কভারস্টোরি I ফ্যাশনটেইনমেন্ট
ফ্যাশন ও বিনোদন। বিশ্বব্যাপী বিশাল দুই শিল্প। ঐতিহাসিকভাবে সমান্তরালে অস্তিত্ব বজায় রেখে চলা। প্রায়শই একে অপরকে প্রভাবিত করে থাকে। বর্তমানে এই দুই জগতের একীভূত হওয়া কেবল একটি ঘটনাই নয়, বরং এই গাঁটছড়ার মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে এক নতুনধারা। সম্যক ধারণা শেখ সাইফুর রহমানের লেখায়
পোশাকি অভিব্যক্তির সঙ্গে শোবিজ সংস্কৃতির মেলবন্ধনের মধ্য দিয়ে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই দুটি শিল্পের মিলিত অবস্থাকে দর্শক কীভাবে গ্রহণ করেছেন, সেটাও খুব স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান। তা সে রেড কার্পেটের মুহূর্তই হোক বা রিয়েলিটি শো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবকই হোক বা সিনেমার কস্টিউম—প্রতিটি বিষয়ই ফ্যাশনটেইনমেন্ট যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমসাময়িক মনোভাবের প্রতিফলন ঘটিয়ে সমসময়ের ভিজ্যুয়াল সংস্কৃতি ও গল্পকথনের মধ্য দিয়ে হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলেছে।
বর্তমানে ফ্যাশনকে বিনোদন থেকে আলাদা করার উপায় নেই; বরং দুটোই গলাগলি করে এগিয়ে যাচ্ছে। উদ্ভাবনের নতুন নতুন পথ ধরে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফ্যাশন ম্যাগাজিনগুলোতে তারকারাই সবার আগে খবর হচ্ছেন তাদের ফ্যাশন ও লাইফস্টাইলের কারণে। এখনকার সামাজিক মাধ্যম ও অনলাইনে লাইকবেট আর ফলোয়ারদের আকর্ষণ করতে সব গণমাধ্যমের এটাই এখন প্রধান হাতিয়ার।
বিবর্তনের ধারায়
ফ্যাশন ও বিনোদনের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী ও ঘনিষ্ঠ। বিশ শতকের গোড়ার দিকে, ফ্যাশনের যেকোনো ট্রেন্ডকে জনপ্রিয় করতে হলিউডের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য; এ ক্ষেত্রে অড্রে হেপবার্ন ও মেরিলিন মনরোর মতো ডাকসাইটে তারকারা বিশ্বব্যাপী স্টাইলের মানদণ্ড প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সঙ্গে ডিজাইনারদের গাঁটছড়ায় পোশাক বস্তুত সিনেমার সীমা ছাড়িয়ে সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠতে পেরেছে। এ কারণে সিনেমার কস্টিউমও জনপ্রিয় ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। এটা কেবল হলিউড নয়; বলিউডে যেমন প্রযোজ্য, তেমনি টালিউড বা আমাদের ঢালিউডের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য।
হিন্দি সিনেমার নায়ক-নায়িকদের পোশাক, সাজ, হেয়ারস্টাইল বহু আগে থেকে অনুসৃত হয়ে আসছে উপমহাদেশের ফ্যানদের মধ্যে। অন্যদিকে উত্তমকুমারের হেয়ারকাট; যা একসময় উত্তমছাঁট নামে পরিচিত ছিল—সত্তর ও আশির দশকে তরুণদের কাছে ছিল দারুণ জনপ্রিয়। এমনকি তার পোশাক-আশাকও। সুচিত্রা সেনের হেয়ারস্টাইল, মেকআপ, কাজল দেওয়ার স্টাইল, শাড়ি পরার ঢং বা তার রোদচশমাও হয়েছে অনুসৃত। যদিও তখন ফ্যাশনটেইনমেন্ট কনসেপ্টের জন্ম হয়নি।
