ফিচার I অষ্টগ্রামের পনির
বাংলাদেশের কত কিছুই যে রয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। অষ্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী পনির এর একটি। সম্প্রতি কিশোরগঞ্জের সেই হাওর এলাকা ঘুরে এসে অষ্টগ্রাম পনিরের অনবদ্য ইতিহাস আর হৃদয়গ্রাহী বর্তমানের অনিন্দ্য চিত্র তুলে ধরেছেন নাসরুল আনোয়ার
দুধ মন্থন করে তৈরি একপ্রকার উপাদেয় খাবার পনির। দুগ্ধজাত অন্যান্য খাবার যেমন কাঁচাগোল্লা, ক্ষীর, সন্দেশ, বরফি, রসগোল্লা ইত্যাদি তৈরি করা হয় দুধকে ছানায় রূপান্তর করে। অনেকটা একই প্রক্রিয়ায় তৈরি হলেও পনিরের স্বাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। পনির দানাদার। এর স্বাদ ‘জিভে জল আসা’ নোনতা। মিষ্টান্ন না হলেও কী এক আশ্চর্য ঘ্রাণ ও স্বাদ পনিরের দিকে আমাদের মন টেনে নেয় এবং পরিতৃপ্ত করে।
একসময় বিশেষ করে হাওরবাসীর সকালের নাশতার মেনুতে পনির থাকত। সে সময় সম্পন্ন কৃষকের গোয়ালে অগুনতি মহিষ ছিল। হাওরজুড়ে চাষাবাদের জন্য তারা মহিষ লালন-পালন করতেন। একরের পর একর পতিত জমি ব্যবহৃত হতো গো-চারণ ভূমি হিসেবে। তাজা ঘাস খেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হতো মহিষের দল। ওই সব মহিষের দুধও ছিল ঘন ননিতে পূর্ণ। সেই দুধ থেকে তৈরি হতো উৎকৃষ্ট পনির। আর বাড়ির গেরস্ত থেকে শুরু করে মাঠের ক্ষেতমজুরও পনির খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলত।
একদা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অতিথি আপ্যায়নেও পনিরের জুড়ি ছিল না। পনির তো ঘিয়ের স্বজন! বাড়িতে আসা মেহমানদের গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করা হতো কুচি কুচি করে কাটা পনির। আর ভাপ ওঠা চিতই পিঠার ওপরভাগে পনিরের টুকরো দিয়ে দিলে তো কথাই নেই! শীতের সকালের খাবার হিসেবে পনির যেন অমৃত! পনির এভাবেই হাওরের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে।
অবশ্য এ প্রজন্মের সঙ্গে পনিরের পরিচয় অন্যভাবে। আজকাল পনির দেওয়া পিৎজা, বার্গার, বি¯ু‹ট পাওয়া যায়। সমুচা, পরাটা বা স্যালাডেও পনির দেওয়া হয়। ঢাকার নামিদামি বেকারি ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় সুস্বাদু এ খাবার সীমাবদ্ধ। তবে ঢাকার বহু এলাকায় পনির পাওয়া যায়। বিশেষ করে পুরান ঢাকার অনেক স্থানেই রাস্তার মোড়ে পনির বিক্রি হয়। তা ছাড়া ধানমন্ডি, গুলশান এমনকি মোহাম্মদপুর, মিরপুর বা উত্তরায়ও পনির মেলে। অলিগলিতেও অনেকে ফেরি করে পনির বিক্রি করেন।
যারা শুনেছেন, ফেরিওয়ালারা কেবল ‘পনির’ বলে হাঁক দেন না; বলেন, ‘রাখবাইন অষ্টগ্রামের পনিরররররর’! ফেরিওয়ালা ছাড়াও ঢাকার এখানে-ওখানে মোড়ে মোড়ের পনির বিক্রেতার মুখে অষ্টগ্রামের পনিরের কথাই শোনা যায়। অভিজাত বেকারি বা হোটেল-রেস্তোরাঁয় পরিবেশনকারীর মুখ থেকে অষ্টগ্রামের নাম ভেসে আসে। এখন দেশের অনেক জায়গায় গাভির দুধের পনির তৈরি হয়।
পনিরের সঙ্গে অষ্টগ্রামের সখ্য সুপ্রাচীন বলেই ধরে নেওয়া হয়। জনশ্রুতি আছে, কেবল কিশোরগঞ্জ, সিলেট বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে নয়, ঢাকাসহ সারা দেশের তৎকালীন নবাব ও জমিদার পরিবারগুলোতে পনিরের কদর ছিল। দিল্লির মোগল বাদশাহরা অষ্টগ্রামের পনির পছন্দ করতেন। এ পনিরের চাহিদা ছিল ব্রিটিশ রাজপরিবারেও। অষ্টগ্রাম কিশোরগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত হাওরে অবস্থিত একটি উপজেলা। আর এসব কারণেই পনির এখন কিশোরগঞ্জ জেলার অনন্য পরিচায়ক বা ব্র্যান্ড!
