ছুটিরঘণ্টা I আংকর থমে একদিন
হারিয়ে যাওয়া আংকর থম। সেখানকার প্রাসাদ, মন্দির, কারাগার আর উদ্যানে কম্বোডিয়ার পরাক্রান্ত রাজার স্মৃতি। লিখেছেন মঈনুস সুলতান
নগরীটি প্রায় আট শ বছরের পুরোনো। খেমার সাম্রাজ্য বা কম্বোডিয়ার এককালের এ রাজধানী শহরটির নাম ‘আংকর থম’। যার সোজা বঙ্গানুবাদ হচ্ছে ‘মহান নগরী’। এর প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে মনে হয়, নামকরণটি নিতান্ত মিথ্যা কিংবা বাগাড়ম্বর নয়। এখানকার চারদিকে এককালের প্রশস্ত গড়খাই- যা আজ রূপান্তরিত হয়েছে ধানক্ষেতে। একটি দীর্ঘ পাথুরে পুল দিয়ে মধ্যযুগের এ খেমার নগরী মূল ভূখ-ের সঙ্গে যুক্ত। পুলের দুপাশে সারি দিয়ে পাহারারত পাথরের সুর ও অসুর সম্প্রদায়। এখানে ফণা তুলে শরীর মোচড়ায় পাষাণের অনন্ত নাগ।
নগরীর সিংহদুয়ারটি- যেহেতু কোনো সিংহ মূর্তি নেই, তাই বলা উচিত হস্তীদুয়ারটি আকারে তেমন বৃহৎ নয়; তবে মাত্র ৭৫ ফুট উঁচু। তিন মাথাওয়ালা একটি পৌরাণিক হাতির শরীরকে কারিগরি দক্ষতায় করা হয়েছে উড়ির খিলান। মনে হয়, শুঁড় দিয়ে দেববাহন এ জন্তুটি একটি পদ্ম ফুল তুলছে। তার উপরে বসে আছেন স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র। একা নন তিনি, দুপাশে আছে দুই অপ্সরা, এবং আছে স্বর্গের রাজাধিরাজের হাতে চিরায়ত বজ্র। পুরোনো দিনের ভাস্করের কারিকুরি কিন্তু এখানেই শেষ নয়। দুয়ার চূড়ায় পাষাণ খুদে নির্মাণ করা হয়েছে চারদিকে চেয়ে থাকা চার মনুষ্য-মস্তক। দেউড়িখানির বয়স আট শ বছর। পাহারারত দেবতা ও দানবের চোখের জ্যোতি হয়ে এসেছে ক্ষীণ। তারপরও এককালের এ রাজকীয় নগরে প্রবেশের সময় শিষ্টাচারে কোনো ভুলভ্রান্তি হয়ে গেল কি না ভেবে শরীর শিউরে ওঠে।
ট্যাক্সিতে চেপে মূল প্রাসাদ প্রাঙ্গণের দিকে চলি। আংকর থম নগরীটি সম্পর্কে আমার প্রথম ধারণা জন্মে বছর তিনেক আগে। কম্বোডিয়ার বর্তমান রাজধানী নমপেনের বিমানবন্দরে আটকা পড়েছিলাম ঘণ্টা ছয়েকের জন্য। বিমানের কল বিগড়ে গিয়েছিল। এ পরিস্থিতিতে কী আর করা। ডিউটি ফ্রি শপ থেকে চড়া মূল্যে কিনেছিলাম আংকর থম নগরী ও খেমার সভ্যতা নিয়ে রচিত একখানা পুরাতাত্ত্বিক উপাত্তে ভরপুর গ্রন্থ। পুস্তকটিতে মধ্যযুগের এক চীনা রাজদূতের খেমার রাজ্যে ভ্রমণের বয়ান উদ্ধৃত আছে। দূত জু ডাগুয়ান আংকর থমের কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা একটি সুউচ্চ স্বর্ণালি মিনার, হাতির দাঁতের কারুকাজ করা রাজকীয় পুল এবং প্রাসাদদ্বারে প্রহরারত দুটি চন্দ্রকান্ত মণির জ্বলজ্বলে চোখওয়ালা সিংহের কথা বিপুল তারিফের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন।
