বিশেষ ফিচার I সৌদিতে সিনেমার মজমা – বিধান রিবেরু
সৌদি আরব। উত্তরে জর্ডান ও ইরাক। দক্ষিণে ইয়েমেন ও ওমান। পশ্চিমে লোহিত সাগর। পূর্বে পারস্য উপসাগর। দেশটির ভেতর উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় নগর রিয়াদ, রাজধানী। এই শহরই আমার গন্তব্য। শুধু রাজধানী নয়, রিয়াদ দেশটির সবচেয়ে বড় শহর এবং অর্থনীতির মূলকেন্দ্র। সৌদির সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবেও রিয়াদ স্বীকৃত। এর কারণও রয়েছে। এখানে রয়েছে অনেকগুলো সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, জাতীয় গ্রন্থাগার, জাতীয় জাদুঘরসহ আরও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। ঢাকা ছাড়ার আগেই জানতে পেরেছিলাম, রিয়াদ হয়ে উঠতে চাইছে আরেক দুবাই। রিয়াদ কেন আমার গন্তব্য, সে সম্পর্কে ধীরে ধীরে জানা যাবে। তার আগে দেশটি নিয়ে দু-একটি কথা না বললেই নয়।

ভোরবেলার সূর্যালোকে রিয়াদ
হজরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেছিলেন সৌদি আরবের মক্কা নগরীতে—বাংলাদেশের মানুষ সাধারণত এই চিন্তাকেই সর্বাগ্রে স্থান দেন সৌদি আরব প্রসঙ্গে। বাঙালি মুসলমানবর্গ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন করে সৌদি আরবের সঙ্গে। সুতরাং সৌদি আরব যাচ্ছি, তা-ও চলচ্চিত্রবিষয়ক সম্মেলনে, এটা শুনে একটু অবাকই হয়েছিল আমার বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজন। ঘটনা হলো, সৌদি আরব গোটা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার যে নীতি গ্রহণ করেছে কয়েক বছর ধরে, তারই ধারাবাহিকতায় তারা চলচ্চিত্রকেও গুরুত্ব দিচ্ছে সমানভাবে।
সৌদি আরব এমনিতে তেল-বাণিজ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সখ্য বজায় রাখলেও ইদানীং দেশটি চাইছে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে; সে কারণে তারা মার্কিনবিরোধী বিভিন্ন জোটের অংশীদার হতে আগ্রহী। শুধু দেশের বাইরে নয়, ভেতরেও ব্যাপক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে সৌদি আরব। ক্ষমতায় থাকা রাজপুত্র মোহাম্মদ বিন সালমান একদিকে ধর্মীয় নেতাদের প্রভাব হ্রাস করেছেন; অন্যদিকে, রাজপরিবারের ভেতর বিরুদ্ধ মতকে কোণঠাসা করে নিজের কর্তৃত্বকে আরও শক্তিশালী করেছেন। সৌদি আরবকে তিনি যে আধুনিক করতে চাইছেন, তার প্রমাণ মেলে নারী স্বাধীনতায়। ২০১৮ সালের পর থেকে দেশটিতে নারীরা গাড়ি চালাতে পারেন; পুরুষ সঙ্গী ছাড়া ও অনুমতি না নিয়ে নিজেরা ঘরের বাইরে যেতে পারেন। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া ছাড়াও চাকরিবাকরিতে সুযোগ পাচ্ছেন নারীরা। বিবিধ আয়োজনে ছেলেমেয়ে একসঙ্গে কাজ করতে পারছেন।
আর যদি চলচ্চিত্রের কথা বলি, তাহলে বলতে হয় চোখে পড়ার মতো কর্মকাণ্ড হচ্ছে এই অঙ্গনে। চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ওপর ১৯৮৩ সাল থেকে ৩৫ বছরের যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, সেটি উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ২০১৮ সালে। নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে সৌদির লোকজন সিনেমা দেখতেন টেলিভিশন, ভিডিও ক্যাসেটের মাধ্যমে। প্রাইভেট প্লেসে ছবি দেখার ব্যবস্থা কিছু ছিল। সৌদি তেল কোম্পানি আরামকোতে অনেক মার্কিনি কাজ করতেন, তাদের জন্য ছিল বিশেষ ব্যবস্থা। আর ২০০৫ সালে রিয়াদের এক হোটেলে ১৪শ আসনের প্রেক্ষাগৃহ খোলা হয়, যেখানে আরবিতে ডাব করা বিদেশি কার্টুন ছবি দেখানো হতো শুধু নারী ও শিশুদের জন্য। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সমাজের রক্ষণশীল মনোভাবের কারণেই সৌদিতে সিনেমা ছিল নির্বাসিত। মজার বিষয়, এই চাপ কিন্তু এসেছিল সামাজিকভাবে। মানে, ইরানে যখন ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হচ্ছে, তখন সৌদি আরবেও এমন ভাবধারার উত্থান ঘটে। এই উত্থিত শক্তি আরও সংঘবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পায় তৎকালীন সৌদি রাজবংশের দুর্নীতি ও অতিরিক্ত পশ্চিমা প্রীতির কারণে। অস্ত্রধারী চরমপন্থীরা এ সময়, মানে উনআশি সালে মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদ নিজেদের জিম্মায় নিয়ে নেয়। তাদের অভিযোগ ছিল, সৌদি সরকার ইসলামবিরোধী। দেশের শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তনের দাবি তোলে তারা। শেষ পর্যন্ত এসব অভিযোগ ও আন্দোলন টেকেনি; চরমপন্থীদের কঠোর হস্তে দমন করা হয়েছিল। এরপর থেকেই সৌদি সরকার একটু একটু করে ইসলামি ভাবধারায় ঝুঁকতে শুরু করে এবং দেশটিতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হতে থাকে। অনেকের মনে থাকার কথা, এ ঘটনা জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার আবির্ভাবে জ্বালানি সংগ্রহ করেছিল।
তবে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম সিকিতে সৌদির ক্রাউন প্রিন্স সালমান মনে করলেন, দেশকে এভাবে ঠুলি পরিয়ে রাখার কোনো মানে হয় না, বিশেষ করে ইন্টারনেটের যুগে। এটাও কিন্তু সেই সমাজের আকাক্সক্ষারই প্রতিফলন। মনে রাখা জরুরি, বর্তমান সৌদি সমাজে তরুণদের সংখ্যা বেশি। তারা নিজের দেশে বসে ভিনদেশি চলচ্চিত্র দেখতে চান এবং সেটা লুকোছাপা না করে। তাই যুগের চাহিদা মেনে নিয়ে, দেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি এগিয়ে নিতে সৌদি রাজকুমার ২০৩০ সাল পর্যন্ত একটি পরিকল্পনা হাতে নিলেন। তারই অংশ হিসেবে ২০১৮ সালের ১৮ এপ্রিল খুলে দেওয়া হলো প্রেক্ষাগৃহ। সেদিন প্রথম রিয়াদে সদ্য খোলা মার্কিন চেইন এএমসি এন্টারটেইনমেন্ট সিনেমা হলে দেখানো হলো মারভেল মুভি ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’।

দিরিয়ার মরুতে নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে জানাতে সুনির্মিত জাদুঘর
সিনেমার জন্য অনুকূল হাওয়া প্রবাহিত হওয়ার পর থেকেই একের পর এক প্রেক্ষাগৃহ খুলছে সৌদি আরবে; এখনো সেই প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। ওদের লক্ষ্য, ২০৩০ সালের ভেতর গোটা দেশে তিন শতাধিক প্রেক্ষাগৃহ খোলা, যেখানে থাকবে দুই সহস্রাধিক স্ক্রিন। দেশের চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নিতে সৌদি আরব এই তো সেদিন, যখন করোনা জ্বরে সকলে আক্রান্ত, সে বছর, ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠা করল ফিল্ম কমিশন। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিশ্ব মেধার সঙ্গে দেশীয় মেধার সম্মিলন ঘটানোর কাজে মনোনিবেশ করেছে কমিশন। দেশের ভেতরে চলচ্চিত্র প্রযোজনাকে প্রণোদনা দেওয়ার পাশাপাশি তারা বাইরের বিনিয়োগকেও আকৃষ্ট করার কাজটি শুরু করে। শুধু তা-ই নয়, সৌদি চলচ্চিত্রকে দেশের বাইরে পরিবেশনের দায়িত্ব নিয়েছে এই কমিশন এবং তারা সফলতার পথে হাঁটছে। তরুণদের জন্য সৌদি ফিল্ম ইনস্টিটিউটও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যেখানে রয়েছে চলচ্চিত্র নির্মাণের সকল যান্ত্রিক ও সৃজনশীল প্রক্রিয়া সম্পর্কে পাঠদানের ব্যবস্থা।
২০২১ সালে জেদ্দায় শুরু হয় রেড সি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। এই উৎসবে লোহিত সাগর পাড়ের সকল দেশের অংশগ্রহণ থাকে। এর মাধ্যমে সৌদি তরুণদের চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে, পাশাপাশি তাদের ছবিরও আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাজার তৈরি হচ্ছে। যার ফল আমি নিজে দেখেছি ২০২৩ সালে টরন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। দুর্দান্ত সব সৌদি চলচ্চিত্র সেখানে দেখানো হয়েছে। সেসব ছবির আলাপ রয়েছে আমার ‘টরন্টো টকিজ’ বইতে। আন্তর্জাতিক মানের সৌদি ছবি শুধু যে প্রশংসা কুড়াচ্ছে তা কিন্তু নয়, পয়সাও কামাচ্ছে। সৌদি সরকার প্রত্যাশা করছে, ২০২৪ সালে সিনেমা খাত থেকে তাদের রাজস্ব আয় হতে পারে প্রায় ৫৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। শুধু মুনাফা নয়, অসংখ্য লোকের কর্মসংস্থানও কিন্তু হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রির আকার বাড়ছে বলে। এরা চেষ্টা করছে নিজস্ব বয়ানে, স্বকীয় সংস্কৃতির চলচ্চিত্র বানাতে এবং অবশ্যই সেটি পশ্চিমা দর্শকদের বিবেচনায় রেখে। তাই উত্তরোত্তর সৌদি সিনেমা নিয়ে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে পুরো বিশ্বে। এ কারণেই বোধ হয় বলা হচ্ছে সৌদির সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি এই মুহূর্তে সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ প্রত্যক্ষ করছে।
এই রেনেসাঁর ভেতরেই আমি পা রেখেছি রিয়াদে। যে সম্মেলনে এসেছি, ফিল্ম ক্রিটিসিজম কনফারেন্স (এফসিসি), সেখানে পোল্যান্ডের চলচ্চিত্র সমালোচক ওলাকে এখানকার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি চাইছে, সে তাদের স্ক্রিপ্ট ডক্টরিং এমনভাবে করুক, যাতে নিজস্ব ঐতিহ্য বজায় থাকে, আবার পশ্চিমা দর্শক ছবির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। সে জন্য ওলা শুনলাম আরবি ভাষা শেখার ক্লাসও করছেন। দ্বিতীয় দিন তিনি একটু তাড়াতাড়িই বের হলেন ভেন্যু থেকে, আমার মতো। আমি বেরিয়েছি জেটল্যাগ কাটাতে, আর তিনি বেরিয়েছেন হোটেলে ফিরে অনলাইনে আরবি শিখতে বসবেন, তাই। সৌদির ফিল্ম কমিশন পুরো দেশে সারা বছর ধরে চলচ্চিত্র নিয়ে ছোট ছোট ফোরাম করে আলোচনা ও ছবি দেখানোর কাজটি করছে। আর চিত্রসমালোচকদের নিয়ে এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন তো আছেই। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, চলচ্চিত্রের নতুন কেন্দ্র হতে যাচ্ছে এই মধ্যপ্রাচ্য। আমার কাছে মনে হয়েছে ইরান চলচ্চিত্র দিয়ে যেভাবে বিশ্বদরবারে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে, তাদের প্রতিপক্ষ সৌদি আরবও চাইছে চলচ্চিত্রকে কোমল শক্তি বা সফট পাওয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে। সকল ক্ষেত্রে এরা পরিবর্তনের সূচনা করতে চাইছে, এই পরিকল্পনার নাম রাখা হয়েছে ‘ভিশন ২০৩০’। অনুভব করতে পারছি—দিনবদলের হাওয়া বইতে শুরু করেছে।
