skip to Main Content

ফিচার I খাজা খিযরের আলোর উৎসব

ইতিহাস, পুরাণ আর ঐতিহ্যে একাকার এক প্রাচীন উৎসব। সময়ের পরিক্রমায় জৌলুশ হারালেও এখনো চলমান। বিস্তারিত আল মারুফ রাসেলের লেখায়

১০ সেপ্টেম্বর ১৬২৬ (২৬ ভাদ্র ১০৩৩ বঙ্গাব্দ)। সরকারি আদেশ পেতেই কিলা আওরাঙ্গবাদের নদীঘেঁষা প্রাচীর থেকে তোপ দাগা হলো, নদীর দিকে। আর সেই সঙ্গে গোটা নদীর জলে যেন আগুন লেগে গেল! অন্ধকার রাতের নদীতে তার চেয়েও কালো পানিতে জ্বলে উঠল হাজার হাজার আলোর নৌকা। পানিতে সেটার প্রতিবিম্ব পড়ে মনে হচ্ছিল, যেন আকাশ থেকে তারাগুলো নেমে এসেছে বুড়িগঙ্গার জলে। ঢাকার প্রতিষ্ঠাতা ইসলাম খান চিশতির জামাতা মুকাররাম খান চিশতি (জাহাঙ্গীরনগরের সপ্তদশ সুবাহদার) এই আয়োজন করেছিলেন। এমনই ছিল খোয়াজ খিযরের আলোর উৎসবের রাত। নদীর ধারে বসত মেলা। মজার ব্যাপার হলো, এই আলোর উৎসব নিতান্তই ছিল বাংলার নিজস্ব। পরে এখানে আসা গুরকানি (মোগল) অভিজাতেরা এটাকে বরণ করে নিয়েছিল নিজস্ব কায়দায়।
দুঃখের ব্যাপার হলো, বাংলাদেশে, এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও বেড়া ভাসান নিয়ে বিশদ কাজ হয়নি। এটা নিয়ে দুকলম লিখেছেন ইংরেজ আমলে জেমস টেইলর, পাকিস্তান আমলে আহমাদ হাসান দানি; দানি অবশ্য টেইলরের পুনরাবৃত্তি করেছেন। টেইলর বলছেন, ‘বেইরাহ উৎসব খানজাহ কিযির (সম্ভবত নবি ইলিয়াস) উৎসব। এ সময় খুব জাঁকালোভাবে আয়োজন করা হতো। এ সময়ে “নাওয়ারা” পালন করা হতো। কিন্তু পরে এই উৎসব উদ্‌যাপন কিছুটা স্তিমিত হয়ে যায়—মুর্শিদাবাদ ও দেশের অন্যান্য শহরের চেয়ে এই উৎসব এখানে কোনো জাঁকজমক ছাড়াই উদ্‌যাপিত হতো। এখানে নদীতে রক্ষাকারী দেবতা “ভাদুর”-এর উপাসনা করা হতো। সাধারণভাবে এবং ফল ও ফুল অর্পণ করে এ দেবতার অনুগ্রহ কামনা করা হতো। মাটির পাত্রে বা কুমড়ার খোলে এসব নৈবেদ্য পুরে পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হতো। মেঘনা নদী বরাবর নিম্নাঞ্চল চট্টগ্রাম পর্যন্ত “ভাদুর” দেবতার উপাসনা হতো…।’ উনিশ শতকের বাঙালি মুসলিমদের ইতিহাস সম্পর্কে মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জানাচ্ছেন, ‘বেশ কয়েকটি পীর নির্ভর ধর্মমত বাংলায় মুসলিম সমাজে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এগুলোর মধ্যে “খোয়াজ খিযর”, “জিন্দা গাযী”, “পীর বদর” এবং “শেখ সাধু” উল্লেখযোগ্য।…যেমন খোয়াজ খিযরের উদ্দেশে নিবেদিত “বেড়া” উৎসব। আঠারো ও উনিশ শতকের বাংলায় ভাদ্র মাসের শেষ বৃহস্পতিবার ধনী-দরিদ্র সকলেই এই অনুষ্ঠান উদ্‌যাপন করত।’
জেমস ওয়াইজের মতে, বর্ষার শেষে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝি ও জেলেরা এই উৎসব উদ্‌যাপন করতেন। ‘বেড়া’ কাগজ দিয়ে তৈরি করে রঙিন কাপড় দিয়ে সাজানো হতো। এটার নারী-চেহারার গলুই থাকত, আর মাথা ও বুক হতো ময়ূরের মতো—অর্থাৎ মাথায় ময়ূরের ঝুঁটিও থাকত। ময়ূরপঙ্খী নৌকার মতোই এটা তৈরি করা হতো। তারপর এই প্রতিকৃতিকে কলাগাছের তৈরি ভেলায় বসিয়ে সূর্যাস্তের সময় ভাসানো হতো। অস্তাচলগামী সূর্যরশ্মি পানির স্রোতে মিশে অপূর্ব দৃশ্য তৈরি করত।
সৈয়দ গোলাম হোসেন (সালিম) খান তাবতাবায়ি তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা মুর্শিদাবাদে এই উৎসব জাঁকজমকের সঙ্গে উদ্‌যাপন করেছিলেন। অবশ্য সুশীল চৌধুরী বেশি অতীতে ঘাঁটাঘাঁটি না করেই বলে দিয়েছেন, ‘বেরাভাষা বলে মুর্শিদাবাদের শিয়াদের একটি প্রাচীন উৎসব আসলে হিন্দুদের গঙ্গাপূজার মুসলিম সংস্করণ।’
কে এই খোয়াজ খিযর
মিথ আর রহস্যে একাকার হয়ে যাওয়া এক চরিত্র খোয়াজ খিযর। সূরা কাহ্ফের ৬০ থেকে ৬৫ নম্বর আয়াতে হযরত মূসা (আ) ও ইউশা বিন নূনকে ধৈর্যশীল ও প্রশ্নহীন হওয়ার দীক্ষা দিতে দেখা যায় খোয়াজ খিযরকে। আবার দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডারের সঙ্গে পথপ্রদর্শক হিসেবে তার অভিযানের কথা শোনা যায়—ইথিওপিয়ায় তারা খুঁজে পেয়েছিলেন অমরত্বের অমৃত সুধা—‘আব-ই-হায়াত’। তিনি এই সুধা পান করতে পারলেও আলেকজান্ডারের অধরা থেকে যায় অমৃত। তাই খোয়াজ খিযর সেই অমরত্ব নিয়ে এখনো বেঁচে আছেন সেমিটিক সংস্কৃতিতে; পাশাপাশি ইরান-তুরান হয়ে সিন্দ পাড়ি দিয়ে বাংলায়। সিন্দ ও বাংলায় তিনি দরিয়ায় পথহারার পথপ্রদর্শক, জলের বিপদ-আপদ থেকে রক্ষাকারী। সিন্দ ও বাংলার লোকবিশ্বাসে তিনি হিন্দু-মুসলিম সবার কাছেই সম্মান ও শ্রদ্ধার। কথিত আছে, তিনি এক মাছের পিঠে সওয়ার হয়ে সিন্দে এসেছিলেন। সিন্দে সেই মাছ হলো পাল্লা মাছ, বাংলায় যাকে আমরা ইলিশ বলি। সিন্দে তিনি অনেক নামে—জিন্দা পীর, ঝুলে লাল, দারিয়া লাল, উদেরো লাল ইত্যাদি হিসেবে পরিচিত হলেও বাংলায় কেবল খোয়াজ খিযর; জিন্দা পীর তার বিশেষণ। তবে তিনি নবি, ফেরেশতা না সুফি সাধক—তা নিয়ে কোনো উপসংহার টানা যায়নি; কেবল তার অমরত্বের গল্পই টিকে আছে। আনন্দ কুমারস্বামী বলেছেন, ‘ভারতে, খাজা খিযর, পীর বদর বা রাজা কিদার নামে পরিচিত নবি, সাধু বা দেবতা, মুসলমান ও হিন্দুদের কাছে সাধারণ একটি এখনো টিকে থাকা জনপ্রিয় ধর্মীয় উপকরণ।… যদিও বিহার ও বাংলায় এই কাল্টের প্রসার খুব কম। হিন্দুধর্মে, খাজাকে আলো দিয়ে পূজা করে ও ভালোমতো ব্রাহ্মণ-ভোজনের মাধ্যমে, আর হিন্দু ও মুসলিম রীতিতে একইভাবে, একটি পুকুর বা নদীতে আলো দিয়ে সাজানো একটি ছোট নৌকা ভাসিয়ে দেওয়া হয়। বিভিন্ন চিত্রে খাজা খিযরকে একজন বয়স্ক মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, একজন ফকির হিসেবে, সম্পূর্ণ সবুজ পোশাক পরা এবং যিনি বাহন হিসেবে একটি “মাছ” নিয়ে জলে চলাচল করছেন।’