ট্যাক্সি চলছে মস্ত মস্ত সব শতাব্দীপ্রাচীন গাছে ছায়াময় রাজসড়ক দিয়ে। পথের দুপাশে ধূসর বেলেপাথরে তৈরি বিপুল আকৃতির খানিক ভগ্ন স্থাপত্যরাজি। চীনা রাজদূতের বর্ণিত স্বর্ণময় কারুকাজ বোধ করি সভ্যতার সোনালি যুগের স্মৃতির মতোই এত দিনে হয়েছে বিলীন; আমি সেসবের তেমন কোনো নিশানা দেখতে পাই না।
ট্যাক্সি থামতেই যা চোখে পড়ে, তা হলো- কৌণিক, অজস্র স্তরে সুবিন্যস্ত, দেয়ালগাত্রে রিলিফে খোদিত মূর্তিময় বিপুল এক মন্দির। মন্দিরটিতে অনেক চূড়া, প্রতিটিতে পাথর কুঁদে কুঁদে তৈরি করা হয়েছে মানুষের মুখম-লের মতো দেখতে দেবতা অবলোকিতশ^রের মূর্তি। এ মন্দিরের ছবি আমি আগেও দেখেছি, তাই দেবালয়টি যে বেয়ন মন্দির, তা চিনে নিতে কোনো অসুবিধা হলো না। নীল আকাশের প্রেক্ষাপটে দেবমহিমায় মোড়া নানা দৃষ্টিকোণে স্থাপিত অনেক পাথুরে মুখম-লের জন্য- খানিক দূর থেকে বেয়ন মন্দিরকে বেশ চৌকস দেখায়। মন্দিরটির দিকে পা বাড়াতেই চারদিক থেকে এসে আমাকে ঘিরে ধরে শিশু ফেরিওয়ালার দল। ওদের ঠেলে অতি কষ্টে এগোতে হয়। কেউ বিক্রি করতে চাইলো কাঠের তৈরি একখানা দৌড়ের নাও, কারও হাতে পসরা হিসেবে আছে বেতের তৈরি সারস- তার ঠোঁটে মাছ। কোনো শিশুর এক হাতে ফিল্ম, আরেক হাতে পিতলের তৈরি অপ্সরা। বছর তিনেকের একটি মেয়ে ভারী আদুরে গলায় পরিষ্কার ইংরেজিতে বলে, ‘যখন ক্লান্ত হবে মিস্টার, তখন এসে আমার কাছ থেকে এক বোতল পানি কিনো কিন্তু।’ এই শিশুশ্রমিকদের মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের বিমুখ করতে কষ্ট হয়। তাই অতি অল্প মূল্যে একটি অপ্সরা মূর্তি ও একখানা নৌকা কিনি। এতে যেন ভিমরুলের চাকে ঢিল পড়ে। বাকি ফেরিশিশুরা এসে আমাকে ছেঁকে ধরে কানের কাছে- ‘প্লিজ, বাই ফ্রম মি মিস্টার’ বলে বলে হুল ফোটাতে শুরু করে। সস্তায় এটা-সেটা কেনার মতো বেআক্কেলির জন্য নিজের ওপর ভীষণ বিরক্ত হই। কিন্তু তাতে ক্ষুদে ফেরিওয়ালাদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায় না।
ঠিক এ সময় চোখাচোখি হয় এক কিশোরীর সঙ্গে। মেয়েটিও ফেরিওয়ালা, তার কাঁধের ঝোলায় একরাশ ‘সারং’ বা রঙচঙে লুঙ্গি। মেয়েটি আমার নাস্তানাবুদ অবস্থা দেখে বেজায় আমোদ পাচ্ছিল। হঠাৎ এগিয়ে এসে ক্ষুদে ফেরি-দস্যুদের খেমার ভাষায় খানিক ধমক দিয়ে, খানিক ঠেলাঠেলি করে সরিয়ে দেয় সে। শিশুশ্রমিকেরা সম্পূর্ণ তিরোহিত হয় না বটে; একটু দূরে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখতে থাকে। মেয়েটি আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমাকে কি বেয়ন মন্দিরে নিয়ে যাব?’ আমি তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে তার সঙ্গে হাঁটতে শুরু করি। ক্ষুদে ফেরি-দস্যুরা কিঞ্চিৎ দূরত্ব রেখে আমাদের পিছু পিছু চলে। মন্দিরের প্রবেশদ্বারে এক বৌদ্ধ ভিক্ষু ধূপকাঠি বিক্রি করছে। অতি নিচু পাথরের চৌকাঠ পার হয়ে আমরা অলিন্দময় প্রায় অন্ধকার বারান্দায় এসে দাঁড়াই। মেয়েটি জিজ্ঞেস করে, ‘এ মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতার নাম তুমি জানো কি?’ আমি জবাবে বলি, ‘নাম জানি না, তবে আন্দাজ করি ওই ফেরিশিশুদের কোনো এক পূর্বপুরুষ এ মন্দির তৈরি করেছিলেন।’ মেয়েটি খিলখিল করে হেসে ওঠে। বলে, ‘ও নো, ইট ওয়াজ মাইটি কিং জয়বর্মন হু বিল্ড দিস টেম্পল। ইট টুক টুয়েলভ্ ইয়ারস টু বিল্ড দ্য হোল কমপ্লেক্স।’ বেয়ন মন্দির তৈরি করতে সত্যি কি রাজা জয়বর্মনের বারো বছর লেগেছিল? আমি মেয়েটির মুখে এহেন তথ্যবহুল ইংরেজি শুনে একটু অবাক হই। জিজ্ঞেস করি, ‘তুমি এত কিছু জানো কীভাবে?’ সে জবাব দেয়, ‘আংকর থম ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষিত হওয়ার পর ইউনেসকো একটি ট্রেনিংয়ের আয়োজন করে। আমি ওই ট্রেনিং থেকে এসব শিখি। ইচ্ছা ছিল ট্যুর-গাইড হবো। কিন্তু কেউ আমাকে নিতে চায় না।’ আমি তার জবাবে একটু বিষণ্নতা শুনি। জিজ্ঞেস করি, ‘তুমি কী বিক্রি করো?’ বলামাত্রই সে ঝোলা থেকে বের করে এক গাদা ‘সারং’ বা লুঙ্গি। লুঙ্গিগুলো রঙিন, সুতির জমিনে মাঝে মাঝে ছাপচিত্র আঁকা। সে আমাকে একখানা লুঙ্গি কিনতে খুব করে ধরে। বলে, ‘তোমার মেয়েবন্ধুর জন্য একখানা সারং কিনে নিয়ে যাও।’ মনে মনে চটে উঠে বলি, ‘আমার কোনো মেয়েবন্ধু নেই।’ মেয়েটি এতে নিরুৎসাহিত হয় না। খিলখিল করে হেসে বলে, ‘আমি তোমার মেয়েবন্ধু হতে পারি, শুধু একখানা সারং কিনে দাও।’ আমার এবার মেজাজ তেতে ওঠে। আপদ বিদায় করার জন্য একটি সারংয়ের দাম জিজ্ঞেস করি। সে ‘দু ডলার’ বলতেই আমি তাকে দুটি ডলারের নোট দিয়ে রূঢ়ভাবে দূর হতে বলি। আমার ঈষৎ অশোভন আচরণে মেয়েটি একটু দমে যায়। গলার চেইনে একটি আঙুল প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে আমার দিকে দুঃখী দুঃখী ভাব করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে ধীরে ধীরে চলে যায়।
