ছুটিরঘণ্টা I যাযাবরদের স্বর্গরাজ্যে
কিরগিজস্তান। মধ্য এশিয়ার অপরূপ সৌন্দর্যের দেশ। পাহাড়-পর্বত আর হ্রদে ভরা। বাংলাদেশি অভিযাত্রী দম্পতি মোহাম্মদ শহিদুল আলম ও জুলিয়া পারভীন তাদের বিশ্বভ্রমণের অংশ হিসেবে চষে বেড়িয়েছেন এর নানা প্রান্ত। তারই একঝলক জুলিয়া পারভীনের লেখায়
পামিরের গন্ধ গায়ে মেখে ওশ শহরের রাস্তায় পা ফেলামাত্রই আমরা যেন কিরগিজস্তানের ইতিহাসের পাতায় পদার্পণ করলাম! কিরগিজস্তানকে মধ্য এশিয়ার সুইজারল্যান্ড বলা হয়। কেননা এ দেশের বেশির ভাগ অংশই পর্বতশৃঙ্গ, হিমবাহ আর স্বচ্ছ হ্রদে আচ্ছাদিত। তিয়েন শান, পামির ও আলাই পর্বতমালাগুলো দেশটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাক্ষ্য দেয় প্রতিনিয়ত। এসব পর্বতমালা অভিযানপ্রেমীদের জন্য একেকটি আদর্শ গন্তব্য; যেখানে তারা ট্রেকিং, পর্বতারোহণ ও স্কিইংয়ের মতো নানা ধরনের অ্যাকটিভিটি উপভোগ করতে পারেন। আমাদের যাত্রা শুরু ওশ থেকে। এর আগে লেনিন পর্বতের পাশ থেকে ঘুরে এসেছি। ওশ শুধু একটি ভৌগোলিক স্থান নয়, সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ধারকও। সিল্ক রোডের গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান হিসেবে এ শহরের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো।
ওশ কিরগিজস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। দেশটির দক্ষিণাংশের ফারগানা উপত্যকায় এর অবস্থান। তাই একে দক্ষিণের রাজধানী বলারও চল রয়েছে। তিয়েন শান পর্বতমালার ছায়ায় বিস্তৃত ফারগানা উপত্যকার এই রত্ন তার সবুজ চাদর, ফলের বাগান আর ভিনেয়ার্ডের জন্য বিখ্যাত। ওশের প্রাচীন বাণিজ্য কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখে আমরা শহরটির গৌরবময় অতীতের সাক্ষী হলাম। অধিবাসীদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ এবং শহরটির ছিমছাম পরিবেশ দেখে মনে হলো, যেন আমরা আগন্তুক নই, বরং ওশেরই অংশ। স্থানীয় জায়মা বাজার ঘুরে, তিনতলাবিশিষ্ট ইয়ার্টে (তাঁবুবিশেষ) চড়ে এবং স্থানীয় রেস্তোরাঁয় খাবার খেয়ে এর সংস্কৃতির ছোঁয়া পেয়ে বেশ বিমোহিত।
এ শহরে থাকা সুলায়মান পর্বত দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। একে সুলায়মান-তুও নামেও ডাকা হয়। পর্বতটি বস্তুটি একটি শিলা গঠন, যা শহরটির ওপর প্রায় ২০০ মিটার (৬৫৬ ফুট) উচ্চতায় দাঁড়িয়ে আছে, উজবেকিস্তানের সীমান্তের কাছে। বহুকাল ধরে এই পর্বত পবিত্র হিসেবে গণ্য। ইউনেসকো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছে। সুলায়মান-তুও শুধু একটি পর্বত নয়; ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ধর্মের এক মেলবন্ধন। প্রাক্-ইসলামি যুগ থেকেই পর্বতটি বিভিন্ন ঐতিহ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। পর্বতের শীর্ষে অবস্থিত বাবরের মসজিদ এবং পাদদেশে অবস্থিত জাদুঘর এর সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতির সাক্ষী।
