পাতে পরিমিতি I শীতে সাবধান
শীতে উদরপূর্তিতে অন্য রকম উষ্ণতার রেশ লেগে থাকে! তবে এ সময়েও প্রয়োজন বাড়তি সতর্কতা। রইল পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশির পরামর্শ
বিভিন্ন রঙের সবজির সমারোহ দেখা যায় শীতকালে। এ সময়ে পিঠাপুলির উৎসব তো লেগেই থাকে। সাধারণত পিঠা মানেই ভাজাপোড়া আর মিষ্টিজাতীয় খাবার। তাই শীত যতই উপভোগের হোক, এ ধরনের খাবার অনিয়ন্ত্রিতভাবে গ্রহণের ফলে বেড়ে যেতে পারে নানা রকম শারীরিক জটিলতা। বিশেষ স্থূলতা ব্যাধি, ডায়াবেটিস, অনিয়ন্ত্রিত চর্বি এমনকি কিডনির রোগ দিতে পারে মাথাচাড়া। তাই ডায়েট হওয়া চাই যথাযোগ্য।
ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে হাইপো বা হাইপার—উভয় ক্ষেত্রই অস্বাভাবিক। এমন রোগীর ডায়াবেটিস নিল বা শূন্য হয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা দেয় হাই ব্লাড সুগার। সাধারণত যেসব রোগীর ডায়াবেটিস বেশি থাকে, তাদের শীতকালে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি। কেননা আমরা যারা শীতপ্রধান দেশে থাকি না, তাদের বেলায় শীতকাল মানেই চারপাশে উৎসবের ধুম। নানা রকম পিঠা-পুলি আর পায়েস তৈরি হয় বাসায় বাসায়। গুড়-চিনির এসব মিষ্টি নাশতা পাতে থাকে সকালে বা বিকেলে। ফলে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস নিয়ে গোটা শীত পার হয়ে যায় কারও কারও। তাদের বলছি, বাড়তি সতর্কতার বিকল্প নেই। মিষ্টি পিঠা যাদের ভীষণ পছন্দ, তারা সম্পূর্ণ বাদ না দিয়ে চিনির পরিবর্তে অলটারনেটিভ সুগার ব্যবহারে তৈরি করা মিষ্টান্ন বেছে নিতে পারেন।
হাই কোলেস্টেরল
রক্তে বাড়তি কোলেস্টেরল মানেই হার্ট অথবা লিভারের নানা সমস্যা। আজকাল আমাদের দেশে ফ্যাটি লিভারের রোগীর সংখ্যাও অনেক। মনে রাখা চাই, প্রয়োজনের অতিরিক্ত যেকোনো খাবারই শরীরে ফ্যাট তৈরি করে। উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবারগুলো যদি আমাদের ডায়েটে মাত্রাতিরিক্ত থাকে, তাতে কোলেস্টেরল অনিয়ন্ত্রিত হওয়ার ঝুঁকি প্রবল। শীতকালে ঘরে ঘরে ভুনা মাংস, কষা মাংস, হাঁসের মাংস খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। এ সময়ে বিয়ের উৎসব থাকে চারপাশে। আর বিয়ের উৎসব মানেই বাহারি তেল-মিষ্টির নানা পদ। বারবার এ ধরনের অনুষ্ঠানে বাড়তি চর্বি গ্রহণ রক্তে চর্বি বাড়ায়। তাই সামাজিকতা রক্ষার্থে প্রোগ্রামগুলোতে যোগ দিলেও হাই কোলেস্টেরলের কথা মাথায় রেখে খাবার গ্রহণের পরিমাণ ঠিক রাখা চাই।
থাইরয়েড
শীতকাল মানেই ব্রকলি, ফুলকপি, বাঁধাকপির আইটেম। এককথায়, মৌসুমি সবজিতে চারপাশ ভরপুর। এ ধরনের সবজিগুলো অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর ভেবে গ্রহণ করলেও থাইরয়েডে আক্রান্তদের পড়তে হয় বিপদে। এই সবজিগুলো গয়ট্রোজেনিক হওয়ায় পরিমিত গ্রহণ করা শ্রেয়।
অ্যাজমা ও নিউমোনিয়া
উইন্টারের আরও দুই ভোগান্তির নাম অ্যাজমা ও নিউমোনিয়া। হাঁপানি রোগীদের তো অবশ্যই, সাধারণ নবজাতক, শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিদেরও এ সময়ে এসব ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। যাদের ফ্লু অ্যালার্জি রয়েছে, তাদের ফুসফুসজনিত সমস্যা বাড়তে পারে উইন্টারে। আর কিছু খাবার রয়েছে, যেগুলো অ্যাজমাকে ট্রিগার করে। যেমন হাঁসের মাংস, হাঁসের ডিম, গরুর দুধ, সিম্পল সুগারগুলো—যেগুলো পিঠাপুলি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। তাই এসব খাবার খাদ্যতালিকা থেকে কোনো কারণে পুরোপুরি বাদ দিতে না পারলে অল্প পরিমাণ গ্রহণ করা তুলনামূলক মঙ্গল।
