বিশেষ ফিচার I সালতামামি ২০২৪
বহুজাতিক গবেষণা ও জরিপকারী প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টার তথ্যমতে, বছর শেষে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন বাজারের আকার হবে প্রায় ৮০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; যার বড় অংশ আসবে চীন থেকে। ম্যাক্সিমালিজম ছাড়া আরও কী কী নিয়ে বছরজুড়ে মেতে ছিল ফ্যাশনবিশ্ব, তারই খোঁজ
ফ্যাশন মার্কেটের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছিল টেকসই তত্ত্ব, প্রযুক্তি, সাপ্লাই চেইন, জিও পলিটিকস আর মুদ্রাস্ফীতি। এসবকে সঙ্গে নিয়ে চলতি বছরটি প্রায় পার করেছে এই বিজনেস সেক্টর, ফ্যাশন; যা এখন মোটামুটি মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্তর্ভুক্ত। পোশাক মানুষের চাই-ই চাই। আবার কারও কারও কাছে নিয়মিত ক্লদিং আইটেম কেনা শখও বটে। ২০২৪ সালে প্রোডাক্ট লাইনে বড়সড় চমক না এলেও ছোট ছোট সংযুক্তি দেখা গেছে। রং, নকশা, মোটিফে বাহুল্য বর্জনের তাগিদ ছিল না; বরং ড্রামাটিক ডিজাইনের প্রতি আগ্রহী হতে দেখা গেছে বেশি। ফ্যাশন বলতে যে শুধু পোশাকই একমাত্র উপাদান, তা-ও নয়। অনুষঙ্গও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এ বছর সামান্যে সন্তুষ্ট হওয়ার প্রবণতা কমেছে; বরং প্রকাশের চূড়ান্তে ছিল ফ্যাশনিস্তাদের অবস্থান।
ম্যাক্সিমালিজম ম্যাডনেস
মিনিমালিজম রাজত্ব করেছে দীর্ঘদিন। সে সময় অতিরঞ্জনে অনাগ্রহ দেখা গেছে ফ্যাশনের সব ক্ষেত্রে। এই দর্শনের পট পরিবর্তন হয়েছে এ বছর। ম্যাক্সিমালিজম এসেছে জৌলুশ নিয়ে। প্রতিপাদ্য মোর ইজ মোর। বাহুল্য বর্জনে টানা হয়েছে যতি চিহ্ন। বরং উজ্জ্বল রং আর বড়সড় মোটিফ, প্যাটার্নের যুগপৎ সন্ধি নজর কেড়েছে। পুরোপুরি মিনিমালিজমের কাউন্টার মুভমেন্ট। উৎসবের তো বটেই; দৈনন্দিন পোশাকও মুখর ছিল ম্যাক্সিমালিজমে।
সাসটেইনেবলে মনোযোগ
টেকসই তত্ত্বের জোর যোগাযোগের খোঁজ পাওয়া যায় মিনিমালিস্টিক ফ্যাশনের সঙ্গে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে ম্যাক্সিমালিজম সাসটেইনেবল ফ্যাশনের প্রতিপক্ষ। একই সূত্র মেনে ধারণ করা যেতে পারে ম্যাক্সিমালিজম। বিশ্বজুড়ে ফ্যাশন আইটেমের ক্রেতার তালিকা এখন প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত—মিলেনিয়াল ও জেনারেশন জেড। এই দুই প্রজন্মই টেকসই ফ্যাশনের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছে। রিসাইক্লিং, থ্রিফটিং, প্রি-লাভড থিওরি জনপ্রিয় হয়েছে তাদের হাত ধরে।
জেনারেশন জেডের দর্শন
