ফিচার I মুক্তবাণিজ্যের বিশ্বকাপ
বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থার উন্মুক্ততায় তাল মিলিয়ে চলছে বিশ্বকাপ। বহুজাতিক এই সওদাগরি যুদ্ধে হারজিতের বিচিত্র সমীকরণ নিয়ে লিখেছেন শেখ সাইফুর রহমান
পৃথিবীর প্রায় সব দেশ গা ভাসিয়েছে উদার অর্থনীতির খোলা হাওয়ায়। ভুবনায়িত লগ্নি পুঁজি বা গ্লোবাল ফিন্যান্স ক্যাপিটালের বাণিজ্য অনেকাংশেই বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক উত্থান-পতন ও সাংস্কৃতিক অভিমুখের নিয়ন্ত্রক। বহুজাতিক করপোরেট ব্যবস্থা, ব্র্যান্ড-চেতনা ও কনজিউমারিজমের ফর্মুলায় আবর্তিত বিশ্বের সংস্কৃতি ও ক্রীড়াজগৎ। তো এই বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার খোলা হাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্বকাপ। যে সোভিয়েত রাশিয়া একসময় পুঁজিবাদের বিকল্পে সমাজতন্ত্রের বটবৃক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেই রাশিয়া ক্রমে পেরেস্ত্রৈকায় নিজের রূপবদলের পর এখন গ্লোবালাইজেশনের অংশীদার। আজ বিশ্ব বাণিজ্যের ছন্দে চলছে বিশ্ব ফুটবলের কার্নিভ্যাল।
ব্যাটেল অব ব্র্যান্ডস
আপাত হার-জিতের অন্তরালে মাঠের অন্দরে ও বাইরে চলছে আরেক ধুন্ধুমার লড়াই। সোভিয়েত মন্তাজের জনক চলচ্চিত্রী সের্গেই আইজেনস্টাইনের সমাজতান্ত্রিক ছবি ‘ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন’-এর দেশে বিশ্বকাপ যুদ্ধের আড়ালে চলছে আরেকটি যুদ্ধ। তার নাম ব্যাটল অব ব্র্যান্ডস। এ লড়াই মূলত দুটি ক্রীড়াসরঞ্জাম প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের। এডিডাস আর নাইকি। বিশ্বে এরাই সুপার-জায়ান্ট। প্রথমটি জার্মান আর পরেরটি মার্কিন। বিশ্বকাপের মতো আসর এলেই তাই প্রশ্ন ওঠে– এ দুইয়ের কে জিতবে বিশ্বকাপ, কে হবে ব্যাটল অব ব্র্যান্ডসে বিজয়ী?
এবারের বিশ্বকাপে সর্বাধিক ১২ দলের স্পন্সর অ্যাডিডাস। এই তালিকায় আছে স্পেন ছাড়াও ২০১৪ সালের চ্যাম্পিয়ন জার্মানি এবং রানার্সআপ আর্জেন্টিনা। গেল পাঁচ বিশ্বকাপে তিনবারই চ্যাম্পিয়ন অ্যাডিডাস।
১৯৯৮ সালে ফিফার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে অ্যাডিডাস। চলতি বিশ্বকাপে সেই সম্পর্কের দুই দশক পূর্তি উদ্যাপন করছে এই ব্র্যান্ড। বল আর রেফারির ইউনিফর্মে লোগো ব্র্যান্ডিংসহ ফিফার অফিশিয়াল পার্টনার হিসেবে প্রায় ১৮ লাখ ডলার ব্যয় করেছে এই জার্মান কোম্পানি।
অন্যদিকে অ্যাডিডাসকে বুট স্পন্সরে টেক্কা দিয়েছে নাইকি। চলতি বিশ্বকাপে সবেচেয়ে বেশি খেলোয়াড় পরছে নাইকির বুট। এমনকি রাশিয়া বিশ্বকাপের সবচেয়ে দামি ২০০ বুটারের ১৩২ জনের পায়ে থাকবে নাইকির বুট। সেখানে অ্যাডিডাসের মাত্র ৫৯। শতকরা হিসাবে ৬৬ বিপরীতে ৩০ শতাংশ।
