ফিচার I বিশ্বরঙের বিজয়রথ
বাংলাদেশের অন্যতম ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘বিশ্বরঙ’। ফ্যাশন ডিজাইনার বিপ্লব সাহার উদ্যোগ। ত্রিশ ছুঁয়েছে কালক্রমে। এই দীর্ঘ পথযাত্রায় মুগ্ধ করেছে অযুত-নিযুত ক্রেতাকে। দেশি ফ্যাশনশিল্পের দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়ার সাহস করেছেন এই সৃজনশীল মানুষ। যার পদচারণায় রঙিন হয়েছে ফ্যাশন বাজারের কলেবর
নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় রাইফেলস ক্লাবের বিপরীতে সান্ত¡না মার্কেটে শুরু হয়েছিল যাত্রা। ১০০ স্কয়ার ফুটের দোকান থেকে দেশব্যাপী জনপ্রিয়তা। বিশ্বরঙের বিজয়ের গল্প এক লাইনে এমনটাই। শুরুর গল্প কিছুটা ভিন্ন। পোশাক নয়, বিয়েবাড়ির সজ্জা আর সিরামিক নিয়ে শুরু হয়েছিল পথচলা। এক বছর পর অর্থাৎ ১৯৯৫ সালে প্রথমবারের মতো শাড়ি নিয়ে আসা হয় প্রাঙ্গণে।
পুঁজির সংকট প্রকট তখন। ঈদ সংগ্রহ আনতে কাঁচামাল প্রয়োজন। কিন্তু জোগাড় হচ্ছিল না যথেষ্ট মূলধন। পাশে দাঁড়িয়েছিলেন প্রিয়জনেরা। তাদেরই সহায়তায় প্রথমবারের মতো ১৯৯৬ সালের ঈদকে কেন্দ্র করে পাঞ্জাবি, শাড়ি ইত্যাদি পণ্য তোলা হয় ছোট্ট সেই বিপণিতে। ক্রেতা আগমনে ধন্য হয় বিশ্বরঙ। অল্প সময়ে বিকিয়ে যায় সব পণ্য। নারায়ণগঞ্জবাসীর জীবনমান ও রুচিবোধে পরিবর্তন তৈরির উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করে বিশ্বরঙ। ধীরে ধীরে শখ থেকে বিশ্বরঙ পরিণত হয় বিপ্লব সাহার দায়িত্ববোধে। কারণ, তত দিনে প্রতিষ্ঠানটি শত শত মানুষের পরিবার। উপার্জনের উৎস।
বিশ্বরঙ তরুণ বিপ্লবের স্বপ্ন। ১৯৯১-৯২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে পড়তে শুরু করেন তিনি। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে আগমন ১৯৯৪ সালে। অনেকটা শখের বশে। ছাত্রজীবনের আগে থেকে ইভেন্টের কাজ করতেন তিনি। হোম ইন্টেরিয়র থেকে শুরু করে সৌন্দর্যবর্ধন-সংক্রান্ত নানা ক্ষেত্রে তখন চারুকলার শিক্ষার্থীদের জয়ধ্বনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর বিপ্লবের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। নারায়ণগঞ্জের ছেলে তিনি। কাজের তাগিদে আসতেন ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে প্রথম বিভাগে এম এফ এ সম্পন্ন করেন তিনি। নিজের শিল্পসত্তাকে দেশ ও জাতির কল্যাণে ব্যবহারের প্রচেষ্টায় নিরলস। কিন্তু কখনো নীতির সঙ্গে করেননি আপোস। মুক্তবাজার অর্থনীতির অস্থির সময়েও নিজস্ব শিকড়সন্ধানের চেষ্টা করেছেন নিরলস। ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে দেশীয় তাঁতকে প্রাধান্য দিয়েছেন সব সময়। নিরীক্ষাধর্মী কাজে তিনি ক্লান্তিহীন। এ দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য—শখের হাঁড়ি, মুখোশ, নকশি পাখা, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলার পটচিত্র, বাংলা পঞ্জিকা, ঐতিহ্যে বাংলা সিনেমা, পানাম নগর, কান্তজী মন্দিরের টেরাকোটা, রিকশা মোটিফসহ আলপনার মতো মহামূল্যবান মোটিফকে পোশাকের অলংকরণ হিসেবে ব্যবহার করে দেশীয় ফ্যাশনকে ইতিহাস-ঐতিহ্যের মিশেলে নিয়ে যেতে চেয়েছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমৃদ্ধির শিখরে।
বিশ্বরঙ দেশকে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন দরবারে পরিচয় করিয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আমেরিকা, ভারত, মালয়েশিয়া, কানাডায় পৌঁছে গেছে বিশ্বরঙের প্রয়াস। পোশাকে অতি উজ্জ্বল রঙের উপস্থিতি নিয়মিত করেছে বিশ্বরঙ; যা বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে রাঙিয়েছে প্রবলভাবে। তাই শুরু থেকেই ছিল অনুকরণীয়। টাঙ্গাইলের মলিন তাঁতের শাড়িকে আধুনিক ফ্যাশনের অনুষঙ্গ করতে নিরলস প্রচেষ্টার ফল বর্তমানে বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে বিদ্যমান। এ বিষয়ে বিপ্লব সাহা বলেন, ‘বিভিন্ন দিবসে পোশাকের বর্ণিলতা আমাদের মাধ্যমেই শুরু হয়, যা আজ অভিন্ন এক রীতিতে সামগ্রিকভাবে প্রচলিত।’
শুধু পোশাকে সীমাবদ্ধ না থেকে সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে ২০১০ সালে জাতীয় জাদুঘরে প্রথমবারের মতো ‘আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে রঙের উপস্থিতি’ শীর্ষক এক যুগান্তকারী প্রদর্শনীর আয়োজন করি, যা সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বোদ্ধামহলেও ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে।
শিশুদের মেধাবিকাশের লক্ষ্যে বিশ্বরঙ মা দিবসে বিশেষ আয়োজন করে। ‘আমার রঙে আমার মা’ শীর্ষক এক ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনী ছিল সেটি। শিশুদের আঁকা প্রাণবন্ত চিত্রকলাকে ফ্যাশনের উপাত্ত হিসেবে ব্যবহার করে দেওয়া হয়েছিল ভিন্ন মাত্রা। ২০ বছর পূর্তিতে আরটিভির সঙ্গে যৌথ আয়োজনে করে ‘টোয়েন্টি-টোয়েন্টি কালারস’ প্রতিযোগিতা। সারা দেশের টিনএজদের মধ্য থেকে প্রতিভাবানদের বাছাই করে উন্নত প্রশিক্ষণের পর এ দেশের মিডিয়াকে উপহার দিয়েছেন একঝাঁক নতুন মুখ। যাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও কাজ করছে এখন। বিপ্লব সাহা এ বিষয়ে বলেন, ‘ফ্যাশনের মাধ্যমে চলচ্চিত্রের প্রচারণার যে প্রচলন শুরু হয়েছে, তাতে আমরাই পথিকৃৎ।’
দেশের ফ্যাশনশিল্পকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয়ে বিশ্বরঙের কর্ণধার প্রখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার বিপ্লব সাহার নেতৃত্বে সম্প্রতি গড়ে তোলা হয়েছে ‘বিশ্বরঙ উদ্যোক্তা ভূমি’। নকশা থেকে শুরু করে উৎপাদন এবং বিপণনের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সহায়তা ও দিকনির্দেশনা প্রদান, প্রদর্শনী আয়োজনের মাধ্যমে বিপণনে সহায়তা করা এবং সেমিনার, প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা আয়োজনের মাধ্যমে নতুন ও পুরোনো উদ্যোক্তাদের গুণগত উন্নয়ন সাধনই এই প্ল্যাটফর্মের উদ্দেশ্য।
প্রতি মাসেই ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন জেলায় আয়োজিত হচ্ছে ‘বিশ্বরঙ উদ্যোক্তা ভূমির আড্ডা’। এখানে উদ্যোক্তারা পাচ্ছেন সুপরামর্শ। তাদের মধ্য থেকে বাছাই করে ১৬ জনকে নিয়ে গেল সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় ‘শরৎ হাওয়া’ শিরোনামে দুদিনের প্রদর্শনী। সেই ধারাবাহিকতায় বিশ্বরঙের ৩০ বছর উপলক্ষে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের প্রায় ১ হাজার ৫০০ উদ্যোক্তা থেকে বাছাই করে ৩০ জনকে নিয়ে ডিসেম্বর ২০২৪ এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জয়নুল গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয় ‘শীতের হাওয়া’।
বিপ্লব সাহা বলেন, ‘বিশ্বরঙের সৃষ্টিশীলতা সব সময় সুস্পষ্ট এবং স্বতন্ত্র। আমরা আমাদের স্থানীয় কারিগর, তাঁতি, সূচিশিল্পী, কারুশিল্পীদের সঙ্গে কাজ করি এবং বিস্ময়করভাবে প্রাণবন্ত সংগ্রহের পরিসীমা অতিক্রম করি ফ্যাশনপ্রেমীদের অভিনব নিরবচ্ছিন্ন চাহিদাকে। আমাদের নকশাগুলো লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্য অনুপ্রাণিত, যা ঐতিহাসিকভাবে দক্ষতার উৎস হিসেবে একটি নির্ধারিত ভূমিকা পালন করে আসছে সুদীর্ঘ ৩০ বছর ধরে। এ দেশের সাধারণ মানুষই আমাদের সৃষ্টির এক মহান অনুপ্রেরণা।
ফ্যাশন ডেস্ক
ছবি: বিশ্বরঙের সৌজন্যে