ভীষণ আলোচিত ছিল জেনারেশন জেডদের ফ্যাশন। কারণ, তারা শুধু রং আর কাটিং দেখে নয়; বরং নানান রকম যুক্তিতে যাচাই-বাছাই করে তবেই নেন সিদ্ধান্ত। এর মধ্যে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ, পানি ব্যবহারে সচেতনতা, মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা, অ্যানিমেল টেস্টিং করা হয় কি না, উৎপাদনে ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি, অ্যানিমেল টেস্টিংয়ের বিষয়ে মতামত, টেকসই তত্ত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যের পরিমাণ গুরুত্ব পায়। এসব ভেবে কেনাকাটা সম্পন্ন করে বলে ফ্যাশনে টেকসই তত্ত্বের প্রভাব অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে গোটা ফ্যাশনবিশ্বে। নয়তো ক্রেতা হিসেবে জেনজিদের হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা বাড়ে।
ফ্যাশন অ্যাসথেটিক
যা তৈরি হয় একাধিক এলিমেন্টের সহাবস্থানে। একটির সঙ্গে অন্যটির ভারসাম্য, অনুপাত ও সাদৃশ্য এখানে গুরুত্বপূর্ণ। আবার রং, টেক্সচার, রেখার ব্যবহার, পোশাক-অনুষঙ্গ-মোটিফের আকৃতিও তাৎপর্যপূর্ণ। ফ্যাশন অ্যাসথেটিক মূলত একটি দর্শন এবং এটি সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। চিরদিন টিকে থাকার মতো কোনো কথা এখানে দেওয়া নেই; বরং পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তন দ্রুত হতে পারে, আবার অনেক ক্ষেত্রে ধীর।
কালার অব দ্য ইয়ার
বছরের শুরুতেই প্যান্টনের নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হয় কালার অব দ্য ইয়ার। ২০২৪ সালের কালার হিসেবে জায়গা করে নিয়েছিল পিচ ফাজ। সাম্যতা, সহমর্মিতা আর সম্পর্কের বাঁধনের প্রত্যয় ছিল শেড ১৩-১০২৩ তে। ঠিক গোলাপি নয়, আবার কমলাও নয় এটি। মিষ্টি রোদের মায়া জড়ানো এক রং। পুরো বছর ধরে রাজত্ব করতে দেখা গেছে। ক্যাজুয়াল থেকে বিয়ের পোশাক—সবেতেই দেখা গেছে উজ্জ্বল উপস্থিতি।
বিশ্বজুড়ে রানওয়ে
এ বছর ফ্যাশন কালচারে বিশ্বায়ন বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। আটকে থাকেনি কোনো সীমারেখায়। অগমেন্টেড রিয়েলিটি এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে বাজার বোদ্ধাদের মত। আফ্রিকান, আরব্য, ভারতীয় আর পশ্চিমা ফ্যাশন—সবকিছুই পৌঁছে গেছে ম্যাপের একদিক থেকে অন্যদিকে। ফলাফল, পোশাক সংস্কৃতিতে নতুন যোগ। কলেবরের বিকাশ। যদিও কারও কারও কণ্ঠে শোনা গেছে নিজস্বতা হারানোর ভয়। কিন্তু গ্লোবাল ভিলেজের অধিবাসীদের এসব ভয়ে আটকে রাখা মুশকিলই বটে!