ওশ শহর আমাদের মনে একটি অমূল্য স্মৃতি রেখে গেছে। এযাত্রায় আমরা শুধু একটি শহর ঘুরে দেখিনি, বরং চোখের সামনে যেন দেখতে পেয়েছি সমৃদ্ধ ইতিহাসের নানা বাঁক। স্থান যত সুন্দরই হোক, অভিযাত্রী মন সেখানে আটকে থাকতে নারাজ! তাই এলো ওশকে বিদায় দেওয়ার ক্ষণ।
আরস্লানববে ফ্রেন্ডশিপ গেস্টহাউসে আমাদের তিন দিন থাকার বুকিং করার পর, আমরা ওশ থেকে হোটেলে যাওয়ার জন্য একটি ব্যক্তিগত গাড়ি ভাড়া করলাম। গাড়িভাড়ার খরচ ৪ হাজার কিরগিজ সোম, যা প্রায় ৪৮ মার্কিন ডলার। গেস্টহাউসে শুধু ব্রেকফাস্টসহ থাকার জন্য রাতপ্রতি ২০ ডলার গুনতে হলো। সামগ্রিকভাবে এই ট্রিপে খরচ পড়ল ১৫০ ডলার। আরস্লানববের সেরা সময় গ্রীষ্মকাল (জুন থেকে আগস্ট) ও শরৎকাল (সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর)। এসব সময়ে আবহাওয়া ভীষণ সুন্দর থাকে; ট্রেকিং, হাইকিং, স্কি এবং অন্যান্য আউটডোর অ্যাকটিভিটির জন্যও আদর্শ।
আরস্লানবব কিরগিজস্তানের একটি ছোট্ট, পাহাড়ি শহর; অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য যার খ্যাতি জগৎজোড়া। কিরগিজ আল্পস পর্বতমালায় অবস্থিত শহরটি মনোরম হ্রদ, ঘন বন আর বাবাশ-আতা পর্বতে পরিবেষ্টিত।
আমরা সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম ওয়ালনাট ফ্যাক্টরি দেখার জন্য। ওয়ালনাট বা আখরোট থেকে কীভাবে তেল উৎপন্ন হয়, তা দেখে পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে হাইকিং শুরু করলাম। উঁচু-খাড়া রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে বিভিন্ন বাড়ির মধ্যে চোখে পড়ল ফলের বাগান। নানা প্রজাতির লাল-হলুদ-বেগুনি বা কালো রঙের চেরি, আপেল, কমলা…কী নেই! পাকা ফল মাটিতে পড়ে রয়েছে; অথচ তোলার মতো কেউ নেই। হাঁটার ক্লান্তিতে এই ফলগুলো আমাদের কাছে অমৃতের মতো মনে হলো। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম ঐতিহাসিক আখরোটের জঙ্গলে। ফারগানা ও চটকল পর্বতে ঘেরা এই জঙ্গলের ব্যাপ্তি ৬০ হাজার হেক্টর। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২ হাজার মিটার উচ্চতায় অবস্থিত, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আখরোট বন। প্রাচীন কাহিনি বলে, আরস্লানববের এই বন থেকে আখরোটের বীজ ইউরোপে নিয়ে গিয়েছিলেন আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট। সেই বীজ থেকেই ইউরোপে আখরোটের বাগান গড়ে উঠেছিল। তাই রাশিয়ানরা আজও আখরোটকে গ্রিক বাদাম বলে ডাকে।
বন ঘিরে ধর্মীয় কিংবদন্তিও রয়েছে। তবে বিজ্ঞানীদের গবেষণামতে, আরস্লানববের চারপাশের আখরোটের বনটি সম্ভবত প্রায় হাজার বছরের পুরোনো। এটি আরেকটি স্থানীয় গল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা বলে, এ বনে বীজ সেই আরস্লানবব-আতার (মতান্তরে, আরস্তানবাপ-আতা) নেতৃত্বে রোপণ করা হয়েছিল, যিনি গ্রামটি নিজের নামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং যার মৃত্যু ঘটেছে আনুমানিক ১১২০ সালে। বিভিন্ন কিংবদন্তি থেকেই বোঝা যায়, আরস্নানববের আখরোট বন কত প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ। বনের অপরূপ সৌন্দর্য দেখে আমাদের চোখ ফেরানো মুশকিল হয়ে পড়ল!
