অর্গানিক I ভেগান স্কিন কেয়ার
রাসায়নিক ও পশুর উপজাত বাদ দিয়ে শুরু হয়েছে উদ্ভিজ্জ উপকরণে তৈরি প্রসাধনীর নতুন অধ্যায়। স্বাস্থ্য ও প্রকৃতি রক্ষার জন্য
বাণিজ্যিক স্কিন কেয়ার প্রডাক্টের দুনিয়ায় উপকারী পণ্য বেছে নেওয়া কষ্টসাধ্য। অনেক পণ্য আছে কম সময়ে ত্বকের বেশ ভালো উন্নতি ঘটায়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারের ফলে এগুলো ক্ষতির কারণ হতে পারে। ত্বকের মারাত্মক সব রোগের উৎস হতে পারে, এমন পণ্যও রয়েছে। এ ছাড়া রাসায়নিক ও প্রাণিজ উপকরণে তৈরি পণ্য পরিবেশের জন্য হুমকি। শেলফ থেকে এগুলো সরিয়ে সেখানে ভেগান স্কিন কেয়ার প্রডাক্ট রাখাই ভালো।
দূষিত হতে থাকা পরিবেশে সুস্থ থাকার জন্য মানুষ সবুজ জীবনযাপনের দিকে ঝুঁকছে। ফলে ভেজিটেবল ডায়েট জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এবং উদ্ভিজ্জ খাদ্যের চাহিদা মাছ-মাংসের তুলনায় বেড়েছে। তবে ভেগান লাইফস্টাইল গ্রহণ খাদ্যেই আবদ্ধ নয়। পোশাক, দৈনন্দিন উপকরণ, এমনকি প্রসাধনী ও ত্বকযত্নের পণ্যও এমনভাবে বাছাই করে নিতে হবে, যা কোনো পশুপাখি থেকে তৈরি হয়নি, ব্যবহৃত হয়নি রাসায়নিক উপাদানে।
ভেগান স্কিন কেয়ার প্রডাক্টে প্রাণী থেকে আহরিত কোনো উপকরণ থাকে না। তবে প্রাণীর বাই প্রডাক্ট বা উপজাত, যেমন- মধু, মোম, ল্যানোলিন, কোলাজেন, কারমিন, কোলেস্টেরল, জেলাটিন, স্কোয়ালিন ও স্টেরাইকের মতো উপকরণ প্রায় সব নামিদামি ব্র্যান্ডের বিউটি প্রডাক্টে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ময়শ্চারাইজার, ক্লিনজার সাবান, সুগন্ধি ইত্যাদির বেশির ভাগেই এনিমেল বাই প্রডাক্ট রয়েছে। এগুলো শেষ পর্যন্ত ত্বকবান্ধব নয়।
সাধারণত প্রাকৃতিক উপকরণ ব্যবহার করে ভেগান স্কিন কেয়ার প্রডাক্ট তৈরি করা হয় বলে এগুলো যেকোনো ত্বকের জন্য সহনীয়। সংবেদনশীল, সহজেই জ্বলুনি হয় বা অ্যালার্জিপ্রবণ ত্বকে এই ধরনের পণ্য জুতসই। নন-ভেগান পণ্যের তুলনায় ভেগান পণ্য তৈরিতে কম কিন্তু কার্যকর উপকরণ ব্যবহৃত হয়।
কোনো নতুন পণ্য কেনার পর অনেকেই ভাবতে শুরু করেন, এটি কাজ করবে তো? ত্বকে দাগ বা জ্বলুনি হবে না তো? ব্যবহারের আগে এর উত্তর অজানাই থেকে যায়। কিন্তু ভেগান পণ্য নিয়ে এসব না ভাবলেও চলে। এগুলো ত্বকের প্রতি যত্নশীল। আর ন্যাচারাল কসমেটিকস সহজেই ত্বকে মানিয়ে যায়। ডার্মাটোলজিস্টরা প্রসাধনীর কিছু উপকরণ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন। বেশি এড়িয়ে যেতে বলেন ল্যানোলিন। এটি পশুর উপজাত, যা প্রায় সব কসমেটিকসে ব্যবহৃত হয়। এটি লোমকূপ বন্ধ করে দেয়, ফলে ব্রণের সৃষ্টি হয়। এই উপকরণ আসে ভেড়ার লোম থেকে এবং এর কোনো উপকারিতা নেই। পণ্যের গায়ে এর উল্লেখ দেখলে তা পরিহার করুন।
