কভারস্টোরি I স্লো লিভিং
‘চলছে জীবন রথ/ যত মত তত পথ/ কার আগে কী পাব কী হারাব/ দে দৌড়…’ জেমসের এ গানের মতোই আধুনিক জীবন আমাদের। প্রতিনিয়ত ছুটে চলা। নিজেকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য। অথচ একান্তই নিজেকে দেওয়ার মতো সময় যেন নেই। এভাবে ছুটতে ছুটতে একদিন চিরন্তন শেষ গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া। অর্থাৎ মৃত্যু। জীবন কি এমনই কাটানো শ্রেয়? বোধসম্পন্ন মানুষ সম্ভবত মাথা নাড়বেন, নারাজ অর্থে। তাই যন্ত্রবৎ ছুটে চলার বিপরীতেও যে জীবন যাপন করা সম্ভব, সেই চর্চার বাড়ছে কদর। তুলনামূলক কম করে হলেও স্লো লিভিং জায়গা নিচ্ছে জীবনপটে। বিস্তারিত রুদ্র আরিফের লেখায়
ব্যস্ত সূচিতে ঠাসা সময়, একের পিঠে আরেক অ্যাপয়েন্টমেন্টে দৌড়ঝাঁপ, চলতি পথেই গাড়িতে বসে মধ্যাহ্নভোজ…এমন ব্যস্ততায় জীবনকে ঘিরে ফেলার মানে হয় না! বরং জীবনের সঠিক তাৎপর্য উপলব্ধির জন্য ধীরে চলাই শ্রেয়। স্লো লিভিংয়ের আবির্ভাব এ ভাবনা থেকেই। এর মানে, দ্রুততার ভেতর নয়, বরং ধীরে-সুস্থে যাপনকে উদ্যাপন। জীবনসম্পর্কিত চলতি ধারণার বিপরীত।
আমাদের সমাজে অবশ্য ব্যস্ততাকে বরাবরই মহিমান্বিত করার চল রয়েছে। মর্যাদার তকমা নিজের সঙ্গে সেঁটে নেওয়ার স্বপ্নে আমরা নিরন্তর ছুটে বেড়াই। অথচ এমন দৌড়ঝাঁপ, এমন চাপের বোঝা পরিণামে জীবনকে করে তোলে ভীষণ ভারী। বোঝার সুবিধার্থে ডেনমার্কের সাম্প্রতিক উদাহরণ টানা যেতে পারে। ইউরোপীয় দেশটির ৪ লাখ ৩০ হাজার নাগরিক মারাত্মক মানসিক চাপ বা স্ট্রেসের বিবিধ উপসর্গে আক্রান্ত, যা উপশমে ডেনিশ সরকারকে প্রতিবছর ২৭ বিলিয়ন ক্রোনার বা প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হয়। তরুণদের মধ্যে এর হার অত্যধিক। দেশটির ৪০ দশমিক ৫ শতাংশ যুবক এবং ২৩ দশমিক ৪ যুবতী উচ্চমাত্রার স্ট্রেসে ভুগছেন। অন্যদিকে, আরেক ইউরোপীয় দেশ নরওয়েতে ৪৪ শতাংশ কিশোরী মানসিক চাপজনিত রোগে জর্জরিত।
‘নিরন্তর মানসিক চাপের মধ্যে জীবনযাপন আমাদের শারীরিক ও মানসিক—উভয় স্বাস্থ্যকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। চাপাক্রান্ত অবস্থায় আমরা যুদ্ধ ও পলায়নরত পরিস্থিতির মধ্যে নিজেদের আবিষ্কার করি। তাতে আমাদের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসে, সমবেদনাবোধ কমে যায়, আর প্রয়োজন ও মূল্যবোধের হিসাব-নিকাশ উল্লেখযোগ্যভাবে কঠিনতর হয়ে ওঠে,’ লন্ডনভিত্তিক গণমাধ্যম স্ক্যান ম্যাগাজিনকে বলেছেন ডেনিশ মনোবিজ্ঞানী ও পডকাস্ট উপস্থাপিকা বির্গিট সোলভ্স্টাইন।
