ফিচার I বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা
চৈত্রের তাপপ্রবাহে ফসলের জমি শুকিয়ে যায়। কিন্তু চাষের জন্য চাই পানি। কারণ, বৃষ্টি হলেই উর্বর হবে জমি। মুন্সিগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামের কৃষকেরা তাই কুলা নামানি বা বৃষ্টি নামানি নামের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। লিখেছেন গাজী মুনছুর আজিজ
নতুন একটি কুলায় সাজানো ধান, দূর্বা ঘাস, বনফুল ও কাকের বাসার কাঠখড়। সাজানো এ কুলা নিয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা গ্রামের একেকটি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, লবণ, শাকসবজি বা টাকাপয়সা। চাল-ডাল দেওয়ার পাশাপাশি বাড়ির লোকজন কুলা নামানির ছেলেমেয়েদের পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেয়। সেই পানিতে ছেলেমেয়েরা আনন্দ করে এবং বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে সৃষ্টিকর্তার কাছে। সংগ্রহ করা চাল-ডাল দিয়ে রান্না করা হয় খিচুড়ি। গ্রামের সবাই মিলে এ খিচুড়ি খায়। এই আয়োজনের নাম স্থানীয়দের ভাষায় কুলা নামানি বা বৃষ্টি নামানি। চৈত্রের তাপপ্রবাহে শুকিয়ে যাওয়া ফসলের জমিনে পানির জন্য মুন্সিগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামের কৃষকেরা এই আয়োজন করেন। এমনই এক আয়োজন দেখার জন্য এবারের চৈত্রের মাঝামাঝি হাজির হই মুন্সিগঞ্জ সদরের টরকী গ্রামে। তৃতীয়বারের মতো নিজের বাড়িতে এই আয়োজন করেছেন স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মী ও শিক্ষক মো. দেলোয়ার হোসেন।
দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘চৈত্রের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে ফসল তোলার পর জমিন থাকে খালি। বিশেষ করে এই অঞ্চলে চৈত্রের মাঝামাঝিতে আলু তোলা হয়ে গেলে জমিন খালি পড়ে থাকে, চৈত্রের তাপপ্রবাহে তা আরও শুকিয়ে যায়। সে জমিতে ফসল বোনা কষ্টকর। উর্বরতা ও নতুন করে ফসল বুনতে পানির প্রয়োজন হয়। এ জন্যই একসময় এই অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে কুলা নামানি বা বৃষ্টি নামানির আয়োজন হতো। মূলত কৃষক পরিবারের সদস্যরা এই আয়োজন করতেন। এই অঞ্চলের কৃষকদের কাছে স্থানীয় লোকজ সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু নানা কারণে বেশ কয়েক দশক ধরে এই আয়োজন আর দেখা যায় না। সে জন্য এবারসহ তিন বছর ধরে নতুনভাবে এই আয়োজন করছি।’
ধান, দূর্বা ঘাস, কাকের বাসার কাঠখড়, বুনোটগরসহ বিভিন্ন বনফুল দিয়ে সাজানো কুলাটি মাথায় নিয়েছে এক কিশোরী। পরনে তার শাড়ি। মুখে মাখানো সাদা চুন ও কালি। এ চুন-কালি মেঘের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কিশোরীর সঙ্গে আরও আছে ১০ থেকে ১২ জন ছেলেমেয়ে; যাদের বয়স ৬ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। তাদের মুখেও সাদা চুন-কালি মাখানো ও গলায় গামছা ঝোলানো। মাথায় তোলার আগে একটি মাটির কলসি বা ঘটির উপর কুলাটি রাখা হয়। এ মাটির ঘটির ভেতর থাকে সোনা-রুপার ভেজানো পানি এবং সেই সঙ্গে চুবানো থাকে পাতাসহ একটি আমের ডাল। স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, আগে মাটির ঘটির বদলে কাঁসার ঘটি ব্যবহার করা হতো। তারপর শুরু হয় এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যাওয়ার পালা।
কুলা নামানি ছেলেমেয়ের সঙ্গে গ্রামের বয়স্ক ব্যক্তিরাও আছেন। তারা চাল-ডাল সংগ্রহের ঝুড়ি বা বড় বোল নিয়ে হাঁটেন। গ্রামের একেক বাড়িতে আসেন আর বাড়ির লোকজন তাদের চাল-ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, শাকসবজি বা লবণ দেন। কেউ কেউ টাকাপয়সাও দেন; সঙ্গে কলসিতে করে আনা পানি ঢালেন কুলা বহনকারী কিশোরীর মাথায়। এই অবস্থায় কিশোরী কুলা নিয়ে ঘুরতে থাকলে পানি ছড়িয়ে পড়ে উঠানজুড়ে। সেই পানিতে কুলা নামানির দল ভিজে ভিজে আনন্দ করে আর সৃষ্টিকর্তার কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা করে; সেই সঙ্গে স্থানীয় ভাষায় ধরে বৃষ্টির গান। যেমন : আল্লাজিরা, তেওল্লাজিরা, বাঁশপাতার ভাই, এমন বরণ বইরা যাবি ভিজ্জা বাড়ি যাই। আউল্লারে ভাই, জাউল্লারে ভাই, কচুক্ষেতে আডু পানি গড়াগড়ি বাই। ও ছেড়ি ধান তোল, ধান তোল, মেঘে ভিজ্জা যায়।
এভাবে বেশ কয়েকটি বাড়ি ঘুরে তারা সংগ্রহ করে চাল-ডাল, লবণ বা শাকসবজি। নামানি শুরু হয়েছে দেলোয়ার হোসেনের বাড়ি থেকে, আবার শেষও হয়েছে সেখানে এসেই। তারপর সংগ্রহ করা চাল-ডাল ও শাকসবজি দিয়ে খিচুড়ি রান্নার জন্য চুলায় চড়ানো হলো। রান্নার দায়িত্ব নিয়েছেন বাড়ির বয়স্ক নারী-পুরুষেরা। রান্নার সময়ও চলে বৃষ্টির গান।
মাঠপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ছোটবেলায় আমাদের গ্রামগুলোতে চৈত্রের মাঝামাঝি সময়ে বৃষ্টির জন্য কুলা নামানি বা বৃষ্টি নামানির আয়োজন হতে দেখেছি। এটা এখানকার কৃষকদের লোকজ সংস্কৃতি। এতে বৃষ্টি নামুক বা না নামুক, গ্রামের কৃষকেরা এই আয়োজন করে আনন্দ পেতেন। পানির মাধ্যমেই তারা ফসল ফলান, তাই কৃষকেরই তো পানির প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। সেই পানির জন্য গ্রামের কৃষকদের এই আয়োজন। তবে ৫ বা ৬ দশক ধরে গ্রামের কোথাও এটা চোখে পড়েনি। নতুন করে এটা হওয়ায় এ সংস্কৃতি আবার জেগে উঠবে বলে মনে করি।
খিচুড়ি রান্না হতেই দেলোয়ারের বাড়িতে জড়ো হয়েছে গ্রামের নানা বয়সী নারী-পুরুষ। তারপর শুরু হয় খিচুড়ি খাওয়ার পর্ব। বয়স্ক এক পুুরুষ খিচুড়ি বেড়ে দেন। নিজের বাসা থেকে আনা প্লেটে নিয়ে খান।
ছবি : লেখক