অর্গানিক I পরিহার্য পাঁচ
রাসায়নিক উপাদানে তৈরি প্রসাধন ত্বকের জন্য বিপজ্জনক। এগুলো এড়িয়ে চলা উচিত
প্যারাবেন
প্যারাবেন হলো এক প্রকার প্রিজারভেটিভ, যা বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন প্রসাধন ও ফার্মাসিউটিক্যালস প্রডাক্টে সংরক্ষণকারী উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন মিথাইল প্যারাবেন, ইথাইল প্যারাবেন, প্রোপি প্যারাবেন, বিউটি প্যারাবেন ও আইসোবিউটি প্যারাবেন। এসব উপাদান দিয়ে শ্যাম্পু, বডি লোশন, মাসকারা, ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন প্রসাধন তৈরি হয়। কিন্তু এগুলো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কি না, গত কয়েক বছরে বিজ্ঞানী, পণ্য নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও প্রসাধননির্মাতাদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে।
২০১১ সালে এক গবেষণার জন্য ৯৯ শতাংশ স্তন কোষের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তাতে অন্তত একটি প্যারাবেন পাওয়া যায়। এই উপাদান উচ্চ মাত্রা এসট্রোজেন হরমোনকে ভারসাম্যহীন করে। আমেরিকার কেমিক্যাল সোসাইটির মতে, ৮৫ শতাংশ সৌন্দর্যপণ্যের মধ্যে প্যারাবেন রয়েছে। পণ্যের মেয়াদ বাড়ানোর কাজে এটি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু যখন প্রয়োগ করা হয়, তখন এটি ত্বকের উপর বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে। প্যারাবেন খুব দ্রুত ত্বকের সংস্পর্শে চলে আসে। শরীরের রক্তসংবহনতন্ত্রে প্রবেশ করে। এ কারণে প্যারাবেনযুক্ত প্রসাধনসামগ্রী এড়িয়ে চলা উচিত।
পলিইথিলিন গ্লাইকল
ইথিলিন গ্লাইকল থেকে এটি তৈরি হয়। যার মূল উপাদান হলো অ্যান্টিফ্রিজ বা জমাটবিরোধী পদার্থ। অর্থাৎ সিনথেটিক পেট্রোলজাত পদার্থ, যা ত্বকের যত্নে ও চুল রঙ করার পণ্যে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত চুল পুরু ও নরম করার জন্য এটি ব্যবহৃত হয়। এই উপাদান মিশ্রিত প্রসাধনগুলো ত্বক দ্রুত শোষণ করে।
ত্বকের জন্য এটি ক্ষতিকর। তাই এর মিশ্রণে তৈরি প্রসাধন ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে বলা হয়। কারণ, পলিইথিলিন গ্লাইকলসে ১, ৪- ডাইঅক্সেন, ইথিলিন অক্সাইড নামের অপদ্রব্য রয়েছে। এই দুটি উপাদান কারসিনোজেন (ক্যানসার সৃষ্টিকারী) ও স্নায়ুতন্ত্রের উত্তেজক নামে পরিচিত। পলিইথিলিন গ্লাইকলের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ। স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতির জন্যও দায়ী। এমনকি এটি বিশ্বযুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো, ত্বক ও চুলের গভীরে এটি দ্রুত প্রবেশ করে। দুই ধরনের পলিইথিলিন গ্লাইকলের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়। সেগুলো হলো, পলিইথিলিন গ্লাইকল ২ এবং পলিইথিলিন গ্লাইকল ৪।
ফিলেটস
রাসায়নিক যৌগ। পলিভিনাইল ক্লোরাইড তৈরিতে এটি ব্যবহৃত হয়। মূলত প্লাস্টিকে নমনীয়তা আনার জন্য এর ব্যবহার প্রচলিত। চিকিৎসার সরঞ্জামে ও গাড়িতে এটি প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। তবে সৌন্দর্যচর্চার কিছু প্রসাধনে ফিলেটস খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন- হেয়ার স্প্রে ও নেইলপলিশ।
উচ্চ মাত্রার ফিলেটসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ডিআইসোনোনিল ফিলেট, ডিআইসোডেসিল ও ডাইপ্রোপিলহেপটিল ফিলেট। এগুলো ব্যবহৃত হয় মেঝে, দেয়ালের কার্পেট, সিনথেটিক চামড়া, ছাদ ও অটোমোবাইলের কাজে। কম মাত্রার ফিলেটসের মধ্যে রয়েছে ডাই এবং ডি বিউটিল ফিলেট। চিকিৎসার সরঞ্জামাদি, আঠালো পদার্থ, কালি ও প্রসাধনসামগ্রীতে এ দুটি ব্যবহৃত হয়। যা স্বাস্থ্য ও ত্বকে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