ম্যাচিং ম্যানিয়া
দুজনে মিলিয়ে পোশাক পরার চল এখন আর নতুন কিছু নয়। তবু স্বমহিমায় অম্লান। এবারও বিশেষ উৎসবে জুটি বেঁধে পোশাক পরতে দেখা গেছে। কখনো রং মিলিয়ে তো কখনো মিল নকশায়, মোটিফে। আবার বৈপরীত্যেও মিল খুঁজে পেয়েছেন অনেক ডিজাইনার। আবার শুধু যে দুজনেই সীমাবদ্ধ ছিল এ ট্রেন্ড, তা বলা যাচ্ছে না। কখনো পরিবারের সবাই মিলে, কখনো বন্ধুরা তো কখনো সহকর্মীরা মিলেও একই রকম পোশাক পরতে দেখা গেছে। বিয়ের আমন্ত্রণপত্রে ড্রেসকোড উল্লেখ করে দেওয়ার চলও সানন্দে হয়েছে গৃহীত।
মাইন্ডফুল শপিং
ইমপালসিভ শপিংয়ে বছরের প্রথম থেকে বলা হচ্ছে বিগ নো। গুরুত্ব পেয়েছে মাইন্ডফুল শপিং হ্যাবিট। কেনাকাটার সময় প্রয়োজন মাথায় রেখে তবেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সূত্র মেনে চলার পরামর্শ মেনে। অহেতুক কেনাকাটা, অতিরিক্ত খরচ কিংবা অনৈতিক কোনো ব্র্যান্ডকে সমর্থন—এর সব কটিই মাইন্ডফুল শপিং থেকে ক্রেতাদের দূরে সরিয়ে দিতে পারে। সচেতনতার সঙ্গে কেনাকাটা করার আগ্রহ বেড়েছে ফ্যাশনিস্তাদের।
হাইপার ফেমিনিন এরা
বছরজুড়ে চলেছে হাইপার ফেমিনিন এরা। রং, মোটিফ—সবকিছুতেই। গোলাপির বিভিন্ন টোন, ফুলেল মোটিফ—সবই ছিল উপস্থিত। গোলাপ ফুলের উদ্ভাসন ছিল লক্ষণীয়। এই ফুল পাপড়ি মেলেছে সবখানে। নিউইয়র্ক, প্যারিস ও লন্ডন ফ্যাশন উইকে নানাভাবে গোলাপের উপস্থিতি দেখা গেছে; নারীত্বের প্রতিনিধিত্বের প্রতীক রূপে।
ফ্যাশন টেপ
ফেমিনিন ফ্যাশনে গেম চেঞ্জার। বুব টেপ, লঞ্জারে টেপ বা বডি টেপ নামেও পরিচিত। ব্রার বিকল্প। অথচ অদৃশ্য। লো ব্যাক, প্লানজিং নেকলাইনের পোশাক পরতে এগুলোর ব্যবহার বেড়েছে।
রুবি রব
জেম স্টোনের প্রতি আগ্রহ সব সময়ের। এমারেল্ড থেকে এ বছর রুবিতে এসে ঠেকেছে। একসময় প্রেয়সীর উপহার হিসেবে জনপ্রিয় ছিল এই বিশেষ জেম স্টোন। পনেরোতম ও চল্লিশতম বিবাহবার্ষিকীতে সঙ্গীকে এই পাথরের আংটি পরাতেন অনেকে। কিন্তু এবারে নেকলেস, ব্রেসলেট, আংটি, ব্রেসলেট, চুড়ি—সবকিছুতেই দেখা গেছে লালের উদ্ভাস।
সিক্স সাইডেড জুয়েলারি
জ্যামিতিক মোটিফ গয়নায় বহুল ব্যবহৃত। কখনো বৃত্ত নিয়ে খেলা তো কখনো রেখার বিন্যাসে নান্দনিকতা মন কেড়েছিল গয়নাপ্রেমীদের। এ বছরে সেই জায়গা নিয়েছে ষড়ভুজ। গয়নার নকশা এবং রত্নের আকার—দুয়েতেই দেখা গেছে এর রাজত্ব। মিনিমালিস্ট হেক্সাগন অথবা কমপ্লেক্স হানিকম্ব—দুভাবেই ক্রেতাপ্রিয় হয়েছে।
হেড র্যাপ হিট
হেড র্যাপ। রঙিন একটুকরো কাপড় মাথায় জড়িয়ে নেওয়ার ট্রেন্ড। মডেস্ট ফ্যাশনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। পাশ্চাত্যে বোহিমিয়ান স্টাইলিংয়ের সেরা উপায়গুলোর একটি। সূচনা সত্তরের দশকে হলেও ২০২৪ সালে রাজত্ব করেছে সদর্পে।
