skip to Main Content

প্রাগৈতিহাসিক I গ্রিক গিমিক

ভাবুন তো, আপনার পাতে এমন সব খাবার, যেগুলো গ্রিসের কিংবদন্তি দার্শনিক প্লেটো, সক্রেটিস ও অ্যারিস্টটল কিংবা ইতিহাসের অন্যতম সেরা ও সফল সেনানায়ক এবং প্রাচীন গ্রিক রাজ্য ম্যাসিডনের রাজা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট উপভোগ করতেন! কিছু খাবার বাদে প্রাচীন গ্রিক হেঁশেলের অনেক খাবার এখনো টিকে আছে; তবে আধুনিক সংস্করণে

প্রাচীন গ্রিক খাদ্য ও রন্ধনপ্রণালিতে প্রাচীন গ্রিসের ভূখণ্ড, জলবায়ু এবং কৃষিপদ্ধতি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাদের স্বাস্থ্যকর প্রাকৃতিক খাদ্য ও ন্যূনতম প্রক্রিয়াজাত খাবারের ওপর নজর বোলালেই বোঝা সম্ভব, এসব খাবার গ্রিকদের বিখ্যাত অ্যাথলেটিসিজম ও সামগ্রিক স্বাস্থ্যে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছিল। প্রাচীন গ্রিকরা প্রধান খাবার হিসেবে শাকসবজি, লেবু ও ফলের বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় পদ উপভোগ করতেন। সারা বিশ্বের পর্যটকদের কাছে স্নিগ্ধ দ্বীপ সান্তোরিনি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। এর দেখা মিলেছে নানা সিনেমা ও লেখনীতে। এ ছাড়া আরও অনেক দ্বীপসহ একটি উপকূলীয় দেশ হওয়ায়, মাছ ও সামুদ্রিক খাবার ছিল প্রাচীন গ্রিসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পাশাপাশি, পশুশিকার করে তারা মাংসের চাহিদা মেটাতেন। সামর্থ্য ও প্রাপ্যতার ভিত্তিতে গৃহস্থালির সম্পদ ও অবস্থান অনুসারে মাছ-মাংসের ব্যবহারে অবশ্য ভিন্নতা লক্ষণীয়। প্রাচীন গ্রিক সমাজে সকালের নাশতা, মধ্যাহ্নভোজ ও নৈশভোজে খাবারের রূপ, স্বাদের ভিন্নতা এবং বিভিন্ন রান্নার পদ্ধতি দেখা যায়।
প্রাচীন গ্রিক রন্ধনপ্রণালি একটু উপলব্ধি করলে সেখানে কৃষকদের পরিশ্রম এবং খাবার জোগানে জনগণের মিতব্যয়িতার দেখা মেলে। সেসব খাদ্যতালিকায় গম, শাকসবজি, ফল, মটরশুঁটি, শস্যকণা, অলিভ অয়েল, মাছ, ডিম, পনির, দই, ওয়াইনের পাশাপাশি আরও বেশ কিছু খাবার ছিল উল্লেখযোগ্য; এগুলোর মধ্যে কিছু খাবার আজও টিকে আছে। এ ছাড়া রেড মিট খাওয়ার চল ছিল; তবে ব্যয়বহুল হওয়ায় তা সবার পাতে জুটত না। তবে কোনো পরিশোধিত চিনি বা প্রক্রিয়াজাত খাবারের চল তখন ছিল না; বরং খাবারে মিষ্টি স্বাদ আনার জন্য সামান্য পরিমাণে মধু মেশানো হতো। হাইড্রেশনের জন্য পানিমিশ্রিত ওয়াইন পানের রেওয়াজ ছিল। তিন বেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি উদরপূর্তি হতো রাতের খাবারে।
 শাকসবজি: টাটকা শাকসবজি প্রাচীন গ্রিক খাদ্যের একটি প্রধান অংশ। সাধারণ সবজির মধ্যে বাঁধাকপি, পেঁয়াজ, রসুন, শালগম, মুলা, গাজর, পার্সলে ও পালংশাক ছিল অধিক জনপ্রিয়। চার্ড, বিটরুট পাতা এবং ড্যান্ডেলিয়নের মতো সবুজ পাতাযুক্ত শাকও খেতেন প্রাচীন গ্রিসের অধিবাসীরা।
