কুন্তলকাহন I কেশসৌরভ
চুলের সৌন্দর্যে সৌরভও একটা শর্ত। তবে বাজারে পাওয়া হেয়ার পারফিউম এড়িয়ে ব্যবহার করতে হবে প্রাকৃতিক সুগন্ধি
পারফিউম বা সুগন্ধি ব্যক্তিত্ব প্রকাশের একটি অংশ ও উপায়। আসলে এটি হচ্ছে সাশ্রয়ী মূল্যে ফ্যাশন বা স্টাইলিংয়ের একটি কৌশল। তবে জানা চাই সুগন্ধি ব্যবহারের কিছু আদব-কেতা। তা না হলে পড়তে হবে অস্বস্তিকর অবস্থায়। স্থান, কাল বুঝে নির্ধারণ করতে হয় কোন ধরনের পারফিউম কখন ব্যবহার করা যায়। হেয়ার পারফিউমের ক্ষেত্রেও এই নিয়ম প্রযোজ্য।
ভাবছেন, চুলের জন্য পারফিউম? সুন্দর, ঝলমলে চুল সবারই কাক্সিক্ষত। কিন্তু চুল সুন্দর রাখার ঝক্কিও তো কম নয়। ধুলা, ঘাম ও তৈলাক্ততার কারণে যে দুর্গন্ধ তৈরি হয়, তা থেকে মুক্তির উপায় হলো এই সুগন্ধি। শ্যাম্পুতে নানান রকমের সুগন্ধি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে তা খুব অল্প সময় স্থায়ী হয়। চুলের জন্য রয়েছে আলাদা সুগন্ধি। অনেকেই মনে করেন, সাধারণ পারফিউম আর চুলের পারফিউম একই। আসলে তা নয়। তবে চুলের জন্য আলাদা যে পারফিউম বাজারে মেলে, তা-ও চুলের জন্য নিরাপদ নয়। কারণ তাতে থাকে বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান। এসব পারফিউমে অ্যালকোহল থাকে, যা চুল শুষ্ক ও প্রাণহীন করে তোলে। অনেকে বডি পারফিউম চুলে স্প্রে করে থাকেন, তা মোটেও উচিত নয়। বাজারে যেসব পারফিউম পাওয়া যায়, সেগুলো সিনথেটিক উপাদানে পূর্ণ, যা আসলে পেট্রো কেমিক্যাল ও শনাক্তকরণের অনুপযুক্ত রাসায়নিক উপাদান।
চুল সুরভিত করে তোলার কিছু প্রাকৃতিক উপায় ও উপকরণ রয়েছে। এগুলো সুরভিত করার পাশাপাশি চুল সুন্দর ও প্রাণবন্ত করে তোলে। এটা অনেকেরই হয়তো অজানা যে, ত্বকের চেয়ে চুলে বেশি সময় সুগন্ধ বজায় থাকে।
এবার জেনে নেওয়া যাক প্রাকৃতিক উপায়ে চুল ঘ্রাণময় করে তোলার কিছু উপকরণ ও উপায় সম্পর্কে। যা একেবারেই নন-টক্সিক, প্রাকৃতিক।
একসময় চুল শুকানো ও সুরভিত করার কাজে ধূপের ধোঁয়া ব্যবহৃত হতো। এটি চুলকে দীর্ঘক্ষণ সুরভিত রাখতো। ধূপের সঙ্গে নানান সুগন্ধি ফুল রেখে চুলে ব্যবহারের কথা জানা যায় আদিকালের রাজ-রাজড়াদের যাপিত জীবনধারা থেকে। অ্যালকোহলিক সুগন্ধির উদ্ভব আঠারো শতকে। এখন তো সেই সুগন্ধির রয়েছে যেমন রকমফের, তেমনি নামিদামি ব্র্যান্ড আর চড়া মূল্য। আজকাল ধূপের ব্যবহার না থাকলেও কিছু প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করা হয় চুল দুর্গন্ধমুক্ত রাখার জন্য। এতে ভালো কাজ দেয় বিভিন্ন ধরনের এসেনশিয়াল অয়েল। যেমন- হ্যাজেল, অ্যালোভেরা, জোজোবা অয়েল প্রভৃতি। আরেকটু বেশি কিছু পেতে চাইলে এসব উপকরণের সঙ্গে যোগ হতে পারে ডিস্টিল্ড ওয়াটার কিংবা গোলাপজল। এসেনশিয়াল অয়েল দারুণ সুগন্ধযুক্ত এবং এটি চুলে প্রয়োজনীয় পুষ্টিরও জোগান দেবে।