এ ক্ষেত্রে অবশ্য একটা বিষয়ের উল্লেখ না করলেই নয়, বিশ শতকের শেষ নাগাদ, টেলিভিশন দর্শকদের পরিচিত করায় ফ্যাশনকেন্দ্রিক বিনোদনের সঙ্গে। ‘সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটি’র মতো অনুষ্ঠান কেবল বিনোদন দেয়নি; বরং নারীদের পোশাকের প্রতি দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গিকে যেমন প্রভাবিত করেছে, তেমনি বদলে দিয়েছে মনোভাব। একুশ শতকে, সামাজিক মাধ্যম ও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের আবির্ভাবের সঙ্গে এই সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে, যা ফ্যাশনটেইনমেন্টকে সর্বজনীন ও ইন্টার্যাকটিভ মাধ্যমে রূপান্তর করেছে।
এখানে একটা বিষয় উল্লেখ প্রয়োজন, ভারতীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে সে দেশের তারকাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এ ক্ষেত্রে অবশ্য ডিজাইনাররাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় বিষয়টা সহজ হয়েছে; বিশেষ করে নব্বইয়ের দশকে ফ্যাশন শোগুলোতে শো স্টপার হিসেবে সিনে তারকাদের উপস্থিতি বিপ্লব ঘটিয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে আবু জানিসন্দীপ খোসলা জুটিকে। তারা কেবল শাবানা আজমির কথা মাথায় রেখে কালেকশন করেছেন। এ ছাড়া তাদের প্রতিটি কালেকশনে তাকেও ব্যক্তিত্ব হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তরুণ তাহলিয়ানি, রোহিত বাল, রোহিত শর্মারাও একই পথে হেঁটেছেন। পরের প্রজন্মও সেই ধারা বেগবান করেছে। মনীশ মালহোত্রা তো বলতে গেলে নিজের নামকে বলিউডের সঙ্গে সমার্থক করে তুলেছেন ছায়াছবির কস্টিউম বানানোর পাশাপাশি তারকাদের পোশাক ডিজাইন করার জন্য। নিজেদের ফ্যাশন শো-ই হোক বা অন্য কোনো আসর, কিংবা তারকাদের বিয়ে—সব্যসাচী মুখার্জি বা অন্যরাও কিন্তু নিজেদের অবস্থানকে সৃদৃঢ় করেছেন।
এই ধারা আমাদের দেশেও যে অনুসৃত হয়নি, তা নয়। কিন্তু বিক্ষিপ্তভাবে হওয়ায় সেটা তেমন চোখে পড়ে না বা দানা বাঁধে না। এ ক্ষেত্রে সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে খাদি উৎসবের কথা বলা যায়। রুনা খান, মেহেরিন কিংবা অমিতাভ রেজাও কিন্তু রানওয়ে মাতিয়েছেন। কিন্তু দেশে এ ধরনের ইভেন্ট এত কম যে একটা আসতে আসতে আরেকটাকে মানুষ ভুলেই যায়।
এ ক্ষেত্রে অবশ্য সবার আগে বলতে হবে এমদাদ হকের নাম। এরপর অবশ্যই বিপ্লব সাহার কথা বলতে হবে। তারাই তারকাদের সবচেয়ে বেশি এনডোর্স করেছেন।
রেড কার্পেটের জমক
কোনো সন্দেহ নেই, বর্তমান সময়ে রেড কার্পেট আসলে ফ্যাশনটেইনমেন্টের মূর্ত প্রতীক। অস্কার, মেট গালা আর কান চলচ্চিত্র উৎসবের মতো আসরগুলো ডিজাইনার ও সেলিব্রিটিদের জন্য একেকটি হাই প্রোফাইল মঞ্চ। এসব ইভেন্ট কেবল কতুর প্রদর্শনই নয়, বরং সাংস্কৃতিক মাপকাঠিতে পরিণত হয়েছে; যেহেতু এখানে আসা তারকাদের পোশাক ও স্টাইলে সামাজিক মূল্যবোধ আর নান্দনিক রুচির প্রতিফলন ঘটে থাকে। সুতীক্ষè নজরে থাকে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের। ফলে পান থেকে চুন খসলে রইরই পড়ে যায়।
