ফিচার I বাংলার দুর্গা
অম্বিকা, রুদ্রাণী, উমা, ভবানী, কন্যাকুমারী, কাত্যায়নী, জয়দুর্গা- কত না রূপ দুর্গার। রূপের পার্থক্য যতই থাকুক, তিনি বাঙালির একান্ত আপনজন, ঘরের মেয়ে উমা। সনাতন হিন্দুধর্মাবলম্বী বাঙালির কাছে দুর্গা বিপত্তারিণী দেবী হিসেবেই বেশি পরিচিত। তাঁর নাম ও আরাধনার বৈচিত্র্য আর লোকাচার নিয়ে লিখেছেন উদয় শঙ্কর বিশ্বাস
বাংলায় এমন কোনো জনপদ নেই, যেখানের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে দুর্গতিনাশিনী মা দুর্গার উপস্থিতি নেই। বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব বা পার্বণই হলো শারদীয় দুর্গোৎসব। দুর্গা পৌরাণিক দেবী। তিনি আদ্যাশক্তি, মহামায়া, শিবানী, ভবানী, দশভুজা, সিংহবাহিনী নামেও পরিচিত। পুরাণমতে, দুর্গা একদা দুর্গ বা দুর্গম দৈত্যকে বধ করেছিলেন। মার্কন্ডেয় চন্ডী ও কালিকাপুরাণে বলা আছে, ব্রহ্মার বর লাভ করে মহিষাসুর দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করেছিলেন তিনি। দেবতারা এর প্রতিকার চাইলে ব্রহ্মা বিষ্ণুর কাছে শিবকে নিয়ে যান। সবকিছু শুনে বিষ্ণু জানান, মহিষাসুরকে কোনো পুরুষ বধ করতে পারবে না এমন বর তিনিই আগেই প্রাপ্ত; তাই আমাদের সবাইকে নিজ নিজ স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয়ে নারীমূর্তি রূপে আবিভর্ূত হতে হবে। সেই কথা মেনে সৃষ্টি হয় তেজময়ী দেবী দুর্গা। তিনিই পরে মহিষাসুরকে বিনাশ করেন। দুর্গা তিনবার মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। প্রথমবার অষ্টাদশভুজা উগ্রচন্ডী রূপে এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার দশভুজা রূপে; প্রতিবারই দেবীর কাছে মহিষাসুর আর্জি করেন, ‘আপনার হাতে মৃত্যুতে আমার কোনো দুঃখ নেই, কিন্তু আপনার সঙ্গে আমিও যেন পূজিত হই- সে ব্যবস্থা করুন।’ দেবী এ কথায় প্রসন্ন হয়ে মহিষাসুরকে তাঁরই পদলগ্ন হয়ে দেবতা-মানুষ-রাক্ষসদের কাছে পূজ্য হবার বর দেন। সেই থেকে মহিষাসুর দেবী দুর্গার সঙ্গে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি- সব যুগেই পূজ্য হয়ে আসছে। দেবীমাহাত্ম্যে প্রভাবিত হয়ে সত্য যুগে রাজ্যহারা ও স্বজনদের কাছ থেকে প্রতারিত সুরথ সমাধি বৈশ্য মেধস মুনির পরামর্শে দুর্গাপ্রতিমা তৈরি করে তিন বছর পূজা করেছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি হারানো রাজ্য লাভ করেছিলেন বলে জানা যায়। ত্রেতা যুগে রাবণ বসন্তকালে ‘বাসন্তীপূজা’ নামে দেবীর আরাধনা করেছিলেন। এই পূজা বাংলাদেশের অনেক জায়গায় শারদীয় দুর্গাপূজার আদলে এখনো অনুষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে রাজা রামচন্দ্র ত্রেতা যুগে রাবণবধের জন্য শরৎকালে বা আশ্বিন মাসে দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন, ‘অকালবোধন’ নামে এটি পরিচিত। অকালবোধনই বর্তমানে শরৎ উৎসব বা দুর্গোৎসব। যা সনাতন ধর্মাবলম্বী বাঙালির প্রিয় উৎসব। সাধারণত আশ্বিন অথবা কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে দেবী বোধনের মাধ্যমে সূচনা হয় বর্তমানে প্রচলিত দুর্গাপূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা এবং বিজয়া দশমীতে বিসর্জনে এর পরিসমাপ্তি ঘটে।
বাংলার প্রথম শারদীয় দুর্গাপূজা
ইতিহাসে থেকে জানা যায়, রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ ৮৮৭ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৫৮০ সালে বাংলায় প্রথম শারদীয় দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিলেন। বারনই নদের পূর্ব তীরে রামরামায় ছিল তাহিরপুর (বর্তমানে লোকমুখে তাহেরপুর) রাজবংশের আদি নিবাস। ভাঙনের কারণে পরবর্তীকালে নদীর অপর তীরে বর্তমান রাজবাড়িটি গড়ে তোলা হয়। রাজবাড়ি প্রাঙ্গণে তাদের প্রতিষ্ঠিত দুর্গামন্দির, শিবমন্দির, গোবিন্দমন্দিরসহ অন্যান্য স্থাপনা এখনো রয়েছে। ইতিহাসখ্যাত এই রাজবংশের প্রথম পুরুষ ছিলেন সংস্কৃত বেণীসংহার-এর রচয়িতা ভট্টনারায়ণ বা নারায়ণভট্ট। তিনি ছিলেন বরেন্দ্রী ব্রাহ্মণ। মনুসংহিতা গ্রন্থের টীকাকার কুল্লুক ভট্টের পুত্র রাজা কংসনারায়ণ তাহিরপুর রাজবংশের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন। রাজপুরোহিত রমেশ শাস্ত্রীর পরামর্শ অনুসারে প্রায় ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে তিনি শাস্ত্রসম্মতভাবে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন। মাসব্যাপী প্রজাসাধারণের ভোজসহ বিনোদনের বিপুল আয়োজন করা হয়েছিল। অপরদিকে রাজা কংসনারায়ণের প্রবর্তিত শারদ দুর্গোৎসবকে ম্লান করার জন্য রাজশাহীরই ভাদুরিয়ার রাজা জগৎনারায়ণ প্রচলন করেছিলেন বাসন্তী দুর্গোৎসবের। বসন্তকালে এ পূজায় তিনিও ব্যয় করেছিলেন ৯ লাখের অধিক টাকা। এসব আয়োজনের কিছুকাল পরে নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদার ১৬০৬ সালে নদীয়ার কৃষ্ণনগরে আয়োজন করেন প্রথম শারদীয় দুর্গাপূজার। প্রায় একই সময় কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশের লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার নিজ বাড়িতে ১৬১০ সালে সূত্রপাত করেন তার বংশের দুর্গাপূজার। তবে, প্রথম সর্বজনীন দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয় হুগলির গুপ্তিপাড়ায়। এরপর বাংলার বড়-ছোট নানা ধরনের জমিদারেরা এমনকি অর্থশালী গৃহস্থরা আয়োজন করতে থাকেন দুর্গাপূজার। সমগ্র বাংলায় দুর্গাপূজা ছড়িয়ে পড়ে, হয়ে ওঠে বাঙালির প্রাণের উৎসব। যদিও গ্রহপূজা, স্তূপপূজা, পশুপক্ষীপূজা, মূর্তিপূজা- সব অর্চনাতেই বাংলায় দুর্গাপূজার অস্তিত্ব