বিশেষ ফিচার I বিপন্ন গুরুসদয় মিউজিয়াম
পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় অবস্থিত অবিভক্ত বাংলার বহু পুরাতাত্ত্বিক ও লোকশিল্পের প্রাচীন নিদর্শনের এই সংগ্রহশালা বন্ধ হওয়ার পথে। লিখেছেন অতনু সিংহ
খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে শুরু করে খ্রিস্টের জন্ম-পরবর্তী উনিশ শতাব্দী অবধি বাংলার প্রত্ন-পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং বাংলার লোকশিল্পের ব্যাপক এক সংগ্রহশালা পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় গুরুসদয় মিউজিয়াম। আজ এটি বন্ধ হওয়ার মুখে।
অভিযোগ, ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে ভারতের রাজনৈতিক পালাবদলের পর থেকেই, দিল্লির শাসকের হিন্দি-হিন্দুত্ব-হিন্দুস্তান মতাদর্শ অহিন্দি বিভিন্ন জাতিসত্তার ওপর আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। কেবল রাজনৈতিক নয়, প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও দিল্লির সরকারের বিরুদ্ধে রয়েছে এই অভিযোগ। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গেও বাঙালি জাতিসত্তার ওপর ‘হিন্দি-হিন্দুত্ব-হিন্দুস্তান’ আধিপত্যবাদ কায়েমের প্রবল চেষ্টা চলছে। এই রাজনৈতিক ডামাডোলেই প্রাচীন বাংলার পুরাতাত্ত্বিক ও লোকশিল্পের সংগ্রহশালার ভবিষ্যৎ থমকে গেছে।
মিউজিয়ামটির পরিচালনায় আর্থিক দায়দায়িত্ব ছিল ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রকের অধীন হস্তশিল্প দপ্তরের। কিন্তু সেজন্য প্রতিষ্ঠানের পরিচালন সমিতির সঙ্গে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের যে চুক্তি ছিল, তা বাতিল করার বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার নিজেদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে ওই সংস্থায় একটি চিঠি পাঠায় ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে। সেই চিঠির ভিত্তিতে ওই সংস্থা পরিচালনার আর্থিক ব্যয়ভার থেকে হাত গুটিয়ে নেয় দিল্লির সরকার। শুধু তা-ই নয়, এই সংগ্রহশালার সঙ্গে যুক্ত প্রায় ১৫ জন কর্মচারীর বেতনও বন্ধ হয়ে যায়। বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে ৬ মাস ধরে কোনো বেতন ছাড়াই এই প্রতিষ্ঠান চালিয়ে যাচ্ছেন সেখানকার কর্মচারীরা।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণে যেকোনো মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যেতে পারে প্রতিষ্ঠানটি। তবে শেষ চেষ্টা হিসেবে এর পরিচালনায় যুক্ত কর্তাব্যক্তিরা আইনি লড়াইয়ের পথে যেতে চাইছেন। প্রতিষ্ঠানটি বাঁচিয়ে রাখার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের সঙ্গেও।
কী কী রয়েছে এই সংগ্রহশালায়
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে বাংলার তাম্রলিপ্তের টেরাকোটা ও চীনামাটির তৈরি দৈনন্দিন ব্যবহারের নানা জিনিসপত্র, যেমন- কলস, সরা, প্রদীপ, ঘটি ইত্যাদি রয়েছে এই সংগ্রহশালায়। রয়েছে পাল ও সেন যুগ থেকে শুরু করে আঠারো শতক অবধি বাংলার নানা প্রান্ত থেকে সংগৃহীত বহু ভাস্কর্য। ঢাকা, বরিশাল, বীরভূম প্রভৃতি জেলা থেকে সংগৃহীত পাথরের ভাস্কর্য এখানে রাখা রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে বীরভূম জেলা থেকে প্রাপ্ত দশম শতকের কালো পাথরের মারীচ, হরগৌরী, স্তম্ভ ও বুদ্ধমূর্তি। ঢাকা থেকে পাওয়া গণেশের ভাস্কর্য উল্লেখযোগ্য। রয়েছে আঠারো ও উনিশ শতকে নির্মিত কাঠের তৈরি কুমিল্লার বিভিন্ন ভাস্কর্য। এগুলোর মধ্যে প্রসবরতা নারী, জাদুদন্ড, দন্ডপাল ইত্যাদি ভাস্কর্যের কথা না বললেই নয়। এই মিউজিয়ামে রয়েছে বাংলার যশোর ও ফরিদপুর জেলার ঐতিহ্যবাহী সন্দেশ ও আমসত্ত্বের ছাঁচ। যেগুলোর বয়স তিন শ বছরের বেশি। ১৬০০ থেকে ১৭০০ সময়পর্বের ফরিদপুরের বিভিন্ন মন্দিরের পোড়ামাটির ফলক আর মেদিনীপুর ও কালীঘাটের বিভিন্ন প্রাচীন পটচিত্র এখানে সংরক্ষিত। এমনকি উনিশ শতকের কুমিল্লার গাজীর পটচিত্রও রয়েছে এই সংগ্রহশালায়। রয়েছে ফরিদপুরের মাটির বিভিন্ন প্রাচীন মূর্তি ও পুতুল। অন্যদিকে, যশোর, খুলনাসহ অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন এলাকার নকশি কাঁথা শোভা পাচ্ছে এই মিউজিয়ামে। এ ছাড়া বাংলার চিত্রকলা, পোড়ামাটির নানা কাজ, কাঠের কাজ, সুন্দরবন এলাকার লৌকিক দেবতা দখিন রায় ও মনসার মূর্তি এবং প্রাচীন বাংলার বহু প্রাচীন পুঁথি এই সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত। মূলত ঢাকা, কলকাতা, যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, বরিশাল, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, অবিভক্ত ২৪ পরগনা, বীরভূম, বাঁকুড়ার মতো জেলাগুলো থেকে সংগৃহীত অবিভক্ত বাংলার প্রত্ন ও লোকশিল্পের নিদর্শন স্থান পেয়েছে এই মিউজিয়ামে।
গুরুসদয় মিউজিয়ামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
