বিশেষ ফিচার I পাতে বর্ষপূর্তি
নানা ঘটনায় মুখর ২০২৪ সালের খাদ্যভুবন। সুখবর ও দুর্ঘটনা লেগেই থেকেছে বছরজুড়ে। এ বছর নতুন জাতের আনারস এসেছে ফলের দুনিয়ায়। অন্যদিকে আগুনের ভয়াবহ কবলে পড়েছিল রাজধানীর একটি রেস্তোরাঁ
অল্প শীতে কাবাব কার্নিভ্যাল দিয়ে বেশ ভালোই শুরু হয়েছিল ২০২৪ সাল। ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টে ১১ থেকে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ভোজনরসিকেরা মজেছিলেন পোড়া ব্যঞ্জনের স্বাদে। হোটেলটির সিগনেচার রুফটপ রেস্তোরাঁ গ্রিল অন দ্য স্কাইলাইনে আয়োজিত হয়েছিল বারবিকিউ উৎসব ‘কাবাব কার্নিভ্যাল’। তাতে মেরিনেট মাংস থেকে শুরু করে গ্রিলড ভেজিটেবলসহ নানা পদ ছিল। আমিষপ্রেমী কিংবা নিরামিষাশী—উভয়ের জন্যই ছিল বৈচিত্র্যময় খাদ্যসম্ভার।
অন্যদিকে ফেব্রুয়ারিতে দুবাইয়ের বুর্জ খলিফার কয়েক গজ দূরে অ্যাড্রেস ডাউনটাউন হোটেলের ৬৪তম তলায় আনুষ্ঠানিক যাত্রা করে ‘বার্ডস’ রেস্তোরাঁ। নতুন এই ডিনার অ্যান্ড শো রেস্টুরেন্টে ভোক্তাদের সামনে ব্যালে ড্যান্স ও সার্কাস শোর ব্যবস্থা ছিল।
মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের বেনটন হারবার শহরের এক রেস্তোরাঁ নজর কেড়ে নিয়েছিল ফুড ইন্ডাস্ট্রির। ৩২ দশমিক ৪৩ ডলারের খাবার খেয়ে বিলের সঙ্গে ১০ হাজার ডলার বকশিশ রেখে গেছেন একজন ভোজনরসিক; বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ১২ লাখ টাকা। এমন কাণ্ড দেখে রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ ভেবেছিল, ওই অতিথি বোধ হয় ভুল করে টাকাগুলো ফেলে গেছেন। পরে জানা যায়, তার মৃত বন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই এত টাকা বকশিশ দিয়েছেন তিনি। ওই রেস্তোরাঁর কর্মীরা তা ভাগ করে নেন।
সে মাসেই আমেরিকান ডানপন্থী গোষ্ঠীর প্ল্যাটফর্মে ইসরায়েলকে সমর্থন করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন দুবাইয়ের ভেগান রেস্টুরেন্ট চেইন ‘ওয়াইল্ড অ্যান্ড দ্য মুন’ ও অর্গানিক ক্যাফে ‘কম্পটয়ার ১০২’-এর কো-ফাউন্ডার এমা সকো। শেষে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন তিনি। ১৯ মার্চ নিজ ইনস্টাগ্রামে ভিডিও পোস্ট করে ক্ষমা চেয়ে এমা বলেন, ‘আমি শুধু বলতে চেয়েছিলাম, আমাদের একটি শান্তিপূর্ণ পথ খুঁজে নেওয়া দরকার।’ প্রতিনিয়ত নিরীহ ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুসংখ্যা বাড়ায় সমবেদনা জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশে ওই মাসে রেস্তোরাঁ ব্যবসায় শুদ্ধীকরণে মনোনিবেশ করেছিল রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। ঢাকার অবৈধ ব্যবসা করা রেস্টুরেন্টগুলোর বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়। তা চলে বিভিন্ন এলাকায় তিন শতাধিক রেস্তোরাঁয়। এ সময় ১৪টি ব্র্যান্ডের রেস্টুরেন্ট বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া অগ্নিনিরাপত্তার দুর্বলতায় একটি ভবনে সিলগালা ও পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে আট লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। রেস্তোরাঁ পরিচালনায় ত্রুটি পাওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে ৪৪৪ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত জরিমানা পরিশোধের শর্তে তাদের জামিন দেন।
এপ্রিলে বিশ্বের রেস্তোরাঁ ভুবনে ঘটেছে অপ্রীতিকর এক ঘটনা। সৌদি আরবের রিয়াদে একটি রেস্তোরাঁয় খাবারে বিষক্রিয়ার ঘটনায় ৩৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছিল। এমনকি আক্রান্তদের মধ্যে ২৭ জনকে রাখতে হয়েছিল নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে।
মে মাসে আর্জেন্টাইন ফুটবলার লিওনেল মেসি জোট বাঁধেন মাল্টিন্যাশনাল ব্র্যান্ড পেপসিকোর মালিকানাধীন পটেটো চিপস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লেইসের সঙ্গে। ফুটবলপ্রেমীদের অনেকে জানেন, গোল উদ্যাপনের সময় দর্শকদের ‘ওলে, ওলে, ওলে…’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় গ্যালারি। চলতি বছর সেটিকে ‘ওহ লেইস’-এ রূপান্তর করা হয়। এরই মধ্যে এক বিজ্ঞাপনে মেসিকে দেখা গেছে, খেলা শুরুর আগে চেঞ্জিং রুমে বসে লেইস চিপস খাচ্ছেন। এ সময় তার দলের অন্য এক খেলোয়াড় ‘ওহ লেইস’ আওয়াজ তোলেন। তা পুরো মাঠ, গ্যালারি ও টিভি দর্শকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
