ফিচার I মাংস উপাখ্যান
উপমহাদেশে মাংস ভক্ষণের উপলক্ষের অভাব নেই। এর ইতিহাস চমকপ্রদ। উভয় বাংলায় আছে বিচিত্র পলপ্রীতি। তা নিয়ে রচিত হয়েছে সাহিত্য। রন্ধনসাহিত্যও। এসবে আলো ফেলেছেন পাঞ্চালী দত্ত
মাংস শুধু রসনা তৃপ্তির জন্য নয়, সৃষ্টিকর্তার কাছে পশু বলিদানেরও রয়েছে যথার্থ কারণ। তাই আমরা বেদে দেখতে পাই, যজ্ঞে পশু বলিদানের মাধ্যমে ত্যাগের বিষয়কে তুলে ধরা হয়েছে। দুর্লভ মনুষ্য জন্মে কর্ম ও ত্যাগের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, যা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে আমাদের সচেতনতার জন্য। ভাগবত গীতায় যেমন বলা হয়েছে-
অন্নাদ্ ভবন্তি ভূতানি পর্জ্জন্যাদন্নসম্ভবঃ।
যজ্ঞাদ্ ভবতি পর্জ্জন্যো যজ্ঞঃ কর্ম্মসমুদ্ভবঃ॥
অর্থাৎ এই প্রাণীর শরীর অন্ন হইতে উৎপন্ন হয়; অন্ন (শস্য) জন্মে মেঘ হইতে; মেঘ জন্মে যজ্ঞ ও কর্মের মাধ্যমে এবং দেবতাগণ যজ্ঞ দ্বারা সংবর্ধিত হইয়া বৃষ্টি প্রদান করেন।
কোরবানির ঈদে যেমন পশু কোরবানির পর সবাইকে মাংস বিতরণ করা হয়, ঠিক তেমনি হিন্দুদেরও বিভিন্ন পূজায় বলির অনুশাসন রয়েছে। সেই পবিত্র মাংস বা ‘বৃথা মাংস’ ভক্ষণের রয়েছে নানা রীতিনীতি।
ভারতবর্ষে যদিও সংখ্যায় বেশি নিরামিষভোজী, তবু ঐতিহ্য ও খানাপিনার জগতে আমিষাশীরাও কোনো অংশে কম নয়। প্রাচীন রাজপরিবারে যেসব রাজকীয় ভোজন ছিল, সেগুলোর মধ্যে মাংস ছিল আবশ্যিক। বিশেষ কিছু রান্না ছিল, যেগুলো করার আগে সেই রান্নায় ব্যবহৃত পাখি কিংবা পশুটিকে নানা প্রক্রিয়ায় বা উপায়ে খাবার-দাবার খাইয়ে সুস্বাদু করে তোলা হতো। তারপর বিভিন্ন মসলার সহযোগে রান্না করে পরিবেশন করা হতো সেই সব উপাদেয় খাদ্য। যেমন মুর্শিদাবাদের নবাবদের মুর্গ ইয়াখনি। আটার মধ্যে বিষ মিশিয়ে ছোট ছোট গোলা করে খাওয়ানো হতো সদ্য যুবক একটি মোরগকে। মোরগটির মৃত্যু হওয়ামাত্রই সেটির শরীর থেকে সামান্য পরিমাণ মাংস নিয়ে আবার আটায় পুরে খাওয়ানো হতো আরেকটি মোরগকে। ঘণ্টা দুয়েক পর তার মৃত্যু হলে বেছে নেওয়া হতো সদ্য যৌবনে পা দেওয়া আরও কয়েকটি মোরগ। শেষে এই বিষ খেয়ে যে মোরগের শুধু পালক খসে পড়ত, তাকেই উপযুক্ত খাবার হিসেবে বাছা হতো ইয়াখনির জন্য। এভাবেই ভোজ নিয়ে আরও অনেক গল্প রয়েছে রাজপরিবারদের নিয়ে।
