মনোজাল I বিউটি বার্নআউট
সৌন্দর্যশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের জন্য গুরুতর সমস্যা। হেলাফেলার ফল দীর্ঘস্থায়ী। সুখকর নয় একেবারেই
বার্নআউট শব্দটির আক্ষরিক বাংলা অর্থ পুড়িয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা বা জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে যাওয়া। শব্দগত এই অর্থের সঙ্গে এর সত্যিকার অর্থের যে খুব একটা অমিল রয়েছে, তা নয়। আসলে দীর্ঘ সময় একটানা কাজের চাপে শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তির চূড়ান্ত অবস্থা বোঝাতে এটি ব্যবহৃত হয়। সুতরাং মিল আছে।
এই বার্নআউট হতে পারে যেকোনো পেশাতেই। তবে সেবা প্রদানযুক্ত কাজগুলোতে এর ব্যবহার বেশি; বিশেষ করে সৌন্দর্যশিল্পে, যেখানে দীর্ঘ সময় ধরে ক্লায়েন্টদের নানামুখী চাহিদা আর উচ্চ প্রত্যাশা পূরণের প্রেশারে বিউটি স্পেশালিস্ট বা প্রফেশনাল বিউটিশিয়ানদের বার্নআউট হয়। কারণ, প্রায়ই নিখুঁত সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে তারা নিজেদের সুস্থতাকে উপেক্ষা করেন, ফলে তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর এই ক্ষতিকর বার্নআউটের প্রভাব পড়ে। যার লক্ষণ ও উপসর্গ বিভিন্ন উপায়ে প্রকাশ পায়। যেমন পর্যাপ্ত বিশ্রাম বা ঘুমের পরেও শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্তিবোধ করা। ফলে তারা কাজের অনুপ্রেরণা হারিয়ে ফেলতে পারেন কিংবা আগ্রহের কমতি অনুভব করেন। এতে তাদের কাজের উৎপাদনশীলতা কমে যায়; বিরক্তি, মেজাজ পরিবর্তন, এমনকি সুস্থ সম্পর্ক বজায় রাখতেও অসুবিধা হয়। কখনো কখনো এ উপসর্গগুলো আরও গুরুতর হতে পারে। যেমন দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তিবোধ, কাজের প্রতি পুরোপুরি অনীহা এবং পেশাদার কার্যকারিতা কমার আশঙ্কা পর্যন্ত।
বোঝাই যাচ্ছে, সমস্যাটি জটিল। সমাধানের জন্য প্রথমে জানা চাই, সৌন্দর্যশিল্পে এ বার্নআউটের কারণ কী। উত্তর ঠিক এককথায় দেওয়া সম্ভব নয়, তবে একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে ক্লায়েন্টদের পাহাড়সম চাহিদা পূরণের চেষ্টা। দেখা যায় বেশির ভাগ ক্লায়েন্টের এমন উচ্চ প্রত্যাশা থাকে, তাদেরকে কোনো কিছুতেই সন্তুষ্ট করা যায় না বললেই চলে। এমন ক্লায়েন্টদের সামলানো সৌন্দর্য পেশাদারদের জন্য চাপের একটি ধ্রুবক উৎস তৈরি করে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তা ছাড়া দীর্ঘ কাজের সময় এবং অনিয়মিত সময়সূচিও একটি কারণ। বিউটিশিয়ানরা প্রায়ই অনেক রাত পর্যন্ত জেগে কাজ করেন, ছুটির দিনগুলোতেও বিশ্রামের সুযোগ পান না। সবচেয়ে বড় কথা, স্ব-যত্ন বা ব্যক্তিগত বিনোদনের জন্যও তাদের পর্যাপ্ত সময় মেলে না। কর্মজীবনের ভারসাম্যের এই অভাব তাদের সামগ্রিক সুস্থতার অবনতি ঘটায়। একটি দীর্ঘ ক্লান্তিকর সপ্তাহ শেষে শরীর-মন বিশ্রাম না পেলে বার্নআউট হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। যার প্রভাব সৌন্দর্য পেশাদারদের ওপর তো পড়েই, পাশাপাশি এ শিল্পকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বার্নআউট শুধু সৌন্দর্য পেশাদারদের শারীরিক-মানসিক সুস্থতাকে প্রভাবিত করে না; বরং তাদের দেওয়া সেবার মানেও প্রভাব ফেলে। একজন বিউটি থেরাপিস্ট যখন তার কাজ নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েন কিংবা নিজের সৃষ্টিশীলতায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন, তখন ক্লায়েন্টরা তার কাছে যে মানের যত্ন ও মনোযোগ আশা করেন, তা সরবরাহ করা রীতিমতো কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে এই অবস্থা গ্রাহকের সন্তুষ্টি কমার কারণ হয়ে উঠতে পারে এবং স্বাভাবিকভাবে থেরাপিস্ট বা সেলুনের সুনামকেও সম্ভাব্য ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয়।