উদ্ভিজ্জ ত্বকচর্চার একটি মজার দিক হলো, তাৎক্ষণিকভাবে ও নিশ্চিন্তে ব্যবহার করা যায় উপকরণের তালিকা না পড়েই। কেননা এসব পণ্য দ্রুত ও সহজে ত্বকে মিশে যায়।
অতিবেগুনি রশ্মি থেকে সুরক্ষায়
ভেগান স্কিন কেয়ার প্রডাক্ট তৈরি হয় সাদা চা, ফল ও সবজির নির্যাসের মতো স্বাস্থ্যকর উপকরণ ও প্রাকৃতিক উপাদান থেকে। যেমন রিসভেরাট্রল, ওয়াইন আঙুরের চামড়ার নির্যাস অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। অতিবেগুনি রশ্মি থেকে সুরক্ষা দিতে বেশ কার্যকর।
বয়সরোধী সুবিধা
অ্যান্টি-এজিং ট্রিকস কোনো অভিনব রাসায়নিক নয়, ময়শ্চার ও ভিটামিনের একটি কার্যকর প্রক্রিয়া। তেল, ইনফিউসড ওয়াটার ও ভেগান প্রডাক্টগুলো নির্ভেজাল। তাই এগুলো স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে ত্বকের তারুণ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। সয়া ও গ্রিন টির মতো উপাদানগুলো বয়সরোধী গুণসমৃদ্ধ। এগুলোর পুষ্টিগুণও রয়েছে। অনেক কৃত্রিম স্কিন কেয়ার প্রডাক্ট রয়েছে, যেগুলোয় ক্ষতিকর প্রিজারভেটিভ দেওয়া থাকে পানি ও রাসায়নিক উপাদান সংরক্ষণের জন্য। এগুলোই অকালে বুড়িয়ে দেয় ত্বক। সমস্যাও সৃষ্টি করে। কিন্তু সব প্রিজারভেটিভ ত্বকের জন্য ক্ষতিকর নয়। যখন অন্যান্য প্রাকৃতিক উপকরণ ভেগান অয়েলের সঙ্গে মেশানো হয়, তা ত্বকবান্ধব হয়ে ওঠে। ব্যবহৃত পণ্যের সুফলও দীর্ঘস্থায়ী করে।
শুষ্ক ত্বকের জন্য
ভেষজ তেল ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে ও শুষ্কতা নিরাময়ে সাহায্য করে। স্যাফফ্লাওয়ার, অ্যাভোকাডো, কোকোনাট, অলিভ অয়েল ও ইভনিং প্রাইমরোজ অয়েল যথেষ্ট উপকারী। যাদের ত্বক সংবেদনশীল, ভেগান স্কিন কেয়ার প্রডাক্ট তাদের জন্য ভালো। এ ছাড়া ডালিম, কফি বিন ও চায়ের নির্যাসও কার্যকর ময়শ্চারাইজার। এসব উদ্ভিজ্জ উপকরণ সহজেই ত্বকের শুষ্কতা হটিয়ে দেয়। এগুলোর তৈরি বেশির ভাগ পণ্যেই রয়েছে প্রচুর পানি। তাই ভেগান উপকরণ ও ত্বক- এ দুয়ের মিলন ঘটিয়ে দিন, আর অনুভব করুন সুপার হাইড্রেট স্কিন।
তৈলাক্ত ত্বকে
উদ্ভিজ্জ উপাদানে সুপার হাইড্রেটিং হওয়ার কারণে তৈলাক্ত ভাব থেকে সহজে মুক্তি মেলে। এটি বাড়তি ময়শ্চার তৈরি বন্ধ করে ত্বকের নানান জটিলতা সারিয়ে তোলে। এতে র্যাশ কমে যায় এবং লোমকূপও বন্ধ হয় না।
বিবর্ণ ত্বকে
অনেকেই ত্বকের বিবর্ণতা বা ফ্যাকাশে ভাব দূর করতে নানান উপায় অবলম্বন করেন। চোখের চারপাশে, জ লাইনে, চিক, কপাল এমনকি শরীরের বিভিন্ন অংশের রঙ অন্যান্য অংশের সঙ্গে না-ও মিলতে পারে। চাইলে সহজেই ত্বকের সব অংশের রঙ একই রকম সুন্দর করে তোলা যায়। সাধারণ ভিটামিনযুক্ত বেশির ভাগ উদ্ভিজ্জ উপকরণ ভেগান কসমেটিকসে রয়েছে, যা সত্যিকার অর্থেই ত্বকের বিবর্ণতা দূর করে।
বাজারে এখন প্রায় সব ধরনের ভেগান প্রডাক্ট পাওয়া যায়। এগুলোর বেশির ভাগেরই রয়েছে উচ্চমানের ভিটামিন, যা ত্বকের জন্য বেশ জরুরি।
এগুলোর কোনোটিতে রয়েছে বয়সের ছাপ প্রতিরোধের ক্ষমতা, কোনোটি আবার চোখের ফোলা ভাব কমাতে কার্যকর। ব্রণ ও দাগ দূর করতে, এমনকি ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে এগুলো কাজ করে চমৎকারভাবে। অধিকন্তু ভেগান মেকআপ আইটেমগুলো ত্বকের ক্ষতি করে না বললেই চলে। তাই মেকআপের বেশি ব্যবহারও বিরূপ প্রভাব ফেলে না। বরং এ ধরনের পণ্য ত্বক রাসায়নিকের পরিমাণ বা চাপ কমিয়ে বাইরের দিকের মতো ভেতরের দিকও সুস্থ রাখে।
এটি এখন সবারই জানা, প্রাকৃতিক উপাদান ত্বকের জন্য ক্ষতিকর নয়। কিন্তু কৃত্রিম বা রাসায়নিক পণ্য শুধু ত্বকেরই নয়, পরিবেশেও বিরূপ প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে, ভেগান স্কিন কেয়ারে ত্বকের উন্নতি চোখে পড়বে দ্রুত। ল্যাভেন্ডার অয়েল এর ভালো উদাহরণ হতে পারে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এতে বহু প্রাণীর জীবন বাঁচবে। তাই শাকাহারের পাশাপাশি বেছে নিন প্ল্যান্ট-বেজ স্কিন কেয়ার প্রডাক্ট। এতে প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পাবে। প্রয়োজনে পণ্যের গায়ে লাগানো লেবেল পড়ে দেখে নিন, এতে প্রাণী থেকে সংগৃহীত কোনো উপাদান বা বাই-প্রডাক্ট ব্যবহৃত হয়েছে কি না। পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন করতে চাইলে ভেগান প্রডাক্ট ব্যবহার একটি চমৎকার উপায় হতে পারে। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি ২০১০-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তন, পানি সংকট ও মাটি ক্ষয়ের মতো পরিবেশগত সমস্যার একটি বড় কারণ অ্যানিমেল প্রডাক্ট।
ফলে, ভেবে দেখার সময় হয়েছে যে আপনার সৌন্দযচর্চা পরিবেশ ধ্বংসের কারণ হচ্ছে না তো?
তাসমিন আহমেদ
মডেল: সূর্য
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: সৈয়দ অয়ন