আমাদের এবারের যাত্রা দীর্ঘ হওয়ার কারণ, আমরা গাড়ি ভাড়া করেছি চার দিন তিন রাতের জন্য। শুধু গাড়ি ভাড়ার খরচই ৫০০ ডলার। থাকার জন্য রাতপ্রতি কোথাও ৬০, কোথাও ৩০ থেকে ৩৫ ডলার খরচ পড়েছে। সব মিলিয়ে ৮০০ ডলার চলে গেছে পকেট থেকে! খরচ আরও বেশি পড়ত, যদি আমরা আরও অ্যাকটিভিটি করতাম। আবহাওয়া অনুকূল না থাকায় যাত্রাপথে অনেক কিছু বাদ দিতে হয়েছে; যেমন সং-কুল (উচ্চারণভেদে, সন-কুল) হ্রদের পাশে হর্স রাইডিং কিংবা কিঞ্জ আর্ট পাস থেকে ঘোড়ায় চড়ে ওই হ্রদে যাওয়া অথবা হ্রদের পাশে কোনো ইয়ার্টে রাত কাটানো। তবু যতটুকু দেখেছি, সং-কুল হ্রদ অন্তরে গেঁথে গেছে চিরকালের মতো। বলে রাখি, কির্গিজ আলা-তু পর্বতশ্রেণির বুকে অবস্থিত এ হ্রদ শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত দৃশ্যের জন্য নয়, হাজার বছর ধরে যাযাবর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দু হিসেবেও তাৎপর্যপূর্ণ। হ্রদটির কিনারে যাযাবরেরা পশুপালন করে এবং প্রকৃতির সঙ্গে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে তোলে।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩ হাজার মিটার ওপরে অবস্থিত সং-কুল লেকে যেতে জালালাবাদ হাইওয়ে হয়ে নারিন শহর অতিক্রম করে ২৭৫ কিলোমিটার পাড়ি দেওয়ার কথা থাকলেও আমাদের আরও অতিরিক্ত পথ পেরোতে হয়েছে। কেননা, হ্রদ থেকে মাত্র ৪০ বা ৫০ কিলোমিটার আগে গাড়িচালক থেমে গিয়ে বললেন, আবহাওয়া নিতান্তই খারাপ বলে গাড়ি আর ওপরে যাবে না। হুট করেই তুষারপাত শুরু হয়ে গেছে; তাই আরও উঁচুতে উঠলে গাড়ির চাকা পিছলে যাওয়ার ঝুঁকি প্রবল। আশপাশে ৬০ কিলোমিটারের মধ্যে থাকার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় গাড়িতেই অপেক্ষা করতে হবে। আমাদের সং-কুল হ্রদ দেখার নিয়তি পুরোপুরি আবহাওয়ার ওপর; সকালে তুষারপাত না হলে তবেই যেতে পারব। অন্যথায় এখানেই যাত্রা শেষ! এমন বাস্তবতায়, কনকনে ঠান্ডায় এখানে থাকার বদলে বরং ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
পরদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। তুষারপাত নেই, ভালো কথা; কিন্তু রোদের ছিটেফোঁটাও নেই! অনেক কষ্টে, কয়েকজন স্থানীয় বাইকারের মাধ্যমে আমরা ড্রাইভারকে রাজি করালাম ওপরের দিকে যেতে। আবহাওয়া খারাপ থাকলে ফিরে আসব—এই প্রতিশ্রুতিতে যাত্রা শুরু হলো। পাহাড়ি রাস্তায় যেতে যেতে তুষারাবৃত পাহাড়গুলো চোখে পড়ল, যেগুলো আগের দিন অন্ধকারে দেখতে পাইনি। আবহাওয়া প্রতিকূল থাকায় ঘূর্ণি পথে, একটি কয়লার খনি পার হয়ে ওপরের দিকে উঠতে থাকলাম। এটি কিরগিজস্তানের বৃহত্তম কয়লাখনি। নাম কারা-কেচে। কোমুরের মালিকানাধীন একটি ভূগর্ভস্থ লিগনাইট কয়লার খনি। এই প্রথম আমরা তুষারাবৃত পাহাড়ে গরু থেকে শুরু করে ভেড়া, ঘোড়ার পাল প্রভৃতি দেখতে পেলাম। এখানকার ঘোড়া দুবাইসহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে রপ্তানি করা হয়। এই পাহাড়ের যাযাবরেরা এখানকার অর্থনীতিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
