ফিচার I অবগুণ্ঠনে শাপলা
রাজবিয়ে বলে কথা। তাই বাতচিত কিছু তো হবেই। আলোচনার রেশ থাকবে আরও অনেক দিন। বস্তুত এ তো সেই অর্থে প্রথাভাঙা বিয়ে। দ্রব হলেন রানি। বদলে গেল রাজবাড়ির নিয়ম। সূচনা হলো নতুন সময়ের। পাঁড় ব্রিটিশরা অবশ্য মুখে কিছু না বললেও ভালো মনে নেননি। তাতে কী? হ্যারি-মেগান গাঁটছড়ায়, পুরোনো পাতা মুড়ে সূচিত হলো ব্রিটিশ রাজেতিহাসের নতুন অধ্যায়
সেন্ট জর্জেস চ্যাপেলে উপস্থিত ৬০০ অতিথির আংটি বদল করে, পূতমন্ত্র পড়ে শুভ পরিণয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে গির্জার বাইরে উৎসুক জনতার সামনে চুমু বিনিময়ের পরে কী উপাধি ওঁরা পাবেন, তা আগেভাগেই রাজবাড়ি নির্ধারণ করে রেখেছিল। ফলে বিয়ের পর ব্রিটিশ রাজসিংহাসনের অন্যতম উত্তরাধিকারী প্রিন্স হ্যারি হলেন উিউক অব সাসেক্স। আর তাঁর নবপরিণীতা মেগান হলেন ডাচেস অব সাসেক্স।
উইন্ডসর প্রাসাদের গির্জায় দুপুরে বিয়ের পর সন্ধের যুবরাজ চার্লস মা-মরা ছোট ছেলে ও তার স্ত্রীর সম্মানে বিশিষ্ট অতিথিদের জন্য নৈশভোজের আয়োজন করেন। সেখানে আবেগময় বক্তব্য দেন বাবা চার্লস। ফ্রগমোর হাউজের এই ভোজাসরে আমন্ত্রিত ছিলেন মাত্র ২০০ জন। নবদম্পতি এই ডিনারে আসেন ১৯৬৮ সালে তৈরি একটি ই-টাইপ জাগুয়ারে। নাম্বার প্লেটে ‘ই’ বর্ণমালার সঙ্গে ছিল ছয়টি সংখ্যা। সেটা আসলে ১৯.০৫.১৮। অর্থাৎ ১৯ মে ২০১৮। হ্যারি নিজেই গাড়ি চালিয়ে মেগানকে নিয়ে উপস্থিত হন ভোজে। বেশ খানিকটা মিল খুঁজে পাওয়া সেল জেমস বন্ড ছবির সঙ্গে।
বিয়ে এবং পরবর্তী নৈশভোজে উপস্থিতদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন অপরাহ্ উইনফ্রে, সেরেনা উইলিয়ামস, জর্জ ও আমাল ক্লুনি, স্যার এলটন জন, ডেভিড ও ভিক্টোরিয়া বেকহাম ও ইদ্রিস এলবা। কোনো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান ছিলেন না আমন্ত্রিত। কারণ, রাজনীতিকে পরিহার করে চলেন এই যুবরাজ। বরং উপস্থিত অতিথিদের বেশির ভাই ছিলেন বয়সে তরুণ। মধ্যাহ্নভোজে সংগীত পরিবেশন করেন স্যার এলটন জন। হ্যারির মায়ের শেষকৃত্যানুষ্ঠানেও গেয়েছিলেন তিনি। উইন্ডসর প্রাসাদে এই বিয়ে দেখতে উপস্থিত ছিলেন অন্তত এক লাখ উৎসুক মানুষ।
তবে এই প্রথাভাঙা বিয়ে নিয়ে আলোচনা কম হয়নি। শেষমেশ রাজি হন সম্রাজ্ঞী, নিজের হাতে লিখে অনুমতি দেন তিনি। তবেই নাতির বিয়ে হতে পারে। অবশ্য রানির তা না করেই বা উপায় কী! মাকে যখন হারায়, তখন আর কতই বা বয়স ছেলেটার। চোখের সামনেই তো বেড়ে উঠলো। তাই তার আবদার ফেলতে পারেননি তিনি।
সে জন্যই তো সিন্দুক থেকে নাতবউয়ের জন্য বের করে দেন কুইন মেরির টায়রা। হীরের দ্যুতি ছড়ানো। ১৮৩২ সালে তৈরি। ১৮৯৩ তে তৈরি ব্রোচ। আর মায়ের ডায়মন্ডকে নতুন করে বসিয়ে বানানো আংটি বিয়েতে মেগানকে পরিয়ে দেন হ্যারি।