ছিল। তবে, আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল না। সেসব না থাকলেও বাংলার প্রাচীনতম স্মৃতি নিবন্ধকার ও ধর্মশাস্ত্রবেত্তা ভবদেব ভট্টের দশকর্ম দীপিকা, কর্মানুষ্ঠান পদ্ধতি, ব্যবহার তিলক প্রভৃতি গ্রন্থে মহাদেবী দুর্গার পূজার্চনা পদ্ধতির লিখিত রূপ ছিল। এমনকি কালিকাপুরাণ, দেবীপুরাণ, মৎস্যপুরাণ, কালীবিলাস, বৃহন্নন্দিকেশর পুরাণসমূহে দুর্গার উল্লেখ দেখা যায়। তবে, বাংলার সব জায়গায় দুর্গা যে একইভাবে নির্দিষ্ট নিয়মে পূজিত হন, এমনটা বলা যাবে না। দুর্গাপূজার আকার-প্রকরণ-রীতিপদ্ধতির ভিন্নতার কিছুটা খোঁজ নেওয়া যাক।
সরাচিত্রে দুর্গা
আশ্বিন মাসের কোজাগরী পূর্ণিমায় ঢাকা ও ফরিদপুর অঞ্চলে মাটির সরায় ধনদেবী লক্ষ্মীকে এঁকে ঘরে-ঘরে আরাধনা করার এক বিশেষ রীতি আছে। যা ‘লক্ষ্মীর সরা’ নামে পরিচিত। সরাচিত্রের বিষয়বস্তুতে পার্থক্য আছে। বৈষ্ণবদের সরাচিত্রে সাধারণত রাধাকৃষ্ণের প্রতিমা আঁকা হয়। অপরদিকে শাক্তদের সরায় দুর্গাপ্রতিমার চিত্র আঁকা হয়। বিশেষত ফরিদপুর, শরীয়তপুর ও ঢাকার নবাবগঞ্জ-দোহার প্রভৃতি অঞ্চলের সরায় দুর্গার প্রাধান্য দেখা যায়। ফরিদপুরের দুর্গা সরাকে ‘সুরেশ্বরী সরা’ বলা হয়। এতে ঘর কাটা থাকে, আলাদা আলাদা ঘরে পুতুল (বিভিন্ন দেব-দেবী) আঁকা হয়। স্থানীয় ও লৌকিক প্রথা অনুযায়ী দুর্গাপ্রতিমার সরায় অনেক পার্থক্য আছে। কোনো কোনো সরায় দুর্গাপ্রতিমার সঙ্গে লক্ষ্মী, সরস্বতীসহ কার্তিক ও গণেশের প্রতিমা থাকে। আবার কোনো কোনোটিতে কার্তিক ও গণেশ বাদ যায়। এর পেছনে আছে সামাজিক কারণ। তবে, প্রতিটি দুর্গাপ্রতিমার সরার মাথায় থাকে দেবাদিদেব শিব এবং নিচে প্যাঁচাসমেত লক্ষ্মী। আবার কোনো কোনো সরায় দুর্গার প্রতিমায় তিনটির পরিবর্তে দুটি চোখ আঁকানো হয়। দুর্গা সরাই সর্বোৎকৃষ্ট ও বৃহৎ। সরার দুর্গাপ্রতিমা ও দুর্গাপূজার দুর্গার কল্পনা যেন একই সূত্রে গাঁথা। পুরাণে অবশ্য দুর্গার সঙ্গে লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশের কোনো উল্লেখ নেই। দুর্গা সরার অন্য এক রীতি আছে ফরিদপুর অঞ্চলে। এখানকার সরাশিল্পীরা একে ‘গণকা’ বা ‘আচায্যি’ সরা বলেন। মনে করা হয়, গণক ঠাকুর নিজ হাতে এই সরা করতেন বলে এমন নামকরণ। গ্রামবাসীর শুভাশুভ নির্ণয় করাই ছিল গণকদের প্রধান কাজ। আর্থিক কারণেই তারা হয়তো পরে সরার কাজে হাত দেন। গণকা সরার পশ্চাৎভূমি লাল রঙের, অন্য সরায় তা সাদা।
পটের দুর্গা