গবেষণায় এই যৌগের সঙ্গে স্তন ক্যানসার এবং জন্মগত ব্যাধির সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গেছে। এই উপাদান শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশে বাধা দেয়। এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা বন্য প্রাণী ও পরিবেশের ক্ষতির কারণ হিসেবে ফিলেটকে দায়ী করেছে।
পারফিউম
বাংলায় সুগন্ধি। যা ত্বকের উপরের অংশে ব্যবহৃত হয়। দুই ধরনের সুগন্ধি রয়েছে- প্রাকৃতিক ও সিনথেটিক। প্রথম ধরনটি তৈরি হয় বিভিন্ন ফুল, গাছ, তেল থেকে। অন্যটি বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান থেকে। তবে কিছু সুগন্ধি এমনভাবে সৃষ্টি করা হয়, যেগুলো প্রাকৃতিক মনে হয়। এসব আসলে তৈরি হয় পরীক্ষাগারে, সিনথেটিক কেমিক্যালস থেকে। ১৯৯১ সালে আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এক গবেষণা থেকে জানিয়েছে, এসব রাসায়নিক উপাদানের ৯৫ শতাংশ পেট্রোলিয়াম ও অন্যান্য বিপজ্জনক উপাদান থেকে তৈরি। পারফিউমে কিছু রাসায়নিক উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন এসিটোন, ইথানল, বেনজালডিহাইড, মিথাইলিন ক্লোরাইড, ইথাইল এসিটেট, লিনালুল ও বেনজাইল অ্যালকোহল। লেবানিজ আমেরিকান জৈব পদার্থবিজ্ঞানী ও গন্ধবিশেষজ্ঞ লুকা তুরিন জানিয়েছেন, বাজারে যেসব সুগন্ধি বিক্রি হয়, সেগুলোর বেশির ভাগই সিনথেটিক। এসব পারফিউমের ৯০ শতাংশ রাসায়নিক ও ১০ শতাংশ প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি।
পারফিউমের বিষক্রিয়ায় অ্যালার্জি দেখা দেয়। আমেরিকার এনভায়রনমেন্টাল ওয়ার্কিং গ্রুপের মতে, কিছু সুগন্ধি স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা ও হাঁপানির জন্য দায়ী। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এসব সুগন্ধি তৈরির রাসায়নিক উপাদানগুলো সম্পর্কে অনেকেরই স্বচ্ছ ধারণা নেই। অন্যদিকে কিছু সুগন্ধি তৈরি করা হয়, যেগুলোর গন্ধ দীর্ঘক্ষণ থাকে। এগুলো মানুষের অ্যালার্জি হওয়ার প্রধান একটি কারণ। পারফিউম কখনো কখনো আশপাশে থাকা ব্যক্তির জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। এসব প্রসাধনের প্রভাবে শরীরে একবার অ্যালার্জি দেখা দিলে তা স্থায়ী হয়ে যায়।
প্যারাফিন
প্যারাফিন বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন কেরোসিন, প্যারাফিন ওয়াক্স (সাদা বা রঙহীন পিচ্ছিল পদার্থ); জৈব রসায়নে প্যারাফিনকে বলা হয় অ্যালকেন। স্পাতে ব্যবহৃত প্যারাফিন ক্রিম বা মলম হিসেবে পরিচিত। একে মিনারেল অয়েলড বলা হয়। এটি ক্রুড অয়েল বা অশোধিত তেল থেকে উৎপন্ন হয়। সৌন্দর্যচর্চায় ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে এর ব্যবহার রয়েছে।
তেল চিটচিটে ভাবের জন্য এর ব্যবহারে ত্বকে সমস্যা দেখা দেয়। এটি ত্বকের ছিদ্রগুলো বন্ধ করে দেয়। ত্বক বাইরের বাতাস গ্রহণে ব্যর্থ হয়। ফলে চুলকানি দেখা দেয় এবং অ্যালার্জি বাড়ে।
রঙ এবং বিভিন্ন উপাদানকে ড্রাগ হিসেবে যত দিন গণ্য করা হবে না, তত দিন এগুলো ব্যবহারে স্বাস্থ্যঝুঁকি-সংক্রান্ত পরীক্ষার প্রয়োজন হয় না। কারখানাগুলো এতই অনিয়ন্ত্রিত যে যেকোনো প্রতিষ্ঠান অনুমোদন ছাড়া যেকোনো উপাদান মেশাতে পারে। কিন্তু এনভায়রনমেন্টাল ওয়ার্কিং গ্রুপ, সেফ কসমেটিকস নামের বিভিন্ন সংস্থা এ নিয়ে কাজ করছে। ফলে, ভোক্তারা এখন তাদের ব্যবহৃত পণ্য নিয়ে অনেক সচেতন হয়ে উঠছেন।
রেন্টিনা চাকমা
মডেল: আয়শা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: ক্যানভাস