বদলাতে থাকা সৌদি আরবে এফসিসির দ্বিতীয় আয়োজনে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় দেশটির সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এই সম্মেলন যৌথভাবে আয়োজন করে ওদের ফিল্ম কমিশন। মজার বিষয়, আমার নাম ওদের কাছে প্রস্তাব করেন মিসরের চলচ্চিত্র সমালোচক ও সংগঠক আহমেদ শাওকি। শাওকির সঙ্গে আমার পরিচয় কান চলচ্চিত্র উৎসবে। সেখানে আমাদের ফিপ্রেসি জুরি প্যানেলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি।

দিরিয়া জাদুঘরে ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা এক কর্মীর সঙ্গে লেখক
আমি যখন প্রথম এফসিসি থেকে আমন্ত্রণপত্র পাই, ২০২৪-এর অক্টোবরের শুরুতে, তখন থেকেই ভীষণ পেশাদারিত্বের সঙ্গে আমার সকল কিছু ওরা ব্যবস্থা করেছে। আমাকে পনেরো মিনিটের একটি বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণও জানানো হয়। রাজি হওয়ায় আমাকে খুব অবাক করে ওরা ব্যাংকের তথ্যাদি নিল। সম্মানী দেবে তাই। আমি দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে ওদের আমার বক্তৃতার সারবস্তু পাঠালাম। যেহেতু ওদের এবারের মূল প্রতিপাদ্য ‘সাউন্ড ইন সিনেমা’, তাই বললাম আমি কথা বলব, জনরা সিনেমায় কেমন করে শব্দের একঘেয়ে উপস্থাপন হচ্ছে। ওরা দুদিন সময় নিয়ে আলাপটালাপ করে জানাল, এটা বড্ড শক্ত আর গভীর বিষয়; এ বিষয়ে বলতে গেলে পনেরো মিনিটে কুলিয়ে ওঠা যাবে না। ‘তোমার দেশের চলচ্চিত্র বা সম্প্রতি প্রকাশিত তোমার বইসংশ্লিষ্ট কিছু একটা করো।’ এ বছরই বেরিয়েছে আমার কিতাব: ‘ন্যাশনালিজম ইন বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার ফিল্মস’। ভাবলাম মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে শব্দের ব্যবহার নিয়ে কথা বললে কেমন হয়, বিশেষ করে সংগীতের ব্যবহার। প্রস্তাব পাঠালাম; সঙ্গে সঙ্গে গৃহীত হলো। এরপর দিলাম বক্তৃতার স্লাইড ও ক্লিপ।
সবকিছু যখন প্রস্তুত, নিমন্ত্রণপত্র, আমি কবে উড়াল দেব, কোন হোটেলে থাকব ইত্যাদি, তখন ভিসা নিয়ে তৈরি হলো জটিলতা। কারণ, ঢাকার দূতাবাস নয়, ভিসা পাঠানো হবে সরাসরি সৌদি থেকে। কিন্তু সেই ভিসা আর আসে না। দুশ্চিন্তার ভেতর পড়লাম। শেষ পর্যন্ত ভিসা পাঠানো হলো ৬ নভেম্বর ভোর পাঁচটায়, যেদিন থেকে সম্মেলন শুরু। আয়োজকেরা দুঃখ প্রকাশ করল। ভিসা জটিলতার কারণে প্রথম দিন উপস্থিত থাকতে পারলাম না। যেদিন ভিসা পেলাম, সেদিনই বায়ুযানে চড়তে হলো দিবাগত রাত পৌনে দুইটায়, অর্থাৎ ৭ নভেম্বর। সাত ঘণ্টার উড়ান শেষে কিং খালিদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামলাম ভোর পাঁচটা নাগাদ। বহির্গমনে দেখলাম, এক আরব তরুণী প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। পরনে ট্রাউজার আর কালো জ্যাকেট। মাথায় হিজাব। ঠোঁটে কড়া করে মাখা লাল লিপস্টিক। ইমিগ্রেশনে থাকা নারী কর্মকর্তাদের দেখেছি পুরো বোরকা পরা, শুধু দুটো চোখ দেখা যায়। সামনে