skip to Main Content

ফিচার I ফ্যাশন মিটস আর্ট

ব্র্যান্ডের বার্তা ক্রেতা অব্দি পৌঁছে দেওয়ার সৃজনী উপায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সর্বজনপ্রিয়তার সুযোগে। তরুণদের জন্য তৈরি করেছে আকর্ষণীয় কর্মক্ষেত্র। লিখেছেন সারাহ্ দীনা

নতুন পণ্য বাজারে আনলেই সেটা নিয়ে হইচই পড়ে যাবে, ক্রেতা ভিড় করবেন দোকানে—বিষয়টা সব সময় এমন নয়। তাই মার্কেটিয়াররা বরাবরই বিভিন্ন পদ্ধতিতে পণ্যের প্রচারের চেষ্টা করেছেন। বিজ্ঞাপনে নির্ভর হয়েছেন। কখনো মিডিয়া হয়েছে প্রিন্ট, কখনো অডিও কখনোবা অডিও-ভিজ্যুয়ালের কম্বো। এই ট্র্যাডিশনাল অ্যাডভারটাইজিংয়ের বাইরেও করোনাকাল থেকে দেখা যাচ্ছে নতুন নতুন আয়োজন। যার একটা বড় অংশ ইন্টারনেট। নানা ধরনের কনটেন্ট তৈরির মাধ্যমে পণ্যের প্রচার পেয়েছে জনপ্রিয়তা। স্পটলাইট পড়েছে এগুলোর ক্রিয়েটরদের ওপর।
নান্দনিক আয়োজনে ছবি তুলে ক্যাপশনে বিস্তারিত লিখে নিজের সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে আপলোড করার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল এই যজ্ঞ। প্রথম দিকে ছিল ওয়ান ম্যান শো। একাই সব জোগাড়যন্ত্র করে কাজ সম্পন্ন করতেন ক্রিয়েটিভ এই কনটেন্ট ক্রিয়েটররা। ইমেজ থেকে ধীরে ধীরে শর্ট স্প্যান ভিডিওতে পৌঁছেছে এই কনটেন্টগুলো। রিল রূপে। একসময় শখের বশে নিজের মতো করে ভিডিও শুট করা থেকে শুরু হয়েছিল যা, তা এখন পরিণত হয়েছে পেশায়। তৈরি হয়েছে টিম। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সব ছকে বসিয়ে তবেই কাজ করছেন এই সৃজনশীল মানুষেরা। কনটেন্ট ক্রিয়েটর থেকে ফ্যাশন ভগার, ফ্যাশন ইনফ্লুয়েন্সার নামেও পেয়েছেন পরিচিতি। পুরো বিশ্বে এদের সংখ্যা ৬৪ মিলিয়ন। আমাদের দেশও এর বাইরে নয়।
২০২০ সাল থেকে তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ জন্মেছে এই বিষয়ে। নিজের মতো করে, ভাবনার সঙ্গে ফ্যাশন সেন্সকে জুড়ে দিয়ে বোনা গল্প যেন। তাতে এডিটের তুলির ছোঁয়া আর সুর মিলেমিশে ঐকতানের সৃষ্টি; যা দেখে সমমনা ফ্যাশনসচেতনেরা ক্রিয়েটরদের ফলো করতে শুরু করেন। এদেরকে বলা হয় ফলোয়ার। কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের প্যারামিটার এই ফলোয়ার। ব্র্যান্ডগুলোর কোলাবোরেটর করার সিদ্ধান্তে কনটেন্ট ক্রিয়েটরের সোশ্যাল হ্যান্ডেলে ফলোয়ারের সংখ্যা কেমন, কোন জেন্ডার বেশি, কোন বয়সের মানুষ বেশি—এই বিষয়গুলো অধিক গুরুত্ব পায়।
একজন প্রফেশনাল কনটেন্ট ক্রিয়েটর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্টের কার্যক্রম এমনভাবে পরিচালনা করেন, যেন তার ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়। তিনি তার কথা, ভাবনা এবং যাপিত জীবনকে কাজের সঙ্গে যুক্ত করে থাকেন। সেসব দেখেই ব্র্যান্ড-সংশ্লিষ্টরা পণ্যের প্রচারে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। আন্তর্জাতিক জরিপ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রিসার্চ গেটের মাধ্যমে পাওয়া তথ্যমতে, ৪২ শতাংশ মানুষ ফ্যাশন আইটেম কেনার ক্ষেত্রে ফ্যাশন কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের বিশ্বাস করে। এর পেছনে একাধিক মনস্তাত্ত্বিক কারণ রয়েছে।