পটের দুর্গা বাংলার লোকায়ত শিল্পকলার এক বিশিষ্ট রূপ। ‘পট’ হলো কাপড়ে আঁকা অনন্য এক শিল্পরীতি। সংস্কৃত ‘পট্ট’ শব্দ থেকে বাংলায় ‘পট’ শব্দটি এসেছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জনপদে পটের দুর্গার প্রচলন কিছুটা রয়েছে। বিশেষত বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের মল্লরাজারা পটদুর্গার স্বতন্ত্র পূজার রীতিপদ্ধতি পালন করে আসছেন কয়েক শ বছর ধরে। এখানে দেবী রমণীয় রণচন্ডী রূপে অঙ্কিত। তিন ফুট উচ্চতা ও দুই ফুট প্রস্থবিশিষ্ট পটের মধ্যে মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা থাকে মাঝে, ডান দিকের দুটি প্রকোষ্ঠের উপরের অংশে লক্ষ্মী ও নিচে গণেশ এবং বাঁ দিকের উপরের প্রকোষ্ঠে থাকে সরস্বতী ও নিচেরটায় কার্তিক। বিষ্ণুপুরের ফৌজদারেরা বংশপরম্পরায় মল্লরাজাদের পটের দুর্গা এঁকে আসছেন। এঁরাই বিষ্ণুপুরের দশাবতার তাসও আঁকেন। পশ্চিম মেদিনীপুরের বিজরাবাঁধিতে আবার চৌকোশ দুর্গাপটের দেখা মেলে। এই ধরনের দুর্গাপট জড়ানো পটেরই রূপান্তর। অর্থাৎ জড়িয়ে রাখা যায় পটটিকে। এটি আঁকেন পটুয়া, পটিদার, পোটো বা চিত্রকর সম্প্রদায়ের লোকজন। তা আঁকা হয় একেবারেই সাধারণ কাগজে। এ ছাড়া ঝাড়গ্রামের রাজবাড়িতে, বর্ধমানের গুসকরা ও মাঝিখাড়ায়, বীরভূমের সিউড়ি, বোলপুর প্রভৃতি এলাকায় বিভিন্ন অঙ্কনরীতির পটদুর্গার অস্তিত্ব এখনো আছে।
বনদুর্গা
সুন্দরবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তিনি ব্যাঘ্রদেবী হিসেবে পরিচিতা। দয়াবতী ও ভক্তবৎসল। মুসলমান ভক্তরা একে বনবিবি বলে মান্য করেন। অপরদিকে হিন্দুরা বনচন্ডী, বনষষ্ঠী বা বিশালাক্ষী বলেও মনে করেন। বাংলার লৌকিক দেব-দেবীর মধ্যে বনদুর্গার প্রভাব এখন দেখা যায়। অপরাপর লৌকিক দেব-দেবীর মতন বনদুর্গার চেহারা উগ্র বা ভয়াবহ নয়, স্বভাবও অন্য দেবতাদের মতো প্রতিহিংসাপরায়ণ নয়। বনদুর্গার প্রতিমা হলুদ বর্ণের। তিনি শাড়ি পরিহিতা, সুসজ্জিতা। মাথায় মুকুট থাকে তার। সর্বাঙ্গে নানাবিধ অলংকার এবং গলায় হার ও বনফুলের মালা থাকে। চোখ দুটি এবং দুই হাতে কোনো প্রকরণ থাকে না। কোলে কখনো-কখনো শিশুপ্রতিমা থাকে। গ্রামের সাধারণ মানুষ মাতৃরূপে বনদুর্গার পূজা করে। মাঘ মাসের শুক্লপক্ষে এটি অনুষ্ঠিত হয়। বাওয়ালি-মাওয়ালিরা সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার আশায় স্নেহপ্রবণ এই দেবীর পূজা করেন। বাংলাদেশ ও ভারতের সুন্দরবনের নানা জায়গায় বনদুর্গার পূজা এখনো সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয়। সুন্দরবনের যেখানে বাঘের উপস্থিতি, সেসব জায়গায় তার থান দেখতে পাওয়া যায়। বনদুর্গার পূজায় ‘মাঙন মাঙা’ লোকাচারটি পালিত হয়। দেবীর থানে ভক্তরা গুড়, পাটালি, মুড়কি, বাতাসা, সন্দেশ ও অন্যান্য মিষ্টিদ্রব্য নিবেদন করেন।
কনকদুর্গা
