skip to Main Content

যাপনচিত্র I কুসুম কথন

কুসুম সিকদার। অভিনেত্রী, প্রযোজক, পরিচালক, মডেল, গায়িকা ও লেখক। গানের জগৎ দিয়ে মিডিয়ায় প্রবেশ। ঘটনাক্রমে ২০০২ সালে লাক্স-আনন্দধারা ফটোজেনিক চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। কেমন তার একান্ত জীবন?

ছোটবেলা থেকে সংগীতচর্চা করতেন। নজরুল একাডেমি থেকে নজরুলগীতি ও ধ্রুপদি সংগীতের ওপর কোর্স করেছেন। পরে ওস্তাদ গুল মোহাম্মদ ও ওস্তাদ মোরশেদের কাছে নিয়েছেন তালিম। মিডিয়ায় গানের জগতে প্রবেশ ১৯৯৯ সালে। প্রকাশ পেয়েছে অ্যালবামও। দেশি রক মিউজিকের, বিশেষত ওয়ারফেজ, মাইলস, জেমস, আর্কের অনুরাগী। ওয়ারফেজের সাবেক ভোকাল সান্জয়ের গগনবিদারী চিৎকারের প্রেমে পড়েছিলেন অল্প বয়সেই। ‘এ রকম ভয়েস রেঞ্জ তখন বাংলা রক মিউজিকে তেমন খুঁজে পাওয়া যেত না,’ অভিমত তার। দেশের বাইরে ব্রায়ান অ্যাডামস, বন জভি, মাইকেল বল্টন, রিচার্ড মার্ক্স, ব্রিটনি স্পিয়ার্স ও ব্যাকস্ট্রিটস বয়েজের গানও মুগ্ধ করে। নো ডাউটের ‘ডোন্ট স্পিক’ তার অলটাইম ফেভারিট।
ব্যক্তিজীবনে কুসুম সিকদার রাতে ঘুমোতে যান বেশ দেরিতে, সাড়ে তিনটা থেকে চারটায়। এক অদ্ভুত নেশা আছে তার; তিনি হরর ফ্রিক। ছোটবেলা থেকেই যেকোনো ভৌতিক বা প্যারানরমাল বিষয়ে অভিভূত। রাত জেগে এখন শোনেন ‘সানডে সাসপেন্স’ নামক হরর অডিওবুক। আগেকার সাহিত্যিকদের গল্প অবলম্বনে দুর্দান্ত সাউন্ড ইফেক্টে এসব শুনতে শুনতেই মধ্যরাত পেরিয়ে যায়। মজার ছলে বললেন, ‘মানুষ রাত জেগে গান শোনে, আর আমি এসব শুনি!’ তার বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে ছিল ভিসিআরের চল। মেয়ের এই আসক্তি দেখে বাবা এনে দিতেন নানা ধরনের হরর সিনেমা, গল্পের বই। বাবার আনা ইংরেজি বইয়ের তেমন ভক্ত না হলেও মেতে থাকতেন কিশোর থ্রিলার বইয়ে। বড় হয়ে সত্যজিৎ রায়ের অনুরাগী হয়েছেন। মায়ের উৎসাহে পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্ম।
অভিনেত্রী হিসেবে বেশি খ্যাতি পাওয়া কুসুম সিকদারের প্রযোজনা ও পরিচালনায় সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে হরর জনরার সিনেমা ‘শরতের জবা’। এতে অভিনয়ও করেছেন তিনি। স্প্যানিশ ফিল্মমেকার পেদ্রো আলমোদোভারের ‘দ্য স্কিন আই লিভ ইন’, কানাডিয়ান ফিল্মমেকার দ্যুনি ভিলনোভের ‘ইনসেন্ডিজ’, আমেরিকান ফিল্মমেকার মাইকেল ক্রিস্টোফারের ‘জিয়া’ এবং পোলিশ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কির ‘কালার ট্রিলজি’র ফিল্ম তিনটি তাকে ভীষণ প্রাণিত করেছে। এই তারকার সেলিব্রিটি ক্রাশ ‘আশিকি’ সিনেমাখ্যাত ভারতীয় অভিনেতা রাহুল রায়।