আর্থ্রাইটিস বা বাতের ব্যথা
শীতে অনেকের পায়ে জয়েন্ট পেইন বা আর্থ্রাইটিসের সমস্যা বেড়ে যায়। মূলত বয়স্ক ব্যক্তিরা এতে বেশি ভোগেন। যাদের রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, অস্টিও আর্থ্রাইটিস রয়েছে, এ সমস্যাগুলো তাদের জন্য আরও কষ্টদায়ক। যাদের আগে থেকে রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি কিংবা হাইপার ইউরোসেমিয়া রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে হাই পিওরিনসমৃদ্ধ খাবারগুলো খাদ্যতালিকায় শীত মৌসুমে না রাখাই ভালো। সে ক্ষেত্রে যেসব খাদ্য এড়িয়ে চলা চাই—
পালংশাক: অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর হলেও পালংশাকে রয়েছে হাই অক্সালেট। ইউরিক অ্যাসিড বাড়াতে এটি যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। তাই হাইপার ইউরোসেমিয়া থাকলে ডায়েট থেকে পালংশাক দূরে রাখতে হবে।
টমেটো: আজকাল সারা বছরই মেলে। তবে শীতের সবজি হিসেবে যেসব কাঁচা ও পাকা টমেটো পাওয়া যায়, সেগুলো যথেষ্ট পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। আর যাদের টমেটো খুবই পছন্দের তালিকায় থাকে, এর স্যুপ, স্যালাদ, পিউরি এমনকি মাছ মুরগি রান্নায়ও এর পেস্ট ব্যবহার করে থাকেন। তবে রক্তে ইউরিক অ্যাসিড বেশি থাকলে অভ্যাস পরিবর্তন করে টমেটো বন্ধ রাখাই উত্তম।
মটরশুঁটি: ডাল বা মটর দিয়ে বিভিন্ন ধরনের সবজি ও মাংসের পদ খুবই সুস্বাদু। তবে প্রোটিন ও ফাইবারের পাশাপাশি এতে থাকে উচ্চ পিওরিন। সে ক্ষেত্রে উইন্টারে যাদের হাত-পায়ে গিঁটেব্যথা হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, তারা এ ধরনের বিচি বা দানা মটর খাওয়া থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকুন।
হেলদি ব্যালেন্সড লাইফস্টাইল
উইন্টারে বাড়তি সতর্কতা হিসেবে ডায়েটের পাশাপাশি মানা চাই হেলদি ব্যালেন্সড লাইফস্টাইলও। সে ক্ষেত্রে যা করতে পারেন—
অনেকের সারা বছর ঠান্ডা পানি বা পানীয় খাওয়ার অভ্যাস থাকে। শীতকালে এ ধরনের অভ্যাস পুরোপুরি বাদ দিয়ে, কুসুম গরম পানি পান করা ভালো। গলায় জমে থাকা কফ বা শ্বাসনালির জীবাণু মুক্তকরণে হালকা গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করতে পারেন।
উইন্টারে যাদের অ্যালার্জি বিশেষত ফুসফুসের প্রদাহ বাড়ার প্রবণতা থাকে, তাদের মধ্যে ডাস্ট অ্যালার্জি সংক্রমণ বেশি দেখা যায়। এ ধরনের বাড়তি কষ্ট দূর করতে মাস্ক পরে বাইরে যাওয়াই ভালো।
তীব্র শীতের সময় ঘরে বা খোলা আবহাওয়ায় প্রয়োজনমতো গরম কাপ, কানঢাকা টুপি এবং গলায় মাফলার ব্যবহার করা উত্তম।
সাধারণত সকালের বাতাসে পোলেন বা ফুলের রেণু ওড়ে। তাই যাদের পোলেন অ্যালার্জি রয়েছে, এ সময় ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রাখাই ভালো।
রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকলে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা বাড়ে। তাই শীতকালে বাড়তি কিছু সতর্কতা গ্রহণ করার পাশাপাশি পুষ্টিকর টাটকা খাবার এবং পর্যাপ্ত পানি পান করলে উপকার মিলতে পারে।
লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট