skip to Main Content

ফিচার I ফলে পরিচয়

দেশীয় ফল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে বর্তমান প্রজন্ম। এর পরিণতি কী? লিখেছেন বিলু কবীর

চালতা

‘বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়’– বাংলা ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো ভাষায় এমন ভুলশূন্য আপ্তবাক্য আছে কি না জানা নেই। আমাদের ভাষায় ফল বিষয়ে রয়েছে বহু প্রায়োগিক ও মার্গীয় অর্থ। একই সঙ্গে রয়েছে ছড়া-কবিতা-গদ্য-বাগধারার সমাহার। এমনকি এই অঞ্চলের মিথ ও পৌরাণিক যে রূপকল্পের জীবন-সাহিত্য, সেখানে পর্যন্ত বৃক্ষ ও ফলের সংশ্লিষ্টতা আমাদের কৃষ্টি ও লোকসংস্কৃতিকে মহীয়ান করেছে। আমাদের বিশ্বাস, অবিশ্বাস, পুষ্টিচেতনা, সমাজচিত্র এবং অনেক উপমা-তুলনায় পর্যন্ত ফল একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাবক। গানের বেলাতেও এর কোনো ব্যতিক্রম নেই। এমনকি কুসংস্কার, লোকবিশ্বাস, স্বাস্থ্যবিধি, পূজা-পার্বণে পর্যন্ত ফলের অপরিহার্যতা লক্ষণীয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফল ও বৃক্ষ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক চিন্তাপ্রসূত সিদ্ধান্তও লক্ষ করা যায়। যেমন আমাদের জাতীয় ফল কাঁঠাল, কিন্তু জাতীয় বৃক্ষ ‘আমগাছ’। আমগাছ আমজনতার বটে। যা হোক বাঙালি কাঁঠালেও খুশি, আমগাছেও খুশি, আর আমে তো অবশ্যই। আমাদের বড় বড় শহরে অনেক ভাস্কর্য আছে। সেগুলোর বেশির ভাগের বিষয়ে ভঙ্গিতে পরস্পর মিলও আছে। কিন্তু ফলের স্কাল্পচার একটাই। এ রকমটি পৃথিবীর আর কোথাও আছে কি না, জানা নেই। যারা জানেন না, তারা উসখুস করছেন। রাজশাহী শহর থেকে বিমানবন্দরে যেতে নগর ছাড়িয়ে একটা মোড়। সেখানে ৪-৫ তলা দালানের সমান উঁচু একটা আমের ভাস্কর্য আছে। একটা প্লেটের ওপর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুটি আম। পাকা দুটো সিমেন্ট পাথরের আম, কিন্তু রসে টসটসে। হলুদ আর সবুজে যেন কেবলই গাছ থেকে বোঁটা ছিঁড়ে পড়া। এই জন্য ওই মোড়ের নাম হয়েছে ‘আমচত্বর’।

কাঁঠাল

যা হোক, মূল প্রতিপাদ্যে আসা যাক। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও অনেক রকমের ফল আছে। তবে সব দেশের ফল একই রকম নয়। এটি নির্ভর করে ওই দেশের ভূ-প্রকৃতির ওপর। কিছু কিছু ফলে মিল যেমন আছে, তেমন অমিলও ঢের। স্বাদে, আকৃতিতে, গুণে, তারতম্য হয়। তবে যার যার অঞ্চলে প্রিয় হবার ক্ষেত্রে তার তার অঞ্চলের কলহ গুরুত্ব পায়। এর পেছনে শত বছরের ঐতিহ্য, জনপ্রিয়তা, সহজপ্রাপ্যতা এবং পরীক্ষণ গুণাগুণজ্ঞান কাজ করে। তবে প্রকৃতির নিয়মে যে অঞ্চলে যেসব খাদ্য ও অখাদ্য ফল হয়, সেই অঞ্চলের মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর খাদ্যপুষ্টিতে ও ভেষজ ধন্বন্তরিতে সেই সব ফল বিশেষ ভূমিকা রাখে।
কোনো অঞ্চলের মানুষের পুষ্টিদানে, অসুখ-ব্যামোর প্রতিরোধক ও প্রতিষেধনে যেসব ফল যত ভূমিকা রাখে, অন্য অঞ্চলের ফল ঠিক সেই রকমের সমন্বিত ভূমিকা রাখতে পারে না। কারণ, প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে প্রতিবেশগত যে লেনদেনের ভারসাম্য, তার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে সেই অঞ্চলের জনস্বাস্থ্য। দৈহিক গড়ন, অন্যান্য পশু-প্রাণীর টিকে থাকা, মাটি, জল, বৃক্ষ লতাগুল্মের জীবন তাতেই আবর্তিত হয়। সেই কারণে আমাদের দেশীয় যেসব ফল, তা আমাদের শরীর-স্বাস্থ্য ও ভারসাম্যগত পুষ্টি প্রদানে বিশেষ সহযোগী ও যোগ্য। এবং সেই সব ফলের গুণাগুণ বিষয়ে প্রজন্ম পরম্পরায় আমাদের যে হাজার বছরের জ্ঞান এবং পরীক্ষিত অভিজ্ঞতা, তাতে নিজেদের ফলের ওপর আমরা নির্ভর করতে পারব। অন্য সব বিদেশি ফলের ওপর অতটা পারব না। এর অর্থ কিন্তু এ নয় যে, বিদেশি ফলের প্রতি একটা নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করছি। বরং এতে করে এটাই বলতে চাওয়া হচ্ছে যে আগে অতি অবশ্যই দেশি ফল। তারপরে বা সঙ্গে বিদেশি ফল।