নিসর্গের রূপে বিমোহিত হতে হতে, অবশেষে পৌঁছতে পারলাম সং-কুল লেকে। প্রায় ২৭০ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত, কিরগিজস্তানের বৃহত্তম স্বাদুপানির হ্রদ এটি। আকারে আমাদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বড়। সড়কটি এক প্রান্তে একটি দীর্ঘ পথ ঘুরে যায়। হ্রদের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস যাযাবরদের। আমরা বহুক্ষণ হ্রদের পাশে বসে এর সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। যেহেতু সকাল থেকেই অভুক্ত, তাই বাধ্য হয়ে দুপুর দুইটা নাগাদ সেখান থেকে অন্য পথ ধরে নামতে শুরু করলাম। ফিরতি পথে বারবার গাড়ি থামাতে হলো; কেননা, ঘোড়া কিংবা ভেড়ার পাল একটু পরপর আটকে দিচ্ছিল রাস্তা।
অন্তরছোঁয়া সং-কুল লেক থেকে ফিরে, পরবর্তী গন্তব্য ইসিক-কুল হ্রদের দিকে পথ চলা শুরু হলো আমাদের। হোটেলে পৌঁছতে বেজে গেল রাত প্রায় নয়টা। ড্রাইভার পরামর্শ দিলেন, সারা দিন যেহেতু অভুক্ত রয়েছি, তার ওপর বেশ রাত হয়ে গেছে, একটু পর খাবার পাওয়া যাবে না, তাই আমরা যেন ঝটপট খেয়ে নিই।
তার পরামর্শ মেনে ডাইনিং ইয়ার্টের দিকে এগিয়ে গেলাম। ম্যাকারনি স্যুপ, সঙ্গে আলু ও মাংসের টুকরো মিশ্রণের একরকমের খাবার যোগে ডিনার সারতে দারুণ লাগল! বোকোনবায়েভোতে অবস্থিত বসোগো ইয়ার্ট ক্যাম্পটি ইসিক-কুল হ্রদের তীরে অবস্থিত। এই তিন তারকা মানের হোটেলের প্রতিটি ইয়ার্ট থেকে লেকের দৃশ্য দেখা যায়। এখানে বিনা মূল্যে ব্যক্তিগত গাড়ি রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। আরও রয়েছে ড্রাইভারদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, যা তারা পর্যটক নিয়ে এলে বিনা মূল্যেই পান। এই প্রথা মধ্য এশিয়ার সর্বত্র প্রচলিত। পামির হাইওয়েতে এর চল সবচেয়ে বেশি দেখতে পেয়েছি আমরা।
হোটেলটি বেশ দারুণ; পরিবেশবান্ধবও। রাতে আরও কয়েকজন পর্যটকের সঙ্গে পরিচয় হলো। তাদের মধ্যে অনেকে দুবাই ও ইউরোপ থেকে এসেছেন; কয়েকজন রাশিয়া থেকে। আমরা একটু হাঁটাচলা করে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে নাশতা সারতে গেলাম হ্রদের পাশে। ভেবেছিলাম, সকালে হ্রদের পানি গরম থাকবে; পা ভেজাতে পারব। কিন্তু বিধি বাম! পানি ভীষণ ঠান্ডা।