সৌভাগ্যজনকভাবে এর প্রতিষেধকও রয়েছে আমাদের নাগালে। তা হলো স্লো লিভিং। এটি এমনই মানসিকতা, যেখানে নিজ মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি অধিকতর ও অর্থপূর্ণ জীবনশৈলী পালন করে নিরাময়কারীর ভূমিকা। তার মানে এই নয়, সবকিছুই স্লথের মতো অতি ধীরগতিতে করতে হবে; বরং যথাযোগ্য সময় নিয়ে, ধীরে-সুস্থে কাজগুলো সঠিকভাবে সম্পন্ন করা। সবকিছু ঝটপট সেরে ফেলার তাড়নাকে পাত্তা না দিয়ে, ভালোভাবে সম্পাদন করার ওপরই জোর দেয় স্লো লিভিং। আর তাতে কাজও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে শ্রেয়তর। এককথায়, নিজস্ব জীবনশৈলীকে অন্তস্তল থেকে মর্যাদা দিয়ে, অটোপাইলট প্রণালির সুইচ বন্ধ করে, গভীর চিন্তা ও আত্মসচেতনতার সময় ও স্থান সৃষ্টি করে নেওয়া।
‘স্লো লিভিং একটি জীবনপন্থা। এ হলো ধীরে চলা এবং এর ফলে আরও বেশি শান্ত ও অস্তিত্বপূর্ণ থাকার ও মানসিক চাপ কমানোর একটি পথ বেছে নেওয়া। নিজেকেই প্রশ্ন করুন, কেমনতর জীবন কাটানো কামনা করেন। কী আপনাকে আনন্দ ও সুখ এনে দেয়। নিজ জীবনের মূল্য কী। আপনার কাছে একটি তাৎপর্যপূর্ণ জীবনের অবয়ব কেমন। ধীরজ জীবনশৈলী গ্রহণ করার কামনা থাকলে এগুলোই আপনার জন্য নিজেকে করার পক্ষে মৌলিক প্রশ্ন,’ অভিমত ডেনিশ লেখক, প্রকাশক এবং স্লো লিভিংয়ের প্রতি নিবেদিত একটি বই, আলাপচারিতা ও অনলাইন যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মের স্বত্বাধিকারী ওল ডিটলেভ নিলসনের।
ইতিহাস বলে, এই জীবনচরিতের শিকড় ইতালিতে। গেল শতকের আশির দশকে দেশটির রোমে ব্যাপকবিস্তারী স্লো মুভমেন্টের একটি অংশের সূচনা ঘটে। এর সঙ্গে রয়েছে খাবারের যোগ! আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল ফাস্ট ফুড চেইন ম্যাকডোনাল্ড’স তখন রোমের কেন্দ্রস্থলে নিজেদের প্রথম রেস্তোরাঁ উন্মোচন করে। স্থানীয় খাদ্য ঐতিহ্যকে সুরক্ষার জন্য প্রখ্যাত ইতালীয় লেখক ও অ্যাকটিভিস্ট কার্লো পেত্রিনির নেতৃত্বে একদল অ্যাকটিভিস্ট এ সময় স্লো ফুড নামে একটি আন্দোলনের সূচনা ঘটায়। সেই আন্দোলনই পরবর্তীকালে বৃহত্তর স্লো লিভিং মুভমেন্টের স্ফুলিঙ্গ হিসেবে কাজ করে, যেটিতে খাবারের পাশাপাশি কর্ম, অবসর, কেতাদুরস্ত, ভ্রমণ, অভিভাবকত্বসহ জীবনের অন্য বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত। তবে এই জীবনশৈলীর ধারণা মূলত ২০০৪ সালে প্রকাশিত কানাডিয়ান লেখক কার্ল অনারের ‘ইন প্রেইজ অব স্লোনেস’ বইটির কাছে ঋণী; যে বই স্লো লিভিংয়ের ধারণাকে বিশ্বজুড়ে মূলস্রোতে জায়গা করে দিয়েছে।