লটকন

এখন বিবেচনার বিষয় হলো, আমাদের খাদ্যফল গ্রহণের সেই সমাজ বর্তমানে বিরাজমান কি না? সেই উত্তর ইনিয়েবিনিয়ে দেয়ার কষ্টে না নেমে সহজেই আমরা ফলের বাজারে চলে যেতে পারি। সেটা কেবল সহজই হবে না, একাধারে হাতেনাতে, যাকে বলে সরেজমিন তদন্তও হবে। দেশি আম-জাম, কাঁঠাল-লিচু, কলা-আনারস– এসব মিলবে বটে। কিন্তু বিদেশি ফলমূল যে পরিমাণে মিলবে, তাতে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠবে– বিদেশি ফলেরা দেশি ফলের জায়গাটি অনেকাংশে দখল করে নিয়েছে। এই লক্ষণ আমাদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য কোনো কিছুর জন্যই ধনাত্মক বা ইতিবাচক নয়। কিন্তু এই নেতিবাচক সত্যকে তো অস্বীকারও করা যাচ্ছে না। এবং এই ক্ষতির মধ্যে আমরা ইতোমধ্যেই নিপতিত। এতে করে আমরা কেবল স্বাস্থ্যপুষ্টি ক্ষেত্রে থেকেই বঞ্চিত হচ্ছি না, সাংস্কৃতিক ক্ষতির মাধ্যমে আত্মবিমুখও হয়ে পড়ছি। অর্থাৎ এই পরিণতিতে আমরা নিজেদের ফলের কদরই কেবল ভুলছি না, মূর্খের মতো, না বুঝে, তথাকথিত শৌখিনতার নামে বিদেশি ফলের আদরকে উৎসাহিত করছি। এখন বাজারে গেলে যেসব ফল দেখতে পাবেন, তার বেশির ভাগেরই নাম আপনি জানবেন না। দু-একটার নাম শুনলেও মুখস্থ হবে না। দু-চারটে পরিচিত বিদেশি ফল যে পাবেন না, সে কথা বলছি না। এই রকমের চেনার মধ্যে পাবেন খেজুর, আপেল আর আঙুর। আর যেসব বিদেশি ফল একেবারে আমাদের ফলবাজারে জেঁকে বসেছে, তার মধ্যে (সব নাম তো আমি জানি না) রয়েছে ড্রাগন (সম্ভবত চীনা বা জাপানি), পেয়ার (সাউথ আফ্রিকা), রামব্রুটাল (থাইল্যান্ড), কিউই (সম্ভবত অস্ট্রেলিয়া)। তারপরে আছে আলুবোখারা, মনাক্কা, সেফ ইত্যাদি। ‘ইত্যাদি, মানে আরও আছে, নাম জানি না। তবে আমি-আপনি না জানলেও বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই জানে এবং অনেক দেশি ফলের নাম জানে না।