‘ইসিক-কুল’ কিরগিজ ভাষার শব্দ। সরল বাংলা হতে পারে ‘উষ্ণ হ্রদ’। তিয়েন শানের ‘নিলাম্বিত মণি’ বলে খ্যাত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১ হাজার ৬০৭ মিটার উচ্চতায় অবস্থান। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পার্বত্য হ্রদ। গভীরতা প্রায় ৬৬৮ মিটার। বায়োসফিয়ার সংরক্ষিত এলাকার মধ্যে অবস্থিত এই হ্রদ দৈর্ঘ্যে ১৮২ এবং প্রস্থে ৬০ কিলোমিটার। মোট আয়তন প্রায় ৬ হাজার ২৩৬ বর্গকিলোমিটার। উচ্চতায় অবস্থান ও পানির উৎসের কারণে এই হ্রদের পানি শীতকালেও তুলনামূলক উষ্ণ থাকায় এমন নামকরণ। অভিযাত্রী হিসেবে আমাদের জন্য সবচেয়ে রোমাঞ্চকর হয়ে ধরা দিলো পাড় ঘেঁষে গাড়িতে চড়ে পুরো হ্রদ ভ্রমণ এবং দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে পাওয়া।
ইসিক-কুল হ্রদের দক্ষিণে লুকিয়ে রয়েছে এক জাদুকরি স্থান—সাজকা ক্যানিয়ন; যাকে রূপকথার গিরিখাতও বলা হয়। অপূর্ব সুন্দর। এই গিরিখাতে এমন সব অদ্ভুত ও বিচিত্র পাথরের গঠন রয়েছে, দেখতে চীনের গ্রেটওয়াল, জলহস্তী, দুর্গ ও পেঙ্গুইনের মতো! লাল বালু, ধূসর ও সবুজ রঙের এই পাথরগুলো দেখে আমরা রীতিমতো হতবাক। কিংবদন্তি অনুসারে, ইসিক-কুল হ্রদ একসময় বেশ কয়েকটি ধনী ও শক্তিশালী শহরের মিলনস্থল ছিল। সত্যি বলতে, পুরাতত্ত্ববিদেরা হ্রদের নিচে বেশ কয়েকটি বসতির প্রমাণ আবিষ্কার করেছেন, তাই সম্ভবত এই কিংবদন্তিতে কিছু সত্যতা রয়েছে।
তবে কিংবদন্তি অনুসারে, এই শহরগুলোর একটিতে একজন অতি সুন্দরী নারী বাস করতেন। তিনি এতই রূপসী ছিলেন যে এক ড্রাগন তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু নারীটি সেই প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে রাগে ফেটে পড়ে ড্রাগনটি এই উপত্যকাকে অভিশাপ দিয়েছিল, নারীটি তার মন পরিবর্তন করে ড্রাগনকে বিয়ে করতে রাজি না হওয়া পর্যন্ত প্রতি পূর্ণিমার রাতে ইসিক-কুল উপত্যকা প্লাবিত হবে। স্থানীয় অধিবাসীরা এই উপত্যকাকে প্লাবিত হওয়া থেকে রক্ষা করতে এর কূপগুলোকে পর্যায়ক্রমে সোনার ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিতেন। এভাবে তারা কয়েক দিনের জন্য উপত্যকাটি বাঁচাতে পেরেছিলেন। কিন্তু একদিন নারীটি নিজেই কূপগুলো ঢাকতে ভুলে গেলেন। ফলে কূপ থেকে পানি উপচে পড়ে ইসিক-কুল হ্রদে পরিণত হলো। পুরো এলাকা তলিয়ে হ্রদে পরিণত হতে দেখে ড্রাগন এতটাই শোকাহত হয়েছিল যে, সে পাথর হয়ে গেল। সেই পাথর থেকেই এই গিরিগাতের জন্ম।
কিংবদন্তিটি আমাদের কাছে বেশ মজার ও অদ্ভুত মনে হলেও, চোখের সামনে দেখে মুহূর্তেই স্বীকার করে নিয়েছি, এর পাথরের গঠনগুলো সত্যিই রূপকথার মতো। আর সম্ভবত এ কারণেই এমন নামকরণ।