ডিজাইনার: শীর্ষ সারির তারকাদের পোশাক পরানোর জন্য মুখিয়ে থাকে ফ্যাশন হাউসগুলো। চলে প্রতিযোগিতা। কারণ, কোনো একটি ব্র্যান্ডের পোশাক পরে লালগালিচায় হাঁটা মানেই বিপুল দর্শকের কাছে সেটা পৌঁছে যাওয়া এবং সেটাই পরোক্ষে বাণিজ্যিক সাফল্যে রূপান্তরিত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ২০১৯ সালের মেট গালায় ব্র্যান্ডন ম্যাক্সওয়েলের ডিজাইন করা গাউনে লেডি গাগার উপস্থিতি নাটকীয় ফ্যাশনের উদাহরণ হয়ে ওঠে এবং তাকে স্টাইল আইকনে পরিণত করে। অন্যদিকে ব্র্যান্ডন হয়ে ওঠেন আলোচনার মধ্যমণি।
এখানে স্মরণ করা যেতে পারে ডিজাইনার লেবেল ভ্যালেন্তিনোর কথা। অস্কার হোক বা কান; সেলিব্রিটিদের অনেককে তার লাল গাউনে হাজির হতে দেখা গেছে। এখনো হন। একটা সময় ভ্যালেন্তিনোর লাল গাউন তাই ওই সব আসরের সঙ্গে সমার্থক হয়ে ওঠে। তাই বলে অন্য ডিজাইনাররা যে ছিলেন না, তা নয়।
একইভাবে আমরা নিজেদের উদাহরণও দিতে পারি। আজমেরী হক বাঁধনের কথাই ধরা যাক। আড়ংয়ের তৈরি জামদানি আর স্টেটমেন্ট ব্লাউজে কেবল নজরই কাড়েননি, বরং তিনি ফ্যাশন আইকনে পরিণত হয়েছেন। তেমনি আড়ংও ব্র্যান্ড হিসেবে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছে এর গতানুগতিক পরিচয়ের বাইরে। বলা যেতে পারে, ফ্যাশনটেইনমেন্টের এটাই সাফল্য।
একইভাবে ভারতীয় ডিজাইনাররা সেই প্রচার পেয়ে থাকেন। একটা জল্পনা তো থাকেই, কোন তারকা কার ডিজাইন করা পোশাক পরবেন, তা নিয়ে।
দর্শক: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে রেড কার্পেটের প্রতিটি মুহূর্ত দর্শকের নখদর্পণে থাকে। ছড়িয়ে যায় বিশ্বব্যাপী। ফলে কোটি কোটি মানুষ রিয়েল-টাইমে এসব মুহূর্তের সাক্ষী থাকেন বা থাকতে পারেন। তারা নানা ধরনের আলোচনায় অংশ নিতে পারেন; নেনও। মিম দেখেন এবং সেসব শেয়ার করেন। নানা কিছু নিয়ে সমালোচনাও করেন। #MetGala কিংবা #OscarsRedCarpet-এর মতো হ্যাশট্যাগগুলো ভাইরাল মুহূর্ত তৈরি করে দর্শকদের আগ্রহী করে রাখে বা বলা যেতে পারে আটকে রাখে।
ধারণার রূপায়ণে টিভির ভূমিকা
সিটকম থেকে রিয়েলিটি শো অবধি ফ্যাশন ও বিনোদনকে একীভূত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে টেলিভিশন। ‘গসিপ গার্ল’ এবং ‘ম্যাড ম্যান’-এর মতো আইকনিক সিরিজগুলো স্টাইল নিয়ে জনসাধারণের ধারণা তৈরি করেছে। একইভাবে অনুপ্রেরণামূলক ও যোগসূত্র তৈরির মতো ফ্যাশনের নানা মুহূর্ত দর্শকেরা উপভোগ করতে পেরেছেন।
ভারতের বিভিন্ন টিভি সিরিজ আর সিনেমাও এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। আনারকলি আর পাখি ড্রেসের কথা এখনো নিশ্চয়ই মনে আছে অনেকের।
রিয়েলিটি শো: ‘প্রজেক্ট রানওয়ে’ ও ‘আমেরিকাস নেক্সট টপ মডেল’-এর মতো প্রোগ্রামগুলো ফ্যাশন জগতের জটিলতাকে মূলধারার দর্শকদের কাছে তুলে ধরেছে। প্রতিযোগিতা ও শিক্ষার মিশেল ঘটিয়ে বিনোদনের পাশাপাশি এই ধরনের শিল্পের রহস্যময়তাকেও দূর করেছে। উপমহাদেশীয় বাস্তবতায় রোডিজের মতো এমটিভির নানা শো, ভারতের বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ড প্রোগ্রাম কিংবা পাকিস্তানের কোক