জীবনশৈলী হিসেবে স্লো লিভিং বেছে নেওয়া একান্তই ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন জীবনকে স্বাগত জানানোর অর্থ হলো দ্রুতগতির গাড়িতে চড়ার কিংবা কোনো পেন্টহাউস অ্যাপার্টমেন্টে বসবাসের প্রয়োজনীয়তাকে বিসর্জন দেওয়া; বলা বাহুল্য, এই উদাহরণগুলো প্রতীকার্থে ব্যবহৃত। অন্যভাবে বললে, নিরন্তর ছুটে চলার জীবনে একজন ব্যক্তিমানুষ সাধারণত আধুনিক দুনিয়ার জাহির করা সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগের আকাঙ্ক্ষা রাখে। আর তা অর্জন করতে হলে গতির দৌড় থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। অন্যদিকে, স্লো লিভিং ঠিক এর উল্টো। অতি অল্প কিছু নিয়ে, তারিয়ে তারিয়ে জীবন উপভোগ করা। নিলসন বলেন, ‘ধীরজ জীবনশৈলীকে “হ্যাঁ” বলতে চাইলে আপনাকে অন্য অনেক কিছুকে “না” বলতেই হবে। ধীরগতির জীবনশৈলী যাপন এবং ডিজাইনার ক্লোদ কিংবা কোনো ইন্টেরিয়র ম্যাগাজিনে গ্লোসি পেপারে মুদ্রিত—এমন দামি ও চকচকে গাড়ি-বাড়ি ব্যবহার করা—এ দুটো বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রে একই সঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। অবশ্য, এই জীবনশৈলী বেছে নেওয়ার মাধ্যমে আপনি একটি অধিকতর শান্ত, ভারসাম্যপূর্ণ এবং কম চাপযুক্ত জীবন কাটাতে পারবেন।’
ভোগ-বিলাসিতার মানদণ্ডে, আক্ষরিক অর্থে স্লো লিভিংকে অনাকর্ষণীয় মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা তুলনামূলক ঋদ্ধ জীবনের নিশ্চয়তা দেয়—এমন দাবি করে সোলভ্স্টাইনের ভাষ্য, ‘যখন আমরা যাপনকে ধীরস্থির করে তুলি, তখন সবকিছুতে আমাদের উপস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই আরও প্রগাঢ় হয়ে ওঠে, যা মনে এই বোধ এনে দেয়— “আমার যা আছে, তা-ই যথেষ্ট”। আলতো কামড় বসানো আপেল কিংবা সকালের কফির স্বাদ তখন প্রকৃত মহিমা নিয়ে ধরা দেয় আমাদের কাছে। আশপাশে থাকা গাছগুলো শোনাতে থাকে নানা গল্প। এই গুণাবলি আসলে মানসিকভাবে ভালো থাকার মূল ভিত্তি।’
স্লো লিভিংয়ের মাধ্যমে কম কিছু করেও অনেক বেশি কিছু পেয়ে যাই আমরা। বর্তমানের মধ্যে হাজির থাকতে এবং গভীর ও অর্থপূর্ণ আলাপচারিতায় অংশ নিতে পারি বলে আমাদের সম্পর্কগুলোও সঠিক যত্ন পায়। মানসিক চাপগুলো ধাপে ধাপে সরে যেতে থাকে বলে নিজেদের সত্যিকারের মূল্যবোধের প্রতি উদার ও সমব্যথী হতে এবং মূল্যবোধকে অনুভব করতে সক্ষম হই।
স্বভাবতই স্লো লিভিং ঘিরে রয়েছে প্রচুর ভ্রান্ত ধারণা। যেমন এর মানে হলো, সবকিছু নিতান্তই ধীরগতিতে করা এবং শারীরিক ভাষার মধ্যে হিমবাহের ছাপ ফেলা! অথচ সত্য হলো, স্লো লিভিং মানে স্রেফ নিজের জীবনগতিকে পরিমাপ করা এবং যন্ত্রবৎ দৌড়ঝাঁপ থামানো। আমাদের জীবনে সত্যি কী দরকার, তা অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রয়োজন আমরা মরিয়াভাবে অনুভব করি। কিন্তু ই-মেইল, সংবাদ, সন্তানদের চিৎকার-চেঁচামেচি, ডেডলাইন, কফি ডেট, বিল মেটানো প্রভৃতিতে ক্যাওজে ভরা প্রাত্যহিক জীবনে এমন জীবনচরিতের চর্চা কীভাবে করা সম্ভব?