শবরী, পর্ণশবরী, বনদেবী, মা-ডুমনি, ভান্ডারী, রাজ-বল্লভী, উত্তরবাহিনী, শাকম্ভরী, রঙ্কিনী, বড়ামচন্ডী, বাশলী ইত্যাদি দুর্গার লৌকিক রূপবিশেষ। ভারতের ঝাড়গ্রাম জেলার চিলকিগড়ে ‘কনকদুর্গা’ নামে এমনই এক আঞ্চলিক দুর্গামন্দির আছে। রাজা গোপীনাথ সিংহ ১৭৪৯ সালে পাথর খোদাই করে কনকদুর্গার বিগ্রহ তৈরি করেছিলেন। রাজা, রাজপুরোহিত ও ধাতুশিল্পী যোগী কামিল্যা তিনজনই স্বপ্নে দেবীর একই রূপ দেখেছিলেন। স্বপ্নাদেশের বর্ণনা অনুযায়ী পরে দেবীর প্রতিমা নির্মাণ করা হয়। দক্ষিণমুখী মন্দিরে দেবী এখানে অশ্ববাহনী, ত্রিনয়না ও চতুর্ভুজা। তাঁর চার হাতের উপরের বাম হাতে আছে পানপাত্র এবং নিচের বাম হাতে ঘোড়ার লাগাম। উপরের ডান হাতে খড়গ আর নিচের ডান হাতে আছে বরাভয় মুদ্রা। গোবিন্দমণির হাতের সোনার কঙ্কণ দিয়ে তৈরি হয় বলে দুর্গার নাম হয়েছে কনকদুর্গা- এমনটাই মনে করা হয়। অরণ্যবেষ্টিত কনকদুর্গার খ্যাতি জেলা ছাড়িয়ে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। কনকদুর্গার পূজাপদ্ধতি দুর্গাপূজা থেকে ভিন্ন। পূজার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয় শাক, মাছ ও বিভিন্ন উদ্ভিদ। দেবীর উদ্দেশে একসময় নরবলি দেওয়া হতো; এখন সেই প্রথা না থাকলেও নবমীর দিন মহিষবলির রীতি প্রচলিত আছে।
কাত্যায়নী
ভগবতীর প্রতিমাবিশেষ। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব তাঁদের নিজ নিজ দেহের তেজ দিয়ে এই দেবীকে সৃষ্টি করেছিলেন। মহর্ষি কাত্যায়ন এই দেবীর প্রথম পূজা করেন বলে এইরূপ নামকরণ হয়েছে। দুর্গাপূজা এই দেবীরই পূজা। মহিষাসুর নিজের সৈন্য, সেনাপতিসহ কাত্যায়নীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সদলবলে নিহত হন। দশভুজা সিংহবাহিনী দেবী আশ্বিনের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে সৃষ্ট হন এবং শুক্লা সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে কাত্যায়নের পূজা নিয়ে দশমীতে মহিষাসুরকে বধ করেন- এসব কথা শাস্ত্রে বলা আছে। বাংলাদেশে শুধু মাগুরায় প্রতিবছর মহা ধুমধামের সঙ্গে কাত্যায়নী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। শারদীয় দুর্গাপূজার ঠিক এক মাস পরে পাঁচ দিনব্যাপী। মাগুরার সাতদোহাপাড়া, মাঝিপাড়া, আঠারখাদা, দরি মাগুরা, নতুন বাজার, সাহাপাড়া, জামরুলতলায় অর্ধশতাধিক নয়নাভিরাম তোরণ ও শৈল্পিক মন্ডপ তৈরি করা হয় এই পূজা উপলক্ষে। মাগুরা সদরের মাধবপুর গ্রামেও কাত্যায়নী পূজা শুরু হয়েছে। তা ১৯৩০ সাল থেকে হলেও আশির দশক থেকে এর রমরমা চলছে। পারনান্দুয়ালী গ্রামের সতীশ মাঝি প্রথম এই অঞ্চলে কাত্যায়নী পূজা শুরু করেন। সে ধারা এখনো অব্যাহত। পূজা উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লাখো মানুষের সমাগম হয় মাগুরায়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকেও দর্শনার্থীরা আসেন। পূজা উপলক্ষে মাসব্যাপী মেলা বসে। হেন জিনিস নেই, যা এ মেলায় পাওয়া যায় না।
লালদুর্গা