ঠিক কবে থেকে এ জনপদে অতি সুস্বাদু পনিরের উৎপাদন ও বিপণন শুরু হয়েছিল, তার সঠিক তথ্য উদ্ধার করা যায় না। প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে যত দূর জানা যায়, এ দেশে আসা পাঠান-মোগলদের একটি দল অষ্টগ্রামের কাস্তুলে ছাউনি গাড়ে। সে তিন শ থেকে সাড়ে তিন শ বছর আগের কথা তো বটে! পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে অষ্টগ্রামের হাবিলি বাড়ি, বাজিতপুরের ভাগলপুর দেওয়ানবাড়ি, ইটনার দেওয়ানবাড়ি ও করিমগঞ্জের জঙ্গলবাড়িতে মোগলদের বসতি গড়ে ওঠে। এখনো এই অঞ্চলের বহু স্থানে তাদের বংশধর বা উত্তরসূরিরা আছেন।
ওই সময় কিশোরগঞ্জের সুপ্রাচীন থানা অষ্টগ্রাম ও এর আশপাশের বড় হাওরে স্থানীয় কৃষকেরা মহিষ চরাতেন। ছিল গরু-মহিষের খামারও। তাই প্রচুর পরিমাণে দুধের জোগান ছিল। একদিন কাস্তুলের ছাউনির কোনো এক মোগল পাঠান বড় হাওরে গিয়ে গরু-মহিষের পাল দেখে বিস্মিত হন। পাশাপাশি দুধের বিপুল উৎপাদন চোখে পড়ে তাঁর। কথিত আছে, ওই সময় স্থানীয়দের দুগ্ধজাত খাদ্যদ্রব্য তৈরি করতে দেখে তিনিও তাতে হাত লাগান। এভাবে ওই সেনাসদস্য একদিন নিজের অজ্ঞাতেই দুধের ছানা দিয়ে একধরনের নতুন খাবার তৈরি করে বসেন। পরে এর নাম রাখা হয় ‘পনির’। আবার অনেকে মনে করেন, এ খাবারের নামকরণ হয়েছে মোগলদের উত্তরসূরি কোনো এক দেওয়ান ‘পনির খাঁ’র নামানুসারে। দত্ত বংশীয় অভিজাত শ্রেণির এ দেশে আগমনের সঙ্গে পনিরের উৎপাদনের যোগসূত্র থাকতে পারে বলেও অনেকের ধারণা।
হাওরের বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিদের কাছ থেকে আরও জানা যায়, শতাব্দীকাল আগে হাওরে বিচরণ করা মহিষের ওলান থেকে এত দুধ পাওয়া যেত যে, খেয়ে বা হাটে বিক্রি করে তা শেষ করা যেত না। তাই বাধ্য হয়েই মণ মণ দুধ ফেলে দিতে হতো। হাওরের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে প্রচলিত আছে, ‘বর্ষায় নাও, হেমন্তে পাও’। কেবল যাতায়াতের দুর্ভোগের কারণে সে সময়ে উদ্বৃত্ত দুধ বাজারজাত করতে বাইরের এলাকায় পাঠানো যেত না। সে কারণেই হয়তো পনির তৈরির মাধ্যমে দুধ সংরক্ষণের বিষয়টি কারও মাথায় আসে।
একদা পনিরের ব্যবসা করতেন, এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেড় দশক আগেও হাওরে ছিল প্রচুর গো-চারণ ভূমি। এলাকার কৃষকদের শত শত গরু ও মহিষ চরতো। ওই সময়টাতে বিশেষ করে অষ্টগ্রামের অন্তত পঞ্চাশ ঘর পনির তৈরির কাজ করতো। দেড়-দুই শ মানুষ এ কাজে সরাসরি যুক্ত ছিল। আর পনির নিতে বাইরের এলাকার পাইকারেরাও সে সময় অষ্টগ্রামে ভিড় জমাতো। দুধের প্রাচুর্যের কারণে সিলেট সদর, সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ, মৌলভীবাজারের কুলাউড়াসহ এই অঞ্চলের বহু এলাকায় পনির তৈরি হতো। অষ্টগ্রামের পনির কারবারিরাই সেসব এলাকায় অবস্থান করে পনির বানাতেন।
দুধের চাহিদা বেশি থাকায় দাদনে ময়মনসিংহের ত্রিশাল এবং নেত্রকোনা, গাজীপুর প্রভৃতি অঞ্চল থেকে গরু ও মহিষের পাল নিয়ে আসা হতো। একেকজন ‘দাদনদার’ ১০০-২০০ গরু ও মহিষ নিয়ে বছরের পাঁচ-ছয় মাস হাওরে এসে পড়ে থাকতো। গো-চারণ মৌসুম শুরু হতো পৌষ মাস থেকে। শীতকাল বলে এ সময়টাতে হাওরে প্রচুর পরিমাণে ঘাস জন্মাতো। ‘চাইল্যা’ ঘাস ছিল অধিক পুষ্টিমানসমৃদ্ধ। অবাধে ঘাস খাওয়ার সুযোগ পেত বলে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠত গবাদিপশু।
আর বেশি উৎপাদিত হওয়ায় দুধও পাওয়া যেত সস্তায়। ১৫-১৬ টাকা ছিল দুধের লিটার। এ সুযোগে তখন অষ্টগ্রামে পনির তৈরির ধুম পড়েছিল। পনিরও বিক্রি হতো ১৫০-১৬০ টাকা কেজিতে। একপর্যায়ে কৃষি চাষাবাদে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। হালের জায়গা দখল করে ট্রাক্টর। কৃষিতে গবেষণায় ব্যাপক সাফল্যের সূত্র ধরে ধানের ফলনও বাড়ে আশানুরূপ। তাই নতুন করে ফসল চাষাবাদে ঝুঁকে পড়ে হাওরের কৃষক। ফলে পতিত জমি আর গবাদিপশু কমে যেতে থাকে। গরু-মহিষের দাদনদারেরা হাত গোটায়। এতে করে পনিরের প্রধান উপাদান দুধের ঘাটতি দেখা দেয়। এভাবে পনিরের ব্যবসা ধীরে ধীরে ম্লান হতে থাকে।
অবশ্য টানা কয়েক বছর ধরে অকালবন্যায় হাওরাঞ্চলে ফসলহানি ঘটছে। সর্বস্বান্ত হয়ে কৃষকদের একটা বড় অংশ দিনে দিনে শহরে পাড়ি জমিয়েছে। জীবিকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে যাওয়া কৃষকেরা বাধ্য হয়ে তাদের সম্বল গবাদিপশুও বিক্রি করে দিয়েছে। ফলে পনিরের মূল কাঁচামাল দুধের উৎসের ঘাটতিও এখন চরমে। আর দুধের দামও নাগালের বাইরে চলে গেছে। এসব কারণে সাম্প্রতিক সময়ে পনির ব্যবসা রয়েছে প্রান্তিক অবস্থানে।
সুনামগঞ্জের হাওরের আলীপুর বাজারে পনিরের কারখানা ছিল পূর্ব অষ্টগ্রামের মো. কাসেদ মিয়ার। প্রতিদিন তাঁর কারখানায় ৪০-৪৫ কেজি পনির উৎপাদিত হতো। ঢাকা, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলায় তিনি উৎপাদিত পনির সরবরাহ করতেন। বললেন, গরু-মহিষের দাদনদারেরা হাওরে আসা বন্ধ করে দেয়। ফলে দুধের ভীষণ ঘাটতি দেখা দেয়। লোকসানের একপর্যায়ে পনির তৈরি বন্ধ করে দিয়ে তিনি মৎস্য উৎপাদনে চলে যান। এই ব্যবসায়ী এখন পূর্ব অষ্টগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান।
অষ্টগ্রামে এখনো যারা পনির তৈরি করছেন তাদের মধ্যে অষ্টগ্রাম সদরের খানঠাকুর দীঘিরপাড় চৌধুরীবাড়ির মফিজ চৌধুরী একজন। ৩৫ বছর ধরে তিনি পনির তৈরি করছেন। তাঁরও আগে শ^শুর রিয়াত আলী পনির বানাতেন। এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করছেন তিনি। ষাটোর্ধ্ব এ কারিগর পনির তৈরির কাজে ব্যস্ত। বঙ্গভবনে পাঠানোর জন্য নাকি চার কেজি ওজনের পনিরের অর্ডার পেয়েছেন। জানালেন, চার কেজি পনিরের জন্য বাজার থেকে ৫০ টাকা দরে ৪২ লিটার দুধ কিনেছেন। আবার অর্ডার পেলে বানাবেন।