এ ক্ষেত্রে প্রকৃতির দ্বারস্থ হওয়াকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, প্রতিদিন নৈশভোজের পর পার্কের রাস্তায় ১৫ মিনিট হাঁটা কিংবা মধ্যাহ্নভোজের পর খানিকটা পায়চারিতেও মিলতে পারে সমাধান। ব্যস্ততার মধ্য থেকে নিয়মিত সময় করে অল্প কিছুক্ষণ দিনলিপি লেখা, ছবি আঁকা কিংবা বাদ্যযন্ত্র বাজানোর মাধ্যমেও চর্চা করা যায় স্লো লিভিংয়ের। সবচেয়ে ভালো হয়, সকালে একটু আগেভাগে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করতে পারলে। তাহলে কর্মঘণ্টা শুরু নিয়ে তাড়াহুড়ো থাকবে না; একটু ধীরে ধীরেই প্রস্তুত করা যাবে নিজেকে। এ সময়ে ধ্যান বা যোগব্যায়াম, প্রতিবেশীর সঙ্গে হাঁটতে বেড়ানো, কোনো বইয়ের দু-এক পৃষ্ঠা পাঠ কিংবা সময় নিয়ে, ধীরে-সুস্থে কফি পানও কাজে দিতে পারে। তবে সময়টিতে ই-মেইলের উত্তর দেওয়া কিংবা সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রলিং করা মোটেই বুদ্ধিমানের পরিচায়ক নয়; বরং নিজের জীবনে প্রশান্তি এনে দেয়—এমন কোনো তাৎপর্যপূর্ণ কর্মযজ্ঞে জড়িয়ে থাকা কিংবা নিজেকেই সময় দেওয়া।
নিজের বর্ষপঞ্জিতে তারিখের ঘর যথাসম্ভব বেশি বেশি সাদা রাখার, অর্থাৎ ব্যস্ততা থেকে নিজেকে ছুটি দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ‘দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে শুধু নিজের উপস্থিতি সত্তার ওপরই মনোনিবেশ করুন। সোশ্যাল মিডিয়া, ই-মেইল, সংবাদ, অ্যাপয়েন্টমেন্ট—সব তোলা থাক শিকেয়! স্রেফ বর্তমান মুহূর্তটির মধ্যেই বাঁচুন,’ পরামর্শ সোলভ্স্টাইনের।
আমেরিকান স্লো ও সিম্পল লিভিং অ্যাডভোকেট এবং ‘সিকিং স্লো: রিক্লেইম মোমেন্টস অব কাম ইন ইওর ডে’ গ্রন্থের রচয়িতা মেলানি বার্নসের মতে, স্লো লিভিং শুধুই একটি জীবনশৈলী নয়, রীতিমতো শিল্পও। তিনি দাবি করেন, একটি ধীরজ গতি মেনে চলার, ভাবনাচিন্তার জন্য একটু দম নেওয়ার এবং প্রাত্যহিক জীবনে স্থির থাকার মুহূর্ত বাড়ানোর মাধ্যমে আমাদের পক্ষে আরও বেশি সুখকর ও স্বাস্থ্যকর জীবনের অধিকারী হওয়া সম্ভব। যদিও সমাজ, কর্ম, বন্ধুবান্ধব, পরিবার, এমনকি সার্বিকভাবে স্বয়ং জীবনও আরেকটু গতিশীলতা চায়, তবু গতির বাড়বাড়ন্তকে থামিয়ে দিয়ে ধীরতালের জীবনকে আরও বেশি সুযোগ করে দেওয়া আমাদের নিজ স্বার্থেই প্রয়োজন।
‘স্লো লিভিং নতুন কিছু নয়। বহু মানুষ এমন জীবনযাপন বহু শতাব্দী ধরেই করে আসছে; তবে আজকের দিনে এই তকমায় বিষয়টিকে আমরা তুলনামূলক ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারছি, যার জনপ্রিয়তা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এটি বলতে এমনই এক জীবনশৈলীকে বোঝায়, যেটির ভঙ্গিমা একুশ শতকের জীবনচিত্রের চিরচেনা তাড়াহুড়োর চেয়ে একদম ভিন্ন। এটি অপেক্ষাকৃত ধীরগতিকে উৎসাহিত করে এবং মননশীল মনোভাবকে মর্যাদা দেয়, যা মানুষ হিসেবে আমাদের বর্তমানের মধ্যে অবস্থান ও জীবনের সামগ্রিক তাৎপর্যকে উপলব্ধির আহ্বান জানায়,’ বলেছেন মেলানি।
তার জিজ্ঞাসা, প্রাত্যহিক জীবনের করণীয় বিষয়গুলোর সঙ্গে গভীর যোগাযোগ স্থাপন ছাড়াই সেগুলোর মধ্যে দৌড়ঝাঁপ করে কাটিয়ে দেওয়ার বদলে আমরা যদি তারিয়ে তারিয়ে মুহূর্তগুলোর নিজস্ব নির্যাস অনুভব ও উপভোগ করি, তা কি মঙ্গল নয়? সবচেয়ে বড় কথা কাজ, চাপ ও জীবনের ব্যস্ততায় এসব চমৎকার আন্তরিক মুহূর্ত আমাদের জীবনে একান্ত নিজের হয়ে ধরা দিতে পারে না। যদি ব্যস্ততাগুলোকে আমরা প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর নকশা করা কর্মসূচি থেকে সরিয়ে নিতে পারি, তাহলে নিজেদের ভালোবাসার কাজগুলোর প্রতি আরও বেশি মনোযোগী হতে পারব। সন্তানদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে ও সময় কাটাতে পারব। কাজের চাপে, চোখের পলকে ওরা বড় হয়ে যাবে না; বরং ওদের বেড়ে ওঠা উপভোগ আর উপলব্ধি করতে পারব। তাতে অপরাধবোধ কমবে আমাদের। নিজের জীবনকে আরও বেশি নিজেরই মনে হবে।
প্রাত্যহিক চর্চায় স্লো লিভিংয়ের গুরুত্বারোপ এবং একে শিল্পে রূপান্তর করা প্রসঙ্গে নিজ গ্রন্থের ‘ডেইলি স্লো-লিভিং রিচুয়ালস’ অধ্যায়ে মেলানি লিখেছেন, ‘রিচুয়াল বা আচার সৃষ্টির একটি শিল্প রয়েছে। আচার হলো এমনই মুহূর্ত, যখন আমরা সচেতনভাবে সময় নিই একে আত্মস্থ করার এবং এর মধ্যে সত্যিকার অর্থে উপস্থিত থাকার জন্য। এটিকে বিনির্মাণ করলে আমরা দেখতে পাব, একটি আচার মানে একগুচ্ছ পবিত্র কর্মযজ্ঞের সমাহার। আচারকে রিচুয়াল ডিজাইনার ও ইনস্পিরেশনাল স্পিকার টিউ ডি হান অভিহিত করেছেন কোনো মুহূর্তকে ঘিরে রাখা একটি পাত্র হিসেবে, যেভাবে একটি শিল্পকর্মকে ঘিরে রাখে ফ্রেম।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘খাদ্য ও পানি যেভাবে শরীরে পুষ্টি জোগায়, আচার সেভাবে আত্মাকে পুষ্ট করে।’ আচারের পক্ষে আমাদের প্রাত্যহিক দিনগুলোতে সম্ভ্রমের মুহূর্তগুলোকে সবচেয়ে সহজ পন্থায় বয়ে আনা সম্ভব। আচারের শিল্প আমাদের শরীরকে ধীরগতিসম্পন্ন ও মননশীল হতে, আরেকটু গভীরভাবে নিশ্বাস নিতে পারার এবং বর্তমানের মধ্যে আরও বেশি মাত্রায় উপস্থিত থাকার সক্ষমতা দিতে একটি দৃশ্যগত ও বস্তুগত সংকেতে পরিণত হয়। এই আলোকে কোনো আচারকে বিবেচনা করলে আমাদের প্রাত্যহিক কর্ম রুটিনে সেগুলোকে জায়গা করে দেওয়ার সুবিধা আমরা দেখতে পাব।’
কেমন সেই আচার? কেমনই-বা তার শৈল্পিক রূপ? মেলানির ভাষ্যমতে, এ খুবই মামুলি কাজকারবার! নিজের চা নিজে বানিয়ে নেওয়া, নিজের পছন্দের পোশাক নিজ হাতে ধোয়া, তাকে জমে থাকা বইগুলো নিজে গুছিয়ে রাখা ইত্যাদি কাজের চর্চা করা যেতে পারে। অর্থাৎ যে কাজগুলো করে দেওয়ার জন্য অন্যরা আছে, আপনি-আমি নিজেকে হয়তো ব্যস্ত রাখছি তথাকথিত আরও অনেক ‘বড়’ কাজে, ফলে এসব করার ফুরসত আমাদের নেই—এমন চলতি চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসা চাই। তাতে জীবনের ঘৌড়দৌড়ে প্রাথমিক ছেদ পড়বে বটে, তবে আখেরে মঙ্গল!