তবে বাঙালি ব্রাহ্মণ ব্যতিরেকে ভারতবর্ষের বাকি ব্রাহ্মণরা পুরোপুরি নিরামিষভোজী। কারণ, পূজা-আর্চা ছিল তাদের প্রধান জীবিকা। তাই শরীরকে শান্ত রাখতে ধ্যান, জপ-তপ একাগ্রতা ও অহিংসার পথে চলতে নিরামিষ খাদ্যকেই বেছে নিয়েছিলেন তারা। এবং এই প্রথা এখনো রয়েছে। অবশ্য সিন্ধু সভ্যতায় ফিরে গেলে আমরা দেখতে পাই যে মাংস ছিল তখনকার যুগে একটি প্রধান আহার। গৃহপালিত পশু, বাইসন, ভেড়া, ছাগল, কচ্ছপ, খরগোশ, শজারু, গোসাপ, হরিণ, শূকর ইত্যাদি নানা রকম মাংসে অভ্যস্ত ছিল তারা। বেদে আড়াই শর বেশি পশুর নাম উল্লেখিত রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে পঞ্চাশ রকমের পশু ঈশ্বরের কাছে বলিদানের জন্য ছিল আদর্শ। ঋগবেদে বলিদানের জন্য যেসব পশুর নাম রয়েছে, সেগুলো হলো ঘোড়া, মোষ, ভেড়া, ছাগল। সাধারণত রাজারা যজ্ঞে বলি দিতেন ঘোড়া। বিভিন্ন বৈদিক দেবতাদেরও তাদের পছন্দের পশু উৎসর্গ করা হতো। যেমন অগ্নির জন্য মোষ এবং বন্ধ্যা গাভি, রুদ্রের জন্য লাল গাভি, ইন্দ্রের ষাঁড় ইত্যাদি। এ ছাড়া বিশেষ অতিথিদের সম্মান জানানো হতো হৃষ্টপুষ্ট গাভি বা ছাগল বলিদানের মাধ্যমে। সে সময় মাংস সাধারণত রোস্ট অথবা চালের সঙ্গে সেদ্ধ করে খাওয়া হতো। এ ছাড়া মাংসের কিছু রন্ধনপ্রণালিতে ব্যবহৃত হয়েছে ফলের রস, লবঙ্গ, জিরা। উল্লেখ রয়েছে, মাংসের কিমার সঙ্গে ভাত খাওয়া হতো। রাজা-মহারাজাদের চড়–ইভাতির সময় শিকার করে আনা হরিণের মাংস, নানা রকম পাখির মাংসে ঘি, সৈন্ধব লবণ, গোলমরিচ, হিঙ, ফলের রস মেখে রোস্ট করে খাওয়ার কথাও জানা যায়। গার্নিশিংয়ের জন্য সাজিয়ে দেওয়া হতো বেদানা, লেবু এবং নানা রকম কাঁচা সবজি, যা আজও আমরা অনুসরণ করি।
কিন্তু মৌর্য সাম্রাজ্যকালে হিন্দুরা পশু বলিদান এবং মাংস ভক্ষণে অনীহা প্রকাশ করে। তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে, এই দুটি ত্যাগ না করলে মোক্ষপ্রাপ্তির দরজা চিরতরে ঘুচে যাবে। গুপ্তযুগে গরুকে ঈশ্বররূপে পূজা করতে শুরু করা হয়। কারণ, কৃষিকাজে গরুর অবদানের কথা ভেবে গোমাংস ভক্ষণ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। উত্তর ভারতে মুসলমানদের আগমনের পর শূকরের মাংস খাওয়া অনেকাংশেই কমে যায়। তারপর বহিরাগতদের আগমন, বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, ঔপনিবেশিকতার বিস্তার ইত্যাদির মিশেলে ভারতবর্ষে খাদ্যাভ্যাসে আসে প্রভূত পরিবর্তন।
আর বাঙালি! নদীমাতৃক এলাকায় বসবাসকারী এরা যেমন মৎস্যপ্রেমী, ঠিক তেমনি আসক্ত মাংসে। তাই এখনো প্রতি ছুটির দিনে ধোঁয়া ওঠা ভাতের সঙ্গে দুপুরবেলার পাতে মাংস না থাকলে ছুটির আমেজটাই ফিকে হয়ে যায়। যা হোক, সপ্তম-অষ্টম থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত বাঙালির কয়েকটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থে মাংস ভোজন সম্পর্কে রচিত কিছু পঙ্ক্তি তুলে ধরছি। চর্যাপদে শিকারের বর্ণনায় মাংসের কথা এসেছে প্রতীকী ব্যঞ্জনায়:
আপনা মাংসে হরিণা বৈরী
খনহ ন ছাড়তা ভুসুকু অহেরী।
