রসনাবিলাস I শেফ’স টেবিল
ভোজনরসিকদের নতুন এক গন্তব্য। নানা দেশের নানা পদের পসরা সেখানে
নগরে শেফ’স টেবিল নামের একটি ফুড কোর্ট চালু হয়েছে শুনে মনে পড়লো নিউইয়র্কের শেফ’স টেবিল অ্যাট ব্রæকলিন ফেয়ার রেস্তোরাঁর কথা। সিজার নামের একজন বিখ্যাত আমেরিকান শেফের তত্ত্বাবধানে মাত্র ১৮টি আসন নিয়ে চলছে রেস্তোরাঁটি। তবে ওই আসনগুলোর একটিতে বসতে হলে কমপক্ষে ছয় সপ্তাহ আগে বুক করতে হয়। অতুলনীয় ২০ পদের খাবার দিয়ে শেফ সিজার তাঁর অতিথিদের আপ্যায়ন করেন।
গুলশান ২-এর ৯০ নম্বর রোডে গুলশান সেন্টার পয়েন্টের তৃতীয় তলায় গড়ে ওঠা শেফ’স টেবিলে সে রকম কোনো ব্যাপার আছে কি না, জানা নেই। ২৭ হাজার বর্গফুটের বিশালায়তন শেফ’স টেবিলের মেঝে উজ্জ্বল টাইলসে মোড়া। তাতে বিম্বিত হবে নিজের প্রতিকৃতি। পুরো চত্বরেই রসনাসুখের দৃশ্য। খোলামেলা পরিসরে ভিড়টা মালুম হয় না। বলাই হয়নি, শেফ’স টেবিল আসলে একক কোনো রেস্তোরাঁ নয়। বরং ছোট ছোট ২৬ রেস্তোরাঁর সমাহার। ২৬ রেস্তোরাঁয় ২০টি কুজিন। প্রতিটি রেস্তোরাঁয় একজন করে দক্ষ শেফ রয়েছেন।
শেফ’স টেবিলে পা রাখতেই ঘ্রাণেন্দ্রিয় সুখকর হয়ে ওঠে। বলা যায় তাতে সারা হয় অর্ধভোজন। ছাদ থেকে ঝুলে থাকা বাল্বের মৃদু আলো চোখে আরাম দেয়। একেকটি টেবিলে চারটি করে চেয়ার পাতা। এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলের মাঝে রয়েছে ভদ্রস্থ দূরত্ব। লিফটের পাশের একটি দেয়ালজুড়ে ভাস্কর্য। দেখতে বেশ লাগে। মানায় আবহের সঙ্গে।
সিঁড়ি থেকে নেমে নাক বরাবর সো জুসি। এটা জুসবার। এখানকার ফ্রেশ জুস ও ডিটক্স আছে অতিথিদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে। খানিক এগিয়ে গেলেই ‘স্বাদ তেহারি ঘর’। গরু, ছাগল, মুরগি- মিলবে তেহারি, এই তিন মাংসের। তবে তেহারি ঘর বলে শুধু তেহারিই নয়, পাওয়া যাবে বিরিয়ানি, কাবাব আর খিচুড়িও।
পাশেই ক্র্যাক শেক। চায়নিজ ও জাপানি মিক্সড কুজিন সম্ভার। এখানে ফ্রায়েড চিকেন অন্যান্য পদের তুলনায় বেশি চলে।
আই লাভ মাই হোম। চায়নিজ কুজিন। সেখানে গিয়ে দেখা গেল একজন চৈনিক অতিথি ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে কী যেন বলছেন। ভিড় বেশি হওয়ায় দাঁড়ানোও গেল না।
মেক্সিকান অথেনটিক পদ চাখতে চাইলে থামতে হবে দোস লোকোস-এ। এখানে অন্তত দোস লোকোস ছাড়া অন্য কোথাও নাচো ও টাকো পাওয়া যাবে না।
মাংসের পদের পসরা সাজিয়ে বসেছে দ্য স্টেক জয়েন্ট। মাংস দিয়ে তৈরি সম্ভব- এমন অনেক পদই পাওয়া যাবে এখানে।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছে তাড়কা। তাদের সেট মেনু ছাড়াও দোসা ও চাটে অতিথিদের বিশেষ নজর।
এখানে একমাত্র পিৎজেরিয়া হলো পিৎজা গায়। ইতালিয়ান পিৎজার আসল স্বাদের জন্য শেফ’স টেবিলের জুড়ি নেই। হাতে বানানো ডো দিয়েই তৈরি হয় প্রতিটি পিৎজা। নাইট মেয়ার রিবোন, এলিভস নাইট মেয়ার ও মাশরুম লাভার্সের কদর তুলনামূলক বেশি।
শুধু জাপানি কুজিন নিয়ে পাল্লা দিচ্ছে কিয়োসি। তাদের ফিউশন রোলস চেখে দেখতেই হয়।