গিয়ে দাঁড়ালে বোর্ডিং পাস দেখাতে বলছিলেন। বোরকায় মুখ ঢাকা বলে দ্বিতীয়বার শুনে বুঝেছি, ভদ্রমহিলা কী চাইছেন। ইমিগ্রেশনের ওই নারীর চেয়ে অপেক্ষমাণ এই তরুণীর পোশাক ভিন্ন। আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসে হাত থেকে অনেকটা ছোঁ মেরে লাগেজ নিয়ে নিলেন নিজ দায়িত্বে। এরপর পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন। বিমানবন্দরের বাইরে দেখি চকচকে কালো রঙের শ্যাভ্রোলে এসইউভি কার দাঁড়িয়ে, তাতে লেখা ফিল্ম ক্রিটিসিজম কনফারেন্স। তরুণী আমাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন। চার তারকা খচিত নভোটেল রিয়াদ সাহাফা হোটেলে পৌঁছুলাম আধঘণ্টার ভেতর। ঘড়িতে তখন সকাল ছয়টা। এসেই যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম মনে আর জেনোর সঙ্গে। আমার দুই পুত্র। ঢাকায় তখন সকাল ৯টা। মনে অবশ্য স্কুলে তখন। আমি ওদের মায়ের সঙ্গে আলাপ করে ঘুমুতে গেলাম। কিন্তু ঘুম আর আসে না। সৌদি এয়ারলাইনসের বিজনেস ক্লাসেও হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করেছিলাম। হয়নি। এখন হোটেলে এসেও দেখি ঘুম নির্বাসিত।
প্রয়োজনীয় টেক্সট ও মেইল লিখতে লিখতে কিছুটা ঘুম এলো। কিন্তু সকাল সাড়ে নয়টায় হোটেল লবিতে গিয়ে দেখি অপেক্ষা করছেন আমার ইউক্রেনের কলিগ এলেনা রুবাশেভস্কায়া। ওর সঙ্গে আরও অনেকে তখন নাশতার টেবিলে। এলেনা সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আলাপে ঠিক হলো, সেমিনারস্থলে যেহেতু বেলা সাড়ে তিনটা নাগাদ যেতে হবে, তার আগে সকাল ও দুপুরটা কাজে লাগানো যায়। এলেনা খুঁজেটুজে বের করলেন, কাছেই রয়েছে একটি ঘোরার মতো জায়গা।
জায়গাটির নাম দিরিয়া। হোটেল থেকে গাড়িতে কুড়ি মিনিটের দূরত্ব। দিরিয়া নামটা শুনে আমার ‘ওরে নীল দরিয়া’ গানের কথা মনে হলো। কিন্তু দিরিয়ায় দরিয়া থাকার সম্ভাবনা একেবারেই শূন্য। জায়গাটি গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, আরব পেনিনসুলায় সৌদি রাজবংশের গোড়াপত্তন হয় এই দিরিয়ায়। পঞ্চদশ শতাব্দীতে গড়ে ওঠা এই নগরে যে ধরনের নাজদি ঘরানার স্থাপত্যকলা ছিল, সেটিকেই পুনর্গঠন করা হয়েছে হুবহু। আর প্রাচীন নগরীর কিছু ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষিত করা হয়েছে চমৎকারভাবে। আরব দুনিয়ায় অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই দিরিয়া অঞ্চলের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। এখান থেকেই সালাফিয়া মতাদর্শ ছড়িয়ে পড়ে।
নিজেদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে দেখলাম, ইউরোপীয়দের মতো এদেরও সমান দক্ষতা। অবশ্য যে হারে এখানে মেগা প্রজেক্ট হচ্ছে, বাহারি নকশার সুউচ্চ ভবন নির্মিত হচ্ছে, তাতে এমন একটা জাদুঘর তারা তৈরি করে রাখবে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। প্রক্ষিপ্ত কিন্তু সংযুক্ত ছোট ছোট হলরুমে, যেখানে কোথাও আরব ঘোড়ার ইতিহাস, কোথাও অস্ত্রশস্ত্রের সংগ্রহ, কোথাও-বা আরব পোশাকের ক্রমবিবর্তনের খতিয়ান রাখা নমুনাসহ, সকল জায়গাতেই শীতল পানি বোতলজাত করে রাখা। তৃষ্ণার্ত দর্শনার্থীরা যেন পানি পান করতে পারে, সে জন্য এই সুব্যবস্থা। এর জন্য কোনো পয়সা লাগে না।