প্রাকৃতিক হেয়ার পারফিউম তৈরিতে এসেনশিয়াল অয়েল ব্যবহারের আগে এটি সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া প্রয়োজন। যা হেয়ার পারফিউমের মাত্রা নির্ধারণে সহায়তা করবে। প্রতিটি এসেনশিয়াল অয়েলকে কয়েকটি নোটে বিভক্ত করা যায়। এই নোটগুলোর পরিমাপের ওপর নির্ভর করে চুলে সুগন্ধি কতক্ষণ স্থায়ী হবে। প্রথমেই আছে টপ নোট। এটি এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। এই পর্যায়ে পারফিউমে ১৪ ফোঁটা এসেনশিয়াল অয়েল ব্যবহার করা হয়। এরপর আছে মিডল নোট। এটি দ্ইু থেকে চার ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এ ক্ষেত্রে ২২ ফোঁটা অয়েল মেশানো হয়। বেজ নোট আরও দীর্ঘ সময় স্থায়ী হয়। এই নোটের পরিমাণটাও মিডল নোটের তুলনায় বেশি থাকে। এবার ঠিক করে নিতে হবে, চুলে সুগন্ধের মাত্রা ও স্থায়িত্ব কতটুকু দরকার। হালকা, মাঝারি না তীব্র। ক্ষণস্থায়ী, দু’ঘণ্টা না আরও বেশি।
এবার মিশ্রণে আসা যাক। চুলে সতেজ ঘ্রাণ নিয়ে আসতে চাইলে লেমন ফ্লেভারই উপযুক্ত। পরিমাণমতো পছন্দের কোনো এসেনশিয়াল অয়েল, লেবুর রস কয়েক ফোঁটা, সামান্য ডিস্টিল্ড ওয়াটার ভালো করে মিশিয়ে ছোট একটি স্প্রে বোতলে ঢেলে নিতে হবে। ব্যবহারের আগে বোতল ঝাঁকিয়ে নিতে হবে। এ ছাড়া প্রতিদিন গোসলের পর এক মগ পানিতে সামান্য লেবুর রস মিশিয়ে চুলে ঢেলে দিন। এতে চুলে আর বাজে গন্ধ হওয়ার সুযোগই থাকবে না।
গোলাপজল চুলের সুগন্ধি হিসেবে সেরা। বড় সাইজের কয়েকটি গোলাপের পাপড়ি ও ডিস্টিল্ড ওয়াটার নিতে হবে। পাপড়িগুলো ধুয়ে একটি পাত্রে নিয়ে তাতে ডিস্টিল্ড ওয়াটার ঢেলে দিন। ডিস্টিল্ড ওয়াটার এই পরিমাণ দিন, যাতে পাপড়িগুলো ডুবে যায়। পাত্রটি ঢেকে সেদ্ধ করে নিন যতক্ষণ পর্যন্ত না পাপড়ি রঙহীন হয়ে যায়। এরপর ঠান্ডা করে ছেঁকে নিন। ব্যস, হয়ে গেল গোলাপজল তৈরি। এটি সরাসরি বা পারফিউমের মিশ্রণে ব্যবহারের মাধ্যমে চুল পারফিউমড করে নেওয়া যায়।
পাঁচ টেবিল চামচ গোলাপজল, এক টেবিল চামচ অ্যালোভেরা জেল, কয়েক ফোঁটা রোমান, সুইট অরেঞ্জ ও লেভেন্ডার এসেনশিয়াল অয়েল ভালোভাবে মিশিয়ে স্প্রে বোতলে সংরক্ষণ করুন।
অ্যালোভেরা এসেনশিয়াল অয়েল ও পানির সঙ্গে ভালোভাবে মিশে যায় সুগন্ধিকে কোনো রকম প্রভাবিত না করেই। এটি পারফিউমে ব্যবহার করার উদ্দেশ্য হলো এর রয়েছে কন্ডিশনিংয়ের গুণ। আর চুলে উজ্জ্বলতা আনতেও এর জুড়ি নেই। সুন্দর গন্ধের পাশাপাশি অ্যালোভেরার গুণে যদি ঝলমলে চুল বোনাস হিসেবে পাওয়া যায়, কেউই নিশ্চয়ই তা হাতছাড়া করতে চাইবেন না।
অ্যালকোহল বেজড পারফিউম বেশ জনপ্রিয়। এমনকি প্রাকৃতিক সুগন্ধিতেও অনেকে সামান্য পরিমাণে অ্যালকোহল ব্যবহার করতে চান। কেননা এটি সহজে যেকোনো উপকরণের সঙ্গে মিশে যেতে পারে এবং সুগন্ধ বাড়াতে ও ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। এটি মিশ্রণকে হালকা করে তোলার ফলে ব্যবহারের পর চুল ভারী হয়ে লেপ্টে যায় না। তবে এটি সব সময় প্রাকৃতিক হয় না বলে একটু সাবধানতা প্রয়োজন।
কেরিয়ার অয়েল একেবারেই অ্যালকোহলমুক্ত। তাই এটি ক্ষতি তো করবেই না, বরং চুলে উজ্জ্বলতা যোগ করবে। এর ব্যবহার নির্ভর করে এটি সুগন্ধিকে কতটুকু প্রভাবিত করে বা চুলকে কতটুকু ভারী বা চিটচিটে করে তোলে, এসবের ওপর। এ ক্ষেত্রে ভালো কাজ দেবে জোজোবা অয়েল। প্রয়োজনে সামান্য ব্যবহারের পর দেখবেন এটি চুলকে কেমন অবস্থায় ফেলছে। অবস্থা বুঝে পরিমাণটা বাড়াতে বা কমাতে হবে। তবে এটি সুগন্ধ ছড়ায় চমৎকার।
এবার চুল সুরভিত করে বেরিয়ে পড়ুন।
তাসমিন আহমেদ
মডেল: মাহি
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: সৈয়দ অয়ন