ইন্টারনেটের দুনিয়ায় ক্রিয়েটরের সঙ্গে দর্শকের একপক্ষীয় যোগাযোগ বেশি। তবু লাইভ, কমেন্টের রিপ্লাই, ইন্টারঅ্যাকটিভ কনটেন্টের কারণে ফলোয়ার আর ক্রিয়েটরের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা ব্যক্তিগত কনটেন্টও এখানে ভূমিকা রাখে। দর্শক মোবাইল স্ক্রিনে দেখা মানুষটিকে আপন ভাবতে শুরু করেন। তার বাস্তব জীবন দেখে মিল খুঁজে পেলে বিশ্বাস বাড়ে; যা পরে পণ্য কেনার ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। কনটেন্ট ক্রিয়েটর যখন কোনো পণ্য ব্যবহার করেন, তখন সেটি তার ফলোয়ারদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। কারণ, তত দিনে মুঠোফোনের পর্দায় ভেসে ওঠা মুখটি হয়ে ওঠে চিরচেনা। সকাল থেকে রাত অবধি তার যাপিত জীবনের গল্পে নিজেকেও চরিত্র হিসেবে চিন্তা করতে শুরু করেন ক্রেতা। তাই তার দেওয়া পরামর্শ বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন অনেকে। সেখান থেকেই আকাশ ছুঁয়েছে ক্ষেত্রটির জনপ্রিয়তা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটকের ভিডিও কনটেন্টের জনপ্রিয়তা ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামকে আগ্রহী করেছে শর্ট ভিডিও কনটেন্টের অপশন চালু করতে। রিলস আর শর্টস নামে যুক্ত হয়েছে এমন ফিচার।
শিল্প আর ফ্যাশন, এদের একটির সঙ্গে অন্যটির আত্মার সম্পর্ক। আলাদাভাবে দুটির অস্তিত্ব অবশ্যই আছে। কিন্তু, দুয়ে মিলে তারা একটি পণ্যকে ক্লাউড নাইনে পৌঁছে দেওয়ার মতো ক্ষমতা রাখে। শিল্পমনা তরুণদের দেখা যাচ্ছে চিরচেনা পণ্যগুলোকে আনকোরা উপস্থাপনের মাধ্যমে তুলে ধরতে। প্ল্যাটফর্ম অবশ্যই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। বিশেষ করে ইনস্টাগ্রাম, টিকটক আর ফেসবুক। রিসার্চ গেটের তথ্য থেকে জানা যায়, ৪২ শতাংশ মানুষ ফ্যাশন আইটেম কেনার ক্ষেত্রে ফ্যাশন ইনফ্লুয়েন্সারদের বিশ্বাস করে। স্ট্যাটিস্টা একটি জরিপের মাধ্যমে জানতে পেরেছে, ২০২৩ সালে ইনফ্লুয়েন্সারদের মোট আয়ের পরিমাণ ২১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। বেশ কয়েকটি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ফ্যাশন কনটেন্ট প্রচারে ভূমিকা রেখেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে ইনস্টাগ্রাম। ৭২ শতাংশ ইনফ্লুয়েন্সার এই প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে তাদের কনটেন্ট ফলোয়ারদের মাঝে পৌঁছে দেয়। এ জন্য অবশ্য ইনস্টাগ্রামের প্রস্তুতিও কম নয়। বিভিন্ন রকম ইফেক্ট, ফিল্টার ব্যবহারের সুযোগ বাড়ছে। আছে রকমারি টেমপ্লেট। প্রিয় গান অথবা সুরযুক্ত করে ড্রামাটিক করে তোলাও সম্ভব। সঙ্গে আছে টেক্সট অ্যাড করার অপশন।
ফ্যাশনের প্রোডাক্ট লাইনের কলেবর বিশাল। সেখানে নানান পোশাক যেমন আছে, তেমনি অনুষঙ্গও। এসব নিয়ে যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কনটেন্ট তৈরি করা হয়, তখন তা নিয়ে প্রথমেই প্রয়োজন পরিকল্পনার।
