skip to Main Content

ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I শুদ্ধতার শ্রাদ্ধ!

জেনারেশন জেড আবার আলোচনায়। ফ্যাশন ব্যাকরণের একদম বাইরে। সূত্রহীন সূত্রে বুনন। নিজস্বতার শতভাগ প্রকাশ। কাস্টমাইজেশন রেভল্যুশন কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা দেখার অপেক্ষায়

ম্যাক্সিমালিজমের ম্যাজিক ২০২৪ সালের পুরোটাই বেশ মাতিয়ে গেছে। স্ট্রিটওয়্যার থেকে শুরু করে কতুর কাহন—সবখানেই জাঁকজমকের জয়। তবে প্যান্টন ২০২৫ সালের রং হিসেবে মোকা মুস নির্ধারণ করার কারণে এ বছরের ফ্যাশনে একটুখানি দোলাচল তৈরি হয়েছিল। ক্লিন গার্ল অথবা কোয়াইট লাক্সারির মতো মিনিমালিস্টিক ফ্যাশন কোর সদর্পে ফিরবে বলেও ধারণা করেছিলেন ফ্যাশনবোদ্ধাদের একাংশ। কিন্তু ট্রেন্ড ফোরকাস্টিং এজেন্সি ওর্থ গ্লোবাল স্টাইল নেটওয়ার্ক মিলিয়ে দিয়েছে হিসাব। ফ্যাশনবিষয়ক এই আন্তর্জাতিক গবেষণা ও জরিপ প্রতিষ্ঠানের মতে, এবারের ফ্যাশন দুনিয়াতে কেওটিক কাস্টমাইজেশনের কোলাহল চলবে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর অবধি। এর ক্রেতা হবে মূলত জেনারেশন জেড। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ব্লুমবার্গের তথ্যমতে, বিশ্বে মোট ৩২ শতাংশ মানুষ আছে প্রজন্মটিতে। সংখ্যা থেকেই আঁচ করা যায়, বিপুল এই জনসংখ্যার চাহিদা যদি কেওটিক কাস্টমাইজেশনকে ঘিরে থাকে, তাহলে ২০২৫ এর শীর্ষস্থানীয় ট্রেন্ড হওয়ার সম্ভাবনা প্রকট হয়ে ওঠার পসিবিলিটি প্রবল।
উৎসে উত্তর
জেন-জিদের অন্যতম পছন্দের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটক। ২০২৪ সালে সেই প্ল্যাটফর্মে একটি কনটেন্ট ভাইরাল হয়। ব্রিটিশ-ফরাসি গায়িকা এবং অভিনেত্রী ফ্যাশনসচেতন জেন বার্কিনের নিত্যদিনের ব্যাগবিষয়ক ভিডিও চিত্র। সেখানে তিনি ব্যাগে কী কী আছে, সেগুলো দেখানোর পাশাপাশি ব্যাগের বিভিন্ন অনুষঙ্গ যোগ করার কারণ ব্যাখ্যা করেন। নিজের মতো করে ব্যাগ সাজিয়ে নেওয়ার তত্ত্বটি বেশ মনে ধরে জেন-জিদের। প্রয়াত এই স্টাইল-সচেতন ব্যক্তির ভাষ্য, নিজের পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে সবকিছু সাজিয়ে নেওয়া। কারণ, তার মতে ব্যক্তিত্ব প্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ব্যক্তির পোশাক ও অনুষঙ্গ।
আবার, আমেরিকান ডিজাইনার সুজান কর্ন ফ্যাশন ম্যাগাজিন ফ্যাশনিস্তাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কেওটিক কাস্টমাইজেশন ট্রেন্ডের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ক্রেতার ব্যক্তিসত্তার প্রতিফলন ঘটে তার কাস্টমাইজেশনে।’