লিচু

এটা তো শিকড় হারানি আত্মপরিচায়নাশক অনাকাক্সিক্ষত পরিণতি ছাড়া আর কিছুই নয়। কীভাবে? উত্তর খুব সোজা।
আপনি ইদানীংকার ফলে দুর্বল বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের নিয়ে ফলের বাজারে যান, যেসব ফলের নাম আপনি বলতে পারবেন না, ওরা ঠাসঠাস করে বলে দিতে পারবে। পাশাপাশি আপনি এদেরকে বলুন: রসাল, মাকন্দ, মর্তমান, চালতা, পানিফল, পানিয়াল, পিচফল, চুবাহি, ফলসা, বৈঁচি, লটকন, ঢেঁপড়, ট্যাঁড, বেতস, ডেউয়া, কাউফল, তুত, করমচা, আতা, গাব, সাতকরা, বিলম্বি, গোলাপজাম, কাঠবাদাম এগুলো কী? দেখবেন ওরা বলতে পারবে না। একটা দুটো পারবে, সে কথা আলাদা। তাহলে নিজ দেশীয় ফলের পুষ্টি হারানোর সঙ্গে সঙ্গে আত্মপরিচয় খোয়ানো– এই দ্বিমুখী ক্ষতির হাত থেকে জাতিকে, প্রজন্মকে, সংস্কৃতিকে রক্ষা করবে কে? ক্ষতিটা কত বেশি এবং ব্যাপক বিস্তারী তা নিশ্চয়ই এতক্ষণে অনুমান করা যাচ্ছে। তাহলে এখন কী করা? এখন যা কর্তব্য সেটা নির্ণয় করা খুব সোজা। তবে বাস্তবে চর্চা করা অতটা সোজা না হলেও অসম্ভব বা কঠিন নয়। সেই কাজটা শেষ করা যাবে না, শুরু না করলে। শুরুটা তাহলে কী? তেমন কিছুই না। বিদেশি ফলকে বর্জন করতে চলছি না। দেশি ফলের সমাদর বাড়ানোটা দরকার। এবং সেটা করতে গেলে এ প্রজন্মের ছেলেমেয়ের মধ্যে তুলনায় দেশি ফল যে বিদেশি ফলের চেয়ে গুণে-মানে-স্বাদে এবং আমাদের শরীরের চাহিদা পূরণে বেশি জুতসই, সেই কথাটা তাদের বোঝাতে হবে। আর সেটা বোঝাতে গেলে এমন সব কথা আসবে, তার ফলে তাদের দেশপ্রেমও বাড়বে। সেটি হবে আরেকটি উল্লেখযোগ্য অর্জন।

কামরাঙ্গা

এখন আপাতত শেষ বিতর্ক। লেখাটা শুরু করেছিলাম এই কথা দিয়ে: ‘বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়’। মানুষের চারিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য এতে বোঝানো হয়েছে। ফলে ফল হয়ে উঠেছে ‘ফল’ এর চেয়ে বেশি কিছু। তবে বর্তমান সমাজ তো পাল্টে গেছে। কিন্তু ফলের আশ্রয় পাল্টেনি। এখন এভাবেও বলা যেতে পারে, ‘ফল তোমার নাম কী? বৃক্ষে পরিচয়’। মানে ঠিক উল্টো করলেও কথার মাহাত্ম্য কিন্তু একটুও কমে না। গাছের ক্ষেত্রে ফল যেমন একটা আবশ্যিক বিবেচ্য, ফলের ক্ষেত্রে গাছও তেমনই। বিতর্ক একটা আছে। সেটা হলো গাছ আগে, নাকি ফল আগে? উত্তর নানা রকম হতে পারে; গাছই আগে, বা ফলই আগে। যুক্তিও নানা রকম: গাছই যদি না হলো, তাহলে ফল ধরলো কীভাবে। আবার এটাও তো যুক্তি যে ফলের বীজই যদি না হলো, তাহলে গাছ জন্মালো কীভাবে? বেজায় বিপদ। ‘মুরগি আগে না ডিম আগে’র বিতর্কের মতো। কিন্তু যুক্তি দিয়ে বোঝাতে না পারলেও আমার বিবেচনায় গাছই আগে। আচ্ছা, যারা এটা মানবেন না, তাদের পক্ষেই যাই, হলো, না হয় গাছের আগেই ফল হলো। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোন ফল আগে? আমাদের উত্তর: সবার আগে দেশি ফল। তারপরে অন্য কথা।

ছবি: সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top