আমি এবার বেয়ন মন্দিরটি ভালো করে দেখার সুযোগ পাই। এ দেবালয়কে একটি নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে দেখার জন্য চলে যাই খোলামেলা আঙিনায়। নানা উচ্চতায় সারি সারি সুবিন্যস্ত পাথরের স্তূপ সৃষ্টি করছে কৃত্রিম পাহাড়ের অনুকৃতি। প্রতিটি স্তূপের চূড়ায় নানা দিক নিশানা করে পাষাণে খোদাই হয়েছে অবলোকিতেশ্বরের ম্লান শান্ত হাসিমুখ। একটু মগ্ন হয়ে তাকালে মনে হয়, মন্দিরটির পাষাণে গড়া অজস্র চোখ যেন অবলোকন করছে দিগন্ত, আকাশ ও প্রকৃতি। আমার নিমগ্নতা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ‘সারং’ বিক্রেতা মেয়েটি আবার উদয় হয়। এবার তার বেশভূষা একটু অন্য রকম। একটু খেয়াল করে বুঝতে পারি, সে তার আগের আধ-ময়লা ‘সারংটি’ বদলে একটি নতুন সারং পরে নিয়েছে। চোখেও বুলিয়ে নিয়েছে সস্তা আইশ্যাডো। আমি জিজ্ঞেস না করে পারি না, ‘তুমি এর মাঝে চেঞ্জ করলে কোথায়?’ মন্দিরের অজস্র প্রায় অন্ধকার অলিন্দের একটি দেখিয়ে বলে, ‘ওখানে গিয়ে শুধু তোমার দেয়া সারংটি পরে এলাম।’ জবাব শুনে আমার বাক্রুদ্ধ হওয়ার দশা। সে কিন্তু সাবলীলভাবে বলে, ‘মিস্টার, এখানে আমার একটি ছবি তুলে দেবে কি?’ সাতপাঁচ ভেবে অবশেষে অনুরোধটি রাখি। ক্লিক শেষ হতেই সে ঠোঁট ঈষৎ ফুলিয়ে বলে, ‘আমার নাম মিস কিমেনা, সবাই আমাকে কিম বলে। তোমাকে আংকর থমের সবকিছু খুঁটিয়ে দেখাতে পারি, তবে তুমি না চাইলে আমি কিন্তু এখনই চলে যাচ্ছি।’ বলেই সে সত্যি সত্যি যেতে উদ্যত হয়। আমি পেছন থেকে তার সদ্য পরা সারংয়ে একঝাঁক অপ্সরার ছাপচিত্রকে তরঙ্গায়িত হতে দেখি। দৃশ্যটি আমাকে এতই আকৃষ্ট করে যে কোনো ভাবনাচিন্তা না করেই বলি, ‘কিম, তোমার যাওয়ার দরকার নেই। আমাকে তুমি এ এলাকাটি একটু ঘুরিয়ে দেখালে খুব খুশি হবো।’
সে চকিতে ঘুরে আমার দিকে তাকায়। আমরা চলে আসি আরেকটি মন্দিরের প্রাঙ্গণে। জাপানের কারিগরি সহায়তায় এখানে পুনঃসংস্কারের কাজ চলছে। আমরা গড়খাইয়ের উপরে ঝুলন্ত পুল ধরে হাঁটি। মূল আঙিনার প্রবেশমুখের দুদিকে দুটি চতুষ্কোণ বাঁধানো পদ্মপুকুর। ভেতরে ঢুকে অলিন্দ থেকে অলিন্দে হেঁটে বেড়াই। কিম তার প্রায় সাবলীল ইংরেজিতে দেয়ালচিত্রের মর্মার্থ বোঝাতে থাকে। আমরা একটি বিপুল আকৃতির পাথরের লিঙ্গের সামনে এসে দাঁড়াই। বস্তুটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কিমের গন্ডদেশ রক্তিম হয়ে ওঠে। আমি তাকে বলি, ‘শিবঠাকুরের পৌরাণিক প্রত্যঙ্গটি নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যার দরকার নেই কিম।’