সুজানের মন্তব্যে জেনারেশন জেডদের নতুন এই ক্রেজের সহজ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এই জেনারেশনে অন্তর্ভুক্ত যারা, তাদের জন্ম ১৯৯৫ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে। বুঝতে শুরুর সময় থেকেই নিজস্বতাকে গুরুত্ব দিতে পছন্দ করে এই প্রজন্ম। ফ্যাশনেও দেখা গেছে তাদের এই দর্শনের প্রদর্শন। রেডিমেইড ড্রেস নয়, নিজের মতো করে টেইলরিং তাদের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে। আলংকারিকে কৌতূহল দেখা গেছে বেশি। অর্থাৎ একটি পোশাককে নিজের মতো পুনরায় সাজিয়ে নেওয়ার আগ্রহ। সেখান থেকে ডু ইট ইওরসেলফ ট্রেন্ডের উত্থান। স্ট্রিট ওয়্যার, থ্রিফটিং, প্রি লাভড ট্রেন্ড জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনেও আছে জেন-জিদের ভূমিকা। এসবের পুরোটাই নিজস্বতার উল্লাস। জেন-জিদের কাছে এসব ফ্যাশন ফিলোসফি প্রিয় হওয়ার কারণ, ব্যক্তিস্বাধীনতায় গুরুত্ব দিয়ে নিজেকে সাজিয়ে তোলা। সে কারণেই পোশাকের আলংকারিক নকশায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে এই প্রজন্ম। যেমন কাটিং, প্যাচিং, এমব্রয়ডারিং, লেয়ারিং আর মিসম্যাচিংয়ের জনপ্রিয়তা। এর সবই কাস্টমাইজেশনের অংশ। কোনোটাই আনকোরা কিংবা অভিনব নয়। কিন্তু মনের চাহিদা, ভাবনা, দর্শন, মতবাদকে পোশাকে বিপুলভাবে তুলে আনার আগ্রহ সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে জেনারেশন জেডদের মাঝে।
শৃঙ্খলশূন্য
কুকি কাটার ফ্যাশনে অভ্যস্ততা বহুদিনের। এই ট্রেন্ডে ব্যক্তিস্বাধীনতার কোনো জায়গা ছিল না বললেই চলে। সূত্র মেনে তৈরি পোশাকের বাজারের কলেবর ছিল বিশাল। সেখানে নিজস্বতার জয়গান গাইতে হাজির হয়েছে কাস্টমাইজেশন। মাস প্রডিউজড থেকে একেবারে ইউনিক পিস। আগাগোড়া ব্যতিক্রম।
কেওটিক কাস্টমাইজেশন ট্রেন্ডে কোনো সূত্র না মেনে করা হয় নকশা। লাউড লোগো, ওয়ার্ড, লেটার, নম্বর, প্রতীকসহ যেকোনো কিছু ব্যবহার করা যেতে পারে নকশা করাতে। যিনি পরবেন, তার ইচ্ছাই এখানে বেদবাক্য। শতভাগ বিশুদ্ধ সৃজনশীলতা।
মূলে দর্শন
সূত্র মেনে না চললেও কিছু বিশেষ বিষয় নতুন এই ট্রেন্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বলা যায়, কেওটিক কাস্টমাইজেশন শুধু একটি ট্রেন্ড নয়, ফিলোসফিও বটে। যেখানে প্রথা ভাঙার গানের স্পষ্ট উচ্চারণ শোনা যায়। অনুভব করা যায় ধরণীর প্রতি প্রেম। জ্যামিতির মতো স্কেল মেপে নকশায় তাদের আগ্রহ নেই বললেই চলে; বরং শুদ্ধতার প্রশ্নে ভীষণ আপত্তি। মূলমন্ত্রের ব্যাখ্যা থাকছে এখানে।
প্রতিবাদী প্রাণ
সমাজের বিরুদ্ধাচরণ তারুণ্যের একটি অংশ বলা যেতে পারে। প্রচলিত নিয়মের বিরুদ্ধে দৃপ্ত প্রতিবাদেও ফ্যাশন বিভিন্ন সময়ে ব্যবহৃত হয়েছে। সত্তরের পাঙ্ক মুভমেন্টকে প্রতিবাদের জন্য বিশেষভাবে মনে রাখা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় আশা করা যায়, জেনারেশন জেড ফ্যাশনের মাধ্যমে প্রতিবাদের ভাষার পূর্ণ প্রকাশের চেষ্টা করবে। ড্রেসের ক্যানভাসে তাদের ভাবনাচিন্তার উপস্থাপন হতে পারে বাধাহীন। রাজনীতি, সামাজিক বাধা কিংবা হাস্যরস—এসবের প্রকাশ্য আলোচনার জায়গা হতে পারে ক্লদিং আইটেম।
