পাতে পরিমিতি I অ্যাজমা অ্যাটাক?
শীত মানেই ধুলাবালুর বাড়বাড়ন্ত! তাতে নানাবিধ শ্বাসকষ্টের উঁকিঝুঁকি। বিশেষত অ্যাজমা বা হাঁপানি এ সময় অনেককে বেশ ভোগায়। খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে এ ব্যাধি প্রতিরোধের পরামর্শ রইল পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশির কাছ থেকে
ধুলাবালুর রাজ্যে শ্বাসকষ্ট বা অ্যাজমার সমস্যা খুব কমন। এরই মধ্যে আমাদের দেশে বায়ুদূষণের মাত্রা কেমন, তা কমবেশি সবার জানা। এমনতর দূষণের কারণে নাগরিকদের মধ্যে রেসপিরেটরি বা ফুসফুসের সমস্যাগুলোর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। রেসপিরেটরির যেকোনো সমস্যার প্রাথমিক উপসর্গ হাঁচি-কাশি। সে ক্ষেত্রে অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট নাকি শুধুই হাঁচি-কাশির সমস্যা, তা অনেকে ধরতেই পারেন না। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে আক্রান্তদের কেউ কেউ বেশিক্ষণ হাঁটা-চলা, ব্যায়াম কিংবা যেকোনো শারীরিক পরিশ্রম করার সময় হঠাৎ শ্বাসকষ্টে পড়ে যান। তখন তড়িঘড়ি শরণাপন্ন হন ডাক্তারের। শীতকালে এ সমস্যা বাড়ে প্রায় দ্বিগুণ!
শীতে ফুলের পরাগ শুষ্ক বাতাসে উড়তে থাকে। নিশ্বাসের মাধ্যমে এ ধরনের ছোট ফরেন পার্টিকেল মানবদেহে ঢুকে ঘটাতে পারে অ্যাজমা, অ্যালার্জির মতো ব্যাধি। যাদের এসব ব্যাধির সেনসিটিভিটি থাকে, তাদের কষ্ট বেড়ে যায় কয়েক গুণ। তাই শীতের শুরুতে নেওয়া চাই বাড়তি সতর্কতা।
যেহেতু শীত শুরুর ঠিক আগমুহূর্তেও আমাদের দেশে অনেক গরম থাকে, তাই অনেকে ঠান্ডা পানীয় পান করার অভ্যাস ছাড়তে পারেন না। অথচ যাদের অ্যাজমাজনিত সমস্যা রয়েছে, তাদের জন্য ঠান্ডাজাতীয় খাবার যথেষ্ট ক্ষতির কারণ। তাই অ্যাজমার সমস্যা জানা থাকলে শীতকালে তো বটেই, অন্য কোনো সময়ও খাদ্যতালিকায় ঠান্ডাজাতীয় খাবার রাখা মোটেই বুদ্ধিমানের পরিচায়ক নয়।
যাদের অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট থাকে, তারা কিছু প্রাকৃতিক ঔষধি খাবার গ্রহণ করতে পারেন। বিশেষত শীতের শুরুতে মেডিসিনাল ফুডগুলো রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। সে ক্ষেত্রে সকালের শুরুটা হতে পারে জিনজার টি কিংবা তুলসী টি দিয়ে। প্রতিদিন গরম পানিতে কিছু আদাকুচির সঙ্গে এক চিমটি চা-পাতা দিয়ে ১০ থেকে ১৫ মিনিট ফোটাতে হবে। এরপর কুসুম গরম অবস্থায় এটি গ্রহণ করা গেলে গলা খুসখুস এবং গা মেজমেজে ভাব থেকে অনেকটা রক্ষা মিলবে। এ ছাড়া শ্বাসনালিতে কোনো ব্যাকটেরিয়াল গ্রোথ থাকলে তা ধ্বংস করতেও এ ধরনের ঔষধি খাদ্য উপাদানগুলো উপকারী ভূমিকা রাখে।
অ্যাজমা কমাতে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও মিনারেলসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ জরুরি।
ওমেগা ৩
আমাদের দেহে ওমেগা থ্রি তৈরি হয় না, তাই বাইরে থেকে খাবার গ্রহণের মাধ্যমে নিতে হয়। বিভিন্ন ধরনের মাছ, বীজ, বাদাম ইত্যাদিতে এটি মেলে। খেতে পারেন ফ্ল্যাক্সসিড বা তিসি। এর তেলও ব্যবহার করতে পারেন নানা ডিশে। এ ছাড়া আখরোট, ক্যানোলা অয়েল, টুনা ফিশ, পমফ্রেট ফিশ, স্যামন ফিশ, সার্ডিন ফিশ প্রভৃতি ওমেগা ৩ এর সেরা উৎস। আজকাল অনেকে ওজন কমাতে প্রতিদিন চিয়া সিড গ্রহণ করেন। বাড়তি ওজনের কারণে অ্যাজমা সমস্যা বরাবরই বাড়ে। চিয়া সিড গ্রহণ ওবেসিটির পাশাপাশি অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা রাখে। তাই রাতে ঘুমানোর আগে কিংবা সকালে খালি পেটে এক গ্লাস কুসুম গরম পানির সঙ্গে পান করতে পারেন হানি-লেমন-চিয়া সিড ড্রিংকস।
বিটা ক্যারোটিন
অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণকারী অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের মধ্যে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বিটা ক্যারোটিন বা ভিটামিন এ। লাল, হলুদ ও কমলা রঙের সবজি ও ফলগুলো এর সবচেয়ে ভালো উৎস। প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের কালারফুল ফল দিয়ে মধ্য সকাল কিংবা বিকেলের হালকা নাশতা হিসেবে খেতে পারেন মিক্সড ফ্রুট স্যালাদ।
ম্যাগনেশিয়াম
বারবার মুড সুইং, মাসেল ক্রাম্পিং, উইকনেস, কনভালশনের পাশাপাশি ফুসফুসের নানাবিধ সমস্যার কারণ হতে পারে ম্যাগনেশিয়াম ডেফিসিয়েন্সি। বাড়তি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে না চাইলে প্রাকৃতিক উপায়ে শরীরে ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতি মেটাতে প্রাত্যহিক খাদ্যতালিকায় রাখা চাই অ্যাভোকাডো, টফু, টুনা, সবুজ শাক, বাদাম, বীজ, মটরশুঁটি, পালংশাক, ডার্ক চকলেট ইত্যাদি। এই শীতে সংকুচিত ফুসফুসকে প্রসারিত করতে, শ্বাসকষ্ট বা অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণে ব্যালেন্সড ডায়েট জরুরি। সে ক্ষেত্রে ম্যাগনেশিয়ামসমৃদ্ধ মিক্স নাটস, সিডস, ফ্রুটস দারুণ কার্যকরী। তবে বাদামে কারও অ্যালার্জি থাকলে তা পরিহার্য।
আমাদের দেশে পশ্চিমা দেশগুলোর মতো বছরের অধিকাংশ সময় আবহাওয়া শীতল থাকে না। বলা যায়, গরমে অভ্যস্ততা মাথায় রেখে আমরা সাধারণত নিজেদের লাইফস্টাইল ও ফুড হ্যাবিট সাজাই। তবে শীতের শুরুতে তা পরিবর্তন করে নেওয়া আবশ্যক।
শীতে নানা ধরনের কালারফুল ভেজিটেবল সহজলভ্য থাকে। যারা ফুসফুসের প্রদাহ বা অ্যাজমা সমস্যায় ভুগছেন, তারা ডেইলি ডায়েটে রাখতে পারেন এমন কিছু মৌসুমি সবজি।
টমেটো
শীতকালে তুলনামূলক সস্তা ও সহজলভ্য সবজির মধ্যে টমেটো বেশ এগিয়ে। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানো, ক্যানসার প্রতিরোধ ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণে সাহায্য করার পাশাপাশি ফুসফুসের নানাবিধ সমস্যা সমাধানেও কার্যকরী ভূমিকা রাখে এটি। শীতে পানি গ্রহণের পরিমাণ অনেকের কমে যায়। সে ক্ষেত্রে রেড টমেটো স্যুপ দেখতে যেমন কালারফুল, তেমনি স্বাস্থ্যকর একটি রেসিপি। যাদের অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট রয়েছে, তাদের জন্য টমেটো ও রসুনের মিশ্রণে হালকা কুসুম গরম টমেটো স্যুপ বেশ সুস্বাদু ও হেলদি চয়েস।
পালংশাক
এর মধ্যে রয়েছে দারুণ পুষ্টিগুণ। তাই একে সুপার ফুড বলা হয়। শ্বাসকষ্ট কমাতে ভিটামিন, মিনারেলস, ফাইবার, প্রোটিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর পালংশাক রোজ ডায়েটে রাখা যেতে পারে। এটি সন্ধ্যায় স্যুপ আকারে কিংবা দুপুরে লাঞ্চ হিসেবে যথেষ্ট হেলদি ডায়েট। যাদের ওজন বেশি থাকার কারণে অ্যাজমার সমস্যা বাড়ে, তারা ওয়েট লসের পাশাপাশি শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার সমাধানেও এই শাক রাখতে পারেন খাদ্যতালিকায়।
বাঁধাকপি
শীতকালে সহজলভ্য এই সবজি স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনায় অসাধারণ। অ্যাজমা সমস্যা নিয়ন্ত্রণে বাঁধাকপিতে থাকা পুষ্টি উপাদানগুলো বেশ উপকারী ভূমিকা রাখে। ভিটামিন কে, ভিটামিন সি, ফোলেট, ম্যাঙ্গানিজ, ভিটামিন বি, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়ামে ভরপুর হওয়ায় এটি আমাদের ফুসফুসের প্রদাহ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
এ ছাড়া অ্যাজমা সমস্যা নিয়ন্ত্রণে খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন কিছু হোম-রেমিডি।
রসুন
হাঁপানির সমস্যা প্রতিরোধে এটি প্রাকৃতিক প্রতিকার হিসেবে কাজ করে। এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ফুসফুসের ব্লক দূর করতে সাহায্য করে এবং শ্বাসনালির প্রদাহ কমায়। তাই দুই কোয়া রসুনের সঙ্গে মধু মিশিয়ে সকালে খালি পেটে খেতে পারেন সপ্তাহে দুই বা তিন দিন।
কালোজিরা
বলা হয়, সকল রোগ নিরাময়ের জন্যই কালোজিরা উপকারী আর অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণে সেই আদিকাল থেকেই এর ব্যবহার হয়ে আসছে। হাঁচি-কাশি, অ্যাজমা বা ফুসফুসের নানাবিধ সমস্যায় যারা ভুগছেন, তারা খাদ্যতালিকায় অল্প পরিমাণ কালোজিরা ব্যবহার করতে পারেন। এটি খাওয়া সম্ভব ভর্তা হিসেবে, অথবা সকালে এক চিমটি কালোজিরা মধুর সঙ্গে মিশিয়ে সরাসরি খেতে পারেন।
অ্যাজমা সমস্যা কমাতে মনে রাখা চাই, অ্যালার্জিটিক কোনো ইস্যু থাকলে এ সমস্যা আরও বেড়ে যায়। তাই কোনো নির্দিষ্ট খাবারে অ্যালার্জি থাকলে সেটি বাদ দিতে হবে। অনেক সময় হাঁসের ডিম, হাঁসের মাংস, গরুর দুধ প্রভৃতি এলার্জি বাড়াতে ট্রিগার করে। তাই খাদ্যতালিকা থেকে এ ধরনের খাবার বাদ দেওয়াই শ্রেয়। অন্যদিকে, অ্যাজমা সমস্যা থাকলে পান করতে পারেন ছাগলের দুধ। শীতকালে ঘুমানোর আগে এক কাপ চিনি ছাড়া গোট মিল্ক গ্রহণ করলে উপকার মিলবে। তবে মনে রাখা চাই, অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণে ডায়েট ও মেডিসিন—দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই শীতে রোগটি নিয়ন্ত্রণে মেডিসিন বা ডায়েট কী হবে, তা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে গ্রহণ করাই মঙ্গল।
লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট