skip to Main Content

স্বাদশেকড় I টফু টুইস্ট

টফু। উচ্চারণভেদে টোফু, তোফু, তৌফু প্রভৃতি। জনপ্রিয় চীনা স্ন্যাকস। ভাজার সময় একধরনের তীব্র গন্ধ ছড়ায়; তবে খাবার হিসেবে বেশ মুখরোচক

২০০০ বছর আগে চীনাদের পাতে ‘দউফু’ নামের একটি খাবারের দেখা মিলত। এর সঠিক উৎপত্তি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। যদিও বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে সয়াবিন, সয়া দই এবং এমনকি টফুর উল্লেখ রয়েছে। (বলে রাখা ভালো, শব্দটির বিভিন্নতা ৯৫০ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে প্রকাশ পেতে শুরু করে।) তবে এশিয়ান সংস্কৃতিতে স্থায়ী সয়াবিন দইয়ের ব্লক কে বা কারা আবিষ্কার করেছেন, তা নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে। এখানে বিভিন্ন তত্ত্ব অন্বেষণ করলে কীভাবে এর ব্যবহার এশিয়ার বিভিন্ন অংশ ছাড়িয়ে সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়েছে, সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া সম্ভব।
মূল তত্ত্ব ১: চীনা রাজপুত্রের উদ্ভাবন
চীনে রন্ধনসম্পর্কীয়সহ বিভিন্ন বড় সাফল্যের জন্য ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের কৃতিত্ব পাওয়া একটি সাধারণ ঘটনা। বলা হয়ে থাকে, হান রাজবংশের রাজপুত্র এবং হুয়াইনান রাজ্যের সাবেক শাসক লিউ আন (খ্রিস্টপূর্ব ১৭৯-১২২) একটি বিশেষ নিরামিষ প্রোটিন আবিষ্কার করেছিলেন, যাকে আমরা টফু বলি। আরও কয়েকটি টফু উৎসের গল্প রয়েছে, কিন্তু এটি এখন পর্যন্ত সর্বাধিক পরিচিত। তাহলে জানা যাক, কে ছিলেন এই লিউ আন। নিজের রাজকীয় মর্যাদা ছাড়াও তিনি একজন মানচিত্রকার, দার্শনিক ও পণ্ডিত হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। কথিত আছে, অসুস্থ মাকে সাহায্য করার জন্য প্রথমে সয়াবিন পিষে দুধ তৈরি করেন তিনি। এর ফলে বিনের দই আবিষ্কার করতে সক্ষম হন; তা থেকেই টফুর সূচনা। কেউ কেউ বলেন, এই চীনা রাজপুত্র আদতে দুর্ঘটনাক্রমে টফু উদ্ভাবন করেছিলেন। রসায়নের উদ্দেশ্যে তার তৈরি করা সয়া দুধের মিশ্রণে কিছু লবণের যোগ ঘটেছিল নিতান্তই কাকতালে। লিউ আন ছিলেন রসায়নশাস্ত্র, জাদুবিদ্যা ও তাওবাদের (ঐতিহ্যবাহী চীনা ধর্ম) প্রতি আগ্রহের জন্যও সুপরিচিত। এ কারণে হয়তো তাকে টফু উদ্ভাবনের কৃতিত্ব দেওয়া হয়।
প্রাচীন গ্রন্থগুলো থেকে জানা যায়, লিউ আন অমরত্বের ধারণায় আচ্ছন্ন ছিলেন এবং তা অর্জনের আশায় রসায়নশাস্ত্রে ডুবে থাকতেন। টফু ছিল তার পরীক্ষার ফলাফল এবং প্রথম সুপারফুড। টফুর স্বাস্থ্য উপকারিতা অবশ্য বেশ ভালোভাবে নথিভুক্ত করা হয়েছে। লোককাহিনির বিভিন্ন পাঠে জানা যায়, লিউ আনের আবিষ্কৃত টফু সাধারণ উপকারের পাশাপাশি স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সরবরাহ এবং রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে। ইউয়ান রাজবংশের সুন তা-ইয়ার লেখা অনুসারে, টফু খাওয়ার পর লিউ আনের বয়স কমতে শুরু করে এবং অবশেষে তার শরীরে ডানা গজায়, যা তাকে স্বর্গে উড়ে যেতে সাহায্য করেছে!
মূল তত্ত্ব ২: মঙ্গোলিয়ান পনির প্রাণিত
এই টফু উদ্ভাবন তত্ত্ব লিউ আনকে নিয়ে যে বয়ান, সেটির তুলনায় অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য। অনেকের মতে, প্রাচীন চীনারা উত্তরের মঙ্গোলীয় আদিবাসীদের কাছ থেকে দুধের দই (টফু তৈরির একটি প্রক্রিয়া) তৈরির শিল্প শিখেছিল, যারা মূলত পনির তৈরির জন্য পরিচিত ছিল। যাযাবর মঙ্গোলিয়ানদের আগমনের আগে চীনে দুধ ঘিরে যে সংস্কৃতি বিদ্যমান (টফুর ক্ষেত্রে সয়া দুধ), তা ছিল না বলে এই তত্ত্বের বাড়তি ওজন রয়েছে।
জাপানি পাঠ্য থেকে জানা যায়, মঙ্গোলিয়া থেকে আদিবাসীরা খ্রিস্টীয় চতুর্থ থেকে সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে চীনে এসেছিল এবং তাদের পনির তৈরির কৌশলগুলোর সঙ্গে স্থানীয়দের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। চীনারা পরবর্তীকালে দুধ চাষের প্রযুক্তির অভিযোজন ঘটায় এবং সয়াবিন প্রক্রিয়াকরণ শুরু করে। এতে নরম দইয়ের মতো পনিরের সামঞ্জস্যের সঙ্গে একই ধরনের গাঁজানো খাবার তৈরি শুরু হয়।
টফু তৈরির জন্য গরম, টাটকা সয়া দুধে ক্যালসিয়াম সালফেট বা খনিজসমৃদ্ধ নিগারির (অপরিশোধিত সামুদ্রিক লবণ) মতো জমাট যোগ করে প্রক্রিয়া করা হয়। সে সময় গঠিত দই আলাদা করা এবং টফুর আকার দেওয়া হয়। সয় ইনফো সেন্টারের মতে, সম্ভবত চীনারা মঙ্গোলিয়ানদের মাধ্যমে ব্যবহৃত ‘রেনেট ও ব্যাকটেরিয়া সংস্কৃতির জন্য বিভিন্ন দেশীয় খনিজ লবণ বা অ্যাসিড জমাট বাঁধানো’ শুরু করেছিল। তথ্যদাতা প্রতিষ্ঠানটি আরও জানায়, বিভিন্ন বিকল্প, যেমন দেশীয় খনিজ লবণ বা অ্যাসিডের ব্যবহার রেনেট ও ব্যাকটেরিয়ার জমাট বাঁধার জন্য সহায়ক—এই সূত্রও সম্ভবত মঙ্গোলিয়ানদের কাছ থেকে পেয়েছিল চীনারা।
মূল তত্ত্ব ৩: আ হ্যাপি অ্যাক্সিডেন্ট
একজন চায়নিজ শেফ কি ভুলবশত সয়াবিন থেকে প্রাপ্ত খাবারকে গাঁজন করে আমাদের এই প্রিয় স্বাস্থ্যকর খাবার তৈরি করেছেন? টফুর উৎপত্তি সম্পর্কে এই চূড়ান্ত তত্ত্ব একটি রাসায়নিক বিক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে তৈরি, যা প্রাকৃতিকভাবে জমাট বাঁধা ও রান্না করা সয়াবিন একসঙ্গে মিলিত হলে ঘটতে পারে। মনে করা হয়, প্রাচীন চীনারা সয়াবিন শুকিয়ে বিভিন্ন উপায়ে ব্যবহার করত। শুকনো সয়াবিন একটি পিউরিতে (পাত্র) মাখিয়ে পোরিজের মতো খাবার তৈরির চল ছিল। চীনা শেফরা প্রাকৃতিক জমাট বাঁধা নিগারি দিয়ে পোরিজ বানাত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি দই আকারে জমা হতো।
এটি টফুর আসল উৎপত্তি ইতিহাস হতে পারে? সম্ভবত; তবে এ ছাড়া নানা উপায়ে ‘ইতিবাচক ভুলে’র মাধ্যমে টফু উদ্ভাবিত হতে পারে। ধারণা করা হয়, অজ্ঞাতনামা সেই চীনা শেফ তার পোরিজ মিশ্রণটি তাপে এতটাই বেশি সময় রেখেছিল, এর ফলে ল্যাকটিক অ্যাসিড উৎপাদনকারী ব্যাকটেরিয়া তৈরি হয়েছিল, আর এটি পেয়েছিল দইয়ের আকার। শেফ তখন দইয়ের মিশ্রণটি ছেঁকে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়, যা দইটিকে অনেকটাই টফুর সাদৃশ্যপূর্ণ করে তোলে।

নাম অন্বেষণ
কীভাবে নাম পেয়েছে টফু? মূলত যাযাবর মঙ্গোলিয়ান আদিবাসীরা দক্ষিণে তাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে দুগ্ধজাত জ্ঞান ভাগ করে নেওয়ার কারণে পরবর্তী সময়ের টফু-সম্পর্কিত তত্ত্বটি জনপ্রিয়তা পায়। বলা হয়, গাঁজানো দুধের মঙ্গোলিয়ান নাম ছিল রুফু এবং সেখান থেকেই খাবারটির এমন নামকরণের সূত্রপাত। এ প্রসঙ্গে সয় ইনফো সেন্টারের ব্যাখ্যা, চীনা ভাষায় শব্দটি লেখার জন্য, চীনাদের দুটি অক্ষর বেছে নিতে হয়েছিল, যে দুটি ছিল শব্দাংশের ধ্বনি। সৌভাগ্যবশত, ‘দুধ’ অর্থের অক্ষরটি ‘রু’ উচ্চারণ করা হয়েছিল। চায়নিজরা ‘ফু’ বেছে নিয়েছিল, যার অর্থ সাধারণত ‘নষ্ট’। প্রাচীন চীনারা সয়াবিনকে পাঁচটি পবিত্র শস্যের অন্যতম বলে মনে করত। তাই এর ব্যবহারে তৈরি একটি খাদ্যপণ্যের নামে ‘নষ্ট’ অর্থটি থাকা বেশ অদ্ভুত শোনাতে পারে।
প্রাচীন চীনারা টফুর প্রেমে পড়েছিল। বিভিন্ন চীনা ভাষায় এর ছিল বিভিন্ন নাম। মান্দারিনে এটি ‘দউফু’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। ক্যান্টনিজভাষীরা বলে ‘টাউ-ফু’। কেউ যদি ভাবেন, এই শব্দ থেকেই ‘টফু’ নামটি এসেছে, তাহলে ভুল ভাবছেন! ‘টাউ-ফু’ এসেছে ‘দাউ-ফু’ শব্দ থেকে; অন্যদিকে, ‘টফু’ শব্দটি আসলে জাপানিজ। ১১৮২ সালের এক সাহিত্যকর্মে এ শব্দ প্রথম প্রকাশিত হয়।
বিস্তার
জাপান টফু অ্যাসোসিয়েশনের মতে, নারা (৭১০-৭৯৪) ও হেইয়ান (৭৯৪-১১৮৫) সময়কালে চীনে জাপানি রাষ্ট্রদূতেরা সম্ভবত তাদের সফরের সময় টফুর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। দিনে দিনে এটি জাপানের বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য একটি প্রধান প্রোটিনের উৎস হয়ে ওঠে, যারা কঠোরভাবে নিরামিষভোজী ছিলেন। টফু একটি দীর্ঘ সময়ের জন্য ছিল বিলাসী খাবার। এটি ইদো শাসনকালের (১৬০৩-১৮৬৮) মধ্যভাগ পর্যন্ত ব্যাপকভাবে উপলব্ধ ছিল না। তবে বর্তমান জাপানে বিভিন্ন ধরনের টফু রয়েছে।
পনেরো শতকের মধ্যে কোরিয়ায় ব্যাপকভাবে টফুর প্রচলন ঘটে। সেখানে এর নাম ‘দবু’। অবশ্য মনে করা হয়, এটি গরিও পিরিয়ডে (৯১৮-১৩৯২) সেখানে পৌঁছেছিল। লোকেরা বাড়িতে তৈরি করতে শুরু করেছিল এবং জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর অপুষ্টিতে ভোগা বন্দীদের প্রায়ই খাওয়ানো হতো। কারামুক্তির পরে টফু খাওয়া আজও একটি প্রতীকী বিষয় হয়ে রয়েছে।
ভিয়েতনামেরও টফু নিয়ে একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। মূলত কারণ, দেশটি ১১১ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চীনা উপনিবেশ ছিল। ভিয়েতনামীরা একে ‘দাউ পু’ বা ‘দাউহু’ বলে। সেখানে প্রায়শই মাংসের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার না করে বরং এই খাবারের সঙ্গে মাংস যোগ করা হয়। অন্যদিকে, টফু ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছেছিল মসলা ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে। বর্তমানেও সে দেশে এটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত। তবে স্থানীয় নাম ‘টাহো’। মিয়ানমারেও জনপ্রিয় এই খাবার। তবে সেখানে এতে সয়াবিনের পরিবর্তে ছোলার আটা ব্যবহারের চল রয়েছে। থাইল্যান্ড ও ভারতে এর জনপ্রিয়তা তেমন আগের নয়; যথাক্রমে বিশ শতকের প্রথম দশকের মাঝামাঝি এবং শেষের দিক থেকে।
বর্তমানে বাংলাদেশেও বিভিন্ন চায়নিজ ও জাপানিজ রেস্টুরেন্টের কল্যাণে কদর বাড়ছে টফুর।

 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top