 ফল: জলপাই একটি ফল হিসেবে বিবেচিত হলেও গ্রিসের প্রাথমিক ফসলগুলোর অন্যতম। দেশটির মাটি উর্বর না হওয়ায় গ্রিকরা উপত্যকার তলদেশে শস্য এবং পাহাড়ের ঢালে আঙুর ও জলপাই চাষ করতেন। বেশির ভাগ খাবার রান্নায় সাধারণত অলিভ অয়েল ব্যবহার করা হতো। এ ছাড়া জলপাই ছিল একটি প্রথাগত অ্যাপেটাইজার। টাটকা ও শুকনো ফল আর বাদাম খাওয়া হতো ডেজার্ট হিসেবে। ডুমুর, কিশমিশ ও ডালিম ছিল গুরুত্বপূর্ণ ফল। তৃতীয় শতাব্দীর শুরুর দিকে ঐতিহাসিক, বক্তৃতাবিদ ও ব্যাকরণবিদ এথেনিয়াস (১৭০-২২৩) তার ঐতিহাসিক রচনা ডিপনোসোফিস্টে খাবার হিসেবে ডুমুর ও মটরশুঁটির বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। শুকনো ডুমুরও অ্যাপেটাইজার হিসেবে কিংবা পানাহারের সময় খাওয়া হতো। বিশ্বাস করা হয়, প্রাচীন গ্রিক সভ্যতায় ফল হিসেবে প্রথম যেসব খাওয়া হয়েছিল, বরই তার অন্যতম। অন্যান্য ফলের মধ্যে আপেল, নাশপাতি ও কুইন্স (নাশপাতি আকারের হলদেটে শক্ত ফল), ক্যারোব, জুজুবস (লাল খেজুর), বার্গামট কমলা প্রভৃতি খাওয়ার চল ছিল। বার্গামট কমলা আধুনিক সময়ে লেবুপ্রধান হয়ে ওঠার আগে গ্রিক খাবারে প্রবেশ করা প্রথম সাইট্রাস ফল ছিল।
 লেগুম (মটরশুঁটি ও বাদাম): লেগুমগুলো ছিল গুরুত্বপূর্ণ ফসল। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে গ্রিক সমর নেতা, দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ জেনোফোনের সময় অনুর্বর মাটিতে লেগুমের পুনরুৎপাদন ক্ষমতা সম্পর্কে জানা যায়। প্রাচীন গ্রিসে প্রথম গৃহে চাষ করা ফসলের মধ্যে মসুর ডাল অন্যতম। প্যালিওলিথিক সময়কাল (৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন বছর থেকে প্রায় ১২ হাজার বছর আগে) থেকে এই অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে এটি পাওয়া যেত। অন্যান্য জনপ্রিয় লেগুমের মধ্যে ছিল ছোলা এবং সবুজ ও হলুদ মটরশুঁটি। জনপ্রিয় বাদামের মধ্যে বিচনাট, চেস্টনাট, আখরোট ও কাঠবাদাম।
 শস্যকণা: গম ও বার্লি প্রাচীন গ্রিসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শস্য ছিল। এগুলো রুটি, বেকড পণ্য, জাউ বা স্যুপে যুক্ত হিসেবে খাওয়া হতো। এসবের বাইরে, বাজরা একটি সাধারণ শস্য ছিল এবং খামিরবিহীন রুটি তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। এ ছাড়া সিরিয়াল ছিল সেখানকার প্রধান খাদ্যশস্য।
 অলিভ অয়েল: প্রাচীন গ্রিক খাবারে অলিভ অয়েল ছিল চর্বির প্রধান উৎস। সেই সভ্যতায় জলপাই গাছ প্রচুর বেড়ে গিয়েছিল। রান্না, ড্রেসিং ও স্বাদ বৃদ্ধির জন্য খাবারে জলপাই ব্যবহার ছিল নৈমিত্তিক।
 মাছ ও সামুদ্রিক খাবার: গ্রিসের সামুদ্রিক সংস্কৃতি ভীষণ ঋদ্ধ। সেই হিসেবে মাছ ও সামুদ্রিক খাবার যেমন টুনা, ম্যাকেরেল, সিবেস, রেড মুলেট, অক্টোপাস, ঝিনুক প্রভৃতি প্রাচীন গ্রিক খাবারে নিয়মিত দেখা মিলত। গারুম নামক ফিশ সস একটি বাড়তি স্বাদ এনে দিত খাবারে।
 মাংস ও মুরগি: প্রাচীন গ্রিকরা আজকের তুলনায় অনেক কম মাংস খেতেন। সেখানে শিকার ও ফাঁদের মাধ্যমে তিতির, বন্য খরগোশ, শূকর ও হরিণ খাওয়ার অনুমতি ছিল। তবে কৃষকেরা মুরগি, রাজহাঁস ও ডিম দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ৫৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের গ্রিক গল্পকার ঈশপের প্রবাদ ‘বাচ্চা ফোটার আগে মুরগি গুনো না’ আভিধানিক অর্থে ভবিষ্যতের কোনো কিছু ঘটার আগে উদ্‌যাপন অথবা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস এড়িয়ে যেতে বলা হলেও নিগূঢ় অর্থে সে সময়কার খাদ্যসংস্কৃতিকেও তুলে ধরেছে। অল্প ধনী বা জমির মালিকেরা ছাগল, শূকর, ছাগল, ভেড়া ও গাধা পালন করতেন। শহরে শূকরের মাংস ছাড়া অন্যান্য মাংসের দাম বেশি ছিল। গ্রিক নাট্যকার অ্যারিস্টোফেনিসের (খ্রিস্টপূর্ব ৪৪৬-৩৮৬) সময়ে একটি শূকরের দাম ছিল তিন ড্রাকমা, যা একজন সরকারি কর্মচারীর তিন দিনের মজুরির সমান। তবে সসেজের দেখা ধনী-গরিব সবার পাতেই মিলত।