সিলেটের রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁওয়ে দেবী পূজিত হন লাল বর্ণে। সর্বানন্দ দাসের বাড়িতে প্রায় ৩০০ বছর ধরে বংশপরম্পরায় উদ্্যাপিত হচ্ছে শারদীয় দুর্গাপূজার ব্যতিক্রমী এই আয়োজন। কথিত আছে, ৩২২ বছর আগে সর্বানন্দ দাশ আসামের কামাখ্যাধামে কুমারীপূজার মানতে যান। তিনি মগ্ন হয়ে দেবীর পূজা শুরু করেন। ছয় ঘণ্টা পর চোখ মেলে দেবীকে লাল বর্ণে দেখে হতাশ হয়ে তিনি দেবীর কাছে বিনীতভাবে জানতে চান, তাঁর প্রার্থনায় কি কোনো অপূর্ণতা ছিল? কেন তিনি এমন বর্ণের হয়েছেন? দেবী তাঁকে আশ্বস্ত করে জানান, না, তেমন কিছু নয়; তার সাধনায় মুগ্ধ হয়ে বলেন, আমি তোর পাঁচগাঁওয়ে জাগ্রত অবস্থায় প্রতিবছর উপস্থিত হবো। সেই থেকে ভারত উপমহাদেশের একমাত্র ব্যতিক্রমী এ পূজার প্রচলন শুরু হয়। প্রতিবছর সারা দেশ থেকে এখানে ভক্তরা আসেন দেবীকে একটিবারের জন্য দেখতে। তাঁকে মানতসহ অঞ্জলি দেন। ভক্তরা মনে করেন, লাল দুর্গাকে পূজা দিতে পারা ভাগ্যের ব্যাপার। সে জন্য প্রতিবছর লাখো ভক্ত-অনুরাগীর পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে লাল দুর্গার মন্ডপপ্রাঙ্গণ। দুর্গার এমন ভিন্নরূপ যেমন আছে, তেমনি ছড়া-ধাঁধা-প্রবাদ-প্রবচন-লোকসংগীতসহ বাংলা লোকসাহিত্যের নানা উপাদানের মধ্যেও তার বর্ণনা আছে।
লোকসাহিত্যে দুর্গা
বাংলা লোকসাহিত্যের বিভিন্ন উপাদানে দুর্গার উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। বিশেষত আগমনী গান নামে পরিচিত লোকসংগীতে। শরতের শুরুতে বৈষ্ণব ভিখারিরা বাড়ি-বাড়ি গিয়ে যে গান গায়, তা ‘আগমনী গান’ নামে পরিচিত। আসলে আগমনবিষয়ক গানকেই বলা হয় আগমনী গান। উমা সংগীত বা বিজয়া গান নামেও তা পরিচিত। তবে, এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। আগমনী গানের সুর ধরে দুর্গাপূজা হয় আর বিজয়া গানে দেবী বিদায় নেন। আগমনী ও বিজয়া গান বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের গার্হস্থ্য জীবনের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে জড়িয়ে আছে। দুর্গোৎসব উপলক্ষে বাঙালির ঘরে-ঘরে যে কন্যার উপাসনা হয়, আগমনী-বিজয়া গানে যেন তারই ভাব প্রকাশ পায়। আধ্যাত্মিক সাধনা ও গার্হস্থ্য জীবনচর্যার মধ্যে এ গানে কোনো দূরত্ব নেই। যে দেবী মাতৃরূপা, তিনিই হয়ে ওঠেন কন্যাস্বরূপা। কন্যা জ্ঞানে মাতৃসাধনা গৃহী বাঙালির যেন এক পরম পাওয়া। গানের মতন বাংলা প্রবাদবাক্যে দুর্গার উপস্থিতি দেখা যায়, যেমন-
‘আরে ও গোপালের নাতি।
এনেছিলে দুর্গামূর্তি, করবেই ত এই কীর্তি।’
