skip to Main Content

ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I মেইড ইন চায়না

পুরোনো এই ট্যাগলাইনই হয়ে উঠেছে ফ্যাশন বিশ্বের নতুন বিস্ময়; যা জুড়ে দেওয়া প্রতিটি পোশাকে পষ্ট সংস্কৃতি ঐতিহ্যের দীর্ঘ ইতিহাস, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, ভোক্তার মূল্যবোধের বিবর্তন আর সামাজিক সচেতনতার পরিণত ভাবনা

২০১৫ থেকে ২০১৭। বিশ্ব পোশাক বাজারের নিয়ন্ত্রণে তিনটি প্রদেশ। শীর্ষ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, তারপর যুক্তরাষ্ট্র এবং এর পরপরই চীনের স্থান। কিন্তু বছর দুয়েক পেরোতেই চিত্রপটের পরিবর্তন। অন্য দুটি দেশকে হটিয়ে প্রথম অবস্থানে চলে আসে চীন। পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফ্যাশন রিটেইল মার্কেটে। গ্লোবাল ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি গ্রোথের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিটি খাতের ৩৮ শতাংশ অব্দি বিস্তার সম্ভব হয়েছে এই দেশের বদৌলতে। শুধু কি তাই! ২০১২ সাল থেকে লাক্সারি ফ্যাশন মার্কেটের প্রায় ৭০ শতাংশ সম্প্রসারণ হয়েছে চীনের হাত ধরে। এর পরের সব গল্পই শুধু এগিয়ে যাওয়ার।
চীনের এমন দ্রুতগতিতে প্রসারের রহস্য আসলে কী—যা পিছে ফেলে দিচ্ছে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে দীর্ঘদিন ধরে নেতা বনে থাকা বাঘা বাঘা দেশকেও? ২০২৩ ছিল চীনের জন্য মাইলফলকস্বরূপ। উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে দেশটির ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে। সে বছর দেশীয়গুলো তো বটেই, আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোও প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল চায়নিজ ভোক্তাদের সঠিক নির্দেশনা দেওয়ায় সক্ষমতা দেখায়। বছরজুড়েই প্রাধান্য পায় অত্যাধুনিক সব ট্রেন্ড আর প্রযুক্তির একীকরণ। সাসটেইনেবিলিটি আর ইনক্লুসিভিটির ওপরও জোর দেওয়া হয় আলাদা গুরুত্ব নিয়ে। ফলাফল—ক্রমাগত বিকশিত ফ্যাশন ল্যান্ডস্কেপ; যা প্রতিনিয়ত নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে সেখানকার ফ্যাশন মার্কেটকে। দেশের ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশ্রণের গতিশীলতার প্রতিফলনেরও দেখা মিলছে তাতে। এখন সাংহাইয়ের সরগরম স্ট্রিট মার্কেট আর বেইজিংয়ের ট্রেন্ডসেটিং অ্যাভিনিউতে সীমাবদ্ধ নেই চীনের ফ্যাশন সিন। আটকে নেই শুধু পোশাকি উপস্থাপনে; বরং ফ্যাশন পরিণত হয়েছে ঐতিহ্যের পরিচায়ক, প্রযুক্তিগত প্রসারের প্রতীক আর সামাজিক সচেতনতার স্মারকে। ঐতিহ্যবাহী মোটিফগুলো প্রাণ জোগাচ্ছে সমসাময়িক ডিজাইনগুলোতে। লাক্সারি ব্র্যান্ডগুলোও পাল্টাতে শুরু করেছে বাঁধাধরা নিয়ম, খাপ খাইয়ে নিচ্ছে ভোক্তার ডিজিটাল-ফার্স্ট অ্যাপ্রোচের সঙ্গে। স্বদেশি চীনা লেবেলগুলো পা ফেলতে শুরু করেছে বিশ্ব মানচিত্রের বুকে। ফল—প্রায় ২৩৬ বিলিয়ন ডলারের ফ্যাশন মার্কেট।
রিটেইলারদের সঙ্গে বোঝাপড়া
কারণ, অনলাইনের পাশাপাশি অফলাইন উপস্থিতিও বেশ জরুরি। ই-কমার্সের ব্যবসা যে এখন তুঙ্গে, তা নিয়ে দ্বিমত নেই। শুধু ২০১৮ সালের একটি সমীক্ষায় চোখ ফেললেই তার প্রমাণ মেলে। সে বছর বিশ্বজুড়ে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন মানুষ শুধু অনলাইন বেসড শপিং করেছিলেন। ২০২৪ যে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২ দশমিক ১৭ বিলিয়নে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অনলাইনে কেনাকাটা ক্রেতার জন্য স্বচ্ছন্দের হলেও এর মানে এই নয়—ফিজিক্যাল স্টোরে গিয়ে কেনাকাটায় আগ্রহ কোনো অংশে কমেছে। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে এটাই চরম সত্য। চীনের হাজার হাজার শপিং মলের দিকে তাকালেই তার প্রমাণ মেলে। অফলাইন স্টোরের স্বত্বাধিকারী হওয়ার যে আলাদা প্রভাব পড়ে ক্রেতাদের ওপর, তার পষ্টতা পাওয়া যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে করা এক মার্কেট রিসার্চ থেকে অবাক করে দেওয়া সব তথ্য মিলেছে এ ক্ষেত্রে; যা দেখে পরিষ্কারভাবে ঠাহর করা যায় ভোক্তাদের চাহিদা আসলে কী।