এরপর আমাদের চোখের সামনে ধরা দিলো জেটি-ওগুজ গর্জ, বা সাতটি ষাঁড়-পাথর। সহজ কথায়, জেটি-ওগুজে সাতটি লাল পাথরের সংগ্রহ রয়েছে, যেগুলোর প্রতিটিকে মাটিতে শুয়ে থাকা ষাঁড়ের মতো দেখায়। কীভাবে এই পাথরগুলো এমন রূপ পেয়েছে, তা নিয়েও একটি কিরগিজ কিংবদন্তি প্রচলিত। বহুকাল আগে এ অঞ্চলে দুই খানের বসবাস ছিল, যাদের মধ্যে একজনের স্ত্রী ছিল বেশ রূপসী। অন্য খান সেই নারীর প্রেমে পড়ে তাকে তার স্বামীর কাছ থেকে চুরি করে নিয়ে গেল। এতে দুই খানের মধ্যে এক নির্মম লড়াই ও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার সূচনা ঘটল। দ্বিতীয় খান এক অনিচ্ছুক জ্ঞানীর কাছ থেকে পরামর্শ চাইল। জ্ঞানী ব্যক্তি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়াতে চায়নি; তবে পরামর্শ দিল, যেন প্রথম খান কখনো ফিরিয়ে নিতে না পারে, সে জন্য দ্বিতীয় খান যেন ওই স্ত্রীকে খুন করে।
দ্বিতীয় খান একটি বড় উৎসবের আয়োজন করে সাতটি ষাঁড়কে হত্যার আদেশ দিল। সর্বশেষ ষাঁড়টিকে হত্যার পরপরই স্ত্রীকে খুন করে ফেলল সে। তার হৃদয় থেকে রক্তের ঝরণা প্রবাহিত হয়ে সাতটি ষাঁড়কে ধুয়ে ফেলল। খান এরপর নিজের দাসদের হত্যা করল। পড়ে থাকা ষাঁড়গুলো একসময় ধীরে ধীরে পরিণত হলো লাল পাথরে। আজও সেই পাথরগুলো জেটি-ওগুজ নামে পরিচিত। এ জন্য নাকি ওপর থেকে দেখলে এই লাল পাথরগুলোর আকার ব্রোকেন হার্টের মতো দেখায়। আমরা পরখ করার জন্য ড্রোন ভিউর সাহায্য নিতে গিয়ে ঘটল বিপত্তি! ড্রোন অপারেট করার সময় হোম পয়েন্ট ভুলভাবে আপডেট হওয়ায় কোথায় ল্যান্ডিং করেছে, বুঝতে পারলাম না। কেননা, এরই মধ্যে ড্রোনের ব্যাটারি জিরো দেখাচ্ছে। আমরা একটি পাহাড়ের ওপর থেকে ড্রোনের ফুটেজ নিচ্ছিলাম। হঠাৎ ফুটেজ খেয়াল করে দেখি, ড্রোন পাহাড় বেয়ে নিচে চলে গেছে! অনেক খোঁজার পরে অবশেষে সেটিকে পাওয়া গেল রাস্তার পাশে। অক্ষত অবস্থায় ড্রোনটিকে উদ্ধার করতে পেরে আমরা তো মহাখুশি! এরই মধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে, তাই হোটেলমুখী হলাম। আমাদের পরের গন্তব্য বিশকেক।
বিশকেক থেকে মাত্র ৮০ কিলোমিটার দূরে, ইতিহাসের পাতায় মুদ্রিত বুরানা টাওয়ার কিরগিজস্তানের মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে। মধ্যযুগীয় এই টাওয়ার এগারো শতকের, ইটের বিশাল এক মিনার। উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এটি পুনর্নির্মাণ করে। সিল্ক রোডের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত। মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন ইটের মিনার হিসেবে পরিচিত। এই প্রাচীন বাণিজ্যপথের ধারে কিরগিজস্তানের অবস্থান এবং এর ইতিহাস এই টাওয়ারের প্রতিটি ইটে খোদাই করা।
তোকমক শহরের দক্ষিণে অবস্থিত এই ২৪ মিটার উঁচু টাওয়ারের চূড়া থেকে পাহাড়ি দৃশ্য অসাধারণ। খাড়া সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময় মনে হলো, আমরা যেন সময়ের স্রোতে ভেসে যাচ্ছি। আমাদের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া ও চীন থেকে আসা বেশ কয়েকজন পর্যটক। টিকিটের বদলে আমরা যখন ডাকটিকিট পেলাম, মনে হলো, এই ইতিহাসের একটি অংশ হয়ে গেছি। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা (গ্রীষ্মে সন্ধ্যা ৬টা) পর্যন্ত টাওয়ারের চূড়ায় ওঠার সুযোগ থাকে।