অর্থাৎ দুর্গার মতো রণংদেহী বউ ঘরে এনে তার কাছে শান্ত আচরণ আশা করা উচিত নয়- এ কথাটিই প্রবাদবাক্যটিতে বলা হয়েছে। অন্যদিকে ‘পাজি হয়েছে উজন সুজন, কার্তিক মাসে দুর্গাপূজন’ অর্থাৎ পঞ্জিকাপ্রণেতাদের মতের অমিল সত্ত্বেও অনেক সময় আশ্বিন মাসের পরিবর্তে কার্তিক মাসে দুর্গাপূজা হতে পারে। আমরা জানি, দুর্গাপূজা সাধারণত পঞ্জিকার দিনক্ষণ মেনেই হয়। পঞ্জিকা রচয়িতা বা প্রণেতা পন্ডিতদের মতপার্থক্যে কী হতে পারে, তা-ই বলা হয়েছে আলোচ্য প্রবাদটিতে। ভিন্ন আরেকটি প্রবাদে বলা হয়েছে, ‘অন্নপূর্ণা যার ঘরে, সে কাঁদে অন্নের তরে।’ অর্থাৎ এ প্রবাদে দুর্গাকে দেখানো হয়েছে ঘরের একজন সাধারণ গৃহিণী হিসেবে। দেবী দুর্গা কাশীতে গিয়ে অন্নপূর্ণা, কিন্তু স্বামী শিব তাঁর ভিখারি। দুয়ারে-দুয়ারে ভিক্ষা করে বেড়ান। পৌরাণিকতা অক্ষুণ্ন রেখে প্রবাদটি প্রাসঙ্গিকতা একটুকু হারায়নি। প্রবাদের মতন বাংলা ছড়ায় দুর্গা প্রসঙ্গ বাঙালির দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ ঘটনা বর্ণনাতেও দেখা যায়-
আজ দুর্গা অধিবাস কাল দুর্গার বিয়ে।
দুর্গা যাবেন শ্বশুরবাড়ি সংসার কাঁদিয়ে।।
মা কাঁদেন মা কাঁদেন ধুলায় লুটায়ে।
সেই যে মা পলাকাঠি দিয়েছেন গলা সাজায়ে।।
বাবা কাঁদেন বাবা কাঁদেন দরবার বসিয়ে।
সেই যে বাপ টাকা দিয়েছেন সিন্দুক সাজায়ে।।
বোন কাঁদেন বোন কাঁদেন খাটের খুরো ধরে।
সেই যে বোন গাল দিয়েছিল ভাতার খাকি বলে।।
দুর্গাকেন্দ্রিক লোকাচার আছে। ষষ্ঠীর দিন ভোরে এখনো গ্রামের মেয়েরা সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে শঙ্খ বা শাঁখ বাজিয়ে দুর্গার বাপের বাড়ি আগমনকে স্বাগত জানায়। এই সিঁদুরের ফোঁটা দেওয়া হয় সাধারণত ডান হাতের তর্জনী বা মধ্যমার অগ্রভাগ দিয়ে। একসময় গ্রামবাংলার একটা গাছের না ফোটা ফুল দিয়ে এই সিঁদুরের ফোঁটা দেওয়া হতো ঘরে-ঘরে, এমনকি গাছপালায়। দুর্গার উদ্দেশে যে গাছটিতে ফুল দিয়ে ফোঁটা দেওয়া হতো, সে গাছটিকে বলা হতো ‘দুর্গা পটপটি’। এবার আলোচনা করা যাক দুর্গাপূজার সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু বিষয় সম্পর্কে। এসব বিষয় এলাকাভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। যেমন-
কুমারীপূজা
দুর্গাপূজার সঙ্গে কুমারীপূজার সম্পর্ক কেমন, তা স্পষ্ট করে বলা যাবে না। কুমারীপূজা ছাড়া দুর্গাপূজার পরিপূর্ণ ফল লাভ হয় না বলে নিষ্ঠাবান সাধকেরা মনে করেন। তন্ত্রসারে এক থেকে ষোলো বছর পর্যন্ত কুমারীকে পূজা করার কথা বলা আছে। তবে শাস্ত্রমতে, দশ বছর পর্যন্ত কুমারীই হলো পূজার উপযোগী। এই কুমারীর আকৃতি ও প্রকৃতি সম্পর্কে শাস্ত্রে বলা হয়েছে, তার আকৃতি হবে সুন্দর ও সুলক্ষণা এবং প্রকৃতি হবে শোভনা। আবার দেবী ভাগবতে এক বছর পর্যন্ত কুমারীকে পূজার যোগ্য মনে করা হয়নি। দুই বছর থেকে দশ বছর পর্যন্ত বালিকাকেই কুমারী পূজার যোগ্য মনে করা হয়েছে। বয়সভেদে এঁদের নামও ভিন্ন। দুই বছর বয়সের কন্যা হলো সরস্বতী। যে দুঃখ, দারিদ্র্য ও শত্রু নাশ করে ধন ও আয়ু বৃদ্ধি করে থাকে। তিন বছর বয়সের কন্যা হলো ত্রিধামূর্তি। এর মাধ্যমে আয়ু, ধন ও বংশ বৃদ্ধি হয়। কালিকা চার