টিকে থাকার গান
জেনারেশন জেডদের মাঝে প্রকৃতিপ্রেম অন্যদের তুলনায় খানিকটা বেশিই বলা যেতে পারে। ধরণী ভালো রাখার চাহিদা থেকে তারা চেষ্টা করে যাচ্ছে ফ্যাশন বর্জ্য কমিয়ে আনতে। স্লো ফ্যাশন তাদের সময়ের বহুল আলোচিত টপিক। তারা পুরোনোকে ফেলে না দিয়ে, নিজের মতো করে নতুনভাবে সাজিয়ে নিতে পছন্দ করে। যেখানে কেওটিক কাস্টমাইজেশন কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।
প্রযুক্তিপ্রেম
ইন্টারনেটের প্রতি আগ্রহ এই প্রজন্মকে বেশ কিছু নতুনের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে। সৃজনশীল সত্তাকে গুরুত্ব দিয়ে নিজের জীবন সাজিয়ে নেওয়ার ফিলোসফির উদ্ভবও সেখানে। ক্রিয়েটিভ ভিডিও, ডিআইওয়াই হ্যাক, সেলাইয়ের অভিনব সব প্রক্রিয়া পাচ্ছে সমাদর। ইনস্টাগ্রাম, পিন্টারেস্ট, টিকটক সৃজনীশক্তিকে আরও তীক্ষè করে তুলেছে।
সৃজনের স্বাধীনতা
দ্য রুলস অব ফ্যাশন রুল করতে পারেনি অনেককে। রং, সেলাই, নকশা, প্যাটার্ন, লাইনে সূত্রমতো চলতে চান না যারা, তারা নিজের মতো করে সাজেন। তাদের স্টাইলিংয়ের মাধ্যমে প্রকাশিত হয় নিজস্বতার প্রকাশ। প্যাটার্নের নিয়মকে ধুর ছাই বলে বোল্ড টেক্সচার আর আনকনভেনশনাল সিলুয়েটে নিজেকে গুছিয়ে নিতে পছন্দ করেন।
জেনারেশনাল কানেকশন
গতানুগতিক রেডিমেইড ড্রেসের চাহিদা কমে এসেছিল মিলেনিয়ালদের হাত ধরে। সে আগুন নতুন করে উসকে দিয়েছে জেন-জি। মেইনস্ট্রিম লাক্সারি লেবেলের উচ্চ মূল্য, একই ধরনের নকশার পুনরাবৃত্তিতে তাদের মন বসেনি। মেলেনি তাদের চিন্তা, ভাবনা আর দর্শন। তাই নিজেদের সঙ্গে মিল খুঁজে পেতে নিজেরাই তৈরি করেছে ফ্যাশন। সত্তরের পাঙ্ক, ২০০০ সালের ওয়াই টু কে-এর ধারাবাহিকতায় হালের কেওটিক কাস্টমাইজেশন। ফ্যাশনে তারুণ্যের জয়গানের প্রকাশ।
স্টাইল নিজস্ব কিন্তু ফ্যাশন সবার—এ কথা ধারণ করে এগিয়েছে ফ্যাশন বিশ্ব। কিন্তু জেনারেশন জেড তা মানতে নারাজ। ডিজাইনার, ফ্যাশনিস্তা, স্টাইলিস্ট থেকে তাই কেওটিক ফ্যাশন সম্পূর্ণ নিজস্ব। বাজারে এর প্রভাব পড়বে, তা বেশ বোঝাই যাচ্ছে। ডিজাইনার ওয়্যারের ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং অনেক আগে থেকে চর্চিত। সেখানে যিনি পোশাকটি পরবেন, তাকে গুরুত্ব দিয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কেওটিক কাস্টমাইজেশনকে গ্রহণ করতে ডেইলি ওয়্যার ব্র্যান্ডদের ক্রেতা প্রাধান্য দিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে বলে ধারণা করছে ফ্যাশন বিশ্ব। রেডিমেইড থেকে ডিজাইনার ওয়্যার—সব ক্ষেত্রে সেখানে জায়গা করে নিতে পারে ফ্যাশন লেবেলগুলোর স্বাধীনচেতা মনোভাব।

 সারাহ্ দীনা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top