কাজ থাকলে সকাল সাড়ে সাতটা, আর না থাকলে সাড়ে নয়টায় ঘুম থেকে ওঠেন কুসুম। গরম পানি পান করে শুরু হয় তার দিন। ব্রেকফাস্ট সারেন সাড়ে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে। পাতে থাকে ভাত। মাছ-মাংস না খেলেও দুধ এবং দিনপ্রতি তিন-চারটি ডিম খেতে পছন্দ করেন। যেকোনো সময় নানা মৌসুমি শাকসবজি খেতে ভালোবাসেন। মধ্যাহ্নভোজ এড়িয়ে চলেন। বাসায় থাকলে বাটার, ঘি দিয়ে রুটি বা পরোটা পেটে পড়ে বিকেলে। ডিনার সারেন রাত সাড়ে ৮টার দিকে; তবে বাসার বাইরে থাকলে সাড়ে দশটা থেকে এগারোটা বেজে যায়। ঢাকায় সুনির্দিষ্ট দুটি রেস্টুরেন্ট ছাড়া বাইরে তেমন খাওয়াদাওয়া করেন না। ইচ্ছে হলে সেই রেস্টুরেন্টগুলো থেকে খাবার নিয়ে আসেন বাসায়। মোরগ-পোলাও থেকে মাংসের টুকরো সরিয়ে পোলাওর সঙ্গে আলু মিশিয়ে খেতেও পছন্দ করেন। বছরে গুটিকয়েক দিন সামান্য মুরগির মাংস এবং বাইরে গেলে খান স্যালমন ফিশ।
একাকিত্ব তার জন্য যেন মানসিক প্রশান্তি; উপভোগ করেন বেশ। বিদেশে গেলে একাই সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেন, কফি শপে গিয়ে নিভৃতে কফির কাপে চুমুক দেন। বিদেশে সলো ট্যুর দেন মূলত প্রশান্তির সন্ধানে। এ পর্যন্ত বেশি গেছেন সিঙ্গাপুরে; বছরে তিন-চারবার। এরপর বেশি যাওয়া হয় লন্ডনে। এ ছাড়া শুটিং ও ব্যক্তিগতভাবে নেপালে গেছেন কয়েকবার। তবে দ্বীপরাষ্ট্র গ্রিসের অ্যাথেন্স শহর তার মনে ধরেছে সবচেয়ে বেশি। গ্রিস সভ্যতার ঋদ্ধতা, সেখানকার নীল পানি ও আকাশ, প্রকৃতি তাকে মুগ্ধ করেছে। বাইরে ঘুরতে গেলেও তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো পোস্ট দেন না; বরং মুহূর্তগুলো উপভোগেই তার আগ্রহ বেশি।
আগে ইনটেন্স ওয়ার্কআউট করতেন; এখন নয়। বাসায় এখনো আগের সেসব ইনস্ট্রুমেন্ট পড়ে রয়েছে। নিজেকে আগের মতো ধরে রাখার রহস্য সম্পর্কে দিলেন সহজ-সরল উত্তর, ‘জেনেটিক ও ডিএনএ।’ ইনট্রোভার্ট নাকি এক্সট্রোভার্ট—এমন প্রশ্নের জবাবে কুসুমের জবাব, অ্যাম্বিভার্ট, অর্থাৎ দুটোর মাঝামাঝি। ‘আমার কাছে মনমর্জি, সময়সীমা গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন, চার-পাঁচজনের আড্ডায় আমি থাকি কেন্দ্রবিন্দুতে; কিন্তু সেখান থেকে যখন বাসায় ফিরি, চুপ হয়ে যাই। যখন যা করি, সবটুকু দিয়ে করি; আবার নিজেকে গুটিয়ে নিই যখন, পুরোটাই গুটিয়ে নিই,’ বললেন তিনি।
একসময়ের তুমুল আড্ডাবাজ কুসুম সিকদার অবশ্য এখন আর বলতে গেলে আড্ডাই দেন না। জীবনের প্রতি অভিমান নেই; তবে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকেই তার এমন সিদ্ধান্ত। নিজেকে মোটেই ডিপ্লোমেটিক মনে করেন না; বরং বেশ খোলামেলা ও বন্ধুত্বপূর্ণ—এমনটাই জানালেন। কুসুম বললেন, ‘বিশ্বাস করতাম, আমার একটি সার্কেল আছে, কিছু বন্ধু আছে; যাদের সঙ্গে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়েছে। একপর্যায়ে উপলব্ধি করলাম, আমি যেভাবে বন্ধুত্বকে দেখি, সংজ্ঞায়িত করি, সেটির সঙ্গে অপর পক্ষের মিলছে না।’