আমেরিকায় বাস্কেটবল আর আমেরিকান ফুটবলের বাজার নাইকির একচেটিয়া দখলে। তবে সে দেশে ফুটবলের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় তারা বদল করেছে কৌশল।
ফিফার অফিশিয়াল পার্টনার হওয়া সত্ত্বেও বিনিয়োগকারীদের পছন্দ অ্যাডিডাস নয়, নাইকি। এর উদাহরণ গেল বিশ্বকাপ। চ্যাম্পিয়ন আর রানার্সআপ জার্মানি ও আর্জেন্টিনা ছিল অ্যাডিডাস স্পন্সরড। অথচ বিশ্বকাপ পরবর্তী তিন মাসে নাইকির শেয়ারের দর বেড়েছে, যা অ্যাডিডাসের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি।
অ্যাডিডাসের মূল বাণিজ্য আসলে জার্সি। এটা বিক্রি করেই আসে সিংহভাগ অর্থ। অন্যদিকে নাইকির বাণিজ্য বুটকেন্দ্রিক। এই ব্র্যান্ডের তারকামুখ রোনালদো আর নেইমার যেমন, তেমনি হ্যারিকেনও। অন্যদিকে অ্যাডিডাসের লিওনেল মেসি।
কৌশলগত দিক থেকে নাইকি এগিয়ে অ্যাডিডাসের চেয়ে। কারণ, কোম্পানিটি অ্যাডিডাসের মতো ফিফাকে বিপুল অর্থ না দিয়ে খেলোয়াড়দের পেছনে আর সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণায় ব্যয় করছে।
নিয়েলসেন স্পোর্টসের ২০১৮ ফুটবল রিপোর্ট অনুযায়ী এ বছরের প্রথম ৫ মাসে ফেসবুক, টুইটার আর ইনস্টাগ্রামে রোনালদোর অনুসরণকারী ৫০ বিলিয়ন। মেসির চেয়ে যা ৩৫০ মিলিয়ন বেশি। তা ছাড়া মেসির আবার টুইটার অ্যাকাউন্টই নেই। বেয়ন্সে আর লেব্রন জেমসের যৌথ অনুসরণকারীর চেয়েও বেশি রোনালদোর ফলোয়ারের সংখ্যা।
বিশ্ব বাণিজ্যের ফুটবল
বিশ্বের জনসংখ্যা বর্তমানে ৭০০ কোটি। রাশিয়া বিশ্বকাপে সরাসরি কিংবা টিভিতে চোখ রাখছে এর অর্ধেক। খেলছে ৩২ দল। আর এই আসর ঘিরে কেবল স্বাগতিক দেশ রাশিয়ায় নয়, সারা বিশ্বে সঞ্চালিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। এই আয়োজনে স্বাগতিক রাশিয়ার সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবদান হবে ৩১ বিলিয়ন ডলার।
একটা চামড়ার বল ঘিরে স্বপ্ন আবর্তিত হয় গোটা বিশ্বের। অংশ নেয় ফিফার সব সদস্য দেশ। অর্থাৎ গোটা গ্লোব। অবশ্য মূল পর্বের লড়াই মাত্র ৩২ দেশের। তাতেই উন্মাতাল পুরো পৃথিবী।
কিন্তু খেলা কি কেবলই মাঠে? প্রশ্নটা সঙ্গত। কারণ, স্বাগতিক হওয়ার দৌড় থেকে আয়োজন পর্যন্ত চলে নানা পর্যায়ের লড়াই। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বিপুল অর্থ।
শুরুটা সেই স্বাগতিক হওয়া থেকে। পুরো আয়োজনে রাশিয়ার ব্যয় হচ্ছে ১১ বিলিয়ন ডলার। এর ৭০ ভাগ এসেছে কেন্দ্রীয় আঞ্চলিক সরকারের তহবিল থেকে, বাকি ৩০ ভাগের সংস্থান হয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষণায়।
অবকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কারে ব্যয় হয়েছে ৩০ শতাংশ। যার পরিমাণ ৪.১ বিলিয়ন। ৫০ ভাগ অর্থাৎ ৬.৮ শতাংশ ব্যয় হয়েছে পরিবহনব্যবস্থার উন্নয়নে। আর আয়োজনের সহায়ক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ব্যয় করা হয়েছে বাকি ২.১ বিলিয়ন।
বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল– এই ৫ বছরের প্রতিবছর ব্যয় হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি ডলার। তবে রাশিয়ার অর্থনীতিতে এই ব্যয়ের রয়েছে বহুমাত্রিক প্রভাব। সবই ইতিবাচক। কর্মসংস্থান এগুলোর মধ্যে প্রধান। এই কর্মযজ্ঞের কারণে অন্তত আড়াই লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
এই আসর উপলক্ষে রাশিয়ায় এসেছে অন্তত ৫ লাখ ফুটবলভক্ত। অন্যরা তো আছেই। আহার-পানীয় আর আশ্রয় ছাড়াও রয়েছে স্মারক উপহার বিক্রি থেকে আয়। পরিসংখ্যান বলছে, একজন দর্শক ৫ থেকে ৮ হাজার ডলার খরচ করবে তাদের রাশিয়াবাসে। ফলে তাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে যোগ হবে ২.৫-৫ বিলিয়ন ডলার। জিডিপি বাড়ছে অন্তত ৩ শতাংশ।
তবে এই সময়ে মেটালারজিকাল, পেট্রোকেমিক্যাল আর নিউক্লিয়ার পাওয়ারের মতো খাতগুলোয় থাকবে মন্দা। তাতে বেশ খানিকটা লোকসান গুনতে হবে রাশিয়াকে।
এ তো গেল রাশিয়ার কথা। এই বিশ্ব ফুটবল যারা নিয়ন্ত্রণ করে, সেই ফিফার এই বিশ্বকাপ ঘিরে লাভের পরিমাণও জ্ঞাতব্য বৈকি। স্পন্সরদের কাছ থেকে ফ্র্যাঞ্চাইজি লাইসেন্স বিক্রি করে পেয়েছে ১.৫৫ বিলিয়ন। এখানে আছে তিনটি ক্যাটাগরি: ফিফা পার্টনার, ওয়ার্ল্ড কাপ পার্টনার আর ন্যাশনাল স্পন্সর। তবে পরিমাণটা ২০১৪ সালের চেয়ে কম। অবশ্য ২০১৮ ও ২০২২ বিশ্বকাপের টিভি স্বত্ব বিক্রি করে ফিফা পেয়েছে ২.৪৩ বিলিয়ন।
এবার আরও গুরুত্ব পাচ্ছে সামাজিক মাধ্যম। সেখানেও রয়েছে চোখ কপালে তোলার মতো পরিসংখ্যান। কারণ, কেবল ফিফা কিংবা প্রতিটি জাতীয় দল নয়, বরং প্রত্যেক খেলোয়াড়েরই রয়েছে একাধিক সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডল। সেখানে অনুসরণকারীর সংখ্যাও তো নেহাত কম নয়।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, যে মহাদেশে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় সেই অঞ্চলের স্পন্সরদের থাকে বেশি অংশগ্রহণ। সে হিসাবে এবার এশিয়ার স্পন্সররা রয়েছে এগিয়ে। এগুলোর মধ্যে চৈনিক প্রতিষ্ঠানগুলো আছে সবার আগে।