স্টুডিও, বাংলাদেশের ক্লোজআপ ওয়ান, মেরিল-প্রথম আলো, লাক্স সুন্দরী প্রতিযোগিতাও এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম: নেটফ্লিক্স এবং অন্যান্য স্ট্রিমিং পরিষেবার আবির্ভাবের সঙ্গে, ‘এমিলি ইন প্যারিস’ কিংবা ‘দ্য কুইন’স গ্যাম্বিট’-এর মতো শোগুলো বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে এবং তাদের পোশাক-আশাক গল্পকথনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। দর্শকেরা প্রায়ই এসব স্টাইল অনুসরণ করেন, যা দ্রুত ফ্যাশন ও ই-কমার্সের অনুঘটক হয়ে ওঠে।
দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কপিল শো বা দেশীয় ওটিটির বিভিন্ন সিরিজও এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
সামাজিক মিডিয়ায় বিপ্লব
বলতে দ্বিধা নেই, ফ্যাশনটেইনমেন্টকে গণতান্ত্রিক বা বলা যেতে পারে সর্বজনীন করেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম; যেখানে প্রভাব, ব্র্যান্ড ও ভোক্তারা একটি গতিশীল ইকোসিস্টেমে সহাবস্থান করছে। ইনস্টাগ্রাম, টিকটক আর ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো নির্মাতা ও দর্শকদের মধ্যে সরাসরি সংযোগ তৈরি করে দিচ্ছে; এর মধ্য দিয়ে বদলে যাচ্ছে ট্রেন্ডে উদ্ভব ও বিকাশের পদ্ধতি।
প্রভাবকেরাই রুচি তৈরির রূপকার: কিয়ারা ফেরাগনি, ব্রেটম্যান রকের মতো সামাজিক মিডিয়া প্রভাবশালীরা বিনোদন ও ফ্যাশনের মধ্যকার সীমানা মুছে দিয়েছেন। আকর্ষণীয় কনটেন্টের মাধ্যমে তারা স্টাইল প্রদর্শন করেন এবং লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে অবিশ্বাস্যভাবে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি করেন। এ ক্ষেত্রে ভারতের ইনফ্লুয়েন্সাররাও এগিয়ে আছেন। কিন্তু বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে যোজন পিছিয়ে। তথাকথিত দেশীয় ইনফ্লুয়েন্সাররা বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত নন। গোটা কয়েক শব্দ আর জারগন মুখস্থ করে সেটাই উগরে দেন। ফলে বিষয়ের গভীরে না ঢুকে তারা ওপর থেকে সবকিছু বলে যান। যদিও তারা উতরে যান তাদের অনুসরণকারীদের সংখ্যায়। কিন্তু সত্যিকারে ট্রেন্ড সেট করার মতো ক্ষমতা ও যোগ্যতায় তারা এখনো অনেকটাই অনগ্রসর।
লাইভ ফ্যাশন শো: বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম এখন ফ্যাশন শোর লাইভ স্ট্রিম করে বিশ্বব্যাপী দর্শকদের নাগালে পৌঁছে দিচ্ছে। অথচ এসব একসময় একটা ঘেরাটোপে আবদ্ধ ছিল। সেখানে অধিকার ছিল গুটি কয়েক মানুষের। গুচি ও বালমেঁর মতো ব্র্যান্ডগুলো এই মাধ্যম ব্যবহার করে রানওয়ে ইভেন্টগুলোতে দর্শককে সম্পৃক্ত করে তাদেরকে দিয়েছে অনন্য অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ।
ভাইরাল চ্যালেঞ্জ: হালের ফ্যাশন ট্রেন্ডগুলো প্রায়শই ভাইরাল চ্যালেঞ্জ বা মিম থেকে উদ্ভূত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইনস্টাগ্রামের #PillowChallenge; ব্যবহারকারীরা বালিশকে বেল্ট দিয়ে আটকে আউটফিট তৈরি করেছিলেন। পুরো ব্যাপারটা ছিল সৃজনশীলতা আর মজার সংমিশ্রণ, যা ফ্যাশনটেইনমেন্টের মূলভাবকেই উপস্থাপন করে।
