ইভেন্ট I ঐতিহ্যের জামদানি
বাংলাদেশ তথা গোটা বঙ্গের সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত জামদানি বয়নশিল্প। বিশ্বদরবারে জামদানির গুরুত্ব অপরিসীম। এই বাংলাদেশ থেকে শুরু করে উপমহাদেশে, এমনকি বিশ্বের বহু বিচিত্র সংস্কৃতির হাটে এই বয়নশিল্প সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ ব্যাপক। বাংলাদেশ ও বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও লোকশিল্প ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান জামদানি। কিন্তু এর বেশ কিছু নকশা আজ বিলুপ্তির পথে। এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় করতে জামদানির বয়নশিল্পীদের জামদানি নকশার সংরক্ষণে বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের দীর্ঘ গবেষণায় প্রকাশিত হলো ‘জামদানি ডিজাইনস’ বা ‘ঐতিহ্যবাহী জামদানি নকশা’ শীর্ষক একটি গ্রন্থ।
এই গ্রন্থ প্রকাশে নানা বিষয়ে অবদান রয়েছে বাংলাদেশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস ও রাষ্ট্রদূত স্টিফেন ব্লুম বার্নিকাট এবং বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ তহবিল থেকে এই গ্রন্থের গবেষণায় অর্থায়ন করা হয়। এই গ্রন্থের যৌথ প্রকাশক বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ও বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদ।
এই দুই প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে ১ জুলাই জাদুঘরের মূল অডিটোরিয়ামে এই গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী ও বিশিষ্ট অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর, বিশেষ অতিথি ছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া স্টিফেন ব্লুম বার্নিকাট। এছাড়া ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মো. আব্দুল মান্নান ইলিয়াস, গ্রন্থের প্রধান গবেষক চন্দ্র শেখর সাহা, বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের প্রকল্প সমন্বয়ক শাহিদ হোসেন শামীম ও বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম।
চন্দ্র শেখর সাহা এই গ্রন্থের বিষয়ে বিশদ জানিয়েছেন। জামদানি বস্ত্রের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, অতীত ও বর্তমান বিপণনব্যবস্থা, জামদানি নকশার বৈশিষ্ট্য, বয়নের কৌশলগত প্রক্রিয়া, নকশার তুলনামূলক বিশ্লেষণ, বয়ন প্রক্রিয়া, নকশা ও নকশা বুননের জন্য পদ্যের ঢঙে সৃষ্ট বুলির সম্পর্ক ইত্যাদি রয়েছে এই গ্রন্থে। এ ছাড়া মোটিফের বৈশিষ্ট্য বুটি, পাড়, তেরছি, জাল আলাদাভাবে পর্যায়ক্রমে এই গ্রন্থে উপস্থাপিত হয়েছে। বয়নের ৮৬টি নকশা থেকে বাছাই করে ৬৭টি নকশা এই গ্রন্থে বিধৃত। রয়েছে বয়নশিল্পীদের নাম ও ফোন নম্বরের ডেটাবেস।
এই অনুষ্ঠানে আসাদুজ্জামান নূর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও লোকশিল্প-কারুশিল্পের ওপর জামদানির বিপুল অবদানের কথা বলেন। তিনি জানান, জামদানির কারুশিল্পে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা মোকাবিলার ক্ষেত্রে এই গবেষণা বিশেষভাবে কাজে আসবে। সংস্কৃতিমন্ত্রী স্বীকার করেন, জামদানি সৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত বয়নশিল্পীদের অর্থনৈতিক অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। এও বলেন, ‘বাজারে ভালোমতো দামে জামদানি বিক্রি হলেও কিছু মধ্যস্থতাকারীর জন্য বয়নশিল্পীরা উপযুক্ত পারিশ্রমিক পান না। যাঁরা জামদানি সৃষ্টি করেছেন তাঁরাই সঠিক পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না, দাম পাচ্ছেন না। অথচ ক্রেতাকে বেশি দামে জামদানি কিনতে হচ্ছে।’ জামদানির বর্তমান বাস্তবতার সূত্রে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, ‘বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে, কিন্তু এই উন্নয়ন তখনই পূর্ণতা পাবে, যখন এর সুফল সবার কাছে পৌঁছবে। আমার মতে, বাংলাদেশ সরকার যেভাবে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ ও কিছু শিল্পের ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেয়, ঠিক সেভাবেই বয়নশিল্পে ভর্তুকি দেওয়া উচিত। জামদানি সৃষ্টির কাজে সরকার যাতে ভর্তুকি দেয়, সেই বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত।’
মার্কিন রাষ্ট্রদূত জানান, বাংলাদেশের মসলিন থেকে জামদানি, এসব কিছুর ইতিহাস ও ঐতিহ্য গৌরবের। হাতে বোনা এসব কারুশিল্প ইউনেসকোর স্বীকৃতিও পেয়েছে। তাই জামদানির নকশা, ইতিহাস, বয়নশিল্পীদের নকশা ও তাদের সৃজনকর্মের বিষয়ে গবেষণা ও সংরক্ষণের এই মহৎ কাজে যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহ দেখিয়েছে। সে জন্যই ২০১৪ সাল থেকে এই গ্রন্থ প্রণয়ণের জন্য যে গবেষণা হয়েছে, তার পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশস্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস।
উল্লেখ্য, নারায়ণগঞ্জের তিনটি জামদানি বয়ন এলাকা রূপগঞ্জ, সোনারগাঁ ও সিদ্ধিরগঞ্জে এই গ্রন্থের গবেষণা ও সমীক্ষার কাজ চলেছে প্রায় ৫ বছর। মোড়ক উন্মোচনের অনুষ্ঠানে বয়নশিল্পীদের কাজ, তাঁদের জীবন ও কারুশিল্পের নানা বিষয়ে বক্তব্য পেশ করেন বয়নশিল্পীদের প্রতিনিধি মো. ইসমাঈল। গ্রন্থটির বিষয় ও প্রেক্ষাপটগত গুরুত্ব নিয়ে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সাবেক মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও সাংবাদিক শেখ সাইফুর রহমান।
অতনু সিংহ
ছবি: সজীব রহমান