শর্টস থেকে জর্টস
এ বছরের সামার ফ্যাশনে জর্টস ছিল পছন্দের তালিকায়। জর্টস নতুন ধরনের বটম। চিরচেনা শর্টস ঘরানার পোশাক। ডেনিমে তৈরি। নব্বইয়ের দশকের ক্লদিং আইটেম এটি। এ সময়ের মেয়েরা আগ্রহ দেখিয়েছেন বেশ।
লাউড লেগ
বটমে স্টাইলিং বেশ মনোযোগ পেয়েছে গেল বছরগুলোর তুলনায়। নব্বইয়ের দশকের আঁটসাঁট টাইটস থেকে ওয়াইড লেগে আগ্রহী হয়েছেন ক্রেতারা। জেনজিরা তো বলেকয়ে লেগিংসকে বাতিলের খাতাতেই ফেলে দিয়েছে। তাদের সেই আন্দোলনের নাম ছিল ক্যানসেল কালচার। প্যাটার্নড এবং এলাবোরেট কাট বাজারে থেকেছে পুরো বছর।
ক্ল ক্লিপ
চুল বেঁধে রাখার জন্য নানা রকম ক্লিপ বাজারে এসেছে নানা সময়ে। ক্ল ক্লিপের ইতিহাসও নতুন নয়। তবে এ বছরে সব দৈর্ঘ্যের চুলের নারীদের ইজি গো হেয়ার ব্যান্ড হিসেবে ক্ল ক্লিপের অবস্থান ছিল সবার ওপরে।
লেয়ারিং লাভ
একটি পোশাকের ওপরে আরও একটি চাপিয়ে নেওয়ার প্রতি আগ্রহ ছিল পুরো ২০২৪। বেসিক পোশাককে লেয়ারিংয়ের সূত্রে আনকোরা করে তুলতে দেখা গেছে অনেককে। মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ তত্ত্বের অনুপ্রেরণায়।
কোমরবন্ধ
চিরচেনা বেল্ট এবার স্টাইলিংয়ের জন্য ব্যপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বলা যায়, বেসিক স্টেটমেন্ট পিসের দৌড়ে এগিয়ে থেকেছে। বেসিক আউটফিটকে পুরোপুরি বদলে দেওয়ার ক্ষমতা যে আছে, তা বেশ বোঝা গেছে এ বছর। ফরমালে তো বটেই, ক্যাজুয়াল আর হাই স্ট্রিটেও উপস্থিতি নজর কেড়েছে।
বেবি ডল ব্লাস্ট
আবেদনময় পোশাক হিসেবে একসময় পরিচিতি পেয়েছিল। তারপরে বহুদিন ছিল অন্দরমহলের পোশাক। এ বছরে ফিরেছে সামার ড্রেস হিসেবে। এ লাইন ফ্রকের আদলে। হেমলাইন শেষ হয়েছে হাঁটুর ওপর অবধি। অতিরঞ্জনের বালাই নেই। ফ্যাব্রিকে সিল্ক অথবা নেটের ব্যবহারেই সই।
রেইনি পাফার জ্যাকেট
পৃথিবীর একটি বড় অংশে বৃষ্টির সময় তাপমাত্রা কমতে শুরু করে। তখনকার প্রয়োজনে পানিনিরোধী পাফার জ্যাকেট দারুণ জনপ্রিয়। কেমন এটা? মূল সূত্র পাফার জ্যাকেটের। চেরি অন টপ বৃষ্টিপ্রতিরোধী বিশেষত্ব।
সব মিলিয়ে ফ্যাশনবিশ্ব নতুন করে সামনে এসেছে এবার। নাটকীয়তার নান্দনিক প্রকাশ দেখা গেছে। কোলাবোরেশনে আগ্রহ বেড়েছে। নিজস্বতা ধরে রেখে অন্য ব্র্যান্ডের সঙ্গে একই পথে হেঁটেছে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড। যুদ্ধের দামামা পুরো বছর ধরে ছিল। রাজনৈতিক অস্থিরতাও দেখেছে বিশ্ব। এসবের প্রভাব ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকেও স্পর্শ করেছে। সবকিছু নিয়ে সমাপ্তির পথে হাঁটছে বছরটি। ৩৬৬ পাতা উল্টে নতুন বছরের ফ্যাশন আসবে আলোচনায়। তবে ২০২৪ পুরোপুরি কখনোই হারাবে না। এখন শুধু দেখার অপেক্ষা।
সারাহ্ দীনা
ছবি: ক্যানভাস আর্কাইভ