গেল মাসে, অর্থাৎ ১২ নভেম্বর ২০২৪-এ প্রকাশিত ‘টাইম এক্সপেনশন এক্সপেরিয়েন্সেস: দ্য সাইকোলজি অব টাইম পারসেপশন অ্যান্ড দ্য ইল্যুশন অব লিনিয়ার টাইম’ গ্রন্থে ব্রিটিশ লেখক, কবি, প্রভাষক এবং মনোবিদ্যা গবেষক স্টিভ টেইলর ধীরগতিসম্পন্ন ও মননশীল জীবনযাপনের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। বইটির ভূমিকায় পাঠকের সঙ্গে দারুণ এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়ে লিখেছেন, ‘বছর পনেরো আগের কথা, আমার বাড়ি থেকে প্রায় ছয় মাইল দূরের একটি কলেজে খণ্ডকালীন চাকরি করতাম। শুরুর দিকে গাড়ি চালিয়েই যেতাম সেখানে। কিন্তু ট্রাফিক জ্যাম আর গাড়ির লাইটের লম্বা সারিতে ঠাসা ওই জার্নি আমার কাছে স্ট্রেসফুল ও হতাশাজনক মনে হতো। তাই ঠিক করলাম, বরং সাইকেল চালিয়েই আসা-যাওয়া করব। কারণ, এর ফলে ট্রাফিক জ্যামের ফাঁকফোকর দিয়ে সহজে গলে যেতে পারব। দেখলাম, এভাবে আসতে-যেতে গাড়ির তুলনায় মাত্র কয়েক মিনিট বেশি সময় লাগে আমার। গাড়ির ভেতরে জড় পদার্থের মতো বসে থাকার বদলে খোলা হাওয়ায় শরীরচর্চা চালিয়ে যেতে পারা আমার জন্য নিঃসন্দেহে ছিল দারুণ অভিজ্ঞতা।’
‘তবে সাইকেল চালানোর সেরা বিষয় ছিল, যাত্রাপথে বাস্তবতার সঙ্গে নিজেকে আরও বেশি সংযুক্ত করার সুযোগ পাওয়া। কৌতূহলোদ্দীপক পুরোনো বাড়ি, নয়নাভিরাম পুরোনো গাছ ও ফুলের বিছানা চোখে পড়েছে আমার, যা আগে কখনো খেয়াল করিনি। এমন সব নীরব রাস্তার ভেতর দিয়ে গেছি, গাড়িতে শাঁই শাঁই করে পাড়ি দেওয়ার কালে যেগুলোর মাহাত্ম্য হৃদয়ে ধরা দেয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, আকাশের দিকে তাকিয়ে, গগনের মাঝে মাঝে মেঘমালা ও নীলাকাশের বিস্তার দেখে, সকালবেলার রোদের আলো গায়ে মাখতে পারার অভিজ্ঞতা পেয়েছি। প্রতিদিন সকালে কর্মস্থলে প্রাণপ্রাচুর্যে পূর্ণ হয়ে পৌঁছেছি। অবাক হয়ে ভেবেছি, গাড়িতে পাড়ি দেওয়ার দিনগুলোতে এই চমৎকার জার্নির কত কিছুই-না অধরা থেকে গিয়েছিল আমার কাছে; অথচ ধীরে চলার পথ বেছে নিয়ে সেগুলোর বাস্তবতাকে আরও বেশি মাত্রায় অনুভব করতে পেরেছি।’ যোগ করেন তিনি।
ড. টেইলর আরও জানান, এটি স্বয়ং জীবনেরই চমৎকার রূপক। তার মতে, ধীরে বাঁচার মাধ্যমে আমরা আরও বেশি বাস্তবতার অভিজ্ঞতা নিতে পারব; ফলে বর্তমানের মধ্যে আরও বেশি যাপন করার সুযোগ মিলবে। মানসিক চাপ কমে আসবে আরও; বাড়বে পরিপূর্ণতার বোধ।
দুনিয়াজুড়ে স্লো লিভিংয়ের আবেদন প্রতিনিয়তই বাড়ছে। বিশেষত করোনাভাইরাস অতিমারির সময়কাল থেকে। গুগলের তথ্যমতে, ইউটিউবে সাম্প্রতিক সময়ে ‘স্লো লিভিং’ শিরোনামের কনটেন্ট বেড়েছে চার গুণ। ‘দ্য কিনফোক হোম: ইন্টেরিয়রস ফর স্লো লিভিং’ গ্রন্থের রচয়িতা নাথান উইলিয়ামসের মতে, ‘আমরা কত কম কিছুর মধ্যে জীবন কাটাতে সক্ষম—তা নয়; বরং স্লো লিভিং মানে কী কী ছাড়া জীবন কাটানো আমাদের পক্ষে অসম্ভব, তা নির্ধারণ করা।’ এ ঘিরে ভ্রান্ত ধারণার মধ্যে রয়েছে, এমন জীবনপন্থা শুধু গ্রামীণ মানুষের পক্ষেই সম্ভব, যা আদতে সঠিক নয়; বরং এই জীবনচরিতে সময়কে আরও বেশি আলিঙ্গনের সুযোগ মেলে। কেননা, নিজেকে বিভ্রান্ত বা লক্ষ্যচ্যুত করে, এমন কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকা; যেমন অহেতুক সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রলিং। এর ফলে নিজের আরেকটু বেশি যত্ন নেওয়ার সময় মিলবে।
এই ডিসেম্বরে, আমাদের মহান বিজয় দিবসের মাসে, যদি নিজেদের গৌরবময় ইতিহাসের প্রতিনিধিত্বশীল চলচ্চিত্র বলয়ের দিকে নজর দিই, তাহলেও স্লো লিভিংয়ের মাহাত্ম্যের চমৎকার নমুনা মিলবে। বলছি মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রগুলোর কথা। এ-বিষয়ক বেশির ভাগ চলচ্চিত্রই বিবিধ শোরগোল ও ক্যাওজে ঠাসা। তা হওয়াই স্বাভাবিক। কেননা, যুদ্ধ তো কোনো প্রশান্তিময় ছেলেখেলা নয়! তাই মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র মানেই কানের পর্দায় তালা লাগিয়ে দেওয়ার মতো গোলাগুলির শব্দ, গগনবিদারী আর্তনাদ, ছোটাছুটি, হাঙ্গামা ইত্যাদি। এমন গতিময় কর্মযজ্ঞের চিত্রমালা থেকে দৃষ্টি একটু পাশে সরিয়ে, সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে মুক্তি পাওয়া আলমগীর কবিরের ‘ধীরে বহে মেঘনা’র কথা ভাবুন তো! যথেষ্ট কাব্যিক ও প্রশান্তিময় চলচ্চিত্রীয় ভাষায় নির্মিত এই সৃষ্টিকর্মে দেখা মেলা মেঘনা নদীর বুকে পালতোলা নৌকার কথা। পানির মৃদু জলতরঙ্গের কথা। আর ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘কত যে ধীরে বহে মেঘনা…’ গানটির কথা। সমগ্র চলচ্চিত্রটিরই এক প্রতীকী রূপ এ যেন। মৃদুভাষী, স্নিগ্ধ তবু স্রোতস্বিনী, অর্থাৎ গতিময়। এমন স্নিগ্ধ গতির ভেতর দিয়ে, এমন থরে থরে সাজানো নীরবতার ফাঁকতালে মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি প্রবল আওয়াজপূর্ণ ও গতিশীল বিষয়ের চলচ্চিত্রীয় রূপ কী সুনিপুণভাবে সৃষ্টি করে গেছেন চলচ্চিত্রকার! তাতে যুদ্ধের সকল ভয়াবহতা, সকল গৌরবগাথা, সকল আশা-নিরাশা, এককথায় প্রকৃত মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতে এতটুকুও সমস্যা হয় না; বরং শোরগোলপূর্ণ চলচ্চিত্রীয় ভাষার ভূরি ভূরি উদাহরণের তুলনায় তা আরও গভীরভাবে করা সম্ভব। স্লো লিভিংও এমনই। মৃদু স্বরে জীবনকে প্রগাঢ়ভাবে পাঠ ও উদ্যাপনের সুযোগে ভরা।
দায় স্বীকার: স্ক্যান ম্যাগাজিন; জিওফ্রে অ্যান্ড গ্রেস ডট কম; ‘সিকিং স্লো’/ মেলানি বার্নস, ২০২৯; ‘টাইম এক্সপেনশন এক্সপেরিয়েন্সেস’/ স্টিভ টেইলর, ২০২৪; ‘দ্য কিনফোক হোম’/ নাথান উইলিয়ামস ২০১৫
মডেল: ইয়াশ রোহান ও নাজিফা তুষি
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: টুয়েলভ
কনসেপ্ট ও স্টাইলিং: নুজহাত খান
ছবি: জিয়া উদ্দীন