এই টাওয়ার একসময় সগদিয়ান ও পরবর্তীকালে কারাখানিদদের রাজধানী হয়ে ওঠা প্রাচীন শহর বালসাগুনের অবশিষ্টাংশে পড়েছে। উনিশ শতকের সত্তরের দশকে সোভিয়েত প্রত্নতত্ত্ববিদেরা এই স্থান খনন করেছিলেন। এখান থেকে পাওয়া বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন একটি ছোট্ট জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। টাওয়ারের পাশেই সুন্দর একটি স্যুভেনির দোকান, যেখানে স্থানীয় হস্তশিল্প পাওয়া যায়। অতীতের স্পর্শ নিয়ে আমরা বিশকেকের উদ্দেশে রওনা হলাম।
বিশকেক কিরগিজস্তানের রাজধানী এবং সবচেয়ে বড় শহর। এ শহরে প্রবেশমাত্রই প্রচণ্ড ট্রাফিক জ্যাম আমাদের যাত্রা প্রায় থমকে দিল। মাত্র দশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের জন্য ঠিক করে রাখা এয়ারবিএনবি অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছতে লেগে গেল প্রায় দেড় ঘণ্টা। বিশকেকে থাকাকালে খেয়াল করলাম, শুধু প্রধান সড়কগুলোতেই নয়, ছোট-বড় সব রাস্তাতেই একটু পরপর ট্রাফিক সিগন্যাল। হয়তো এ ব্যবস্থাই ট্রাফিক জ্যামের মূল কারণ। এ শহরে বেশ কয়েকজন ভারতীয় ও বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সঙ্গে পরিচয় হলো। তাদের বেশির ভাগই এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চিকিৎসা বিষয়ে পড়াশোনা করছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে কিরগিজস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম।
বিশকেক একসময় ফ্রুঞ্জি এবং তারও আগে পিশপেক নামে পরিচিত ছিল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৮০০ মিটার (২ হাজার ৬০০ ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত শহরটি কিরগিজ আলা-তু পর্বতমালার (তিয়েন শান পর্বতমালা) উত্তর প্রান্তের কাছে অবস্থিত। পর্যটকের কাছে এ শহরের প্রতিটি প্রান্তে রয়েছে অগুনতি মুক্তো ছড়ানো! ওশ বাজারের জমজমাট পরিবেশ, আলা-তু স্কয়ারের ঐতিহাসিক গুরুত্ব, রাষ্ট্রীয় ইতিহাস জাদুঘর ও চারুকলা জাদুঘরের সমৃদ্ধ সংগ্রহ—সব মিলিয়ে বিশকেককে এক অনন্য স্থান করে তুলেছে। কীভাবে ভুলে যাব প্লাভের মতো সুস্বাদু খাবারের কথা? বেশবরমাক (ঘোড়ার মাংস ও নুডলস) এবং সাসলিক তো আছেই!
বিশকেকে তিন রাত কাটিয়ে আমরা আলমাটা যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। আশা করি সেখানেও একই রকম আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা পাব।
ছবি: লেখক