পনির তৈরির নিয়মবিদ্যাও বড় অদ্ভুত। বড় গামলায় পরিমাণমতো দুধ ঢালা হয়। এরপর কাঁচা দুধেই ছানার পানি বা মাওয়া ঢালা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুধ জমাট বেঁধে ঘন হয়ে পড়ে। তখন হাত দিয়ে এবং একপর্যায়ে ছোরার মতো তীক্ষè বাঁশের চিলতে দিয়ে জমাট বাঁধা ছানা কেটে কুচি কুচি করে দানার মতো করা হয়। এরপর সেই দানা আস্তে আস্তে গামলা থেকে তুলে বাঁশের টুকরিতে রাখা হয়। এ সময় টুকরি থেকেও জলীয় অংশ চুইয়ে পড়তে থাকে। পানি ছাঁকা শেষ হতে না-হতেই এর ভেতর ছোট ছোট ছিদ্র করে লবণ প্রবেশ করানো হয়। এরপর চাপ প্রয়োগ করে পনিরের চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার পর ইচ্ছেমতো সংরক্ষণ করে রাখা হয়।
কারিগরেরা জানান, এখন আর মহিষ নয়; গাভির দুধই ভরসা। আর এ সময়ে খড়-ভুসির দুধে ননি কম। তাই পনির কম হয়। চল্লিশ লিটার দুধে এখন চার কেজি পনির হতে পারে। পৌষ থেকে চৈত্র- এ চার মাস ঘাসের দুধ পাওয়া যায়। তখন পনির তৈরির ধুম পড়ে। আর চল্লিশ লিটার দুধে পাঁচ কেজি পর্যন্ত পনির হয়। তখন প্রতিদিনই ছয়-সাত কেজি পনির বানান। তাঁর মতে, খোলাবাজারের দুধে অষ্টগ্রামের পনির শিল্প বাঁচবে না। পনিরের ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারিভাবে দুধের খামার গড়া দরকার। এতে দুধের উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি দাম কমে আসবে আর পনিরের প্রসারও ঘটবে।
তবে পনিরের ‘প্রসার’ অন্যত্র থেমে নেই। নানা বাস্তবতায় অষ্টগ্রামের পনির মুখ থুবড়ে পড়লেও পনিরের চাহিদা না কমে বরং বেড়েই চলেছে। দেশের বহু এলাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পনির তৈরি হচ্ছে। কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরেই একটি প্রতিষ্ঠান পনির তৈরি করে বিদেশে রপ্তানি করছে। এ ছাড়া বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, ফরিদপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও এমনকি ঢাকার কাছাকাছি জেলা মানিকগঞ্জেও তৈরি হচ্ছে পনির।
অষ্টগ্রামের শতাধিক পরিবারের জীবিকা চলছে ঢাকায় পনির ব্যবসা করে। এমন কয়েকজন পনির কারবারির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সিরাজগঞ্জ ও বগুড়ার চরে আগে প্রচুর পরিমাণে দুধ পাওয়া যেত। অষ্টগ্রামের বেশ কয়েকজন কারিগর ওই সব এলাকায় গিয়ে পনির বানাতেন। এখন সেখানেও দুধে ঘাটতি থাকায় তারা কারখানা গুটিয়ে চলে এসেছেন। আট-দশটি জেলা থেকে উৎপাদিত পনির ঢাকায় আসছে। তবে ভোক্তাদের কাছে অষ্টগ্রামের পনিরের চাহিদা বেশি।
