বিশেষ ফিচার I বিশ্ব মাতে বিশ্বপ্লেটে!
৩২ দলের মহাযজ্ঞে সবাই শুধু কাপটাই দেখে, প্লেটের কথা ক’জনাই-বা ভাবে! এই যে রুশ দেশে বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে, তাতে অংশ নিচ্ছে ৩২টা দেশ, প্রতিটি দলে ২৩ জন করে ফুটবলার আর সঙ্গে কোচ, সাপোর্ট স্টাফ মিলিয়ে আরও জনাদশেকের লটবহর তো হবেই। গোটা দুনিয়া থেকে দর্শক-সমর্থকদের উত্তাল স্রোতও ধেয়ে আসছে রাশিয়ার দিকে। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপের যে মাসব্যাপী দক্ষযজ্ঞ, তাতে প্লেটের ভূমিকাটা কিন্তু কম নয়। বিশ্বকাপের ৩২ দেশের হেঁশেলের সুলুক সন্ধান নিয়েই এই আয়োজন। লিখেছেন সামীউর রহমান
ভূগোল পৃথিবীকে ৭ মহাদেশে ভাগ করলেও ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক ফিফা পৃথিবীকে ভাগ করেছে ৬টা কনফেডারেশনে। কারণ, অ্যান্টার্কটিকায় তো আর কেউ ফুটবল খেলছে না! পেঙ্গুইনরা খেলতে পারে, তবে তাদের নিশ্চয়ই ফিফার সদস্যপদের দরকার নেই। যে ৬টি অঞ্চল নিয়ে কাজকারবার, তাতেও ভূগোলের সঙ্গে ফিফার একটু গোলমাল আছে। অস্ট্রেলিয়া নিজেই ওশেনিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় দেশ হলেও ফুটবলে ‘সকারু’রা এশিয়ার অংশ। আবার গায়ানা ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ আমেরিকার অংশ হলেও বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে তারা দক্ষিণ আমেরিকার ‘কনমেবল’-এর অংশ নয়, বরং ক্যারিবিয়ান দেশ হিসেবে উত্তর, মধ্য আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চল নিয়ে গঠিত ‘কনকাকাফ’ বিভাগেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। তা সে বুড়ো খোকারা যেভাবে দাগ টেনে রেখেছেন, সেভাবেই চলুক খানা-তল্লাশি!
স্বাগতিক বলে শুরুতেই রাশিয়া। মানে এককালের সোভিয়েত ইউনিয়ন। কাস্তে হাতুড়ির দিন ফুরোলেও একক দেশ হিসেবে রাশিয়া এখনো বিশ্বের সবচেয়ে বড়। বিশ্বে জনসংখ্যার দিক থেকে নবম বৃহত্তম দেশের খাদ্যসংস্কৃতিতে তাই পূর্ব ইউরোপ, মধ্য এশিয়া, ককেশাস, পূর্ব এশিয়াসহ নানান জায়গার প্রভাব। গরম স্যুপ, ঠান্ডা স্যুপ, ধোঁয়ায় সেঁকা মাংস, লবণে সংরক্ষণ করা সবজি, ফলের পুর ভরা মিষ্টি পিঠাসহ অনেক খাবারই আছে রুশ রসনায়। তবে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি পরিচিত বোধ হয় রাশান সালাদ বা অলিভার সালাদ। চৌকো করে কাটা সেদ্ধ আলু, শসা, লেটুস পাতা, বাঁধাকপি, জলপাই, মেয়নেজ, মটরশুঁটি সেদ্ধ, গাজর, কাটা সেদ্ধ ডিম, মুরগি বা গরুর মাংস সেদ্ধ মিশিয়ে বানানো এই সালাদ রাশানদের ছুটির দিনের ভোজের অপরিহার্য পদ। পানীয় হিসেবে ভদকার নাম তো সর্বজনবিদিতই, তবে এই অ্যালকোহলিক পানীয়ের বাইরেও যব থেকে তৈরি করা কেভাস, বেরি জাতীয় ফলের রসের পানীয় মোরস, মধু থেকে তৈরি সি¦টেনও বেশ জনপ্রিয়।