এদিকে বিশ্বকাপ উপলক্ষে বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞাপনের বাজারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫০০ শতাংশ। সারা বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষের চোখ থাকবে রাশিয়ার একেকটি স্টেডিয়ামে। ফলে কেবল ফুটবল নয়, দৃষ্টি কাড়বে বিজ্ঞাপনও। এই খাতের টার্নওভার হবে ২৪০ বিলিয়ন ডলার। সবচেয়ে বেশি বাড়বে চীনে। ৮৩৫ মিলিয়ন। আর স্বাগতিক রাশিয়ায় ৬৪ মিলিয়ন।
লড়াই আরও আছে। ফ্র্যাঞ্চাইজি লাইসেন্স কেনা থেকে ব্র্যান্ডিং আর মার্কেটিংয়ে যেমন ব্যয়, তেমনি আয় আছে নিজেদের পণ্য বিক্রি থেকে। অ্যাডিডাস আর নাইকি এবারের বিশ্বকাপে প্রধান দুই প্রতিপক্ষ। অ্যাডিডাসের জার্সি পরে মাঠে নামছে ১২ দল। ৮ দল রয়েছে নাইকির দিকে। ফিফার কাছ থেকে লাইসেন্স কেনার জন্য যেমন অর্থ দিতে হয়, তেমনি দলগুলোকে তা পরানোর জন্যও গুনতে হয় সম্মানী। এরপরও অ্যাডিডাস ব্রাজিল বিশ্বকাপে বিক্রি করে ৩০ লাখের বেশি জার্সি।
এরপর রয়েছে রেপ্লিকা জার্সি এবং অন্যান্য স্যুভেনিরের বিশ্বজোড়া বিরাট বাজার। রেস্তোরাঁ, ক্যাফে, বার, পাবগুলোয় আহার আর পানীয়ের জমাটি ব্যবসা।
টেলিভিশনও এই সময়ে সারা বিশ্বেই কাক্সিক্ষত পণ্য। সঙ্গে আছে সেলফোন আর ট্যাবও। কেবল বাংলাদেশেই বিক্রি হচ্ছে ৫ লাখ টিভি সেট। আর ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপে খেলছে পেরু। ফলে সোয়া ২ লাখ টিভি সেট তারা আমদানি করেছে।
বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের কোনো কোনোভাবে প্রিয় ফুটবল। ফলে তাকে ঘিরে বাণিজ্য যে হবে, তা বলাই বাহুল্য। তাই কড়ি গোনা নয়, রাশান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ফুটবলের এই বৈশ্বিক আসরকে দেখছেন তাঁর দেশের মর্যাদা বৃদ্ধির উপলক্ষ হিসেবে।
মনে রাখা দরকার, করপোরেট অর্থনীতির প্রধান একটি দিক স্পনসরশিপ। আর এই স্পনসরের ওপরেই অনেকটা নির্ভরশীল ক্রীড়া ও সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্র। বিশ্বকাপ ফুটবলও এর ব্যতিক্রম নয়। বরং ফুটবলের হোক অথবা ক্রিকেটের, যেকোনো টুর্নামেন্ট মানেই, যেকোনো ক্রীড়া আসর মানেই স্পনসরশিপের বাণিজ্য। আর বিশ্বকাপ ঘিরে স্পনসরশিপের খেলা ফুটবলের ক্রীড়ানন্দনের মতোই বর্ণময়। এবার ফিফার আয় গতবারের চেয়ে অনেক বেশি। পরিমাণ ৬.১ বিলিয়ান। এর অর্ধেক অর্থাৎ ৩ বিলিয়ন এসেছে টিভি স্বত্ব থেকে। স্পন্সরশিপ থেকে ১.৬ বিলিয়ন। প্রাথমিকভাবে কমার সম্ভাবনা থাকলেও মুখ বাঁচিয়েছে চায়নিজ কোম্পানিগুলো।
এদিকে, প্রতি বিশ্বকাপেই বাড়ছে ফিফার আয়-ব্যয় আর পুরস্কারের অর্থ। গতবারের তুলনায় ফিফার প্রাইজ ফান্ড এবার ১২ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৪০০ মিলিয়ন ডলার। ৪ বছর পর বাড়বে আরও ৪০ মিলিয়ন।
ছবি: সংগ্রহ