অষ্টগ্রামের রেজাউল করিম ঢাকায় পনির ব্যবসা করছেন অনেক দিন। জানালেন, ঢাকার শ খানেক স্থানে এখন পনির পাওয়া যায়। বিভিন্ন শপিং মল, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা সুপারমার্কেটের পাশে জনকোলাহলে পনির নিয়ে বসেন তারা। ফেরি করেও অনেকে পনির বেচেন। এই পনির ব্যবসায়ী জানান, পাইকারি বাজারে অন্যান্য এলাকার পনিরের চেয়ে অষ্টগ্রামের পনিরের দাম প্রতি কেজি এখনো প্রায় ১০০ টাকা বেশি। ঢাকায় গড়ে প্রতিদিন ৫০-৬০ মণ পনির কেনাবেচা হয়।
বঙ্গভবনে এখন পনিরের বিস্তর কদর। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদই এর কারণ। তিনি ‘হাওরের মানুষ’। তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা বলেন, ছোটবেলা থেকেই পনির তাঁর অতি পছন্দের খাবার। দৈনন্দিন খাদ্যতালিকা ও অতিথি আপ্যায়নে পনির রাখা হয়। আর রাষ্ট্রপতির জন্য বিশেষ সতর্কতায় পনির তৈরি করা হয়। নিশান নামে অষ্টগ্রামের এক পনিরের কারিগর জানালেন, রাষ্ট্রপতি একবার অষ্টগ্রামে এলে এসএসএফের তত্ত্বাবধানে তিনি পনির তৈরি করে দেন। বঙ্গভবনে ফেরার সময় রাষ্ট্রপতি পনির নিয়ে যান। বঙ্গভবন থেকে সেই পনির গণভবনেও যায়!
অষ্টগ্রামের পনিরের এত কদরের কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, এ পনিরে কোনো ভেজাল করা হয় না। খাঁটি দুধ দিয়ে এখানে পনির তৈরি করা হয়। এসব তথ্য স্থানীয় পনির কারিগরদের। তারা জানান, তরতাজা দুধে তৈরি পনিরের ঘ্রাণই আলাদা। দূর থেকেই তা টের পাওয়া যায়। তাই টাটকা পনিরের স্বাদ অন্য রকম। তা ছাড়া অষ্টগ্রামে সকালবেলা দুধ সংগ্রহ করে সকালেই পনির বানিয়ে ফেলা হয়। যেখানে অনেকে দুই দফায় দুধ সংগ্রহ করে রাতের বেলা পনির বানায়। ফলে স্বাদেরও তারতম্য ঘটে। মোদ্দা কথা, পনিরের উৎপত্তিস্থল যে হাওরে, তার আলাদা বৈশিষ্ট্য তো থাকবেই! অষ্টগ্রামের মজাদার পনিরের মূলমন্ত্র এখানেই।
অত্যন্ত উপাদেয় এ পনির মূলত হাওরের অন্ত্যজ শ্রেণির হাতে তৈরি এক শিল্প। একসময় সাধারণের নাগালেই ছিল তা। এখন এ মুখরোচক খাবার যেন দুষ্প্রাপ্যই ঠেকছে। লোকসান গুনে গুনে এবং নানা বাস্তবতার শিকার হয়ে পিছিয়ে পড়েছে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা। এ পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় ঝুঁকেছেন অনেকেই। তাই বলা যায়, পনিরের সূতিকাগার অষ্টগ্রামের পনিরের এখন দুর্দিনই চলছে। তবু, প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষের হাতে গড়া এ শিল্প অভিজাত শ্রেণির কদর পেয়েছে; তাই-বা কম কিসে!
লেখক: দৈনিক কালের কণ্ঠের স্টাফ রিপোর্টার
ছবি: লেখক