পাকিস্তানের সিন্দ এলাকার সুক্কুর শহরের পাশের এক দ্বীপে তার যে দরগা রয়েছে, সেটি ৯২৫ হিজরিতে অর্থাৎ ১৫১৯-২০ সাল নাগাদ তৈরি। তবে সেখানে তিনি শায়িত আছেন এমন দাবি করা যাবে না; তার অমরত্বের কারণেই যদিও অনেকে এমনটা দাবি করেন।
খোয়াজ খিযরের বেড়া ভাসান
বলা হয়, বাংলায় বেড়া ভাসান শুরু গুরকানিদের শাসনামলে, কারতলব খানের (পরে মুর্শিদ কুলি খান) হাত ধরে। তবে এটা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। কারণ, প্রকৃতিগতভাবে পানি যেখানে মানুষের জীবনের নিয়ন্তা, সেখানে বেড়া ভাসানের মতো লৌকিক আচার গুরকানি শাসন আসা পর্যন্ত হয়নি, এটা ভাবা উচিত হবে না। হয়তো গুরকানি শাসনামলে বিপুল পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে রাজন্যবর্গ, অভিজাতদের। শাসকের বিশ্বাস চেপে বসেছে জনমানুষের প্রাচীন বিশ্বাসের ওপর। ফলে সেটাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। প্রাচীন বিশ্বাসের এমন প্রমাণ মেলে ভাদুলি ব্রত আর মাকাল ঠাকুরের পূজায়। স্বামী, সন্তান বা আত্মীয় নৌযাত্রায় যাওয়ার আগে ও ফিরে আসার আগে ভাদুলি ব্রত পালন করতেন হিন্দু নারীরা। তারা স্বজনকে নৌযাত্রায় পাঠিয়ে জলের কল্পিত অদৃশ্য শক্তির উদ্দেশ্যে নানাবিধ উপচার ও নৈবেদ্যর ডালি সাজিয়ে স্তুতি ও প্রশংসামূলক গান-গীতসহ ভাদুলি ব্রতের আয়োজন করতেন। আবার জেলে ও মাঝিদের মধ্যে অভিযানের আগে দেখা যায় মাকাল ঠাকুরের পূজা। পুরোহিত ও আড়ম্বরহীন এই পূজা দিলে জালে মাছ পড়বে বেশি, পথে বিপদ হবে না—এই বিশ্বাসে মন্ত্রহীন পূজায় মনোকামনা ব্যক্ত করে ফুল, বাতাসা ও সিঁদুর নৈবেদ্য দেওয়া হয় কল্পিত মাকালের ঢিবিতে। দুটোই হয় বা হতো ভাদ্র মাসে, যখন বর্ষার পর নদী ভরাট হয়ে বিপদের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিত।
ঠিক একইভাবে ‘বেড়া’তে যখন নৈবেদ্য দেওয়া হয়, মূল উদ্দেশ্য থাকে পানি দিয়ে যেন তার কোনো অকল্যাণ না হয়। বিভিন্ন মানুষ, বিভিন্ন মনোকামনায় মোমবাতি, আগরবাতি, বাতাসা, ফুল, সিঁদুর নিয়ে নৈবেদ্য দেয়; এর জন্য মৌলবি বা পুরোহিতের দরকার পড়ে না। প্রাচীন ব্রত বা পূজার সঙ্গে এখানেই এর সাদৃশ্য রয়েছে। নদ-নদীবেষ্টিত বাংলার সকল এলাকাতেই তাই বেড়া ভাসান পালিত হয় সেই এলাকার বৈশিষ্ট্য ও স্বতন্ত্রতায়। বেড়া ভাসানের প্রথম উল্লেখ তাই গুরকানিদের পড়ন্ত সময়ে পাওয়া গেলেও তা আদৌ গুরকানি কোনো উৎসব নয়; বরং এটা বাংলার লোকসমাজের সম্প্রীতির এক নিদর্শন হয়ে উঠেছিল সে সময়ে।