 পানীয়: প্রাচীন গ্রিসের প্রধান পানীয় ছিল পানি ও ওয়াইন। মিসরে প্রায় ৫ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিয়ারের উদ্ভাবন ঘটে; পরবর্তীকালে তা গ্রিসেও পাওয়া যেত। বিয়ার ও হানি মিড সম্ভবত প্রাচীন বিভিন্ন উৎসবের জন্য সংরক্ষিত ছিল। ওয়াইন এত বেশি পান করার চল ছিল, যার অন্য রকম তাৎপর্য রয়েছে। বাড়ির নারীদের একটি দৈনন্দিন কাজ ছিল এই প্রধান পানীয় প্রস্তুত করা। এর গুরুত্ব এতই ছিল, প্রাচীন গ্রিক সভ্যতায় একজন ‘গড অব ওয়াইন’ও ছিলেন, যার নাম ডায়োনিসোস। দিনের সমস্ত খাবারের সঙ্গে ওয়াইন পরিবেশন করা হতো। গ্রিকরা রেড, হোয়াট, রোজ ও পোর্ট স্টাইলের ওয়াইন তৈরিতে পারদর্শী ছিলেন। উৎপাদনের প্রধান জায়গা ছিল থাসোস, লেসবোস ও চিওস দ্বীপ। বলে রাখা ভালো, প্রাচীন গ্রিকরা উন্মত্ত হওয়ার জন্য ওয়াইন পান করতেন না; বরং ওই সভ্যতায় মাতাল হওয়াকে খারাপ হিসেবে গণ্য করা হতো। প্রকৃতপক্ষে, প্রাচীন গ্রিক সিম্পোজিয়ামের (একত্রে কিছু মানুষের পানাহারের পার্টি) সময় ইভেন্টের নেতা, যাকে সিম্পোজিয়ার্ক বলা হতো, তিনি ওয়াইনকে প্রথমত পানি মিশিয়ে পাতলা করে নিতেন এবং এটি কতটা কড়া থাকবে, তা নির্ধারণ করতেন। কেউ অতিরিক্ত নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে তাকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখা হতো।
 অন্যান্য খাবার: প্রাচীন গ্রিকরা গৃহে পশুপালন করতেন। তা থেকে দুধ সংগ্রহ এবং পনির তৈরি করা হতো। ৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইউরোপজুড়ে গৃহে মৌমাছি পালনের চল ছড়িয়ে পড়ে; তবে তারও আগে প্রাচীন গ্রিকের দ্বীপ ঘেরা শহর মিনোয়ানে মৌমাছি থাকার প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ মেলে। গ্রিক রন্ধনপ্রণালিতে ভিনেগার একটি জনপ্রিয় প্রধান উপাদান। ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হিপোক্রেটিস নামের এক চিকিৎসক ও দার্শনিক ছিলেন, যাকে ওষুধের জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কাশি, সর্দিসহ বিভিন্ন রোগের নিরাময়ে মধুর সঙ্গে মিশিয়ে আপেল সিডার ভিনেগার খাওয়ার পরমর্শ ছিল তার। প্রাগৈতিহাসিক ও প্রাচীন ভূমধ্যসাগরীয় সংস্কৃতিতে এসকারগট বা স্থল শামুকও খাওয়া হতো বলে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ রয়েছে।
ধীরে ধীরে বাণিজ্য রুট এবং অভিযাত্রীদের মাধ্যমে গ্রিসে নতুন সব খাবারের প্রচলন ঘটে। অনেক খাবার সেখানকার জলবায়ু ও মাটির পক্ষে অনুকূল ছিল, যা পরবর্তীকালে আধুনিক গ্রিক খাবারের অংশ হয়ে উঠেছে।

 ফুয়াদ রূহানী খান
চিত্রকর্ম: সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top