সে এবার আমাকে নিয়ে চলে ‘প্যালেস অব দি স্কাই’ বা আকাশপুরী দেখাবে বলে। আমরা পিরামিড আকৃতির স্তরে স্তরে উপরের দিকে উঠে যাওয়া বর্তমানে প্রায় ভগ্ন একটি স্থাপত্যের সামনে এসে দাঁড়াই। কিম এখানে আমাকে জানায় যে রাজা জয়বর্মনের হাজার তিনেক স্ত্রী ও উপপত্নী থাকা সত্ত্বেও তিনি নাকি প্রতি রাতে এখানে এসে একটি নাগকুমারীর সঙ্গে নিদ্রা যেতেন। আমি রাজাটির শয্যাভ্যাস নিয়ে বিশেষ একটা ভাবিত হই না। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য হয় প্রাসাদ প্রাঙ্গণ।
রাজপুরীর দেয়ালসংলগ্ন দুটি পুকুর। কিমের ভাষ্যানুযায়ী- একটিতে রাজমহিষী এবং অন্যটিতে নাকি দেহরক্ষী প্রতিহারীরা অবগাহন করতেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, ‘তুমি এত কিছু এত সঠিকভাবে জানো কীভাবে?’ সে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে, ‘তোমার বিশ্বাস না হলে তুমি একা একাই ঘুরো, আমি কিন্তু চলে যাচ্ছি।’ একা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় কৃত্রিম হলেও খানিক ভয় পেয়ে, বলি, ‘অবিশ্বাসের কিছু না, তবে এই যে বৃহৎ আঙিনাকে তুমি রাজপুরী বলছ- এখানে ঘরদুয়ার, শয়নকক্ষ, মন্দির, আস্তাবল- কিছু নেই কেন?’ কিম আমার পুরাতাত্ত্বিক জ্ঞানের বহর দেখে মৃদু হেসে বলে, ‘মন্দিরগুলো ঈশ্বর ও দেবতাদের জন্য গড়া হয়েছিল বেলেপাথর ও আগ্নেয় শিলা দিয়ে, তাই সেগুলো বহু শতাব্দী পর আজও বহাল তবিয়তে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু প্রাসাদগুলো তৈরি হয়েছিল কাঠ দিয়ে। সাত-আট শ বছর পর কাঠের অস্তিত্ব কি আর কিছু থাকে?’ আমি তার যুক্তি মেনে নিয়ে নীরবে হাঁটি। অবশেষে আমরা এসে পৌঁছাই ‘এলিফ্যান্ট টেরাস’ বা হস্তী মঞ্চের কাছে। স্থানটি বেলেপাথরে গড়া প্ল্যাটফর্মের মতো। বিস্তীর্ণ দেয়ালের সর্বত্র নানা ভঙ্গিমায় যুদ্ধের সাজে হাতি ও সশস্ত্র সৈনিকের অজস্র চিত্র ব্যাস রিলিফ পদ্ধতিতে আঁকা। আমরা আরও কয়েক পা এগিয়ে যাই। দেখি দেয়ালের উপর দিয়ে নেমে এসেছে ছয়টি যুদ্ধহস্তীর শুঁড়।
রিলিফের কাজগুলোর রেখাবিভঙ্গে শেষ মধ্যাহ্নের সূর্যালোক তীব্র হয়ে ফোটে। কিমের ঠোঁটের উপর ও নাকের ডগায় ফুটে ওঠে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আমারও পিপাসা পায়। আমি এদিক-ওদিক তাকাই। বেশিক্ষণ খুঁজতে হয় না। ঘণ্টা দেড়েক আগে দেখা হওয়া ছোট্ট পানি বিক্রেতা মেয়েটিকে টলোমলো পায়ে হাঁটতে দেখি। আমি তার দিকে এগিয়ে গিয়ে দুই বোতল পানি কিনি। মেয়েটির চোখমুখ ভীষণ শুকনা দেখায়। ইচ্ছা হয়, তাকে কিছু একটা কিনে দিই। একটু দূরে গাছতলায় দাঁড়িয়ে জটলা করছে ক্ষুদে ফেরিদস্যু শিশুশ্রমিকেরা। তাই ছোট্ট মেয়েটিকে কিছু দিতে সাহস হয় না। আমি নীরবে কিমকে একটি জলের বোতল দিই। আমাদের খানিকটা সময় কাটে হস্তীমঞ্চের সামনের একটি বৃহৎ বৃক্ষছায়ায় দাঁড়িয়ে থেকে। কিম জানায়, ‘এই মঞ্চে বসে রাজা জয়বর্মন অপরাধীদের সাজা দিতেন।’ মঞ্চের সামনের মাঠটুকু পেরোলেই এক সারি মন্দির আকৃতির ঈষৎ ভগ্ন ছয় কিংবা আটটি প্রকোষ্ঠ দেখা যায়। আমরা ওই দিকে হাঁটি। কিম আবার বলে, ‘এই প্রকোষ্ঠগুলো ছিল সে আমলের রাজকীয় কারাগার। একেকটি রাশিচক্রের জাতকের জন্য নির্ধারিত ছিল একটি করে কারাগার।’ আমি তাকে জিজ্ঞেস করি- তার জন্মরাশি কী? সে রহস্যভরা চোখে আমার দিকে তাকায়। তারপর বাতাসে আঙুল দিয়ে তার রাশিচক্রের চিত্র আঁকে। আমি অবাক হয়ে বলি, ‘আমার জন্মও হয়েছে একই রাশিচক্রে, কী আশ্চর্য।’ সে বলে, ‘ঠিক আছে, ওই কোণের কারাগারটি আমাদের রাশিচক্রের মানুষদের জন্য ছিল নির্ধারিত।’ কারাগারের এ প্রকোষ্ঠ বা কুঠুরিটি অন্যান্য কুঠুরি থেকে খানিক দূরে- একটি নির্জন মাঠের প্রান্তে। পাথরের কাঠামোটি ঘিরে গজিয়েছে অত্যন্ত পুরোনো একটি বটবৃক্ষের অজস্র শিকড়। গাছটি দাঁড়িয়ে আছে কুঠুরিটির ঠিক উপরে। আমরা পরস্পরের দিকে একটু তাকাই, তারপর অবলীলায় ঢুকে পড়ি পাথরে আমাদের রাশিচক্র খোদাই করা একটি কুঠুরিতে।
কুঠুরিটির দেয়ালে বেশ ফাটল। পাথরের খোদাই ব্যাস রিলিফের চিত্রে বিস্তৃত হয়েছে বটের বিরাট বৃক্ষের শিকড়। স্থানটি বসার উপযুক্ত নয়। তাই আমরা পরস্পরের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। কারাগারের চূড়ায় একটি তক্ষক তিনবার ডেকে ওঠে। কিম আমাকে ফিসফিস করে বলে, ‘আমার মা প্রায়ই বলে, এখানকার তক্ষকের ডাক হিসাব করে সেই সংখ্যানুযায়ী লটারির টিকিট কিনলে ভাগ্য ফিরে যেতে পারে।’
আমার ফেরার সময় হয়ে আসে। ট্যাক্সির দিকে যেতে যেতে কিমকে জিজ্ঞেস করি, ‘সবচেয়ে ভালো মানের একটি লটারির টিকিটের দাম কত হতে পারে?’ সে জানায়, ‘দু থেকে তিন ডলার।’ আমি ড্রাইভারের পাশের সিটে বসতে গিয়ে তার হাতে এক ডলারের তিনটি নোট গুঁজে দিয়ে বলি, ‘ভালো দেখে একটা লটারির টিকিট কিনে নিয়ো।’ কিম কোনো প্রতিক্রিয়া প্রকাশ না করে ডলারগুলো হাতে নেয়। তারপর নির্লিপ্তভাবে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘মিস্টার, ট্যাক্সিতে উঠে তোমার সঙ্গে হোটেলে আসবো কি?’ আমি উত্তরে বলি, ‘তার প্রয়োজন নেই, আমি খানিক পরে বিকেলের ফ্লাইটে ব্যাংকক চলে যাচ্ছি।’ ট্যাক্সি ছেড়ে দেয়। ভাবি পেছন ফিরে তাকাবো না। কিন্তু রিয়ার ভিউ মিররে একটি ‘সারং’-এর কিয়দংশ ও নৃত্যরতা অপ্সরার প্রতিফলন দেখা যায়।
mainussultan@hotmail.com
ছবি: লেখক