কদম মাস্তানের বেড়া ভাসান
২০২৩ সালে আমার সুযোগ হয়েছিল মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং এলাকার ঘোড়দৌড় বাজার লাগোয়া কদম আলী মাস্তানের দরগার ভাসান দেখার। মুন্সিগঞ্জ জেলার সবচেয়ে বড় বেড়া ভাসান হয় এখানেই, ভাসানের জন্য প্রমত্তা পদ্মার চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে! সেপ্টেম্বর মাসের ১৪ তারিখ, বৃহস্পতিবার বিকেলে ঘোড়দৌড় বাজারে গিয়ে দেখা গেল এলাহি ব্যাপার-স্যাপার। দরগা এক সরু গলির ভেতরে হলেও মাওয়া-মুন্সিগঞ্জ সড়কেও দূরদূরান্ত থেকে আগত মানুষের ভিড়। ভিড় ঠেলে মাজারের কাছে শুরুতেই দেখা গেল গ্রাম্য মেলার সবচেয়ে সাধারণ দৃশ্য—গজা, নিমকি, তেলেভাজা আর জিলিপির দোকান, অস্থায়ী প্যান্ডেল টাঙিয়ে। তারাই জানালেন, এক সপ্তাহ ধরে চলছে তাদের দোকান। মাজারে ঢুকতে ঢুকতে পাওয়া গেল শহুরে খাবারের দোকান, চটপটি, তেহারি, কাবাব, চিংড়ির মাথা ভাজার দোকান। সঙ্গে মাটির জিনিস, টুকটাক মনিহারির দোকান, বাচ্চাদের খেলনা, বেলুন তো ছিলই।
মাজার প্রাঙ্গণে ঢুকতেই চোখ ছানাবড়া হওয়ার দশা। দুপাশে তেরপলের নিচে যে যার মতো করে বসেছে হাজারখানেক মানুষ, ছোট ছোট দলে। তাদের পীরের, মুর্শিদের ছবিতে ফুলের হার, সামনে মোমবাতি জ্বালিয়েও অনেকে ছিলেন। আর ছিল ছোট ছোট গানের দল। দুই পাশের প্যান্ডেলের মাঝ দিয়ে যে পথ চলে গেছে, সেখানে বিক্রি হচ্ছে নৈবেদ্য, নানা ধরনের ফল। সেখানেও অবশ্য জাতপাতের বালাই নেই। মাল্টা থেকে শুরু করে আমড়া, দেশি কলা, জাম্বুরা, বেল—সবই রয়েছে। পাশেই মানতের জন্য আগরবাতি আর মোমবাতির বিক্রিবাট্টা। সেটা উজিয়ে আরও সামনে কদম মাস্তানের মাজারের সামনে যাওয়াই কষ্টের। পাশেই যে শিরনি বিতরণ চলছে মাটির মালসায় করে—নিরামিষ খিচুড়ি। সেদিকে আর না গিয়ে আবার পিছিয়ে আসা। জানা গেল নদীর ওপার, মানে মাদারীপুর থেকেও মানুষেরা এসেছে এখানে; ঢাকা থেকে তো আছেই। তেরপলের এক পাশে তখনো চলছে বেড়া সাজানোর কাজ। আঞ্চলিক স্বকীয়তা চোখে পড়ল এখানেও। কোথাও সেই নারীমুখ বা ময়ূরের সাজ নেই; বরং মুন্সিগঞ্জের চিরাচরিত বহনযোগ্য টিনের ঘরই এখানে ভাসানো হয় কলার ভেলায় করে। স্থানীয় লোকেরা তখন কাগজের নকশা সাঁটছে ঘরে। আরেক পাশে ব্যান্ড পার্টি বেসুরোভাবে কিছু সুর তুলছে। গাঁদা ফুলের মালা তখনো গাঁথা হচ্ছে। যেখানে বেড়ার কাজ চলছে, সেটা বাঁশের ঘের অনেকখানি ঘিরে দেওয়া, আর তারও ভেতরে আরেকটি অদৃশ্য ঘের রয়েছে আগরবাতির। যারা মানত করে নৈবেদ্য দিচ্ছেন, তারাই কেবল সেই অদৃশ্য