বছর বয়সের কন্যা; বিদ্যার্থী, বিজয়ার্থী এবং রাজ্যার্থী। পাঁচ বছর বয়সের কন্যা সুভগা। রোগনাশ হয় তাঁর মাধ্যমে। উমা হলো ছয় বছর বয়সের কন্যা। তাঁর কাজ শত্রু নাশ করা। সাত বছর কন্যার নাম মালিনী, ধনৈশ্বর্য লাভ হয় এর মাধ্যমে। আট বছর কন্যা কুষ্ঠিকা। শত্রুকে মোহিত করার ক্ষমতা রয়েছে তাঁর। নয় বছর বয়সের কন্যা হলো কালসন্দর্ভা। ঐহিক দারিদ্র্য ও শত্রু বিনষ্ট করতে পারে সে। সব শেষ দশ বছর বয়সের কন্যার নাম অপরাজিতা, অভীষ্ট সিদ্ধি লাভে যে সক্ষম। অর্থাৎ এই দশ বছর বয়স পর্যন্ত কুমারী মেয়েদের পূজা করার নিয়ম শাস্ত্রে বলা হয়েছে। বাংলাদেশে ঢাকা ও চট্টগ্রামের রামকৃষ্ণ মিশনে মহাষ্টমীতে কুমারীপূজা হতে দেখা যায়।
বলিদান
মহাস্নান, পূজা, হোম ও বলিদান- এই চারটি ক্রিয়াই অবশ্যম্ভাবী। এগুলোর কোনো একটি বাদ দিলে পূজার অঙ্গহানি হয়। সে জন্য সব কয়টি অংশ পালন করা কর্তব্য। একসময় নবমীতে দুর্গাপূজার সন্ধিপূজার পর মহিষ বলি দেওয়ার রীতি ছিল। দেবীর কাছে মহিষ বলিই শ্রেষ্ঠ বলিরূপে পরিচিত। মহিষকে বলি দেওয়ার আগে মালা পরিয়ে পূজা করা হতো। বলির সময় খুব জোরে ঢাকঢোল বাজানো হতো। এরপর মহিষকে হাড়িকাঠে চেপে ধরা হতো। পূজারি খড়গকে পূজা করে বলিদানকারীর হাতে দিতেন। সে আবার খড়গ পূজা করে মাটিতে লুটিয়ে প্রণাম করে এক কোপে মহিষের মুন্ডুচ্ছেদ করত। কাটা মুন্ডটি অর্ঘ্যরূপে দেবীর সামনে রাখা হতো। আর মোষের দুখানা পা হাঁটু পর্যন্ত কেটে নিয়ে আড়াআড়ি করে মুন্ডটির কাছে রেখে তার উপরে একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে দেওয়া হতো। এভাবেই সম্পন্ন হতো বলিদান সমগ্র প্রক্রিয়াটি। বর্তমানে মহিষ বলির প্রথা দেখতে পাওয়া যায় না, অন্য কিছু বলি দেওয়া হয়। পশু বলিতে আপত্তি থাকলে কুমড়া, আখ, মদ ও মধু- এই কয়টি বলিদান করা যেতে পারে। এর মধ্যে কলি যুগে নরবলি, অশ্বমেধযজ্ঞ এবং মদকে পরিত্যাগ করতে বলা হয়েছে। সে জন্য কুমড়া বা আখকে এক কোপে কেটে বলিদান সম্পন্ন করা হয়।
সিঁদুর খেলা
বিজয়ার দিন সিঁদুর খেলা মেয়েদের একটি বিশেষ অনুষ্ঠান। লৌকিক এ আচার আজ দুর্গাপূজার অঙ্গ হিসেবে পরিচিত। বাঙালির ঘরে দুর্গা পূজা পান দেবীরূপে, বিদায় নেন কন্যারূপে। বিদায়বেলায় এয়োস্ত্রীরা নতুন কাপড়ে বরণ করেন দেবীকে। উমাকে ঘরের মেয়ে কল্পনা করে কোথাও কোথাও কনকাঞ্জলি অনুষ্ঠান হয়। দেবীকে বরণ শেষে স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনায় বিবাহিত মেয়েরা সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন। সিঁদুর খেলার সমাপ্তিতে থাকে বিসর্জন। রব ওঠে ‘আসছে বছর আবার হবে’। সত্যিই আগামী বছর আবার মমতাময়ী মা দুর্গা সম্পর্কে কিছু কথা বলা যাবে।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক এবং গবেষক
ছবি: সংগ্রহ