ফিচার I রুশ একাদশ
বিশ্বকাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে সোভিয়েতহীন রাশিয়া আন্তর্জাতিকতার উৎসবে সেজে উঠেছে। রাশিয়ার ১১টি স্বাগতিক শহরে আবিশ্বের ফুটবলপ্রেমী কেবল খেলা নয়, প্রস্তুত উদ্যাপনের উপচারে। নাচ-গানের সঙ্গে থাকবে চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয়র এলাহি আয়োজন।
রুশ উপকথা কিংবা রুশদের দুনিয়া কাঁপানো ১০ দিনের গল্প শোনার জন্য একসময় যতটা আগ্রহ ছিল বাঙালির, বিশ্বকাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে সোভিয়েতহীন রাশিয়া কী রকম আন্তর্জাতিকতার উৎসবে সেজে উঠেছে, তা জেনে নিতে চাইছেন অনেকেই। বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে রুশ দেশের স্বাদবাহার নিয়েও চর্চা শুরু হয়েছে নানা মহলে।
লেনিন-স্তালিন থেকে পুতিন, সে দেশের জাতীয় নায়ক থেকে শুরু করে সমসাময়িক রাষ্ট্রপ্রধানকে নিয়ে গোটা বিশ্বেই রাজনৈতিক আগ্রহ রয়েছে। তা নিয়ে চর্চা ও আলোচনার ইতিহাস প্রায় এক শ বছরের। কিন্তু খোদ রাশিয়ায় এসব বিষয় ছাপিয়ে গেছে মেসি-রোনালদোদের নিয়ে গণ-উন্মাদনা। কারণ, এখন রুশ দেশে ফুটবলের বসন্ত। মস্কো, সেন্ট পিটার্সবার্গ, ভলগোগ্রাদ, কালিনিনগ্রাদ, কাজান, সোচি, নিজনি নোভগোরোদ, একাতেরিনবার্গ, রোস্তোভ-অন-ডন, সামার ও সারান্সক- এই শহরগুলো বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে নানা খাদ্যসম্ভার নিয়ে প্রস্তুত।
পূর্ব রাশিয়ার মস্কোভা নদীতীরে অবস্থিত মস্কো শহরের ইতিহাস হাজার বছরের কিছু পুরোনো। এই শহরে ইতিহাস কথা বলে ওঠে। ইতিহাসের বহু উত্থান-পতন আর রণরক্তের সাফল্য-ব্যর্থতার সাক্ষী এই মস্কো। ক্রেমলিন, রেড স্কয়ারসহ বহু ঐতিহাসিক ক্ষেত্রকে ধারণ করে আছে এই শহর। বাইজেনটাইন ও স্লাভ সংস্কৃতির মিশ্রণ, মোঙ্গল আক্রমণ, গ্র্যান্ড ডিউকের আধিপত্য, জার সা¤্রাজ্য, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা, প্রায় বিনা প্রতিরোধে ভেঙে যাওয়া সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তার পরবর্তী সময়ে উদার অর্থনীতির সঙ্গে গা ভাসিয়ে দেওয়ার ইতিহাস ও নৈমিত্তিকতার ঘটনাপ্রবাহকে ধারণ করে আছে মস্কো।
রাশিয়ার বন্দর মোমান্সকে যে কড লিভার পাওয়া যায়, তার নানা রকমের পদ মিলবে মস্কোয়। বিশ্বকাপের দর্শকদের সঙ্গে এই পদগুলোর পরিচয় করিয়ে দিতে চায় মস্কোবাসী। তাই ফুটবল যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মস্কোয় যে ফুড ফেস্টিভ্যাল অনুষ্ঠিত হবে, তাতে পাউরুটিসহ কড লিভারের নানা পদের সঙ্গে বিশ্ববাসীর পরিচিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ফুটবলপ্রিয় ভোজনরসিকদের জন্য মস্কোর খাদ্যোৎসবকে তাই বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