কেবল সেবার মানের ওপর প্রভাব নয়, বার্নআউট ব্যক্তি স্বাস্থ্যের জন্যও গুরুতর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী চাপ ও ক্লান্তি রোগ প্রতিরোধক্ষমতাকে দুর্বল করে তোলে। সৌন্দর্যপেশায় ক্রিয়েটিভিটি সবচেয়ে বড় ব্যাপার। একজন পেশাদার বিউটিশিয়ান যখন সেই জায়গাতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন, তখন তার মানসিক স্বাস্থ্য স্বাভাবিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এটি প্রতিরোধের জন্য কী করা? সমস্যা জটিল হলেও সমাধান কিন্তু সহজ।
সীমানা নির্ধারণ
কাজ ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে স্পষ্ট সীমারেখা টেনে দিতে হবে। অতিরিক্ত কাজের চাপ এড়িয়ে চলা চাই। প্রয়োজনে ‘না’ বলা জানতে হবে। সৌন্দর্যসেবার পেশার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের মনে রাখা চাই, এটি একটি আর্ট। ক্লান্তি, বিরক্তি বা অনুৎসাহ যেটিকে একেবারে নিঃশেষ করে ফেলতে পারে।
স্ব-যত্ন
নিজেকে সময় দিতে হবে। কাজের চাপে প্রিয় শখগুলো ভুলে যাওয়া চলবে না। নিয়মিত ব্যায়াম, ইয়োগা করা যেতে পারে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে কিছুক্ষণ বিরতি বা ডিপ ব্রিদিং এক্সারসাইজের মতো মননশীল কৌশল অনুশীলন করা যেতে পারে। কেবল অবসর সময়ে নয়, কাজের ফাঁকে ফাঁকেও এ প্র্যাকটিসগুলো অব্যাহত থাকলে ভালো।
সহযোগিতায় স্বস্তি
কাজ বেশি হয়ে গেলে সেগুলো অন্য কারও সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া বা প্রয়োজনে সহায়তা চাইতে দ্বিধাবোধ করা যাবে না। সুনামের জন্য নিজেই সবকিছু করতে হবে—এই প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন। কীভাবে নিজেকে ও কাজকে ব্যালেন্স করা যেতে পারে, সেটি মেইনটেইন করার জন্য প্রয়োজনে প্রফেশনালের দ্বারস্থ হওয়া যায়।
সময় ব্যবস্থাপনা
গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবসম্মত সময়সূচি তৈরি করা চাই। ‘আমি পারব’ বা ‘সময় ম্যানেজ হয়ে যাবে’—ব্যাপারটি মাথায় না রেখে বরং কীভাবে হেসে খেলে সবকিছু করা সম্ভব হয়, তার জন্য প্রয়োজনীয় যা কিছু করা যায়, তা করতে হবে। বিশ্রাম না নিয়ে কাজে দেরি করা এড়িয়ে চলা চাই; কারণ, এতে কাজের ক্ষতিই বেশি হবে।
শিক্ষা ও দক্ষতার বিকাশ
নিত্যনতুন বিউটি ট্রেন্ড ও কৌশলগুলো সম্পর্কে আপডেটেড থাকা চাই। তবে অতিরিক্ত জ্ঞানে নিজেকে জ্ঞানী করা থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়! ক্লায়েন্ট ও কাজের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক দক্ষতা—এমন বিষয়ে অর্জনের ওপর ফোকাস করাই যথেষ্ট। কিছু সময় কাজ থেকে পুরোপুরি ছুটি দেওয়া যায় নিজেকে। বিউটিশিয়ানদের ছুটি নেই—এই আপ্তবাক্য থেকে বেরিয়ে মনে রাখা শ্রেয়, কাজের উন্নতির প্রয়োজনেই সেই ছুটির সময়টা বের করে নেওয়া জরুরি।
স্ব-যত্ন অনুশীলন
প্রত্যেক পেশাদার বিউটিশিয়ানের উচিত তার দৈনন্দিন রুটিনে কয়েকটি স্ব-যত্ন অনুশীলন অন্তর্ভুক্ত করা। যেমন প্রতি রাতে পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম। পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ। পর্যাপ্ত পানি পান। শক্তির জন্য ক্যাফেইন বা চিনিযুক্ত পানীয়ের ওপর নির্ভর করা যাবে না একদমই। এতে ভালোর চেয়ে ক্ষতির ঝুঁকিই বেশি। মানসিক চাপ কমাতে এবং মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মমাফিক ব্যায়াম করা যেতে পারে। সেটি যোগব্যায়াম, দৌড়ানো বা নাচ—যা-ই হোক না কেন। স্ট্রেস কমাতে ডিপ ব্রিদিং এক্সারসাইজ, একাগ্র মনে ধ্যান বা উষ্ণ পানিতে গোসল—এগুলো কিন্তু বেশ কার্যকর।
সামাজিক সমর্থন
সৌন্দর্যশিল্প ভালোবাসেন, বোঝেন বা কাজটিকে সম্মান করেন এমন বন্ধু, পরিবার বা সহকর্মীদের একটি সহায়ক নেটওয়ার্কের সঙ্গে জড়িত থাকা যেতে পারে। ফেসবুক গ্রুপ এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বার্নআউট প্রতিরোধের জন্য সমর্থন সব সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ।
রত্না রহিমা
ছবি: পারসোনার সৌজন্যে