অর্থাৎ নিজের মাংসে হরিণ নিজেরই শত্রু। মনসামঙ্গল কাব্যে কবি বিজয় গুপ্তের রচনায় বর্ণিত হয়েছে বরিশাল অঞ্চলের লোকজ জীবনের অন্তরঙ্গ ছবি। এ ছাড়া কবি বর্ণনা করেছেন চাঁদ সওদাগর পত্নীর তৈরি উপাদেয় খাদ্যসামগ্রী:
‘মাংসের ব্যঞ্জন রান্ধে হইয়া হরষিত
ধুম নিধুম রান্ধে দিয়া চৈইর ঝাল।
আখিনি পালাহ্ন রান্ধে ঘৃতের মিশাল।’
মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চন্ডীমঙ্গল কাব্যের বহু জায়গায় বিভিন্ন ধরনের খাদ্যের দৃষ্টান্ত মেলে। মৈমনসিংহ গীতিকায় কবি মনসুর এক কৃষক রমণীর প্রগাঢ় প্রেমের কথা লিখেছেন তার প্রেমিকের প্রতীক্ষায় খাদ্য প্রস্তুতির বর্ণনার মাধ্যমে-
‘ভালা ভালা মাছ আর মোরগের ছালুন
আইজ আইব বল্যা রাখে খসমের কারণ।
সতেরো শতকের কবি আবদুল হাকিমের রচনায় নানা ধরনের মাংস-ব্যঞ্জনের বর্ণনা পাই-
‘উট-গাভী মৈষ ভেড়া দুম্বা অজা খাসি
অন্নের সহিত মাংস রান্ধ রাশি রাশি।
গইজ গয়াল ষন্ডা মৃগ কবুতর
খরগোস রাজহংস কুক্কুট কৈতর।’
ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যেও মাংসের গরগরে ঝোলের কথা বলা হয়েছে। যেমন-
‘কবি ছাগ মৃগ মাংসে
ঝার ঝোল রসা।’
বাংলা ভাষার সর্বপ্রথম দুটি রান্নার বই- ১৮৩১ সালে প্রকাশিত বিশ্বেশ্বর তর্কালঙ্কার ভট্টাচার্যের ‘পাক রাজেশ্বর’ ও ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশের ‘ব্যঞ্জন রত্নাকর’। এই দুই পন্ডিতের লেখায় মাংসের কথা উঠে এসেছে বারবার। ‘পাক রাজেশ্বর’-এ প্রলেহ অর্থাৎ কোর্মা তৈরির প্রণালি রয়েছে, যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে নানাবিধ মাংসের কথা। যেমন মেষ, কচ্ছপ, হরিণ, খরগোশ। তারপর তিলের তেল সহযোগে ছাগলের মাথা ও নাড়ির রান্নাকৌশলের কথা বলা হয়েছে।
গৌরীশঙ্করের ‘ব্যঞ্জন রত্নাকর’-এ পাবেন মাংস পরিষ্কারের কথা-
‘লোমসহ চর্ম্ম দূর করণের পর উদরসহ মূত্র পুরীষ ও পিত্তস্থলী এবং নাড়ি ইত্যাদি ত্যাগ করিবে, পরে ওষ্ঠ দন্ড চক্ষূ কর্ণ ক্ষুর ও চরণ আদি ত্যাগ করিবে।’ নাড়ি রন্ধনে নিজেকে আরও পটু করে তুলতে চাইলে তাতে যোগ করুন ঘি, গরমমসলা, আদা, পেঁয়াজের ফোড়ন। রয়েছে করলা বা বেগুনের শুক্ত প্রলেহ, মাংস দিয়ে লাউ অথবা ঝিঙে। শসা বা কাঁকুড়ের শাঁস বের করে তাতে মাংসের পুর ভরে যে কাবাবটির কথা বলা হয়েছে, সেটাও অত্যন্ত সুস্বাদু।
মৎস্যপ্রিয় বাঙালির হেঁশেলে তাই সমান জনপ্রিয় মাংসও। না হলে বয়স বেড়ে যাওয়ার পর শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় সাধে কি আর বলেছিলেন, ‘ওরা আমাকে আর মাংস খেতে দেয় না, তাহলে বেঁচে থাকার কী মানে…।’
তথ্যসূত্র: সাহিত্য পত্রিকা, আনন্দবাজার পত্রিকা
ইলাস্ট্রেশন: দিদারুল দিপু