দেয়ালের ভেতরে যাচ্ছেন। ফল, ফুল, আগরবাতি, বাতাসা, কদমা, শিরনির খিচুড়ি, পায়েস, মোমবাতি থেকে শুরু করে কবুতরও রাখা হচ্ছে বেড়ার ঘরে। ছাগল আর মুরগি মানতে এলেও সেটা চলে যাচ্ছে মাজারের খোয়াড়ে। নারীরা মানত দিচ্ছেন আর প্রণাম করছেন এই বেড়ায়; এ ক্ষেত্রে বোরকা ও সিঁদুরে বিভেদ নেই। আবার মুসলিম পুরুষেরা বসে দোয়া পড়ছেন; হিন্দুরা পড়ছেন মন্ত্র। মূলত এশার নামাজের পর থেকেই শুরু হলো গান। কোনো দলে গাইছে—
‘আমার নাওখান কে চালাইবোরে মাঝি মাল্লা নাই/ নৈরাকারে দৈরার পরে খোয়াজ খিযির সাঁই/ চারিদিকে চাইয়া দেখি কূল কিনারা নাই।’
আবার কোথাও চলছে—‘আল্লা আল্লা বল সবে/ দয়াল আল্লার নামটি সার/ খোয়াজ খিযরের নামটি লইয়া/ ভব দইরা হইয়া যাইবা পার।’
রাত দশটা নাগাদ আকাশে বিদ্যুতের চমক আর দমকা হাওয়ার কারণে জলদিই মোনাজাত শুরু হলো। মোনাজাতে পাঁচ পীর, কদম মাস্তানের নাম নেওয়া হয়। তারপর জলদিই সেটা শেষ করে দেওয়া হয় বিরূপ আবহাওয়ার কারণে। এরপর কলাগাছের ভেলার ওপরের ঘরকে ট্রাকে তোলা হয়, বিসমিল্লাহ ও কলেমা পড়ে। ততক্ষণে ভেলায় আরও যোগ হয়েছে মাটির এক ঘড়া পানি; সঙ্গে পাঁচটি আমপাতা আর সিঁদুর। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির ভেতরেই সেই বেড়া মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় প্রায় এক কিলোমিটার দূরের লৌহজং ঘাটে। নিতান্ত অনাড়ম্বরভাবে, সেটা ভাসিয়ে দেওয়া হয় পদ্মার জলে। অবশ্য সেখানে ভাসানোর আগে কবুতরের ডানার বাঁধন খুলে দেওয়া হয়, যেন তারা পরে উড়ে যেতে পারে। আপাতচোখে খুব সাধারণ হলেও এই বেড়া ভাসান শিয়া-সুন্নি, মুসলিম-হিন্দু সম্প্রীতির বাণী দেয়। লোকধর্মের এই চরিত্র বাংলাজুড়েই এক; আর্থসামাজিক, রাজনৈতিকভাবে সবাইকে এক করে রাখার মন্ত্র।

দায় স্বীকার:
১. সৈয়দ গোলাম হোসেন খান তাবতাবায়ি;
‘সিয়্যার-উল-মুতাখ্‌খিরিন’; ২য় খণ্ড (ইংরেজি অনুবাদ); পৃষ্ঠা ৫৩৩
২. জেমস ওয়াইজ; ‘নোটস অন রেসেস, কাস্টস অ্যান্ড ট্রেডস অব ইস্টার্ন বেঙ্গল’; হ্যারিসন অ্যান্ড সন্স; ১৮৮৩
৩. আহমাদ হাসান দানি; ‘ঢাকা: আ রেকর্ড অব ইটস চেঞ্জিং ফরচুনস’; এশিয়াটিক সোসাইটি অব ঢাকা; ১৯৬২
৪. মুঈন উদ-দীন আহমদ খান; ‘বাংলায় ফরায়েযী আন্দোলনের ইতিহাস’; বাংলা একাডেমি, ঢাকা; ২০০৭
৫. আনন্দ কুমারস্বামী; ‘হোয়াট ইজ সিভিলাইজেশন অ্যান্ড আদার এশেস’; কেমব্রিজ; ১৯৮৯
৬. সুনীলা আহমাদ; ‘মিথোলজি: খাজা খিযর অব ইন্দুস’ (ফিচার); ডন; ১২ জানুয়ারি ২০২০
৭. ফাহ্মিদা হক; ‘বাংলার লোকউৎসব বেড়া ভাসান’; বাংলা একাডেমি, ঢাকা; ২০০৭
ছবি: লেখক

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top