে মিশে যাওয়া।
নেওয়ারিরা মোমো তৈরিতে মাংসের কিমা কুচি করত, যা চালের গুঁড়ার ডো দিয়ে তৈরি মোড়কের ভেতরে রেখে, আটকিয়ে সেদ্ধ করা হতো। মোমো পরিবেশনের জন্য টমেটো ও কাঁচা মরিচের মিশ্রণে তৈরি একধরনের চাটনি বানানোর চল ছিল। তা ছাড়া সঙ্গে আইলা নামক চাল দিয়ে তৈরি একধরনের অ্যালকোহল, বিয়ার এবং শিশুদের জন্য ফলের জুস দেওয়া হতো।
নেপাল ও ভারতে রয়েছে মোমো বিক্রির হাজারো রেস্টুরেন্ট ও স্ট্রিট ভেন্ডর। পরিসংখ্যানমতে, কাঠমান্ডুর রাস্তায় এখনো প্রায় প্রতিদিন স্ট্রিট ভেন্ডররা গড়ে ৬ হাজারের বেশি মোমো বিক্রি করেন।
মোমোকে নেওয়ার সম্প্রদায়ের একটি সমৃদ্ধিশালী সংস্কৃতি বলা যায়। মূলত ওই জাতিগোষ্ঠীর ব্যবসায়ীরাই সুস্বাদু এ খাবারকে তিব্বতের লাসার সুউচ্চ ভূমি থেকে কাঠমান্ডুর রাস্তায় বাণিজ্যিকভাবে নিয়ে এসেছিলেন। খাবারটির বিস্তৃতি ঢাকা থেকে নিউইয়র্কের কুইন্স শহর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন পাঁচ তারকা হোটেল, রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে স্ট্রিট ফুড হিসেবে (বিশেষত মোহাম্মদপুরে) এর বিস্তার প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট