প্রাগৈতিহাসিক I মায়া মিস্ট্রি
সময়কাল নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতবিরোধ থাকলেও অনেকের মতে মায়া সভ্যতার সূচনা ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ কিংবা তারও আগে। এর সমাপ্তি নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। কারও কারও মতে, ১৬৯৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এর বিনাশ ঘটে। অবস্থান ছিল মধ্য আমেরিকায়। বর্তমানের গুয়াতেমালা, বেলিজ, এল সালভাদর ও হন্ডুরাসের পশ্চিম অঞ্চল এবং মেক্সিকোর কিছু শহরে। কেমন ছিল এই সভ্যতার খাদ্যাভ্যাস?
মায়া জনগোষ্ঠী ছিল দক্ষ শিকারি ও কৃষক। প্রকৃতপক্ষে, মায়া মতবাদ অনুসারে, এই জনগোষ্ঠীকে ‘ম্যান অব দ্য কর্ন’ বলা হতো। কারণ, তাদের বিশ্বাস ছিল, দেবতারা প্রথম মানবের দেহে খাদ্যশস্য কর্ন বা ভুট্টা ব্যবহার করেছিলেন। জেনে রাখা ভালো, মায়া খাবারের জন্য পাঁচটি মৌলিক উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ছিল—শস্যদানা, ভুট্টা, কোকোয়া, স্কোয়াশ (একধরনের ফল) ও মরিচ।
মায়ারা পাখি থেকে হরিণ, এমনকি বানর ও মাছ পর্যন্ত শিকার করত। ব্রেকিং দ্য মায়ান কোড (২০০৮), দ্য ফাউন্টেন (২০০৬), দ্য কার্স অব দ্য মায়াস/সিবালবা (২০১৭), দ্য রুইন্স (২০০৮), ইক্সকনুল (২০১৫), ইভেন দ্য রেইন (২০১১), কিংস অব দ্য সান (১৯৬৩) সিনেমাগুলো দেখা থাকলে তাদের জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে অনুমান করা সহজ হতে পারে।
যোদ্ধার খাদ্যরহস্য
মায়াদের নিয়ে হাজারো উদ্ভট তথ্য রয়েছে। যেমন তারা অদৃশ্য হয়ে যেত, স্বভাবগতভাবে নির্মম কিংবা আদতে ছিল অ্যালিয়েন! তবে সঠিক পরিচয় শনাক্তে তাদের খাদ্যাভ্যাস রাখতে পারে সহায়ক ভূমিকা।
প্রথমে বলা চাই গুয়াকামোলের কথা। মায়া সভ্যতায় খাবারটির বেশ জনপ্রিয়তা ছিল। একে এর মসৃণ টেক্সচার ও সুস্বাদু ঘ্রাণের জন্য ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করা হতো। আজকাল স্প্যানিশ উপাদান ও বর্তমান মেক্সিকান ফুডের মধ্যে সমন্বয় করে এমন কিছু খাবার তৈরি করা হয়, যাতে মায়া সভ্যতার খাবারের শৈল্পিকতা ফুটে ওঠে। টোস্টাডাস (টোস্ট), টাকোস ডুরাডোজ (টাকো), নাচোস, আলু, হ্যামবার্গার, টর্টিলাস, কোয়েসাডিলাসের মতো খাবারে আপনি গুয়াকামোলের পরশ খুঁজে পেতে পারেন।
দ্বিতীয়ত, কোকোয়া নিয়ে কথা বলতেই হবে! মেক্সিকোতে এর একটি সহস্রাব্দ পুরোনো ঐতিহ্য রয়েছে এবং এই সুস্বাদু খাবারের যোগসূত্র এসেছিল মায়াদের কাছ থেকে। কোকোয়া গাছের আদিনিবাস যে অঞ্চলে, সেখানে একদা মায়া সভ্যতার রাজত্ব ছিল। কোকোয়ার আছে একটি জোরালো ধর্মীয় প্রেক্ষাপট। বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহারের এবং মুদ্রায় এর ছবি মুদ্রণের চল ছিল। ষোলো শতকে যখন স্প্যানিয়ার্ডরা এই ভূখণ্ডে আসে, তারা কোকোয়ার পানীয় (চকলেটের আদি রূপ) পান করে এর জাদুকরি স্বাদের প্রেমে পড়ে যায়। দুধ ও চিনি যোগ করে পানীয়টিকে আরও সুস্বাদুও করে তোলে। সেসব অঞ্চলে তেজতে, পোজল, চকলেট উইদ পেপার, চম্পারদের অতোলে, আল্টলাকুয়েতজালি, টল্যাস্কালাতের মতো জনপ্রিয় পানীয়তে কোকোয়ার ব্যবহার ঘটে।
5সবশেষে বলা যায় বীজ ও ভুট্টাজাতীয় খাদ্যশস্যগুলোর কথা। হাতে প্রক্রিয়াজাত কর্র্ন টর্টিলা আদিবাসী মায়াদের কাছে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। কেননা, ভুট্টা ছিল তাদের প্রায় সকল খাবারের ভিত্তি। এই খাদ্যশস্য সব মেক্সিকান গ্যাস্ট্রোনমির রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু, যে কারণে এটি প্রাচীনকাল থেকেই অনন্য। সেই থেকে মেক্সিকোতে যারা মাংস খুব একটা পছন্দ করতেন না, তাদের পাতে এই সমৃদ্ধ বিকল্প থাকত। আজকাল দেশটিতে ঘরে তৈরি খাবারে কখনোই টর্টিলাস ও বিনের অভাব পড়ে না। ফন্দিতা (মেক্সিকোর যে স্পটে স্থানীয় খাবার মেলে) বা মেক্সিকোর ঐতিহ্যবাহী ঘরোয়া স্পর্শ রয়েছে, এমন সব বাড়িতে এ ধরনের খাবার আস্বাদনের অনুভূতি নিঃসন্দেহে অন্য রকম! স্যুপ, হুয়ারাচেস, তলাকোয়োস, তলায়ুদা, টাকোস দ্য গিসাদো (স্টু টাকোস), টাকোস ডোরাডোসের (গোল্ডেন বা ফ্রাইড টাকোস) মতো খাবার বিন ও কর্ন ছাড়া চিন্তাও করা যায় না।
শক্তিরহস্যে খাদ্যযোগ
মায়া সভ্যতার লোকেরা কিসের মাংস খেত, তা নিয়ে বিভিন্ন তত্ত্ব ও তথ্য প্রচলিত আছে। উল্লিখিত উপাদানগুলোর মধ্যে কিছু এখনো মেক্সিকোতে বেশ জনপ্রিয়। বিভিন্ন ধরনের পতঙ্গ তারা প্রোটিনের অংশ হিসেবে খেত। চায়া, আতোল এবং পোজলও তাদের খাদ্যের অংশ ছিল। ‘অ্যাপোক্যালিপ্টো’ যারা দেখেছেন, তাদের অনেকের হয়তো জানা, মুভিটিতে পরিচালক মেল গিবসন বিভিন্ন প্রাক্-হিস্পানিক সংস্কৃতিকে মিশ্রিত করেছেন। মানুষ বলিদানের রেওয়াজ তিনি কোন সংস্কৃতি থেকে নিয়েছেন, তা বিভ্রান্তিকর। ঘাবড়ে যাবেন না, আজকাল ক্ল্যাসিক মায়া মেক্সিকান খাবারে নরমাংস ভক্ষণের মতো কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই! নতুন স্পেন যুগের স্প্যানিশ ইতিহাসবিদ ও নৃতাত্ত্বিক বার্নার্দিনো দি সাহাগুন তার ষোলো শতকের বই ‘হিস্টোরিয়া জেনারেল দ্য লাস কোসাস দে নুয়েভা এস্পানা’য় (‘ফ্লোরেন্টাইন কোডেক্স: জেনারেল হিস্ট্রি অব দ্য থিংস নিউ স্পেন’) প্রাচীন মেক্সিকানদের জন্য খাবারকে পবিত্র বিষয় হিসেবে অভিহিত করেছেন, যা মানুষকে একটি ভিন্ন সত্তা দিয়েছে। সেখানে বলা আছে, ‘কারণ, এটি (অর্থাৎ খাদ্য) আমাদের অস্তিত্ব; কারণ, এটি আমাদের জীবন; কারণ, এটি হাঁটে; কারণ, এটি চলে; কারণ, এটি সুখী; কারণ, এটি হাসে; কারণ, এটি বেঁচে থাকে।’ আরও লেখা হয়, ‘খাদ্য পৃথিবীতে সবকিছুকে জীবন্ত রাখে। এটির মাধ্যমে বিশ্ব জীবিত। (এটির মাধ্যমে) আমরা বিশ্বকে পূর্ণ করছি। খাদ্যকে ঘিরেই আমাদের সব আশা।’
পৌরাণিক কাহিনি ও মায়া খাবার