অবিভক্ত বাংলার লেখক, লোকসংস্কৃতিবিদ ও গবেষক গুরুসদয় দত্ত ১৯২৯-৩৯ সালে তৎকালীন বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে এসব পুরাতাত্ত্বিক ও লোকশিল্পের নিদর্শন সংগ্রহ করেন। পাশাপাশি কলকাতার অদূরে জোকা নামক একটি জায়গায় ১০১ বিঘা জমি কিনে সেখানে ব্রতচারী গ্রাম গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন তিনি। ব্রতচারী শিক্ষা প্রসারের পাশাপাশি তাঁর লক্ষ্য ছিল এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, যার মাধ্যমে বাংলার শহুরে বাবু-পরিসরের মানুষ নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও লোকশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেন। এ ছাড়া বাংলার শিল্পীদের লোক-ঐতিহ্যের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক সম্পর্ক স্থাপনও ছিল লোকসংস্কৃতি গবেষক গুরুসদয় দত্তের লক্ষ্য। কিন্তু ১৯৪১ সালে মাত্র ৫৯ বছর বয়সে আকস্মিকভাবেই তাঁর মৃত্যু হয়। বেশ কিছু সময়ের জন্য থমকে যায় গুরুসদয় দত্তের স্বপ্নের এই প্রকল্প। তারপর ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের ছোবল আর কংগ্রেস ও হিন্দুমহাসভার গোঁয়ার্তুমির কারণে বাংলা ভাগ হয়।
গুরুসদয় দত্তর মৃত্যুর দুই দশক পর খন্ডিত বাংলার পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার অদূরে জোকায় বাংলার লোকশিল্প ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সংগ্রহশালা সাধারণের জন্য খুলে দেয় ‘বাংলার ব্রতচারী সমিতি’। ১৯৬১ সালে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় গুরুসদয় দত্ত সংগ্রহশালার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন, ৬৩ সালে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী হুমায়ুন কবীর এই সংগ্রহশালা উদ্বোধন করেন। ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত এই সংগ্রহশালা পরিচালনার দায়ভার সামলেছে স্বশাসিত সংস্থা ‘বাংলার ব্রতচারী সমিতি’। ওই বছরই কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি অনুযায়ী এই মিউজিয়াম কেন্দ্রের হাতে তুলে দেয় স্বশাসিত ‘বাংলার ব্রতচারী সমিতি’। তারপর থেকে গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক দায়ভার সামলেছে কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু হঠাৎ করেই তারা চুক্তি রদ করা হয়েছে বলে জানিয়ে দেয়।
সংগ্রহশালার থমকে যাওয়া ভবিষ্যৎ
‘গুরুসদয় সংগ্রহশালা’র কিউরেটির ও এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি ড. বিজন মন্ডল জানিয়েছেন, এই বিশাল সংগ্রহশালা আপাতত নিজস্ব ফান্ড থেকে কোনোমতে চলছে। কর্মচারীদের বেতন বন্ধ হয়ে আছে। ফান্ড শেষ হয়ে গেলে যেকোনো মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যেতে পারে বাংলার সংস্কৃতির শিকড়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত এই প্রতিষ্ঠান। তাঁর অভিযোগ, এই মিউজিয়ামে সেসব কর্মচারী চাকরি করেন, মিউজিয়াম পরিচালনার চুক্তি রদ করার মধ্য দিয়ে তাঁদের আর্থিক অধিকারগুলো পর্যন্ত খর্ব করেছে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার। সাধারণভাবে সরকারি কর্মচারীরা অবসরের পর যেসব আর্থিক অধিকার ভোগ করেন, তাঁদের সেসব থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে। এ ছাড়া ফান্ড বন্ধ করে দেওয়ার মাধ্যমে এই সংগ্রহশালার ভবিষ্যৎকে অন্ধকারের মুখে ঠেলে দিয়েছে কেন্দ্রের সরকার। তাঁর আরও অভিযোগ, কেন্দ্রের পূর্বতন সরকারগুলো এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে খুব একটা সুবিচার না করলেও এতটা সংকটের মুখে আগে কখনো পড়েনি এই প্রতিষ্ঠান। দিল্লির বর্তমান সরকার আগেপিছে না ভেবেই একতরফাভাবে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি রদ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ড. বিজন মন্ডল এই বিষয়ে বারবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁর কথায়, ‘কোনো জাতিসত্তার ইতিহাস মুছে দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি কাজ হচ্ছে তাকে শিকড় বিচ্ছিন্ন করা। শিকড়হীন কচুরিপানার মতো যাতে একটা জাতির ইতিহাস ভেসে যায়, সেই চেষ্টাই চালানো হচ্ছে। এ রকম একটি মিউজিয়ামকে ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে বাঙালির ইতিহাসকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। বিজন মন্ডল জানিয়েছেন, এই প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাদের সম্ভাব্য পদক্ষেপ ও পরবর্তী কর্মসূচির বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে। আইনি পথেও তারা যেতে পারেন। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, তারা বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। কেন্দ্রের কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইতে পারে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায়, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে আলাপ চালাতে পারে।
ছবি: লেখক