আত-ত্বীন মিক্সড গ্রিল, একটি আরব্য পদ। এটির জোগান দিচ্ছে ‘আত-ত্বীন’ রেস্তোরাঁ। তারা আরব্য কুজিন ধরে এগিয়ে যাচ্ছে।
এমারাল্ড বেকারি অ্যান্ড ক্যাফে। খাবারদাবার শেষ করে আগন্তুকেরা এখানে ভিড় জমান সুস্বাদু ডেজার্টের লোভে। বিশেষ করে মুড কেক ও রেড ভেলভেটের জন্যই।
বার্গার পাবেন শুধু ম্যাডশেফ এক্সে। ম্যাডশেফের সিগনেচার বার্গারের ‘গারলিক মেয়ো’। এ ছাড়া রেগুলার বার্গারের মধ্যে আছে নাগা ব্লাস্ট, তন্দুরি চিকেন, স্মোকড বিবিকিউ ও হাওয়াইয়ান চিকেন।
হপার্ড ও কত্তু- শ্রীলঙ্কান দুটি পদ। সে দেশের অন্যান্য খাবার নিয়ে শেফস টেবিলে জায়গা নিয়েছে টেস্ট অব লঙ্কা। এ ছাড়া থাই স্যুপ ও স্যালাডের পসরা সাজিয়েছে থাই এমারাল্ড। ভর্তা-ভাজি জাতীয় পদে আগ্রহীদের জন্য রয়েছে দ্য ভোজ। সঠিক ডায়েট মেনে বা সঠিক পুষ্টি আছে এমন কোনো খাবার খেতে চান, সে জন্য আছে লেন নেশন।
গ্রিন অ্যান্ড সিডসের কথা না বললেই নয়। দেশি-বিদেশি স্যালাডের সমাহার। জানা গেল, তাদের অতিথিদের ৬০ শতাংশই বিদেশি। রাশান স্যালাডটি অন্যগুলোর তুলনায় বেশি চলে। অতিথিরা মিক্সড স্যালাডও খেতে পারবেন।
শেফ’স টেবিলের জার্নি শুরু হয়েছিল সো জুসি দিয়ে। সেখানে ফিরে এসে আলাপ হলো ম্যানেজার টিপু সুলতানের সঙ্গে। জানা গেল নানা তথ্য। ১২ জুলাই শুরু। আপাতত প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চলে এই ভোজাসর। তবে রাত ১২টা পর্যন্ত সেখানে সময় কাটাতে পারেন অতিথিরা।
ফুড কোর্ট, ফুড হাব কিংবা ফুড জোন- যা-ই বলা হোক না কেন, এমন প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশে এর আগে ছিল না। দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর উচ্চপদস্থদের প্রিয় জায়গা হয়ে উঠেছে শেফ’স টেবিল। তারা প্রায় প্রতিদিনই এখানে আসেন- হয় লাঞ্চে নয় ডিনারে। সপ্তাহান্তের নৈশভোজে এখানে অতিথিদের ধুম পড়ে যায়। ভিড় বাড়ে দুপুরেও। সন্ধ্যায় সপরিবারে এখানে আসেন অনেকেই। শিশুদের জন্য শেফ’স টেবিলের আছে ভিন্ন আয়োজন। বেশ বড় করে সাজানো হয়েছে শিশু অঙ্গন। এর নাম দেওয়া হয়েছে প্লে টাউন। সেখানে আছে বিভিন্ন রাইড ও গেমস। অবশ্য এর জন্য আলাদা কড়ি গুনতে হবে।
দেশি অতিথিদের পাশাপাশি বিদেশি অতিথিদেরও মন জয় করেছে শেফ’স টেবিল। আগন্তুকদের প্রায় ১০ শতাংশই বিদেশি।
ঠাসাঠাসি যাতে না হয়, এ জন্য খুব পরিপাটি করে মোট ছয় শ মানুষের বসার বন্দোবস্ত করা হয়েছে।
প্রাইভেট পার্টিও করা যাবে শেফ’স টেবিলে। প্রাইভেট রুম নামে একটি আলাদা রুম রাখা হয়েছে। বার্থ ডে পার্টি, সেমিনার, বই কিংবা গানের সিডি লঞ্চের মতো প্রোগ্রামগুলো ছোট পরিসরে করা যাবে ২০ আসনবিশিষ্ট প্রাইভেট রুমে।
মূলত গুলশান, বনানী ও বারিধারার মানুষের জন্য শেফ’স টেবিল খুব কাছাকাছি। ঢাকার অন্যান্য প্রধান এলাকা থেকে গুলশান ২ একটু দূরেই। তাই শেফ’স টেবিলের পরবর্তী পরিকল্পনা হচ্ছে শাখা-প্রশাখা বিস্তারের। বাস্তবায়িত হতে পারে এ বছরই।
শিবলী আহমেদ
ছবি: সৈয়দ অয়ন