রাজধানীতে দুটি বাসা এই অভিনেত্রীর। নিকুঞ্জ ও ধানমন্ডিতে। বাসায় রয়েছে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, পাবলো পিকাসোসহ অনেকের পেইন্টিং। ‘পেইন্টিংয়ের ফ্রেমিং করার কিছু নিয়ম আছে, যেগুলো আমি অনুসরণ করি না’—জানিয়ে তিনি যোগ করেন, ‘লন্ডনে একটি অডিটোরিয়ামে ভ্যান গঘের পেইন্টিয়ের একটি থ্রি-সিক্সটি এক্সিবিশনে গিয়েছিলাম। থ্রিডি দিয়ে চারদিকে এই বিখ্যাত পেইন্টারের পেইন্টিং আর মাঝখানে আমি। এই অভিজ্ঞতা আমার কাছে যেমন সুন্দর, তেমনি পরাবাস্তব ছিল। সেখানে যাওয়ার পর একজন আমাকে ভ্যান গঘের স্ট্যারি নাইট, সানফ্লাওয়ারসহ নানা বিখ্যাত পেইন্টিংয়ের নোটবুক ও পোস্টার দিয়েছিলেন। সেসব পেইন্টিংয়ের নিচে লেখা ছিল ভ্যান গঘ বা থ্রি-সিক্সটি ভ্যান গঘ এক্সিবিশন, লন্ডন। নিয়ম না মেনে সেসব লেখাসহ আমি ফ্রেমিং করিয়েছি। পেইন্টিং যারা বোঝেন, তারা অনেকে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। আমার ভালো লাগাটাই মুখ্য; কেননা, আমি মোটেই স্টেরিওটাইপ নই।’ তার দুই বাসারই ফার্নিচার ডার্ক ব্রাউন, মেহগনি, ডার্ক গোল্ডেন…এককথায় রাস্টিক কালারের। ফার্নিচারের স্টাইল ইউরোপিয়ান। সুযোগ পেলেই ঘর অন্ধকারাচ্ছন্ন রাখতে পছন্দ করেন। তিনি ক্যান্ডেল লাভার। বাসায় মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখতে ভালো লাগে তার। ফ্র্যাগরেন্স ও নন-ফ্র্যাগরেন্স মিলিয়ে বাসায় আছে বেশ কিছু ক্যান্ডেল কালেকশন।
পোশাকে প্রাধান্য পায় স্বস্তি। ট্রেন্ড অনুসরণ করেন না কোনো কিছুতে; দামকে প্রাধান্য দেন না। অনেকের মতে, শাড়িতে তাকে বেশি মানালেও এ পোশাক দীর্ঘক্ষণ পরে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। ফতুয়া, জিনস, শার্ট, টি-শার্টে স্বস্তি পান। পছন্দের ক্লদিং ব্র্যান্ড দেসিগুয়াল। সব সময় সঙ্গে রাখেন আংটি, একটি চুড়ি ও ঘড়ি। পছন্দের ওয়াচ ব্র্যান্ড মাইকেল কোরস। এ ছাড়া আছে গেস, সোয়ারোভস্কি, ডেজার্টসহ নানা ব্র্যান্ডের ঘড়ির কালেকশন। জুতার মধ্যে স্নিকার্সে আস্থা বেশি; পছন্দের ব্র্যান্ড আলডো। সুগন্ধি ব্যবহারেও বেশ শৌখিন। স্ট্রং ফ্র্যাগরেন্স হিসেবে নারসিসো রদ্রিগেজ এবং মাইল্ড ফ্র্যাগরেন্স হিসেবে গুচিকে বেছে নেন। মেকআপ নিজেই করেন; তাতে বেশ মিনিমালিস্টিক। নিজের ডিরেকশন বা অভিনয় করা সকল সিনেমায় নিজেই মেকআপ করেছেন; তবে হেয়ার সেট করতে স্টাইলিস্টের শরণাপন্ন হন প্রয়োজনমতো।
জীবনদর্শনে প্রথমত, নিজের মতো জীবনযাপনে গুরুত্বারোপ করেন; তবে তা যেন অন্যের বিরক্তির কারণ না হয়। দ্বিতীয়ত, রাগ পরিহার করা। বিশ্বাস করেন, সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতি অনেক সময় ঠিক হয়ে যায়। তৃতীয়ত, এড়িয়ে চলা। উদাহরণ হিসেবে জানালেন, তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক কনটেন্টে কমেন্ট করে অহেতুক ইস্যু ক্রিয়েট করতে চান না। সর্বশেষ, ব্যক্তিজীবন লো প্রোফাইল মেইনটেইন করা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তারকার ব্যক্তিজীবন অনেক অনুরাগীর পছন্দ না-ও হতে পারে।
 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন
লোকেশন: লো মেরিডিয়েন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top