জুনে খাদ্যভুবনের নজর গিয়ে পড়ে একটি আনারসের ওপর। যেটির দাম ৪০০ ডলার। আমেরিকান ফুড প্রোডাকশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ডেল মন্টে ফুডস এই বিশেষ জাতের আনারস উৎপন্ন করেছে। লালচে গোলাপি আনারসটির নাম রাখা হয়েছে ‘রুবিগ্লো’। প্রতিষ্ঠানটির অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, চলতি বছর এই প্রজাতির কয়েক হাজার আনারস চাষ হচ্ছে। পরের বছর বীজ সংরক্ষণ করে সীমিতসংখ্যক চাষ হবে। বীজ থেকে ফল হতে রুবিগ্লোর দুই বছরের মতো সময় লাগে বলে জানা গেছে।
খাবার নিয়ে পাগলামিও কম হয়নি এ বছর। জুনে সুশি দিয়ে তারকাদের বেশ কিছু ভাস্কর্য গড়েছেন ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট সাসেক্সের ফুড আর্টিস্ট মিচেল উইবোও। আন্তর্জাতিক সুশি দিবসে লন্ডনের ক্যাসিল্ড আর্ট গ্যালারিতে ওসব ভাস্কর্যের প্রদর্শনী হয়। জানা যায়, সুশি দিয়ে তারকা কণ্ঠশিল্পী এলটন জন, এড শিরান, ফুটবলার হ্যারি কেন, বুকায়ো সাকা প্রমুখের অবয়ব গড়েছেন শিল্পী। প্রতিটি ভাস্কর্য উচ্চতায় ১৮ এবং প্রস্থে ১০ সেন্টিমিটার। সেগুলো বানাতে ১২০ ঘণ্টা সময় লেগেছে মিচেলের। তার ভাষ্য, ‘সুশি তৈরি করতে কী পরিমাণ খাদ্য উপাদানের প্রয়োজন পড়ে এবং সেগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে কারও চুল ও মুখের আদল কীভাবে গড়ে তোলা সম্ভব—এই নিরীক্ষা আমার জন্য ছিল এক দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা।’
পরের মাসে বাংলাদেশের একটি রেস্তোরাঁয় নেমে আসে শোকের ছায়া। অগ্নিকাণ্ডের কবলে পড়ে রাজধানীর ধানমন্ডিতে ফরেস্ট লাউঞ্জ রেস্টুরেন্ট। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট নেমে পড়েছিল। ২৫ জুলাই ভোর ৪টা ৪৫ মিনিটে আগুন লাগার খবর মেলে। সকাল সাড়ে ৬টা নাগাদ তা পুরোপুরি নির্বাপণ সম্ভব হয়। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
সেপ্টেম্বরে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে জিনা কিচেন নামে রেস্তোরাঁ ব্যবসা শুরু করেন সিরীয় শরণার্থী নারী জিনা আববুদ। তার ভাষ্য, ‘রান্নাঘরই আমার রাজ্য’। জিনা সিরিয়ার সবচেয়ে বড় শহর আলেপ্পোর বাসিন্দা। ২০১১ সালে গৃহযুদ্ধ শুরুর দুই বছর পর তিন সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে দেশ ছাড়েন তিনি। শেষে ২০১৫ সালে নেদারল্যান্ডসে পৌঁছান। একপর্যায়ে আমস্টারডামের একটি শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নেন। এরপর স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেন শিবিরের রান্নাঘরে। তিনি এখন শহরটির অন্যতম জনপ্রিয় রন্ধনশিল্পী।
চলতি বছরের অক্টোবরে ঘটে যায় আজব এক ঘটনা। মৃত মায়ের ফ্রিজে ৮৪ বছরের পুরোনো বিস্কুট খুঁজে পান এক সন্তান। ঘটনাটি যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই বিস্কুটের ছবি ভাইরাল হয়। ওই বিস্কুটের সঙ্গে ছিল একটি চিরকুটও। জানা যায়, ১৯৪০ সালের আগস্টে ব্ল্যাঙ্কেনশিপে নিজ বাড়িতে বিস্কুটটি বানিয়েছিলেন মিসেস ড্যারা এল চেম্বারস।
অন্যদিকে নভেম্বরে সুইডেনে কর্মী সংকটে বন্ধ হয়ে যায় বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ। সে দেশের অভিবাসননীতির কারণে বিপাকে পড়েন বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীরা। নতুন কর্মী নিয়োগে জটিলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের। এ কারণে সুইডেনে বাংলাদেশি রেস্তোরাঁর চাহিদা বাড়লেও ব্যবসা রমরমা হচ্ছে না। তাই অনেকে রেস্তোরাঁ বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন। দেশটিতে বাংলাদেশি মালিকানাধীন রেস্তোরাঁর সংখ্যা প্রায় ২০০। যেগুলোর প্রায় সব কটিতেই কাজ করেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
আহমেদ সজিব
ছবি: ইন্টারনেট