সিনেমা ও ফ্যাশন: নাটকীয় সম্পর্ক
সিনেমার পোশাক কেবল পোশাক নয়; এগুলো গল্প বলে, চরিত্র প্রতিষ্ঠা করে এবং এমন ভিজ্যুয়াল পরিচয় তৈরি করে, যা দর্শকদের মনকে স্পর্শ করে। ‘ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানিস’ এবং ‘দ্য ডেভিল ওয়্যারস প্রাডা’র মতো আইকনিক সিনেমাগুলো ফ্যাশন ইতিহাসে অমলিন ছাপ রেখে গেছে।
সিনেমার কস্টিউম ডিজাইনার: এডিথ হেড ও প্যাট্রিসিয়া ফিল্ডের মতো পেশাদারেরা পোশাক ডিজাইনকে শিল্পের স্তরে উন্নীত করেছেন। তাদের কাজ রানওয়ে কালেকশন এবং সাধারণ বাজারের ফ্যাশন—উভয়কেই প্রভাবিত করে। হলিউড ছাড়িয়ে বলিউডেও এই ট্রেন্ড স্থায়ী হয়েছে। বাংলাদেশেও পেশাদার কস্টিউম ডিজাইনাররা যেমন কাজ করছেন, তেমনি ডাকসাইটে ডিজাইনাররা কস্টিউম ডিজাইন করে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন।
সাংস্কৃতিক প্রভাব: চলচ্চিত্র প্রায়শই ট্রেন্ড সেট করে দেয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৭৭ সালের ‘অ্যানি হল’ চলচ্চিত্র নারীদের জন্য মেন্সওয়্যার-প্রভাবিত স্টাইল জনপ্রিয় করে তোলে। আবার ২০১৮ সালের ‘ব্ল্যাক প্যানথার’ আফ্রিকান ফ্যাশনকে উদ্যাপন করে এবং সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিত্ব নিয়ে বৈশ্বিক আলোচনাকে উসকে দেয়।
সংগীত ও ফ্যাশন: সামঞ্জস্যপূর্ণ সৃজনশীলতা
ফ্যাশনের জন্য বরাবরই একটি শক্তিশালী মাধ্যম সংগীত। এলভিস প্রিসলির রকবিলি স্টাইল থেকে লেডি গাগার অ্যাভাঁ-গার্দ পোশাক-সংগীতশিল্পীরা তাদের শিল্পীসত্তার উপস্থাপনায় এবং নিজেদের প্রচারে ফ্যাশনকে কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এই দুইয়ের বাইরেও তো কথা আছে। ম্যাডোনা, বিয়ন্সে, রিয়ানা, থেকে হালের ইরাস ট্যুর শেষ করা টেইলর সুইফট বা ডুয়া লিপা—সবাই আছেন এই তালিকায়। দেশীয় ব্যান্ডগুলোকেও তো অনুসরণ করেন ফ্যানরা।
মিউজিক ভিডিও: বিয়ন্সে কিংবা বিটিএসের মতো শিল্পীরা তাদের ভিডিওতে উচ্চ ধারণার ফ্যাশন ব্যবহার করে গল্প বলার এবং ব্র্যান্ড পরিচয় বাড়িয়ে তোলেন। এই ভিজ্যুয়ালগুলো প্রায়ই ট্রেন্ড সৃষ্টির পাশাপাশি শিল্পীদের প্রভাব—দুটিকেই শক্তিশালী করে।
কনসার্ট ও ট্যুর: টেইলর সুইফট ও হ্যারি স্টাইলসের মতো পারফরমাররা তাদের ট্যুরকে ফ্যাশন ইভেন্টে পরিণত করেন। ডিজাইনারদের সঙ্গে সমন্বয় করে এমন লুক তৈরি করেন, যা তাদের সৃজননৈপুণ্যের অংশ হয়ে ওঠে। দেশেও কিন্তু এই ধারা আগে থেকে জনপ্রিয়। ব্যান্ড মিউজিকের বরাতে। ফলে ব্যান্ডের তারকারা নানাভাবে অনুসৃত হয়েছেন।
প্রযুক্তির ভূমিকা
প্রযুক্তি ফ্যাশনটেইনমেন্টকে নতুন মাত্রায় উন্নীত করেছে, অগমেন্টেড রিয়েলিটি এবং ভার্চ্যুয়াল ফ্যাশনের মতো উদ্ভাবনগুলোর মাধ্যমে।
ভার্চ্যুয়াল রানওয়ে: করোনা মহামারির সময় ব্যালান্সিয়াগার মতো ব্র্যান্ডগুলো ডিজিটাল ফ্যাশন শো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে, গেমিংয়ের নান্দনিকতাকে ওত কতুরে সন্নিবেশ ঘটিয়ে। এই ধারা আমরা উপমহাদেশের ফ্যাশনেও দেখা গেছে। ল্যাকমে ফ্যাশন উইক হয়েছে ভার্চ্যুয়ালি।