মায়ারা বিশ্বাস করত, দেবতারা পৃথিবীতে কাকোয়া পাঠিয়েছিলেন মানবজাতির জন্য বিরাট আশীর্বাদ হিসেবে। আজটেক ও মায়া দেবতা কেটজালকোয়াটল (বিভিন্ন গবেষকের মতে মায়া পুরাণের সর্পদেবতা কুকুলকান) মানুষকে ভুট্টা চাষ করতে শিখিয়েছিলেন; অন্যদিকে অন্যান্য দেবতা যেমন ওপোচৎলি (মেক্সিকান পুরাণে আজটেক প্যান্থিয়নের দেবতা) শিখিয়েছিলেন মাছ ধরার শিল্প।
রাত, জাদুবিদ্যা, রাজা ও যোদ্ধাসম্পর্কিত দেবতা টেজকাটলিপোকার মতো কেটজালকোয়াটল নরবলির অনুরাগী ছিলেন না। তাই টেজকাটলিপোকা ক্রুদ্ধ হয়ে কেটজালকোয়াটলকে ধ্বংস করতে একটি মাকড়সার জাল ব্যবহার করে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নেমে আসেন। বৃদ্ধের ছদ্মবেশে হাজির হয়ে তিনি কেটজালকোয়াটলকে অমরত্বের পানীয় সরবরাহ করেছিলেন, কিন্তু সেটি ছিল পুলকে নামক একটি নেশাজাতীয় পানীয়। এর প্রভাবে কেটজালকোয়াটল হযবরল পরিস্থিতি তৈরি করেন। জনগণ তাকে তিরস্কার করলে তা তিনি মেনে নিতে পারেননি। ফলে নির্বাসনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কথা দেন আবারও ফেরার।
দীর্ঘকাল পরে তিনি ইউকাটান উপদ্বীপে ফিরে আসেন, যেখানে মায়ারা বাস করত। ফলে মায়া জনগোষ্ঠী কুকুলকান পূজা শুরু করে। বহু বছর পরে বলা হয়, মেক্সিকা (ঐতিহ্যগত ইতিহাস গ্রন্থে আজটেক) হার্নান কর্টেসকে কেটজালকোয়াটল (মেক্সিকোর বিজয়ী) ভেবে ভুল করেছিল, যিনি কোনো একদিন ফিরে আসার শপথ করেছিলেন। বাকি ইতিহাস অনুমেয় বটে!
অন্যান্য গল্প
প্রাচীন গ্রন্থ ‘পপল ভু’তে বলা হয়েছে, মায়া পাতালপুরী জিবালবার অবস্থান ছিল যেখানে, তার ওপরের স্তরে বল খেলছিল যমজ ভাই হুনাহপু ও ইক্সবালঙ্ক। জিবালবার দেবতারা তাদের বিভিন্ন বিপজ্জনক পরীক্ষার চ্যালেঞ্জ জানান। তাতে তারা হেরে গেলেও দেবতাদের অধীনস্থ রাক্ষসেরা জানত না, ভ্রাতৃদ্বয়কে কীভাবে হত্যা করতে হবে। তাই তারা তাদেরকে আগুনে পুড়িয়ে, হাড়ের ধ্বংসাবশেষ সমুদ্রে ফেলে দেয়। তারা অবশ্য ভাবতে পারেনি, মাছ হয়ে এই যমজ পুনর্জন্ম নিয়ে মানুষে রূপান্তরিত হবে। পরবর্তীকালে এই দুই ভাই নানা অলৌকিক ঘটনার জন্ম দেয়; সেগুলোর মধ্যে ছিল প্রতিশোধ হিসেবে জিবালবার দেবতাদের হত্যা করা। এরপর দেবতা ও রাক্ষসদের হাতে নিহত বাবার দেহাবশেষ উদ্ধার এবং তাকে পুনর্জীবিত করে। শুধু তা-ই নয়, বাবাকে ভুট্টার তরুণ দেবতায় পরিণত করে তারা, যার পুনরুত্থান ঘটে মাটি ভেদ করে।
এই পৌরাণিক কাহিনি ভুট্টার মাহাত্ম্য প্রকাশ করে। এটি প্রথমে মাটির নিচ বা পাতালপুরী হয়ে পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়। তারপর জীবন সঞ্চারিত হয়ে অঙ্কুরিত এবং উদ্ভিদ হিসেবে বেড়ে ওঠে। স্বভাবতই পৌরাণিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ এখনো মেক্সিকান গ্যাস্ট্রোনমিতে বিরাজমান। হতে পারে এই ইতিহাস পাঠের পর আপনি যখন ভুট্টা খাবেন, মনের অজান্তেই নিজেকে মায়াদেবতা বা যোদ্ধা হিসেবে ভাবতে থাকবেন!