 অনলাইন ও অফলাইন—উভয়েই উপস্থিত আছে এমন ব্র্যান্ডের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখান ৮৫ শতাংশ ক্রেতা; ২০১৭ সালে যা ছিল ৮০ শতাংশ।
 তিনজনের মধ্যে মাত্র একজন ভোক্তা সরাসরি আউটলেটে যাওয়ার পরিবর্তে অনলাইনে কেনাকাটা করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
 ফেসবুকের একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষা অনুসারে ৮৫ শতাংশ ভোক্তার স্থানীয়ভাবে কেনাকাটা করার প্রধান কারণ সুবিধা ও স্বচ্ছন্দ।
 ফ্যাশন ক্যাটাগরিতে এখন অব্দি ৭০ শতাংশ কেনাকাটা অফলাইনেই সারা হয়। অন্যদিকে লাক্সারি ব্র্যান্ডগুলোর বিক্রয়ের মাত্র ১৩ শতাংশ মেলে অনলাইন থেকে।
 জরিপে অংশগ্রহণকারী অনলাইনে কেনাকাটায় অভ্যস্ত গ্রাহকদের ৮৮ শতাংশ সমীক্ষার আগের তিন মাস অফলাইনেই সেরেছেন বেশির ভাগ কেনাকাটা।
তাই ফ্যাশন বিশ্বের ঘোড়দৌড়ে বিশেষ করে লাক্সারি ফ্যাশন মার্কেটে সেসব ব্র্যান্ডই এগিয়ে থাকে, যাদের অনলাইনের পাশাপাশি অফলাইন উপস্থিতিও শক্তিশালী। চায়নিজ ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো ঠিক সে পথেই হেঁটেছে। সুফলও মিলেছে হাতেনাতে।
তারুণ্যতাড়িত
নতুন প্রজন্মের কারণেই ক্রমাগত পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়ে যাচ্ছে চায়নিজ ফ্যাশন মার্কেট। আর তারুণ্যের তাড়নাকে প্রাধান্য দেওয়ার ফলে বিকশিত হচ্ছে বাজার। ক্রমাগত উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে ফিজিক্যাল স্টোর উপস্থাপনের অভিনব সব উপায় বের করে আনছে ব্র্যান্ডগুলো। শপিং এখন শুধু কেনাকাটায় সীমাবদ্ধ রাখতে নারাজ চীনারা, বরং উপভোগ্য এক অভিজ্ঞতায় পরিণত করার প্রয়াস যেন সবার মাঝে। যার মাধ্যমে মিলবে শৈল্পিক ও সাংস্কৃতিক দর্শনের পূর্ণ স্বাদ।
চীন তার শপিং মলগুলোকে এক্সপেরিয়েন্সিয়াল আর্ট স্পেসে পরিণত করে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন বিপ্লবের জন্ম দিয়েছে। বেইজিংয়ের এসকেপি সাউথ হল মল এর দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ। যেখানে কনটেম্পরারি আর্টিস্টদের নতুন নতুন ইনস্টলেশন প্রদর্শনের জন্য আলাদা জায়গা রাখা হয়েছে।
পুডংয়ের সাংহাই টাইমস স্কয়ারকে পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে জাপানিজ ডিজাইন স্টুডিও নেন্ডো। চোখে আঙুল দিয়ে ফ্যাশন বিশ্বকে দেখানো হয়েছে শপিং মল কেমন হওয়া উচিত আর কেমন হতে পারে। থিয়েট্রিক্যাল আমেজ দেওয়া হয়েছে পুরো জায়গায়। আরও অবাক কাণ্ড করে দেখিয়েছে চায়নিজ টেক কোম্পানি চিতা মোবাইল। চীনজুড়ে হাজারখানেক মলে স্থাপন করেছে সাত হাজারের মতো রোবট। যাদের কাজ, আরও কার্যকরভাবে কেনাকাটায় সহায়তা করা। ফেশিয়াল রিকগনিশন ব্যবহার করে এরা ভোক্তাদের শনাক্ত করতে পারে। পরে কথোপকথনের মাধ্যমে তাদেরকে দোকান বাছাইয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরামর্শ আর নির্দেশনা দিতেও সক্ষম। ফিডব্যাক সংগ্রহ করে, এমনকি গিফট কুপনও দিতে পারে ভোক্তাদের। এমন রিটেইল এক্সপেরিয়েন্স পৃথিবীর আর কোথাও মিলবে কি না সন্দেহ!
কেনাকাটার পাশাপাশি ক্রেতাদের আনন্দময় সময় উপভোগের ব্যবস্থা করে দেওয়াই মূল উদ্দেশ্য। এগুলো এমন রিটেইল স্পেস, যেখানে প্রতিবারই নতুন কিছুর সঙ্গে পরিচয় হবে ভোক্তার। আনকোরা সব আবিষ্কারের সঙ্গে শেখাও যাবে নিত্যনতুন বিষয়; যা লুফে নিয়েছেন চীনা ক্রেতারা। সমীক্ষায় অন্তত তা সুস্পষ্ট। ২০১৪ সালে অনলাইনে রিটেইল সেলসের ঊর্ধ্বগতির দারুণ প্রভাব পড়েছিল অফলাইন ফিজিক্যাল স্টোরগুলোতে। অনেক ব্র্যান্ডের আউটলেট বন্ধও করে দিতে হয় এর দরুন। কিন্তু সাম্প্রতিক এ পরিবর্তন আবার ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে; বিশেষ করে বয়সে তরুণদের। ফিরিয়ে আনছে ব্র্যান্ডগুলোর ফিজিক্যাল স্টোরে।
তরুণদের আকর্ষণে গেল কয়েক বছর জেন্ডারলেস ফ্যাশন মুভমেন্ট, গ্রিন ফ্যাশনের মতো নিউ এইজ ট্রেন্ডের প্রতি আলাদা গুরুত্ব দিতে দেখা গেছে দেশটিকে। ফ্যাশনের সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে এগুলোও।

 জাহেরা শিরীন
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top