এআর ও ভিআর অভিজ্ঞতা: স্ন্যাপচ্যাট আর ইনস্টাগ্রামের মতো অ্যাপের এআর ফিল্টার ব্যবহারকারীদের ভার্চ্যুয়াল অ্যাকসেসরি এবং মেকআপ ‘ট্রাই অন’ করতে দেয়। ফ্যাশন, প্রযুক্তি আর বিনোদনের এই সংমিশ্রণ তরুণ, প্রযুক্তিবান্ধব দর্শকদের আকৃষ্ট করে।
এনএফটি ফ্যাশন: নন-ফাঞ্জিবল টোকেন-এর উত্থান ডিজিটাল-অনলি ফ্যাশন আইটেমগুলোর প্রাপ্তিকে সম্ভব করেছে। ডলশে অ্যান্ড গ্যাবানার মতো ব্র্যান্ড এই জগতে প্রবেশ করেছে। এর মধ্য দিয়ে প্রতীয়মান হচ্ছে ফ্যাশনটেইনমেন্টের শারীরিক সীমানা অতিক্রম করা পদ্ধতি।
নৈতিকতা নির্ণয়
ফ্যাশন ও বিনোদনের সীমানা অস্পষ্ট হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নৈতিকতার প্রশ্নও অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। ফ্যাশনটেইনমেন্টের প্রকৃতিই হলো দ্রুত ও গতিশীল; যা কিনা প্রায়শই ভোগবাদ আর অপচয়কে উসকে দেয়। এ ছাড়া অপ্রাপ্য সৌন্দর্যের ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সমস্যা তৈরি করতে পারে। কারণ, তাতে করে শারীরিক গঠনসংক্রান্ত বিষয়গুলো উঠে এসে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
টেকসই: ফ্যাশনশিল্পের পরিবেশগত প্রভাবকে উপেক্ষার উপায় নেই। তাই পরিস্থিতি বিবেচনায় পরিবেশবান্ধব অনুশীলনের দিকে স্থানান্তর একান্ত আবশ্যক। সেলিব্রিটিরা তো বটেই, ব্র্যান্ডগুলোরও ফ্যাশনটেইনমেন্টের আকর্ষণকে উপেক্ষা করা কঠিন। এ জন্য দায়িত্বের ভারসাম্য বজায় রাখা উভয় পক্ষের জন্য আবশ্যক। আর এটাই সময়ের দাবি।
বৈচিত্র্য ও প্রতিনিধিত্ব: ফ্যাশনটেইনমেন্ট এতটাই শক্তিধর যে সামাজিক বদলে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যে কয়টি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক, সেগুলো হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক, বিভিন্ন শারীরিক গঠনকে অগ্রাধিকার প্রদান, সংস্কৃতি ও পরিচয়ের উদ্যাপন। এর মধ্য দিয়েই বৈশ্বিক সমৃদ্ধির অনন্য ছবিই প্রতিফলিত হবে।
ব্যবসা বিস্তারে
এর অর্থনৈতিক প্রভাব উল্লেখযোগ্য। এই দুটি শিল্পের সংমিশ্রণ নতুন আয়ের উৎস তৈরি করেছে। পণ্য বিক্রয় ও ব্র্যান্ডেড সহযোগিতা এ ক্ষেত্রে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
সেলিব্রিটি এনডোর্সমেন্ট: সেলিব্রিটি ও ব্র্যান্ডের মধ্যে গাঁটছড়া প্রচার এবং বিক্রয়ে বিশাল প্রভাব ফেলে। রিহানার ফেন্টি আর কানিয়ে ওয়েস্টের ইয়েজি লাইন এই ট্রেন্ডের বিশেষ উদাহরণ।
ই-কমার্স ইন্টিগ্রেশন: ইনস্টাগ্রাম শপিং এবং আমাজনের ‘মেকিং দ্য কাট’ স্টোরফ্রন্টের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো ফ্যাশনটেইনমেন্টের সঙ্গে ভোক্তাদের নির্বিঘ্নে সংযুক্ত করে তাদের কেনাকাটাকে নির্বিঘ্ন করেছে।
কনটেন্ট ক্রিয়েশন: ব্র্যান্ডগুলো এখন তাদের নিজস্ব বিনোদন তৈরি করে, বিজ্ঞাপন আর গল্প বলার মধ্যকার সীমানাকে নস্যাৎ করে দিয়ে। এ ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সঙ্গে লুই ভিতোঁর কোলাবোরেশন এই হাইব্রিড পদ্ধতিকেই হাইলাইট করে।