ফুটবলের মেলা বসছে রাশিয়ার অন্তর্গত তাতারস্থান প্রজাতন্ত্রের রাজধানী কাজান। ভোলগা নদী, কাজানকা নদীর সংযোগস্থলে কাজান শহর অবস্থিত। তাতারদের এই শহর তাতারস্থানের মধ্যে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই রাশিয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ইতিহাসেও কাজানের গুরুত্ব অপরিসীম। ডিম, চিজসহ ঐতিহ্যবাহী পেস্ট্রি ককেশিয়ান খাচাপুরি কিংবা তাতারদেশের মিষ্টান্ন চাকচাকসহ নানা প্রকার তাতার ডিশের সম্ভার থাকছে গোটা কাজানসহ রাশিয়ার ১১টি শহরেই।
রাশিয়ার মর্দোভিয়ান শহর সারান্সক শহরও বেশ প্রাচীন। রাশিয়ার মর্ডোভিয়ান রিপাবলিকের এটি একটি অর্থনৈতিক কেন্দ্র। বাঁধাকপি, বিটসহ এই শহরের বিফ কাটলেট ‘বিয়ার পাও’ বেশ বিখ্যাত খাবার। বিশ্বকাপ উপলক্ষে রুশ দেশের নানা প্রান্তে যে খাদ্যমেলা বসছে, তার অন্যতম আকর্ষণ এই বিয়ার পাও।
কমিউনিস্ট নেতা ইয়েকোভ সভের্দলোভার শহর মধ্য রাশিয়ার একাতেরিনবার্গ। অত্যন্ত প্রাচীন ঐতিহাসিক এই শহর জোসেফ স্তালিনের জমানায় সোভিয়েত ইউনিয়নের ভারীশিল্পের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এই শহরের নানা ধরনের প্যানকেক খাদ্যরসিক মহলে জনপ্রিয়। পাশাপাশি সোলিয়াঙ্কা নামক বিশেষ এক স্যুপের কদর রয়েছে। বিফ, গাজর, আলু, টমেটো, পেঁয়াজ, ক্রিম ইত্যাদি সহযোগে এই স্যুপ বানানো হয়।
দক্ষিণ রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ একটি বন্দর শহর রোস্তোভ-অন-ডন। মাছ সেদ্ধ করে বানানো উখা নামের একটি স্যুপ এই অঞ্চলের বিশেষ একটি পদ। ভদকার সঙ্গে এই উখা টেস্ট করার জন্য রাশিয়ানদের আগ্রহ চোখে পড়ার মতো। আর তাই রুশ দেশের মানুষ বিশ্বকাপের ময়দানে বিশ্ববাসীকে এই স্যুপের স্বাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চায়।
ফিনল্যান্ড উপসাগরের মাথায় নেভা নদীর তীরে অবস্থিত রাশিয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শহর সেন্ট পিটার্সবার্গ। একদা এই শহরের নাম ছিল পেত্রোগ্রাদ। বিপ্লবের পর নাম হয়েছিল লেনিনগ্রাদ। এই সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরের রেস্তোঁরাগুলো বিশ্বকাপের কথা মাথায় রেখে স্থানীয় খাবারের সম্ভারসহ প্রস্তুত। ভলগা ও সামারা নদীর সংযোগস্থলে অবস্থিত সামারা শহুর বিশ্বকাপকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত ঝিঙ্গুইলেভস্কি নামের এক বিয়ার সহযোগে। এভাবেই প্রতিটি শহর নিজ নিজ খাদ্যের মেনু সাজিয়ে রেখেছে বিশ্বকাপের আন্তর্জাতিক পরিসরের সামনে। আর তার সঙ্গে রুশ সাহিত্য, সংগীত, নাটক, সিনেমা ইত্যাদি তো রয়েছেই।
অতনু সিংহ
ছবি: সংগ্রহ