আমাদের দেশের জনপ্রিয় কনটেন্ট ক্রিয়েটর প্রত্যাশা। নিয়মিত ক্রিয়েটিভ কনটেন্ট তৈরি করছেন। এই যাত্রা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি যখন কোনো কনটেন্ট তৈরি করি, সেটিকে বাস্তব জীবনের অংশ হিসেবে প্রকাশের চেষ্টা করি। বডি পজিটিভিটি নিয়ে আমি বরাবরই সচেতন। আমি চাই, দেহাবয়ব বা ত্বকের রং নিয়ে কোনো মেয়ে যেন অস্বস্তিতে না ভোগে। আমার নারী ফলোয়ারের সংখ্যাই বেশি। তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হয়। তাদের ভালো লাগা, মন্দ লাগা সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল। তাই চেষ্টা করি তাদেরকে গুরুত্ব দিয়ে কনটেন্ট তৈরি করতে। আমার ফলোয়াররা উপকৃত হবেন—এমন কাজ করতে।’
সৃজনশীল এই কাজকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার বিষয়ে তিনি বললেন, ‘ছোটবেলা থেকে ফ্যাশনের প্রতি আগ্রহী ছিলাম। এরপরে মস্কোতে পড়াশোনা করার সময়ে তাদের স্টাইলিংয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি। সেখানে বয়স ফ্যাশনে কোনো বাধা নয়। তরুণ থেকে বৃদ্ধ—সবাই নিজেদের ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী সেজে ওঠেন। আনন্দে সময় কাটান। আবার, একসময় মনে হতো, বডি শেপের কারণে সব ধরনের পোশাকে আমাকে মানায় না। নিজের ত্বকের রং নিয়েও ভাবতাম। নিজেকে নিজের মতো করে উপস্থাপনের চিন্তা সেখান থেকেই শুরু। বডি শেপ অনুযায়ী আমাকে কোন ধরনের পোশাকে মানাবে, কেমন রং আমার ব্যক্তিত্বকে প্রস্ফুটিত করবে, সেসব নিয়ে নিজেই রিসার্চে বসে যাই। পড়াশোনা, গবেষণা আমাকে কনটেন্ট তৈরিতে সাহায্য করেছে। পণ্য অনুযায়ী নিজেকে সাজিয়ে তোলা সম্পর্কে সেখান থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছি। আমাকে অনেকে ইনবক্স করেন। জানান তাদের অনুভূতি, আমাকে নিয়ে ভাবনাসহ আরও অনেক খুঁটিনাটি। সেসবেই উৎসাহ খুঁজে পাই। নিজেকে বিউটিফাই করার সঙ্গে সঙ্গে ফলোয়ারদের জন্যও কাজ করার তাগিদ অনুভব করি।’
ব্র্যান্ড কোলাবোরেশন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘যখন কোনো ব্র্যান্ড আমার সঙ্গে কোলাবোরেট করতে চায়, তাদের সঙ্গে একাধিক মিটিং করি। কারণ, বুঝতে চাই, তারা আমার কাছে ঠিক কী চাচ্ছে, কীভাবে চাচ্ছে। এরপরে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করি। কেমন কনটেন্ট তৈরি করব, সেটা নিয়ে ভাবি। পরিকল্পনা করি। প্রয়োজনে ব্র্যান্ড-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে পুরো পরিকল্পনা শেয়ার করি।’
প্রত্যাশা আরও বলেন, ‘বাসায় শুট করা সম্ভব হলে একাই তা ম্যানেজ করে নিতে পারি। কিন্তু প্রোডাক্ট যদি আউটডোর এনভায়রমেন্ট ডিমান্ড করে, তাহলে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। তখন আমার ফটোগ্রাফার প্রয়োজন পড়ে। আবার অনেক ক্ষেত্রে বন্ধুরাও সাহায্য করে। ভিডিও তৈরির পরে বেসিক এডিট করতে অন্তত এক দিন সময় দরকার হয়। এরপর সেটাকে আরও সুন্দর করে তুলতে সময় দিই। এতে দু-তিন দিন লেগে যায়।’
ফ্যাশন কনটেন্টে প্রতিনিয়ত নানা পরিবর্তন আসছে। কনটেন্টের অনন্যতায় আগ্রহী হচ্ছেন দর্শক। অনেকে ক্যাপশনের মাধ্যমে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলছেন। ব্র্যান্ডের প্রভাব বিস্তারে তরুণ প্রজন্ম এভাবেই রাখছে শক্তিশালী ভূমিকা। নিত্যনতুনের চাহিদা বাড়ছে। কনটেন্ট ক্রিয়েটররাও নিজেকে ভাঙছেন-গড়ছেন নতুনের সঙ্গে পা মিলিয়ে।

ছবি: প্রত্যাশা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top