ভবিষ্যৎ ট্রেন্ড
ফ্যাশনটেইনমেন্টের বিবর্তন অব্যাহত থাকায় কয়েকটি ট্রেন্ডের ভবিষ্যৎকে নতুন রূপ দিচ্ছে।
মেটাভার্স ইন্টিগ্রেশন: ভার্চ্যুয়াল জগতের উত্থান ফ্যাশনটেইনমেন্টের জন্য অফুরন্ত সম্ভাবনা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। ব্র্যান্ডগুলো ইন্টার্যাকটিভ অভিজ্ঞতা তৈরি করতে পারে, যা ব্যবহারকারীকে ভার্চ্যুয়াল স্পেসে ডিজিটাল পোশাক পরার সুবিধা দেয়।
ব্যক্তিকরণ: এআই ও ডেটা অ্যানালিটিকস হাইপার-পার্সোনালাইজড ফ্যাশনের পরামর্শ দিতে সক্ষম; এর মধ্য দিয়ে ভোক্তারা উন্নততর অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন।
ক্রস-ইন্ডাস্ট্রি সহযোগিতা: ফ্যাশনটেইনমেন্ট ক্রমবর্ধমানভাবে গেমিং, স্পোর্টস ও অন্যান্য বিনোদন খাতের সঙ্গে সংযুক্ত হতে থাকবে, যা বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক ধারণা তৈরি করবে।
উপসংহার
ফ্যাশনটেইনমেন্ট কেবল দুটি শিল্পের গাঁটছড়া নয়; এটি সমসাময়িক সংস্কৃতির ভিজ্যুয়াল ও গল্প বলার যে আকাক্সক্ষা, তারই প্রতিফলন। প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং সামাজিক মূল্যবোধ পরিবর্তনের ধারা অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্টরা কীভাবে সেটা অবলোকন করছে, তারই আলোকে ফ্যাশন আর বিনোদনও পুনঃসংজ্ঞায়িত হতে থাকবে। উদ্ভাবনকে গ্রহণ করে এবং নৈতিকতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে, ফ্যাশনটেইনমেন্টের বিনোদন দেওয়া ছাড়াও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার সম্ভাবনা আছে।
এই নতুন জগতের বাইরে নয় কেউই। ফলে বৈশ্বিক পটবদলের সঙ্গে অভিযোজিত হয়েই এগিয়ে যাওয়া জরুরি। যেতে হবে। সেই লয় কখনো দ্রুত হবে, কখনো-বা মন্থর। তবে দেশে অন্যান্য শিল্প খাতের মতোই ফ্যাশন ও বিনোদনের এই দুটি খাত—এখনো ততটা গতিশীল নয়; বরং ভয়েরই। অবস্থা নড়বড়ে। তাই এখানে যোগ্য প্রভাবকও তৈরি হচ্ছে না। যা অবশ্যই নেতিবাচক দিক। সঠিক শিক্ষাই বদলে দিতে পারে এই দুটি শিল্প খাতের বর্তমানকে।
একই সঙ্গে ব্যবসার কথাও ভাবতে হবে। কারণ, দেশে এই আন্তশিল্প খাত সম্পর্কের মূল্যমান অর্থের নিরিখে কম নয়। কিন্তু সেটা কি ভাবা হচ্ছে। ভাবা হচ্ছে কি এর সময়োপযোগিতা এবং আইনি বিষয়-আশয়? অথচ এসবও তো কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কীভাবে ফ্যাশনটেইনমেন্টকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করা যাবে, তা নিয়ে ভাবতে হবে সংশ্লিষ্টদের। তবে হ্যাঁ, এই অবস্থান থেকে বের হয়ে এসে কীভাবে নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে বৈশ্বিক ধারার সঙ্গে তাল মেলাতে সক্ষম হবে, সেটা পুরোপুরি এখনো জানা নেই। অবশ্য আশাবাদী হতে তো দোষ নেই।
লেখক: কনসালট্যান্ট, হাল ফ্যাশন, প্রথম আলো এবং হেরিটেজ টেক্সটাইল বিশেষজ্ঞ
মডেল: সাদাত, অরূপ, নয়ন ও মালিহা
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: ফিট এলিগেন্স
ছবি: সাগর হিমু