মেগান চেয়েছিলেন বিয়েটা নানাভাবে স্মরণীয় হয়ে থাক। তাই তো তার ইচ্ছেতেই অবগুণ্ঠনে ৫৩টি কমনওয়েলথ দেশের জাতীয় ফুল এম্ব্রয়ডারি করা হয়েছে। ১৬ ফুট লম্বা এই অবগুণ্ঠন তৈরি হয়েছে সিল্ক টুলে ফ্যাব্রিকে। অবশ্য তা হবে না-ই বা কেন, হ্যারি যে আবার কমনওয়েলথের তরুণ দূত। তবে মেগানের পছন্দের দুটো ফুলও ছিল এতে এই ভেইলে। উইন্টারসুইট আর ক্যালিফোর্নিয়া পপি। আর ছিল গমের শিষ। ভালোবাসা আর ঔদার্যের প্রতীক। অন্যদিকে, গাউন তৈরির জন্য ডিজাইনারকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। ফ্রান্সের ঐতিহাসিক ফ্যাশন হাউজ জিভঁশির প্রথম নারী ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর ব্রিটিশ ডিজাইনার ক্লেয়ার ওয়েইট কেলার পুরো ওয়েডিং ড্রেস তৈরির দায়িত্ব পালন করেন। ইউরোপের কাপড়ের মিলগুলো খুঁজে শেষ পর্যন্ত তৈরি করানো হয় ডাবল বন্ডেড সিল্ক ক্যাডি। ধবধবে সাদা। এটাই পছন্দ মেগানের। তবে আধুনিকতার সঙ্গে ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটানো হয়েছে এই বোটনেক গাউনে। তাই তার ট্র্যাডিশনাল গাউনকে মাত্রা দিয়েছে আধুনিক স্লিম থ্রি-কোয়ার্টার হাতা।
কানাডার বিখ্যাত হেয়ারস্টাইলিস্ট জেনিসা ম্যালরোনি আবার মেগানের অন্তরঙ্গ বন্ধু। তিনি দায়িত্ব পালন করেন স্টাইলিংয়ের। হ্যারির মায়ের খুব কাছের বন্ধু ছিলেন বিখ্যাত ফটোগ্রাফার মারিও টেস্তিনো। তাঁরই সহকারী অ্যালেক্সি লুবোমিরস্কিকেই বেছে নেন হ্যারি আর মেগান।
রাতের অনুষ্ঠানের জন্য মেগান পরেছিলেন আরেক ব্রিটিশ ডিজাইনার স্টেলা ম্যাককার্টনির স্লিক ক্রেপের সাদা হল্টারনেক অফ শোল্ডার ড্রেস। পিঠখোলা। অনেকটা হাতখোঁপা করা। সাদা জুতায় বেবি ব্লু পেইন্ট করা। আর অবশ্যই ছিল ১৯৯৬ সালের সিডনি সফরে পরা প্রিন্সেস ডায়ানার সেই সমুদ্রনীল আংটি। ব্রিটিশ আর্মির ব্লুজ অ্যান্ড রয়্যাল রেজিমেন্টের ইউনিফর্ম দাদির অনুমতি নিয়েই বিয়েতে পরেছিলেন হ্যারি। আর রাতে স্যুট। রাতের অনুষ্ঠানে মেগান তার মার্কিন ঐতিহ্য বজায় রাখেন। হুইটনি হিউস্টনের ‘আই ওয়ানা ডান্স সামওয়ান (হু লাভস মি)’ গানের সঙ্গে পা মেলান মেগান।
সেন্ট জর্জেস চ্যাপেলের এই বিয়েতে উভয়েই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকেন। তবে বাধ্য থাকার কথা দেননি মেগান। আবার আংটি পরে ছক ভাঙেন হ্যারি। এমনকি তিনি রাজপ্রাসাদে সসম্মানে প্রবেশাধিকার দিয়েছেন রাজপরিবারের বাইরের বা ব্রিটিশ আভিজাত্যের বাইরের কাউকে। তা-ও আবার একসময়ের উপনিবেশের মানুষ। মা ডায়ানা ছিলেন জনমানুষের প্রিয়। পিপল’স প্রিন্সেস। হ্যারিও নিজেকে সেই উচ্চতায় উন্নীত করছেন। পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন মায়ের। এই বিয়েতে তার অনেকটাই করে দেখিয়েছেন তরুণ যুবরাজ।
শেখ সাইফুর রহমান
ছবি: সংগ্রহ