বিশ্বকাপ এলেই বাংলাদেশের বেশির ভাগ দর্শক ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় বিভক্ত হয়ে পড়েন। দুই দেশের খাদ্যসংস্কৃতিতে কিন্তু বেশ মিল। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, কলম্বিয়ায় ‘চুরাস্কো’ খুবই জনপ্রিয় এক রন্ধন পদ্ধতি। গরু, মুরগি বা শূকরের মাংসকে বিশেষ এক ধরনের চুলা বা চুরাস্কোয়রায় ঝলসে খাওয়ার রীতির নামই চুরাস্কো। এই ঝলসানো মাংস খাওয়া হয় চিমিচুরি সস দিয়ে, যা তৈরি হয় রসুন কুচি, জলপাই তেল, পার্সলে কুচি, ওরিগ্যানো আর রেড ওয়াইন ভিনেগার দিয়ে। কোথাও তাতে মেশানো হয় প্যাপরিকা বা লাল মরিচের কুচি, লেবুর রস, কুচানো ধনেপাতাসহ আরও অনেক কিছু। ব্রাজিলিয়ান রসনায় ঔপনিবেশিক কারণেই পর্তুগিজ প্রভাব। পেলের দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য চাল, শিমের দানা আর মাংসের ঝোল মিলিয়ে রান্না করা খাবার ফেইয়োদা। পর্তুগিজ উপনিবেশ ছিল এমন অনেক জায়গাতেই এই খাবার প্রচলিত। আগুনে ভারী মাটির পাত্রে রান্না করা হয় এই খাবার। সবচেয়ে জনপ্রিয় ফাস্ট ফুড হচ্ছে প্যাস্টেল, যা আসলে একধরনের ডিপ ফ্রায়েড রোল। ভেতরে দেওয়া হয় মুরগি বা চিংড়ি। কোকোনাট রাইস অনেকটাই দক্ষিণ ভারতীয় রসনার কাছাকাছি। চাল ও মুরগি মিলিয়ে রান্না করা গালিনহাদা তো দেখতে অনেকটাই এদেশীয় চিকেন খিচুড়ির মতোই!
১৯৩০ বিশ্বকাপে উরুগুয়ে জোচ্চুরি করে হারিয়েছে আর্জেন্টিনাকে, এই দাবি বাংলাদেশের অনেক আর্জেন্টিনা-ভক্তেরও! আসলে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল- দুই বড় দেশের মাঝখানে পড়ে উরুগুয়ের একটু ত্রিশঙ্কু দশা। প্রথম বিশ্বকাপ, সীমান্ত জটিলতা, নদীর পানিবণ্টনসহ অনেকগুলো ব্যাপার নিয়েই বেশ চাপানউতোর আছে আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ের ভেতর। কোন দেশের গরুর মাংসের স্বাদ সেরা, এ নিয়েও আছে প্রতিযোগিতা! আর্জেন্টিনা বড় দেশ বলে ইউরোপের বাজারে তাদের ব্র্যান্ডিংটা বেশি, উরুগুয়ে বিপণনে পিছিয়ে থাকলেও স্বাদে এগিয়ে! দুই জায়গার গরুর মাংসের স্বাদের রহস্য লুকিয়ে আছে পাম্পাসের আদিগন্ত বিস্তৃত তৃণভূমিতে। সেখানেই চরে বেড়িয়ে বড় হয় গরু; মাংসের ভাঁজে ভাঁজে জমে চর্বি। সেই মাংসই সামান্য কিছু উপকরণ (জলপাই তেল, গোলমরিচ আর কিছু ভেষজ) মাখিয়ে সেঁকা হয় কাঠের আগুনে। বাঙালি কায়দায় তেল মসলা আর ঝোলের কোনো কারবার নেই, বরং সাহেবি কেতায় অনেকেই স্টেক একটু কাঁচাই বা ‘মিডিয়াম র’ই পছন্দ করেন। বিলেতে বাঙালি রেস্তোরাঁগুলো যেমন ‘ভারতীয়’ হয়ে গেছে, তেমনি প্রচারের সুবিধার্থে উরুগুয়ের গরুর মাংসের স্টেকের গায়েও লেগেছে আর্জেন্টিনার লেবাস। তবে উরুগুয়ের বাসিন্দারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবি ছাড়তে নারাজ! সেখানে মানুষের চেয়ে গরু বেশি, বাণিজ্যিক খামারের চেয়ে প্রাকৃতিক পন্থায় গরু পালনই হয় বেশি। ঘাস খেয়ে মুক্ত প্রান্তরে চরে বেড়িয়ে গরুগুলোও হয়ে ওঠে মোটাতাজা; তাই মাংসের স্বাদেও খোলতাই!
পেরুর রসনায় ইনকা সভ্যতার ছোঁয়া। সঙ্গে মিলেছে স্প্যানিশ, ইতালিয়ান, জার্মান আর পুব এশিয়ার প্রভাব। আন্দেজের ঢালে হওয়া নানান শস্যই ঠিক করে দিয়েছে পেরুর খাদ্যসংস্কৃতি। ভুট্টা, আলু, কিনোয়া (একধরনের ধান) আর টিউবার বা মূলজাতীয় এক রকমের শস্য- পেরুর রসনাজগতে এই চারের প্রধান উপস্থিতি। পেরুর জাতীয় খাবার হলো সাভিচে, যা বানানো হয় লেবুর রসে কাঁচা মাছ চুবিয়ে। সঙ্গে দেওয়া হয় মরিচ। কখনো কখনো টমেটো। স্প্যানিশদের সঙ্গে এই রেসিপি পেরুতে এসেছে বলে অনেকেরই ধারণা, তবে স্থানীয় ইতিহাসবিদেরা বলছেন, ২ হাজার বছর আগে থেকেই পেরুতে এ ধরনের খাবারের প্রচলন ছিল। এ ছাড়া শহরাঞ্চলে চিফা বা ‘চীনা-পেরুভিয়ান’ ফিউশন ঘরানার খাবারও চালু হয়েছে পেরুতে চীনা অভিবাসীদের হাত ধরে।
কলম্বিয়ান খাবারে স্থানীয় চিবাচা ঘরানার সঙ্গে ক্যারিবিয়ান, স্প্যানিশ, আফ্রিকান ও আরব কেতাও যোগ হয়েছে। আইয়াকো স্থানীয় জনপ্রিয় একটি খাবার, যা বানানো হয় মুরগি, আলু, ভুট্টার সঙ্গে স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত ভেষজ গুয়াস্কা (পুদিনা পাতার মতো পাতা) দিয়ে। এ ছাড়া ভুট্টাপাতায় জড়িয়ে পাতুরির মতো করে বানানো তামালে, সমুচা বা পিঠার মতো মাংসের পুর ভরা এমপানাদাও কলম্বিয়ানদের রোজকার খাবার। অ্যালকোহলিক পানীয়র বাইরে হট চকলেটই বেশি জনপ্রিয়।
ইউরোপে পূর্ব আর পশ্চিমে রসনার স্বাদ যায় পাল্টে। ভূমধ্যসাগরের পাড়ের দেশগুলোর খাদ্যসংস্কৃতি এক রকম আর বলকান অঞ্চলে স্বাভাবিকভাবেই ভিন্ন। স্পেনের পায়েইয়া খুবই জনপ্রিয় উৎসবভোজ। বড় চ্যাপ্টা পাত্রে চাল, মাছ, মুরগি, সবজি- সবকিছু মিশিয়ে খিচুড়ির মতো ওয়ান ডিশ মিল হচ্ছে পায়েইয়া। প্রাদেশিক ভিন্নতায় উপকরণে বদল আসলেও মূল সুরটা একই। গাসপাচ্চো স্যুপও বহুল প্রচলিত খাবার স্পেনে। বিশ্বকাপে ইতালি না থাকায় পিৎজা, পাস্তাসহ ইউরোপীয় খাদ্যধারার একটা বড় অংশই বাদ পড়ে যাচ্ছে! তবে পর্তুগিজ রসনাও কম যায় না। ঢাকায় নান্দোস বেশ জনপ্রিয় তাদের পেরি পেরি চিকেনের জন্য; যা মূলত পর্তুগিজ রন্ধনশৈলী। যেটা আবার এসেছে আফ্রিকার পর্তুগিজ উপনিবেশ থেকে! সোয়াহিলি ভাষায় ক্ষুদে অথচ ঝাল একটা মরিচের নাম পিরি পিরি! সেই মরিচের সসে মাখানো পোড়া মুরগিই হয়ে গেল পেরি পেরি চিকেন। পর্তুগিজদের হাত ধরে টমেটো, আনারসসহ অনেক ফল ও সবজিই এসেছে বাংলাদেশে। বলা হয় দুধ থেকে ছানা করার পদ্ধতিটাও পর্তুগিজদের শেখানো। এমনকি লাউ-চিংড়ি আর মরিচ খেতে তো আমাদের শিখিয়েছে ভাস্কো দা গামার দেশের মানুষ। কলকাতার উপকণ্ঠে ব্যান্ডেলে পর্তুগিজদের হাতেই কটেজ চিজ বা আমাদের পনির বানানোর উৎপত্তি। বোঝাই যাচ্ছে, পর্তুগিজ রসনাতেও পনিরের বহুবিধ ব্যবহার থাকবেই।
ফরাসি কায়দায় রান্না তো ভুবনবিখ্যাত! বলা হয় রেস্তোরাঁ ব্যবসার পত্তনই করে ফরাসিরা। ফরাসি রুটি বাগেত, ক্রোয়াশ তো আছেই; চিকেন মেরাঙ্গো, ফোয়া গ্রা- বলতে বলতে শেষ হবার নয়। সৈয়দ মুজতবা আলী উচ্চকণ্ঠে প্যারিসের ক্যাফের প্রশংসা করে গেছেন; আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ বইতেও আছে ফরাসি ‘রোতিসেরি’ বা মুরগি গ্রিল এবং ওয়েস্টার খাবার বর্ণনা।
জার্মানির খাবার তাদের ফুটবল দলের মতোই, ছকে বাঁধা এবং কার্যকর! ব্রেকফাস্টটা দীর্ঘ, মধ্যাহ্নভোজটা মাঝারি আর রাতে স্বল্পাহার। জার্মানদের নিজস্ব ঘরানার রুটি, সঙ্গে মাখন বা মার্মালেড, সসেজ, পনির আর মাংসের কোল্ড কাটস। লাঞ্চে আলুর সালাদ, মিটবল, মাখনে ভাজা সবজি, সেঁকা মাছ, শিমের দানা বা মটরশুঁটি। আর রাতে স্যুপ, সালাদ। জার্মান খাবার বিশ্বব্যাপী যতটা পরিচিত, তার চেয়েও বেশি জনপ্রিয় জার্মান বিয়ার! জার্মানির বিয়ার উৎসব তো রীতিমতো বৈশ্বিক পর্যটন আকর্ষণের প্রধান এক কেন্দ্রবিন্দু। অক্টোবরফেস্টে গলা ভেজাতে বিশ্বের নানান জায়গা থেকেই পর্যটকেরা ছুটে যান মিউনিখে।
বেলজিয়ামের স্বাতন্ত্র্য ওয়াফেলে। দুটো তপ্ত লোহার পাতের ভেতর সেঁকা খামিরকে মধু, ফলের রস ও তাজা ফল দিয়ে খাওয়াটা এখন অনেক দেশেই জনপ্রিয় প্রাতরাশ। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আসলে বেলজিয়ামেরই খাবার। বিশ্বজুড়ে ফাস্ট ফুডের জনপ্রিয় এই অনুষঙ্গ যে আদতে বেলজিয়ান, সেটা রীতিমতো গবেষণা করেই প্রমাণ করেছেন বেলজিয়ান সাংবাদিক জো জেরার্দ! প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকান সৈনিকদের ভুল ধারণা থেকেই নাকি মজার এই খাবারের সঙ্গে জুড়ে গেছে ফরাসিদের নাম। এ ছাড়া বেলজিয়ান চকলেট ও বেলজিয়ান বিয়ারের কদরও বিশ্বব্যাপী।
ক্রোয়েশিয়ার বিখ্যাত সেঁকা মাংসের পদ রাজনিকি, যা অনেকটাই শিক কাবাব বা শাসলিক গোত্রের। কাঠের কাঠিতে গেঁথে সেঁকা মাংসের এই পদ ছাড়াও গুলাশ বা হাঙ্গেরিয়ান মাংসের ঝোলের পদও বহুল প্রচলিত ক্রোয়েশিয়ায়। সার্বিয়াতেও প্লেইয়েসকাভিচা জনপ্রিয় ভোজের পদ। মাংসের সেঁকা কাবাব পরিবেশন করা হয় পেঁয়াজ, টক ননি, মুলার সালাদ ও ভাজা আলুর সঙ্গে। আছে তাদের নিজস্ব ঘরানার রুটি আর সার্বিয়ান সালাদও।
সুইস আতিথেয়তার খ্যাতি ভুবনজোড়া। বিশ্বের সেরা সব হোটেলের কর্তাব্যক্তিরা হোটেল ম্যানেজমেন্টের পাঠ নেন সুইজারল্যান্ডে। সুইস চকলেট ও পনিরের সুখ্যাতি সারা বিশ্বে। জুরিখ ঘরানার কাটা মাংস একটি জনপ্রিয় সুইস পদ, যা পরিবেশিত হয় মাখনে ভাজা বাছুরের মাংসের পাতলা ফালি, ক্রিম, হোয়াইট ওয়াইন ও ডেমিগ্লেস সসের সঙ্গে। সঙ্গে থাকে ভাজা মাশরুম। পোলিশদের সবচেয়ে প্রিয় খাবার বিগোস, যা বানানো হয় মাংসের ঝোলের ওপর টাটকা কুচি বাঁধাকপি ও বাঁধাকপির আচার দিয়ে। রুটির মাঝে খুঁড়ে গর্তের মতো বানিয়ে তাতে পরিবেশন করা হয় বিগোস, সঙ্গে থাকে বিয়ার যা পোল্যান্ডের সবচেয়ে লোকপ্রিয় খাবার। সুইডিশদের বড়দিনের ভোজসভায় থাকে কিমার ঝোলে ভেজানো রুটি, বেকন, মাছ, পনির, আলুর সালাদ, বাঁধাকপির সালাদ, ওলকপি, বিটের সালাদ ও পুডিং। নানান উপনিবেশের রন্ধনশৈলীর প্রভাবে ইংল্যান্ডের রসনাতেও এসেছে পরিবর্তন। ফিশ অ্যান্ড চিপসের সঙ্গে তাই কারি আর চিকেন টিক্কা মাসালাও এখন ইংল্যান্ডে সমান জনপ্রিয়। ডেনমার্কের ‘আরলা’ গুঁড়া দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য তো গোটা বিশ্বেই সমাদৃত। তবে একই সঙ্গে কার্লসবার্গ আর টুবর্গ বিয়ারের পরিচিতিটাও কম নয়! আইসল্যান্ডের খাবারেও মাছ, স্থানীয়ভাবে পালন করা ভেড়ার মাংসের সঙ্গে সিল ও তিমির মাংসও খাওয়া হয়!
জাপানের সুশি, কোরিয়ার কিমচি, ইরানের পোলাও আর কাবাব, সৌদি আরবের কাবস- ঢাকায় এখন চাখতে চাইলে মেলে সবই। গুলশানে হয়েছে বেশ কিছু কোরিয়ান রেস্তোরাঁ, জাপানিজ খাবারের প্রাপ্তিস্থানও আছে গোটাকয়েক। ইরানের নওরোজের পোলাও তো আমাদের উৎসব আনন্দের প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরব রসনার স্বাদও পাওয়া যাচ্ছে ঢাকার অভিজাত পাড়ার কিছু রেস্তোরাঁয়। এ ছাড়া মেক্সিকান টাকোস, নাচোসসহ অনেক পদই ঢাকায় সুলভ।
বিশ্বকাপে এবারই প্রথম খেলছে পানামা। মধ্য আমেরিকার দেশটি খালের জন্য প্রসিদ্ধ হলেও তাদের খাবারে বাহার কম নয়। ভুট্টার আটার রুটি বা তরতিয়া তাদের প্রধান খাবার। জনপ্রিয় খাবার হচ্ছে কাঁচকলা ভাজা। কাঁচকলার স্লাইস ডুবো তেলে ভেজে খাওয়াটা পানামার জনপ্রিয় স্ন্যাক। কোস্টারিকাতেও চাল ও শিমের বিচিই প্রধান খাদ্য। ভাত আর শিম বিচি মিলিয়ে বানানো গাল্লো পিন্টো খাওয়া হয় প্রাতরাশে। ভোজের থালা হচ্ছে কাসাদো! ভাত, শিম বিচি, মিষ্টির সিরায় ডুবানো ভাজা কাঁচকলা, মাছ, মাংস, সালাদ মিলিয়ে বিয়ের ভোজে পরিবেশন করা হয় কাসাদো।
আফ্রিকার নানান আদিবাসী, বিশাল জীববৈচিত্র্য, সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক নানা রূপ খাদ্যাভ্যাসকেও করেছে প্রভাবিত। মরোক্কো ও তিউনিসিয়া ‘মাগরেব’ বা উত্তর আফ্রিকায় অবস্থিত। বারবারি সংস্কৃতি, ইউরোপিয়ান আগ্রাসন- সব মিলিয়ে সেদেশের খাদ্যাভ্যাসেও এসেছে পরিবর্তন। মরোক্কান খাদ্যরীতি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। কারণ, এতে মিসেছে আরব, আন্দালুসিয়ান, বারবার ও ভূমধ্যসাগরীয় খুশবাই। মসলা, মাছ, মাংস, জলপাই তেল, ফল- সবই আছে মরোক্কান রসনায়। সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার হচ্ছে কুসকুস, যা বানানো হয় নানান শস্যের ছাতুর সঙ্গে সবজি ও মাংস সহযোগে। চা, হালুয়া, সামুদ্রিক মাছ ইত্যাদির সমরোহে ভোজনমার্গের এক বহুল প্রত্যাশিত ঠিকানা হচ্ছে মরক্কো। তিউনিসিয়ার খাবারেও মরুভূমির বেদুঈন ও ভূমধ্যসাগরীয় রন্ধনরীতির মেলবন্ধন। এই ভূমি শাসন করেছে রোমান, বাইজেন্টাইন, আরব, স্প্যানিশ, ফরাসিসহ অনেকেই। তাই খাবারে এত বৈচিত্র্য। আসিদা, মারগুজ, শাকশুকা তিউনিসিয়ার জনপ্রিয় খাবার। ভূমধ্যসাগরীয় জলপাই, ডুমুর, খেজুর, অ্যাপ্রিকট যেমন ব্যবহৃত হয় এখানকার রান্নায় তেমনি ভারতীয় মসলা যেমন রসুন, দারুচিনি, ধনে, জিরা, আদা ও লবঙ্গর ব্যবহারও লক্ষণীয়। পানীয়র মধ্যে খেজুর, ডালিম, নাশপাতি ও অনেক রকম ফলের রসের চাহিদাই বেশি। সমঝদারদের কাছে তিউনিসিয়ান ওয়াইনেরও চাহিদা রয়েছে, তা মূলত ফ্রান্সেই যায়। নাইজেরিয়ায় মিষ্টি আলু (ইয়াম) ও কাসাভা (এক প্রকার কন্দজাতীয় খাদ্য) ও ভাতই হচ্ছে প্রধান খাবার। কাসাভা ও কাঁচকলা দিয়ে বানানো ফুফু নাইজেরিয়া, ঘানাসহ আফ্রিকার অনেক দেশের প্রধান খাবার। ভাজা কাঁচকলার চিপসকে বলা হয় ডোডো। এ ছাড়া এগুসি, ওগাদাও নাইজেরিয়ার বেশ জনপ্রিয়। সেনেগালের খাদ্য সংস্কৃতিতে পর্তুগাল ও ফ্রান্সের দারুণ প্রভাব। সেবুু জেন হচ্ছে সেদেশের প্রধান খাবার। মাছে-ভাতে বাঙালি বলা হয়, সেভাবে সেনেগালিজদেরও মাছে-ভাতে বলা যায়। কারণ, আক্ষরিক অর্থে সেবু জেন বা চেবু জেন হচ্ছে ভাত আর মাছ। এটা রান্না করা হয় হয় ম্যারিনেটেড মাছের সঙ্গে লেবু, রসুন, পেঁয়াজ ও অন্যান্য মসলার সঙ্গে টমেটোর চাটনিতে চাল সেদ্ধ করে। অনেকটা স্প্যানিশ পায়েইয়ার মতো। এই সেবু আবার মাংস, মুরগি অন্যান্য কিছু দিয়েও করা যায়, যেমনটা এখানে হয় বিরিয়ানি।
বিশ্বের প্রাচীন একটি সভ্যতা মিসরীয় সভ্যতা। নীল নদের দেশের খাদ্যে রয়েছে সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মিশেল। মিসর হয়েই আগে প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে যেত মসলা। তাই এখানকার খাবারে মিশেছে মসলা, নীল নদের মাছের গায়ে লেগেছে দারুচিনি দ্বীপের সুঘ্রাণ। বাবা গানুশ, তাহিনি, হামুস আর নানা রকম কাবাব, শর্মা, ম্যাকারনি- পর্যটকেরা কেবল পিরামিডের টানে নয়, রসনাবিলাসের আকর্ষণেও মিসরে আসেন!
ঘুরেফিরে সেই সৈয়দ মুজতবা আলীর কাছেই ফিরে আসতে হয়। তিনিই গোটা বিশ্বের রান্নাকে দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন। মসলা দেয়া ও মসলা ছাড়া। উৎপত্তিস্থল থেকে যত দূরে কোনো জিনিস যায়, দাম ততই বাড়ে আর ব্যবহার ততই পরিমিত হয়। তাই স্ক্যান্ডিনেভিয়ান খাবারে মসলা নেই। দক্ষিণ আমেরিকা ও পশ্চিম আফ্রিকায় খাদ্যরসনা পাল্টে দিয়েছে ঔপনিবেশিক রাজনীতি। একইভাবে স্পেন ও পর্তুগালের উপনিবেশ থেকে আনা নতুন সব খাবার একসময় জায়গা করে নিয়েছে মূল স্রোতে। এভাবেই গড়ে ওঠে নতুন নতুন পদ, নতুন খাদ্যরীতি। পর্তুগিজ পেরি পেরি চিকেনের সঙ্গে দিব্যি দেওয়া হয় বেলজিয়ান ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। কোরিয়ান কিমচি আর জাপানি সুশির সঙ্গে খাওয়া হয় মেক্সিকান টাকো- সব মিলিয়ে এ যেন বিশ্বপ্লেট! তবে এখানে রসনায় রসনায় কোনো লড়াই নেই, পার্থক্য এটুকুই।
প্লেটের লড়াইয়ের কোনো ‘কাপ’ নেই। এমনকি নেই প্লেটও। যদি থাকত, তাহলে বাংলাদেশের ফুটবল যতটা তলানিতে, বাংলাদেশের রান্না অতটা নিচে থাকতো না, সেটা হলফ করেই বলা যায়। কারণ মোগলাই, পর্তুগিজ, পারস্য, ইংরেজ- কত ঘরানার খাবারদাবার মিলে যে বাঙালি রসনা তৈরি হয়েছে, তার কাছে কাঁচা মাছ আর মসলাবিহীন সেঁকা মাংস হালিখানেক গোল খাবে, নিশ্চিন্তেই বলে দেওয়া যায়!
লেখক: ক্রীড়া সাংবাদিক, দৈনিক কালের কন্ঠ
ছবি: সংগ্রহ