মায়া খাবারের ঐতিহ্য
ইউকাটানের রোমান ক্যাথলিক আর্চডায়োসিসের প্যানিশ ফ্রান্সিসকান বিশপ দিয়েগো দি লানদা ১৫৬৬ সালের দিকে লেখা তার ‘রিলেসিওন দে লাস কোসাস দে ইউকাটান’ (সরল ইংরেজিতে, ‘রিলেশনশিপ অব দ্য থিংস অব ইউকাটান’) বইয়ে প্রাচীন মেক্সিকানদের জন্য ভুট্টা কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেটির নেপথ্যের একটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া তার লেখার কিছু অংশ রুশ ভাষাবিদ ও এপিগ্রাফার ইউরি নোরোজভকে মায়া সংস্কৃতির লিখনপদ্ধতির রহস্য উদ্ধারে সহায়তা করেছিল। বলাই যায়, মায়া খাবার মানেই দেবতাদের খাবারের সঙ্গে একটি বিশেষ সংযোগ।
প্রকৃতপক্ষে, বিস্ময়কর ও অনন্য গ্যাস্ট্রোনমির জন্য মেক্সিকোকে প্রাক্-হিস্পানিক শিকড় হিসেবে গণ্য করা হয়। দেশটির মায়া জঙ্গলে এখনো এমন কিছু মানুষের বাস রয়েছে, যারা মায়া জাতিগোষ্ঠীর সরাসরি বংশধর। এখনো তারা পূর্বপুরুষদের মতো খাবার তৈরি করেন। যেমন কোচিনিতা পিবিল এমন একটি জনপ্রিয় খাবার, যার রয়েছে দুর্দান্ত ইতিহাস!
মায়া রন্ধনপ্রণালিও সবার জন্য একটি টেকসই জীবনযাপনের বিকল্প। এর উপাদান ও প্রস্তুতির পদ্ধতিগুলো সেই আগের মতো এখনো স্বাস্থ্যসম্মত। মেক্সিকান স্টেট কুইন্টানা রু-এর ছোট ভিলা থেকে শুরু করে বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ পর্যন্ত, মাদার নেচারের সামনে বসে মানুষ অথেনটিক এসব খাবার উপভোগ করেন। আধুনিক ইউকাটান খাবার আসলে মায়া খাবার। মেক্সিকোর দক্ষিণে, সবচেয়ে মুখরোচক যেসব অতীত ও বর্তমান খাবারের দেখা মেলে, সেগুলোর স্বাদ যেন জাদুকরি।
মায়া সভ্যতার ইতিহাস ও সংস্কৃতির স্বাদ গ্রহণ করতে অনুভব শক্তি খুব গুরুত্বপূর্ণ। সময়ের মধ্য দিয়ে ভ্রমণের অংশ হতে পারবেন তাহলে! আপনি কি কখনো ইউকাটান ভ্রমণ করেছেন এবং অনস্কিবিল বুউল ইয়েটেল মাকাল (বিন পিপিয়ান উইদ ইয়াম) খেয়েছেন? ইতিহাস জেনে এসব খাবার খেলে এবং মনে যোদ্ধার অনুভূতি খেলা করলে ভাবতেই পারেন, মায়া সভ্যতার খাদ্যসম্ভার আপনার অপেক্ষায় এখনো!
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি ও চিত্রকর্ম: ইন্টারনেট